- বইয়ের নামঃ আত্মকথা
- লেখকের নামঃ আবুল মনসুর আহমেদ
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
আত্মকথা
আত্মকথা – আবুল মনসুর আহমদ / Atmakatha by Abul Mansur Ahmad
প্রথম প্রকাশ : অগ্রহায়ণ ১৪২৫, নভেম্বর ২০১৮
প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫, বাংলাদেশ
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল
মুদ্রণ : আর জে জেড প্রিন্টার্স ২৫৭ ফকিরেরপুল, ঢাকা ১০০০
প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ১৯৭৮, ঢাকা
.
প্রকাশকের কথা
আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন ব্যক্তিত্ব। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, আইনজীবী ইত্যাদি নানা পরিচয়ে তিনি পরিচিত ছিলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ব্যঙ্গধর্মী রচনার ক্ষেত্রে আমাদের সাহিত্যে তার স্থান আজও কেউ অতিক্রম করতে পারেননি। তাঁর স্মৃতিকথাধর্মী বইগুলোও আমাদের সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এ দেশের তথা উপমহাদেশের গত এক শতাব্দীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য তাঁর এই বইগুলো পাঠের কোনো বিকল্প নেই। তার আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর এবং আত্মকথা এমন দুটি বই। ইতিমধ্যে আমাদের প্রকাশনা সংস্থা থেকে আমরা তার আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইটির একটি সুমুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশ করেছি। বইটিতে লেখক গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অভ্যুদয়-পরবর্তীকাল পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এবার আমরা প্রকাশ করছি তাঁর আত্মকথা বইটি।
আত্মকথায় আবুল মনসুর আহমদ তাঁর পারিবারিক পটভূমি, শৈশব, বাল্য ও কৈশোর, শিক্ষা, সাহিত্য, আইন পেশা ও সংসারজীবনের কথা লিখেছেন। বইটিতে লেখকের বয়ান কেবল নিজ জীবন ও অভিজ্ঞতার কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ, নানা ঘটনা। ও চরিত্রের কথাও এতে উঠে এসেছে। স্মৃতিচারণার আঙ্গিকে লেখা সময়ের এই অন্তরঙ্গ বর্ণনা লেখকের অনুপম রচনাশৈলীর গুণে পাঠককে যে কেবল আকৃষ্ট করবে তা-ই নয়, আমাদের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্ব এবং তার প্রবণতাগুলোকে বুঝতেও অনেকখানি সাহায্য করবে। এক কথায় বলা যায়, পূর্ব বাংলার মুসলমান মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশের পটভূমি ও তার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পেতে বিশেষ সহায়ক এ বই। সেদিক থেকে ইতিহাস বা সমাজ নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাঁদের জন্য এ বইটির মূল্য অত্যধিক।
প্রথমা প্রকাশন বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই পুনঃপ্রকাশের একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। মূলত নবীন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পাঠক ও গবেষকদের কথা ভেবেই আমাদের এই পরিকল্পনা। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা পুনর্মুদ্রণের অভাবে বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারেও পাওয়া যায় না, কিংবা হয়তো যথাযথ প্রক্রিয়ায় অনুমোদন নেওয়া ছাড়াই ও নিতান্ত অযত্নের সঙ্গে ছাপা হচ্ছে, এমন কিছু নির্বাচিত গ্রন্থ লেখক বা তাদের উত্তরাধিকারীদের অনুমতি নিয়ে পুনঃপ্রকাশ করছি। প্রথম পর্যায়ে জীবনী, স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী, গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার ও গবেষণাধর্মী বইয়ের ক্ষেত্রেই মূলত আমাদের উদ্যোগ সীমাবদ্ধ থাকছে।
প্রসঙ্গত, বিভাগোত্তরকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশ নামে পরিচিত ভূখণ্ডটির জন্য আবুল মনসুর আহমদ একটি বিশেষ ভাষারীতির প্রস্তাব করেছিলেন। সেই ভাষারীতির পক্ষে নিজস্ব যুক্তিগুলোই শুধু তিনি তুলে ধরেননি, আপন লেখালেখির ক্ষেত্রেও যথাসম্ভব সে ভাষারীতিকে অনুসরণ করেছেন। বলাই বাহুল্য, লেখকের রচনাশৈলী হিসেবে আমরা সর্বত্র তার সে ভাষারীতি অক্ষুণ্ণ রেখেছি। বানানের ক্ষেত্রেও লেখক কিছু স্বাতন্ত্র্য রক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। বর্তমান গ্রন্থেই এ সম্পর্কে তিনি তাঁর মতামত তুলে ধরেছেন। কিন্তু তার সে নিয়ম আমরা পুরোপুরি অনুসরণ করতে পারিনি। এর একটি কারণ, বইটির পূর্ববর্তী সংস্করণগুলোতে দেখা যায় একই শব্দের বানান দুই বা তিন রকমে ছাপা হয়েছে। লেখকের প্রস্তাবিত বানানরীতির সঙ্গেও যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংগতিপূর্ণ নয়। এ অবস্থায় বানানের সমতা রক্ষার তাগিদ থেকে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হয়েছে। তবে ‘জ’ ও ‘য’-এর ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটিভাবে লেখকের মতকেই প্রাধান্য দিতে চেষ্টা করেছি। বস্তুত পাঠক ও গবেষকদের জন্য মূল্যবান এই বইটির একটি সম্ভব নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য সংস্করণ প্রকাশই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। বইটির এই নতুন সংস্করণ প্রকাশের ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য লেখকের পুত্র ও ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনামের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
মতিউর রহমান
ঢাকা, নভেম্বর ২০১৮
.
ভূমিকা
আত্মজীবনী লেখার কাজটা কঠিন। অসাধারণও। কঠিন এই জন্য যে এর বেশির ভাগ কথাই স্মৃতি হইতে লিখিতে হয়। যখনকার কথা লেখা হয়, তখন আত্মজীবনী-লেখক চিন্তাও করেন নাই যে ভবিষ্যতে একদিন তিনি নিজের জীবনী লিখিবেন। আত্মজীবনী লিখিবার মত জীবনের অধিকারী তিনি কোনো দিন হইবেন, এটা ধারণাও অনেকে ছেলেবেলা করিতে পারেন না। ছেলেবেলা সবাই ছেলেমানুষই থাকেন। মন-মস্তিষ্ক পাকিতে তখনো অনেক দেরি। বড় হইয়া তিনি কী হইবেন, কী করিবেন, তার স্পষ্ট ধারণা-চিন্তাও তখন তিনি করিতে পারেন না। পারেন না মানে তখনকার চিন্তা-ভাবনার বেশির ভাগই থাকে অবাস্তব কল্পনা-বিলাসিতা। এ ব্যাপারে মনীষী ও অমনীষীর মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নাই। যা কিছু পার্থক্য তার বেশির ভাগই পরিবেশগত। আমাদের তরুণেরা যারা কলেজ-ভার্সিটিতে মেধাবী ও যশস্বী ভাল ছাত্র থাকেন, তাঁদের অধিকাংশেরই উচ্চকাঙ্ক্ষা থাকে, তখন সরকারি চাকরি কামনায় সীমাবদ্ধ। আমাদের কালে ছিল ডিপটিগিরি। আজকাল সেটা সিনিয়র সিভিল সার্ভিস। অধুনা কিছু ভাল ছেলের মধ্যে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ার ও অধ্যাপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাত্রজীবনেই দেখা যায়। এঁদেরও কেউ ভবিষ্যতে আত্মজীবনী লিখিবেন, এমন ধারণা সাধারণত পোষণ করেন না। কারণ এই শ্রেণীর প্রতিভাবানেরা আত্মজীবনী লিখিয়াছেন তার দৃষ্টান্ত খুব বেশি নাই। বরঞ্চ যাদের বাপ-দাদাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রচলন আছে, তাদের মধ্যে বাপ-দাদার লাইনটার কথাই আগে মনে পড়া স্বাভাবিক। ডিপটির ছেলে ডিপটি, উকিল-ব্যারিস্টারের ছেলে উকিল ব্যারিস্টার, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়াটাকেই অগ্রাধিকার দিয়া থাকেন। এমনকি চাষির ছেলে চাষি, শ্রমিকের ছেলে শ্রমিক, পীরের ছেলে পীর ও জমিদার-জোতদারের ছেলে জমিদার-জোতদারই থাকিবে এমন ধারণা সাধারণত বাপ-মা ও মুরুব্বিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিলেও এটাই সাধারণ জীবন-চিন্তা। যে শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন লইয়া মুরুব্বিদের এই সব চিন্তা-ভাবনা, সে শিশু কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কিছুই জানে না। না জানিলেও কালক্রমে অনেক লোকই মুরুব্বিদের এই ধ্যান-ধারণায় সংক্রমিত হয়।