ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাপারটা সত্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনে বলেছেন তিনি নিদ্রাকে আমাদের বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত করেছেন, রাতকে করেছেন। আবরণ আর দিনকে প্রস্তুত করেছেন জীবিকা তালাশের জন্য।[১]
স্মার্টফোনের বদৌলতে আমাদের ঘুমের চক্রে এই যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে, তা কীভাবে আমাদের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে জানেন? হার্ভার্ডের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, স্মার্টফোন থেকে বিচ্ছুরিত আলোর কারণে যারা রাতে পর্যাপ্ত ঘুমায় না, ধীরে ধীরে তারা ডায়াবেটিস, অবসাদ, হৃদরোগসহ নানান রোগের দিকে এগিয়ে যায়।
তাছাড়া অপর্যাপ্ত ঘুম আমাদের মানসিক সমস্যারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমন একজন লোকের কথা ভাবা যাক, যাকে প্রতিদিন সকাল সাতটায় অফিসে হাজির থাকতে হয়। সাতটায় অফিস করার জন্য অন্ততপক্ষে তাকে সাড়ে পাঁচটায় ঘুম। থেকে জাগতে হবে। অফিসে যাওয়ার জন্য গোসল, খাওয়া-দাওয়া, প্রস্তুতি সারার জন্য এই সময়টা তার অবশ্যই দরকার। এখন সারারাত ফেইসবুক স্ক্রল করে কিংবা ইউটিউব ব্রাউজিং করে যদি সে ঘুমোতেই যায় রাত দুইটায়, চোখে ঘুম আসতে যদি তার আধা ঘণ্টা সময় লাগে, সব মিলিয়ে তার ঘুম হয় কেবল তিন ঘণ্টা। মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে পরের দিন যখন সে অফিসে যাবে, তখন তার দিনটা কাটবে খুবই নাজুকভাবে। চোখে ঘুম ঘুম ভাব থাকবে, কাজে মন বসবে না, মনোযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে, মেজাজ খিটখিটে থাকবে ইত্যাদি। ঘন ঘন চা-কফি খেয়ে যতই সে শরীরকে চাঙা করার চেষ্টা করুক, অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে কর্মক্ষেত্রে ভুগতে তাকে হবেই।
সাত.
সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি আমাদের জীবনে বয়ে আনতে পারে সমূহ বিপদ এবং এই বিপদের খেসারত হতে পারে ভীষণ ভয়াবহ। এই নেশা আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে আমাদের জীবনটাকে বিপর্যস্ত আর বিধ্বস্ত করে দেওয়ার আগে আমাদের উচিত হবে এই ডিজিটাল ড্রাগের কবল থেকে যত দ্রুত পারা যায় বের হয়ে আসা। ধীরে ধীরে নেশার যে চক্র আমরা গড়ে তুলেছি, সেটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে আমাদের গুনতে হবে কঠিন মাশুল।
ভাবছেন, কীভাবে ভাঙবেন এই নেশার শেকল, তাই না?
এই মিছিলে আপনি একা নন, ডিজিটাল এই ড্রাগের নেশা থেকে বাঁচতে এখন মরিয়া দুনিয়ার হাজার-কোটি মানুষ। এই নেশা থেকে মুক্তির জন্য বিশেষজ্ঞরা বাতলাচ্ছেন এমন কিছু উপায় আমি আপনাকে শোনাতে পারি।
সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির কবল থেকে বাঁচতে সবার আগে আপনাকে একটু নিজেকে নিয়ে বসতে হবে। কোনো এক শান্ত বিকেলে পুকুর-ঘাটে বসে কিংবা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এক কাপ কফি খেতে খেতে চিন্তা করুন তো–এই যে মাইলের পর মাইল। ফেইসবুক লিং, ইউটিউব ব্রাউজিং, এসব আপনার জীবনে ঠিক কতটুকু দরকারি? কী হবে যদি আপনি রোজ পাঁচ ঘণ্টা ফেইসবুক ব্যবহার না করেন? যদি প্রতিদিন দুই-দেড়শো ইউটিউব ভিডিও আপনি না দেখেন, আপনার জীবনের কোথাও কি কোনো ব্যাঘাত ঘটবে?
প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা ফেইসবুক চালানোর ফলে আপনার স্বাভাবিক জীবনের যে ছন্দপতন, জীবনের সেই ছন্দের চাইতে ফেইসবুক আর ইউটিউব বেশি গুরুত্বপূর্ণ? মাত্রাতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির কারণে আপনি আপনার পরিবারে ভালোমতন সময় দিতে পারছেন না, আপনার বাবা-মা’র দিকে খেয়াল দিতে পারছেন না, আপনার শিশুদের নিয়ে খেলাধুলোর সুযোগ পাচ্ছেন না–এসবকিছুর চেয়ে আপনার সোশ্যাল-জীবনটা কখনো কি বেশি প্রাধান্য পাওয়ার দাবি রাখে?
আমি জানি, এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে বসলে আমাদের প্রত্যেকের মন একটাই উত্তর দেবে–’সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির চাইতে আমার পরিবার, আমার কাজ, আমার জীবন অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এই গুরুত্বটা যদি আপনি উপলব্ধি করতে পারেন, তাহলে নেশার এই চক্র ভেঙে দেওয়া আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। আপনার মন যদি এই নেশা থেকে বেরোনোর ব্যাপারে সায় দেয়, তাহলে এই অধ্যায়ের পরের অংশটুকু আপনার জন্য।
আট.
সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি থেকে বের হওয়ার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী যে পন্থা তা হলো–এটা ছাড়াও যে জীবন চলে, এখানে না আসলেও যে আপনি বাঁচবেন, এখানে টু না মারলেও যে আপনার ভালো একটা দিন কাটবে, তা বিশ্বাস করতে পারা। এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য আপনাকে একটা কাজ করতে হবে–সপ্তাহে অন্তত একটা দিন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার পুরোপুরি বাদ দিতে হবে। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিটের জন্যও না। আপনাকে স্থির করতে হবে যে–সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিন আপনি কোনোভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আসবেন না।
কাজটা একটু কঠিন বটে, কিন্তু বিশ্বাস করুন–এই কাজটা করতে পারলে ধীরে ধীরে আপনার আসক্তির লাগাম আপনি টেনে ধরতে পারবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ‘Mental Health Day’, ‘Unplugging Day পালন হচ্ছে। এ সমস্ত দিনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে–ওই দিন তারা সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল ডিভাইসের বাইরে থাকবে। অর্থাৎ, কোনো স্মার্টফোন, কম্পিউটারের সংস্পর্শে আসবে না। দুনিয়াজুড়ে স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি নামে যে মহামারি তৈরি হয়েছে, তা থেকে মুক্তি পেতেই উন্নত দেশগুলো এখন এসব পন্য কাজে লাগাতে মরিয়া।