আমাদের সকল অর্জন, সকল প্রাপ্তি মূলত আল্লাহর কাছ থেকেই আসে। তাঁর দয়া ব্যতীত কোনোকিছু অর্জন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই সূক্ষ্ম ব্যাপারটা আমি আর আপনি না বুঝতে পারলেও, আল্লাহর সত্যিকার প্রিয় বান্দারা বুঝতে পারতেন। তাই, জীবনের সকল অর্জনকে, সকল প্রাপ্তিকে তারা আল্লাহর দিকে ঠেলে দিতেন। আত্মম্ভরিতা, আত্মমুগ্ধতার বশবর্তী হয়ে তারা কখনোই সেগুলোকে নিজেদের যোগ্যতা আর মেধার ফসল ভেবে বসতেন না।
আত্মমুগ্ধতায় বিভোর হয়ে পা ফসকেছে স্বয়ং ইবলিসেরও। নিজের গাঠনিক উপাদানের দিকে তাকিয়ে সে ভেবেছিলো মাটির তৈরি আদমের চেয়ে সে শ্রেষ্ঠ কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি তো ইবলিস নির্ধারণ করবে না, এটা নির্ধারণ করবেন কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। আদম শ্রেষ্ঠ হবে, না ইবলিস–তা নির্ধারণের ক্ষমতা কেবল এককভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার।
এই আত্মমুগ্ধতা থেকে বাঁচতেই সেদিন বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ। হাদিসশাস্ত্রের যে যুগান্তকারী কাজ তিনি করেছেন, সেকারণে যদি তার মনে কোনো অহংকার জেঁকে বসে, সেই ভয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘আহা! এই কথা শোনার আগে যদি আমার এবং এই লোকের মাঝে একটা পাহাড় এসে দাঁড়াতো, কতই না উত্তম হতো।
আত্মগৌরব দ্বারা নিজের অন্তরকে কাবু হওয়ার হাত থেকে উদ্ধার করতেই সেদিন আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহিমাহুল্লাহ রোমান যুদ্ধবাজকে দারুণভাবে পরাস্ত করার পরেও সঙ্গীকে বলেছিলেন, ‘আবদুল্লাহ, এতক্ষণ ধরে তুমি যা দেখলে, আল্লাহর ওয়াতে আমি বেঁচে থাকা অবধি এই ঘটনা তুমি কাউকেই বোলো না।
এই আত্মমুগ্ধতায় বিলীন হননি মারইয়াম আলাইহাস সালাম। আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে যে খাবার তার জন্য বরাদ্দ ছিলো, তা পেয়ে তিনি বলেছেন, এগুলো আমার রবের কাছ থেকেই আসে। আর, আমার রব যাকে ইচ্ছা অবারিত রিযিক দান করেন।
আমরা যখন কোনোকিছু অর্জন করবো অথবা অর্জনের যোগ্যতা অর্জন করবো, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এই অর্জন, অর্জনের এই যোগ্যতা আমাদের প্রতি মহান রব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি দয়া করেছেন বলেই এগুলো আমার জীবনে এসেছে। কখনোই এটা ভাববো না যে–এটা আমি এককভাবে নিজ যোগ্যতায় পেয়েছি। এমন ধারণা করাটা আত্মম্ভরিতারই নামান্তর; বরং আমাদের মারইয়াম আলাইহাস সালামের মতোই ভাবতে হবে। আমাদের যা কিছু অর্জন, যা কিছু প্রাপ্তি সব মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে।
কোনো অর্জন বা অর্জনের কোনো যোগ্যতা যখন আমরা লাভ করবো, তখন আমরা আল্লাহর দিকে ফিরে যাবো সবার আগে। এই শিক্ষাটা আমরা কুরআন থেকেই পাই। সুরা নাসরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বিজয়ের পূর্বাভাস দেওয়ার সাথে সাথে কয়েকটা করণীয়ও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেছেন–
যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, আর (হে নবি) আপনি লোকদেরকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে ফিরতে দেখবেন, তখন আপনি আপনার রবের পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুল করেন।[5]
বিজয় অর্জিত হলে এবং লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলছেন, যেন তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন এবং দ্বীন কায়েমের এই কাজে যদি কোনো ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে, তার জন্য যেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। আল্লাহর নবি, যিনি একজন পূত-পবিত্র মানবাত্মা, যাকে দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা জমিনে বুনেছেন তাওহিদের বীজ, যার মাধ্যমে সুশোভিত করে তুলেছেন তাঁর দ্বীনের সৌন্দর্য, তার জন্যই যদি আল্লাহর আদেশ ও হুকুম এমন হয়ে থাকে, আমাদের বেলায় তাহলে সেটা কেমন হতে পারে?
বিজয় অর্জিত হয়ে গেলে আল্লাহ বলেননি উল্লাসে ফেটে পড়তে। তিনি বলেননি তা নিয়ে গর্ব করে বেড়াতে কিংবা বেপরোয়া হয়ে উঠতে; বরং তিনি বলেছেন, বিজয়ের দেখা পেলে আমরা যেন তাঁর দিকেই ফিরে আসি, সমস্ত প্রশংসার মালিক যে একমাত্র তিনিই–তা অকপটে স্বীকার করি এবং বিজয় অর্জনে আমাদের পক্ষ থেকে যাবতীয় ভুল-ভ্রান্তির জন্য আমরা যেন তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই।
চার.
দ্বীনের পথে হাঁটতে শুরু করার পর আমরা সাধারণ যে ভুলটা সবচেয়ে বেশি করি, তা হলো–আত্মম্ভরিতা। জেনে কিংবা না-জেনে, বুঝে অথবা না-বুঝে জীবনে চলার পথে আমরা কোনো না কোনোভাবে এই ফাঁদে আটকে যাই। জীবন থেকে জাহিলিয়াতের ধুলো ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার পরে আমরা যখন আমলের একটা বৃত্তে প্রবেশ করি, যখন আমরা সালাতে নিয়মিত হই, সিয়ামে তৎপর হই, দান-সাদাকা এবং ভালো কাজে অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি, এমনকি তাহাজ্জুদেও আমরা যখন নিয়মিত জাগতে শুরু করি, তখন আমাদের মনের কোনো এক সূক্ষ্ম কোণে এই ধারণা উঁকি দিতে শুরু করে যে–’আমার চেয়ে বেশি আমল, বেশি সাদাকা, বেশি সিয়াম, বেশি তাহাজ্জুদ-গুজার বান্দা আশপাশে সম্ভবত আর কেউ নেই।
হতে পারে দ্বীন নিয়ে আমার মতন তৎপর, উদগ্রীব আর সচেষ্ট মানুষ আমার আশেপাশে আর একটাও নেই, কিন্তু তবু কোনোভাবে এই ধারণা মনে আনাই যাবে না যে–আমি এত বেশি আমল-ইবাদত করছি, এত বেশি আল্লাহর স্মরণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি, এমন কেউ নেই, যে আমাকে টেক্কা দেবে। এমন ভাবনা নিঃসন্দেহে শয়তানের ওয়াসওয়াসা। আমাদের আমল-ইবাদত, আমাদের তাকওয়ার উচ্চতা যতই আকাশ স্পর্শ করুক না কেন, নিজেকে বড় আর অন্যকে ছোট হিশেবে দেখতে গেলেই আমাদের নিশ্চিতভাবে পা ফসকে যাবে। এমন চিন্তা অবশ্যই অহংকার থেকে উৎসারিত। আমরা কেউ কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আমাদের যাবতীয় ইবাদত আল্লাহ কবুল করে নিচ্ছেন? এটাও কীভাবে ভাবতে পারি যে–অন্যদের সামান্য আমলগুলো আল্লাহর কাছে খারিজ হয়ে যাচ্ছে?