পুরুষজাতটা যে মেয়েদের তুলনায় মূর্খ এবং আপন মঙ্গল কোন দিকে সেটা না বুঝে বাঁদরের মতো যে-ডালে বসে আছে সেই ডালটাই কাটে কুড়িয়ে-পাওয়া করাত দিয়ে। নইলে এই সাত হাজার বছর ধরে এত যুদ্ধ, এত রক্তপাত! আমার নিজের বিশ্বাস, স্ত্রীজাতি যদি এ সংসারের সর্ব গবর্নমেন্ট চালাত, কিংবা এখনও চালায় তবে ওরকম-ধারা হবে না। আজও যদি ইউনাইটেড নেশনস্ থেকে সবকটা পুরুষকে ঝেটিয়ে বের করে দিয়ে নারীসমাজকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, তবে তারা ন মাস দশ দিনের ভিতর মার্কিন-রুশ-মৈত্রী প্রসব করবে! আমি আপনার মতো দেশবিদেশ ঘুরিনি; যেটুকু দেখেছি তার মধ্যে সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি, শিলঙের খাসিয়া সমাজে বাস করে কারণ সে-সমাজ চালায় মেয়েরা। শুনেছি বর্মার সমাজব্যবস্থাও বড়ই সহজ-সরল পদ্ধতিতে গড়া।
আরেকটা কথা : হজরত মুহম্মদ নবী ইসলাম স্থাপনা করেন। এবং সে শুভকর্মের প্রারম্ভিক মঙ্গলশঙ্খ কাকে দিয়ে বাজালেন? কাকে তিনি সর্বপ্রথম এই নবীন ধর্মে দীক্ষিত করলেন? তিনি তো বিবি খাদিজা– নারী। তার পর আসেন পুরুষ সম্প্রদায়, হজরত আলী, আবু বকর, ওমর ইত্যাদি। তা হলে দেখুন, আপনি মুসলমান, আমি মুসলমান, অন্তত আমাদের স্বীকার করতে হবে যে সর্বজ্ঞ আল্লাতালা– যিনি সত্যং জ্ঞানমনন্তং তিনিই তার শেষ-ধর্ম প্রচারের সময় একটি নারীকে সর্বোচ্চ আসন দিয়েছিলেন। ফাতিমা জিন্নাহ্ যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবার জন্য আইয়ুব সাহেবের বিরুদ্ধে দাঁড়ান তখন কলকাতার কোনও কোনও মুসলমান আপত্তি জানিয়ে বলেন, তিনি নারী। আমি তখন বলেছিলুম, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেয়ে মুসলিম জাহানে সর্বপ্রথম মুসলমানরূপে দীক্ষিত হওয়ার শ্লাঘাগৌরব অনেক অনেক বেশি– কোনও তুলনাই হয় না। সেই সম্মান যখন একটি নারী তেরশো বছর পূর্বে পেয়েছেন তখন আরেকটি আজ প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না কেন?
তখন তারা তর্ক তোলেন, কিন্তু হজরত নবী তো পুরুষ।
আমি বলি, তিনি তো আল্লার বাণী– যার নাম ইসলাম আল্লার কাছে মিশন রূপে পেয়ে বিবি খাদিজাকে সেইটি দিলেন। স্বয়ং নবী তো এ হিসেবের মধ্যে পড়েন না। (এ স্থলে আমার মনের একটি ধোঁকা জানাই। উত্তর চাইনে। কারণ পূর্বেই বলেছি, আপনাদের কাউকে দিয়ে আমার কোনও প্রয়োজন নেই। এ চিঠির উত্তর আপনাকে লিখতে হবে না, কারণ সেটি আমি পাব না।… ব্রাহ্মধর্মের সর্বপ্রথম ব্রাহ্ম কে? প্রাতঃস্মরণীয় রাজা রামমোহন? তবে তাকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করল কে?… কিংবা নিন বুদ্ধদেব। তিনি স্বয়ং কি বৌদ্ধ? তাকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করল কে? অন্যদের বেলা, যেমন খ্রিস্ট, রামমোহনের বেলা অনুমান করতে পারি, স্বয়ং গড় য়াভে বা পরব্রহ্ম খ্রিস্টকে খ্রিস্টধর্মে, রামমোহনকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করেন, কিন্তু বুদ্ধের বেলা? তিনি তো ভগবান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন, এবং বলেছেন তিনি, তাঁরা [দেবতারা] থাকলেও তারা মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারে অশক্ত। তা হলে?… এবং আজকের দিনের ভাষায় মার্কস্ কি মার্কসিস্ট? লেনিন অবশ্যই মার্কসিস্ট, কিন্তু লেনিন কি লেনিনিস্ট)
কিন্তু একটা কথা পুরুষমাত্রকেই স্বীকার করতে হবে।
আল্লার হুকুমেই দৃশ্য অদৃশ্য সব-লোকই চলে, কিন্তু মানুষের কৃতিত্বও তো মাঝে মাঝে স্বীকার করতে হয়।
অদ্যাপিও মধ্যে মধ্যে পুণ্যবান হয়।
নারীরে স্বীকার করি জয় জয় কয়।
হজরত নবী এঁদেরই একজন। বড় বিরল, বড় বিরল, হেন জন যে নারীকে চিনে নিয়ে তার প্রকৃত ন্যায্য স্বীকৃতি দেয়। তাই হজরত বলেছিলেন,
বেহেশত মাতার চরণপ্রান্তে।
এবং নিশ্চয়ই তখন একাধিক দীক্ষিত মুসলমানের অমুসলমান মাতা ছিল। হজরত এ স্থলে কোনও ব্যত্যয় করেছেন বলে তো জানিনে। এবং একথাও জানি হজরত শিশুকালেই তার মাকে হারান।
আমি হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে পারছি, আপনি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।
আমি করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করছি এবং সঙ্গে সঙ্গে নিবেদন করছি, আপনার উদ্দেশে লেখা এই চিঠিই আমার শেষ চিঠি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। পূর্বেই বলেছি, এ চিঠির উত্তরও আপনাকে লিখতে হবে না।
আপনিই আমাকে একদিন বলেছিলেন, যখন আপনার কোনও পাঠক বহু সমস্যাবিজড়িত, নানাবিধ প্রশ্নসম্বলিত দীর্ঘ পত্র লিখে, দফে দফে তার প্রতিটি প্রশ্নের সদুত্তরসহ দীর্ঘতর উত্তরের প্রত্যাশা করে তখন আপনি মনে মনে স্মিতহাস্য করে বলেন, ভদ্রলোক যা জানতে চেয়েছেন, সেগুলো একটু গুছিয়ে রম্যরচনাকারে দেশ বা আনন্দবাজারে পাঠিয়ে দিলে তো আমার দিব্যি দু পয়সা হয়। আর লেখা জিনিসটা নাকি আপনার পেশা। ওটা আপনার নেশা নয়। এবং পেশার জিনিস তো কেউ ফ্রি বিলিয়ে বেড়ায় না। আমি তাই আপনার কাছ থেকে কোনওকিছু মুফতে চাইনে।
(শহর-ইয়ারের চিঠি এতখানি পড়ার পর অকস্মাৎ শংখচূড়ের ডংশনের মতো আমাকে সে-চিঠি স্মরণে এনে দিল, আমি এমনই পাষণ্ড যে, যবে থেকে, পোড়া পেটের দায়ে লেখা জিনিসটাকে পেশারূপে স্বীকার করে নিয়েছি, সেই থেকেই শহর-বর্ণিত ওই কারণবশতই আপন বউকে পর্যন্ত দীর্ঘ প্রেমপত্র লিখিনি। স্তম্ভিত হয়ে ভাবলুম, সেই যে স্যাকরা যে তার মায়ের গয়নায় ভেজাল দিয়েছিল আমি তার চেয়েও অধম। স্যাকরা তবু ভালো মন্দ যাহোক মাকে একজোড়া কাকন তো দিয়েছিল, আমি সেটিও প্রকাশক সম্পাদককে পাঠাচ্ছি!…এই অনুশোচনার মাঝখানে আমার মনে যে শেষ চিন্তাটির উদয় হল সেটি এই : এ হেন নির্মম আচরণে হয়তো আমিই একা নই। নেইবনে হয়তো আমি একাই খাটাশ হয়েও বাঘের সম্মান পাচ্ছিনে। আরও দু চারটে খাটাশ আছেন। কিন্তু হায়, তারা তো আমাকে পত্র লিখে তাদের হাঁড়ির খবর জানাবেন না!)