অভাবে শয়তানও মাছি ধরে খায়

অভিজ্ঞতাজনিত বিজ্ঞতা আসে ল্যাটে। তখন ওটা আর কোনও কাজে লাগে না। বিলকুল বেকার। কীরকম? প্রকৃতির নিয়ম : মাথায় বিপর্যয় টাক পড়ে যাওয়ার পর চিরুনি-প্রাপ্তি। ইরানি কবি একটু ঘুরিয়ে বলেছেন : বৃদ্ধ বয়সে অনুশোচনায় দাঁত কিড়মিড় করছি। কিড়মিড় করার জন্য, হায়, দাঁতও যে আর নেই।

ল্যাটে বুঝলুম, মাতৃভাষা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আর নিতান্তই যদি আরেকটি ভাষা শিখতে হয় তবে সেটি হবে, তোমার মাতৃভাষা যার কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণী সেইটি শেখা : বাঙলার বেলা সংস্কৃত, ফারসির বেলা আরবি, ফরাসির বেলা লাতিন। তার বেশি ভাষার পিছনে ছুটোছুটি করা নিছক আহাম্মুকি। মাসান্তে যে দু-একখানা বিদেশি বই কিনবে, তার আর উপায় রইল ন! কেন?– কলকাতাতে কি বিদেশি বই পাওয়া যায় না? পাওয়া যায় বইকি, এন্তের অঢেল। অল ইন্ডিয়া রেডিও তো দিবারাত্তির গান গাইছে। মুশকিল শুধু, আপনার পছন্দের গান গায় না।

ইতোমধ্যে আমি দু-খানি চিঠি পেয়েছি। দুটি তরুণ আমার সদুপদেশ পাওয়ার পূর্বেই ফরাসি জৰ্মনে সার্টিফিকেট নিয়ে বসে আছে। তাদের সামনে সমস্যা, এখন এগোয় কী প্রকারে? তারা থাকে মফস্বলে–কী করে বলি, কলকাতার কোনও কোনও লাইব্রেরির লেনডিং সেকশন আছে, তাদের শরণাপন্ন হও, যখন জানি, কলকাতার খাস বাসিন্দার পক্ষেও কর্মটি সুকঠিন।

তখন হঠাৎ খেয়াল গেল, এরা মফস্বলে বাস করে। তার একটা মস্ত সুবিধে, ইলেকট্রিকের উৎপাত সেখানে নেই, কিংবা নগণ্য। বেতারযন্ত্রটির পুরো ফায়দা সেখানে ওঠানো যায়। কলকাতাবাসীও অবশ্য খানিকটে পারবে।

উপস্থিত বেতার খুললেই শর্টওয়েভে পাবেন, গাক গাঁক করে আপন পরিচিতি জানাচ্ছেন চীন (চীন আমাদের অতি কাছে বলেই তাকে পাওয়া যায় হরবকৎ, কিন্তু আমাদের কাজে লাগে অত্যল্পই), রুশ, আমেরিকা (VOA = Voice of America), ব্রিটেন (BBC), এবং অস্ট্রেলিয়া। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের যেগুলো দরকার, যেমন ফ্রান্স, জর্মনি, ইতালি সেগুলো জোরদার নয় এবং আমাদের উপকারার্থে তারা ব্রডকাস্ট করে অল্প সময়।

এই বেতারের সাহায্যে পুস্তকের অভাব খানিকটা পুষিয়ে নেওয়া যায়।

এর পূর্বে দু-একটি কথা অবতরণিকা হিসেবে বলে নেওয়া ভালো।

ভারতবর্ষে যে নিরক্ষরতা দ্রুতগতিতে লোপ পাচ্ছে না, তার প্রধান কারণ এ নয় যে, গ্রামে গ্রামে আমরা পাঠশালা খুলতে পারছিনে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার আসল কারণ, যারা পাঠশালা পাস করে বেরোয় তারা পুনরায় নিরক্ষর হয়ে যায় পড়বার জন্য বই খবরের কাগজের অভাবে। যে গ্রামে পঞ্চাশ বছর ধরে পাঠশালা আছে, সেখানে যে কোনও সময়ে অনুসন্ধান করলে দেখতে পাবেন, মাত্র যারা দু-এক বছর হল পাস করে বেরিয়েছে তারাই এখনও লিখতে পড়তে আঁক কষতে পারে (থ্রি আর= রিডিং, রাইটিং, রেকনিং)। বাদবাকিরা কিংবা তাদের অধিকাংশ পুনরায় নিরক্ষর হয়ে গিয়েছে। এই বিষয় নিয়ে বছর কুড়ি পূর্বে আমি সপ্তাহের পর সপ্তাহ জোর প্রোপাগান্ডা-ক্যামপেন চালিয়েছিলুম; সুযোগ পেলে মৃত্যুর পূর্বে আরেকবার চালাব– মা ফলেষু কদাচন মন্ত্র স্মরণ করে।

তাই বছ, তুমি যে ফরাসি, জর্মন বা রুশ ভাষায় সার্টিফিকেট পেয়েছ সেটা উত্তম কর্ম, কিন্তু যেটুকু শিখেছ সে-ও ভুলে যাবে, ওই গ্রামের পড়ুয়ার মতো পুস্তকাভাবে। তাই বলছিলুম, বেতার তোমাকে খানিকটে বাঁচাতে পারে।

তার পূর্বে কিন্তু একটি ভেরি ভেরি ইম্পরটেন্ট তত্ত্বকথা বলে নিই। এটা আমার নিজের উপদেশ নয়– পৃথিবীর যে কোনও বেতারকেন্দ্র তোমাকে এই উপদেশ দেবে।

রুম অ্যারিয়েল শর্টওয়েভের জন্য সম্পূর্ণ বেকার না হলেও ছাতের উপর বাঁধা দীর্ঘ, দীর্ঘতম বাঁশের অ্যারিয়েলের তুলনায় নগণ্য। আমার উপদেশে যারাই কান পাতছ, তাদেরই বলি, যারা মফস্বলে থাকো তারা নেবে দীর্ঘতম বাঁশ (শহরে বোধহয় এর একটা সীমা আছে, কিন্তু যেহেতু তুমি চোদ্দতলা বাড়িতে বাস কর না, সেটা তোমার ওপরে প্রযোজ্য নয়) এবং নির্মাণ করবে সর্বোত্তম অ্যারিয়েল। এস্থলে বলে রাখা ভালো, তিন-চারশো টাকা সেট + আউটসাইড ব্যামবু অ্যারিয়েলে যে রিসেপশন পাবে, হাজার টাকা সেট+রুম অ্যারিয়েলে পাবে তার চেয়ে ঢের নিকৃষ্ট রিসেপশন। অবশ্য দামি সেটে যে-রকম ধ্বনিকে–বিশেষ করে সঙ্গীতের বেলায় ইচ্ছেমতো কড়া মোটা করা যায়, সস্তা সেটে সেটা করা যায় না। কিন্তু ভাষার বেলা– যাকে বলে স্পোকেন ওয়ার্ড– সস্তা সেটও+দীর্ঘতম আউটসাইড অ্যারিয়েল ১০০% কাজ দেবে। আমার সেট আরও দামি হলে আরও ভালো রিসেপশন হত এটা ভুল ধারণা। যে কোনও দিন সকাল সাতটা-আটটা গোছ সময় ১৩ মিটার ব্যান্ডে অস্ট্রেলিয়া শুনে নিয়ে (ওই সময় ১৩ মিটার মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট) অন্য বাড়িতে দামি সেট শুনে এস- দেখবে তফাৎ নেই। পুনরায় সন্ধে ৬-৩০-এ ১৩ মিটারে প্যারিসের ইংরেজির প্রোগ্রাম খানিকটা শুনে (প্রোগ্রাম মাত্র আধ ঘন্টার, ৭টা থেকে ফরাসি ভাষাতে প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যায়) দামি সেটের রিসেপশনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখ। প্যারিস দুলা স্টেশন, তদুপরি ওই সময় ১৩ মিটারে বিস্তর স্টেশন ঝামেলা লাগায় গোটা তিনেক বিবিসি, একটা vOA, ভাটিকান, সুইজারল্যান্ড, পাকিস্তান, রুশ, হল্যান্ড, আরও কে কে আছেন– কাজেই তুমি যদি তখন প্যারিসের ইংরেজি প্রোগ্রাম পরিষ্কার বুঝতে পার তবে আর চিন্তা কর না, তোমার সেট এবং অ্যারিয়েল দুই-ই ঠিক। অবশ্য বর্ষার অতি নিকৃষ্ট আবহাওয়া হলে দামি, সস্তা কোনও সেটেই, শহর মফস্বল কোনও জায়গাতেই হয়তো প্যারিস ধরতে পারবে না।

আপন দেশের ভাষা শেখাবার জন্য সবচেয়ে উৎসাহী ইংরেজ। কিছুদিন থেকে বাঙলার মাধ্যমে পর্যন্ত ইংরেজি শেখাতে আরম্ভ করেছে। যারা ইংরেজিটা মোটামুটি জানো, তারা অ্যাডভান্স কোর্সটি শুনলে উপকৃত হবে।

প্যারিস একদা, বোধহয়, ইংরেজির মাধ্যমে ফরাসি শেখাত। এখন সাড়ে ছটা থেকে সাতটা পর্যন্ত যে ইংরেজি প্রোগ্রাম দেয় তাতে তো সে আইটেম শুনিনি। তবু নিরাশ হবার কারণ নেই। প্রথম ১৮.৩০ থেকে ১৯.০০ অবধি (আমি সর্বত্রই ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম দিচ্ছি) মনোযোগ সহকারে ইংরেজি প্রোগ্রামটি বিশেষ করে সংবাদ শুনে নেবে। তার পর সেই সংবাদই ফরাসিতে শুনতে পাবে ১৯.০০ থেকে ১৯.৩০-এর কোনও এক সময়। ইংরেজিতে খবরটা বুঝে নিয়েছ বলে ফরাসিতে সেটি ধরতে সুবিধে হবে। মাসখানেক প্র্যাকটিসের পরেও যদি না বুঝতে পারো তবে মেনে নিয়ে, যে ফরাসি জ্ঞানের পুঁজি নিয়ে প্র্যাকটিস আরম্ভ করেছিলে সেটা যথেষ্ট নয়। দুপুরেও প্যারিস ফরাসি প্রোগ্রাম দেয়– প্রধানত ইভেচায়নার জন্য। তবে রিসেপশন সবসময় ভালো হয় না।

সুইজারল্যান্ডও ফরাসিতে গ্রোগ্রাম দেয়। ইংরেজিতেও। আমাদের জন্য (অর্থাৎ ফর ফার ইস্ট অ্যান্ড সাউথ ইস্ট এশিয়া) তাদের স্টেশন খোলে ১৬.৩০ ওই ১৩ মিটার ব্যান্ডেই। ওরা কিন্তু ব্রডকাস্ট করে (১) জর্মন, (২) সুইস জর্মন, (৩) ফরাসি, (৪) ইতালীয়, (৫) ইংরেজি এবং কোনও কোনও দিন এসপেরান্তোতেও। প্যারিসের বেলা যে প্রক্রিয়ার সুপারিশ করেছি এস্থলেও সেটি প্রযোজ্য। তোমাকে শুধু তক্কে তক্কে থাকতে হবে, কখন কোন ভাষায় প্রোগ্রাম দেয়।* এছাড়া রুশ চীন, জাপান এরাও ফরাসিতে ব্রডকাস্ট করে, (বিবিসি-ও করে, কিন্তু এদেশে শীতকালে রাত ঘনিয়ে এলে কখনও কখনও পাওয়া যায়– আসলে এটা আমাদের উদ্দেশ্যে বেতারিত হয় না ওটা পূর্ব ইয়োরোপের জন্য, জর্মনের বেলাও তাই)।

কিন্তু সর্বোত্তম ব্যবস্থা অল ইন্ডিয়া রেডিও-র ফরাসি প্রোগ্রাম শোনা। রাত ঘনিয়ে এলেও বোধহয় সন্ধ্যার দিকেও ইটি বেতারিত হয়। এটা শোনার সুবিধা এই, রিসেপশন মোটামুটি ভালো, কী কী খবর মোটামুটি দেবে সেটা আগে থেকে জানা আছে বলে বুঝতে সুবিধে হয়, এবং যে দু-চারটে কথিকা দেয়– যেমন রবীন্দ্রনাথ বা ভারত ইতিহাসের কিছু একটা আমাদের কিছুটা জানা বলে ওই একই সুবিধে। এদের উচ্চারণ সবসময় ১০০% খাঁটি হয় না– তবে আপনার-আমার কাজের জন্য যথেষ্টর চেয়েও প্রচুর। এস্থলে উল্লেখ করি, যারা কনভারসেশনাল আরবি এবং ফারসি বুঝতে নিজেকে অভ্যস্ত করাতে চান তারা যেন আকাশবাণীর আরবি-ফার্সি প্রোগ্রাম শোনেন। এঁদের উচ্চারণ অত্যুকৃষ্ট। কিছুদিন আগেও মক্কার এক উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোক ও মদিনাগতা তার স্ত্রী অ্যানাউনসার ছিলেন।…

ধার্মিকজন মিশরে গৃহীত রেকর্ডে অত্যুত্তম কুরান পাঠও শুনতে পাবেন।… রাজনৈতিক তথা প্রাকৃতিক আবহাওয়া ভালো থাকলে ফরাসি ইকোয়েটরিয়াল আফ্রিকার ব্রাজভিল শহরের উত্তম ফরাসি ব্রডকাস্ট এদেশে পাওয়া যায়। শীতকালে রাত ঘনিয়ে এলে ত্যুনিস আলজেয়ারস থেকেও মিডিয়াম ওয়েভে ফরাসি প্রোগ্রাম পাওয়া যায়। এবং রাত দশটা-এগারোটা থেকে ভোরবেলা পর্যন্ত মন্তে কার্লো– ফরাসিতে। শীতকালে মিডিয়াম ওয়েভে ২০৫ মিটার (=১৪৬৬ কি. সা.) ব্যান্ডে। আমার জানামতে এটিই ইয়োরোপের সবচেয়ে জোরদার মিডিয়াম ওয়েভ স্টেশন। এর জোর ৪০০ কি.ও.। ফরাসিটা সড়গড় হয়ে গেলে শীতকালে অনিদ্রায় এর প্রোগ্রাম ঘন্টার পর ঘণ্টা পরমানন্দে শোনা যায়। তবে কমার্শিয়াল বলে উৎপাতও আছে।… ওয়েস্ট বার্লিনও ৩০০ কি.ও. স্টেশন, কিন্তু কে জানিনে একে বড় জ্যাম করে।

জর্মনির যে বেতারস্টেশন বিদেশের জন্য বেতার ছাড়ে তার নাম ডয়েচশে ভেলে (Deutsche Welle) 178 fola Pauca (Koeln-Cologne Costa Rice w acana আসে)। ভারতের জন্য এদের প্রোগ্রাম ১৮.২০ থেকে ১৫ পর্যন্ত, ১৯ এবং ১৬ মিটারে কিন্তু নিরেট জর্মন ভাষায়। তবে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু এবং ফের ইংরেজিতে ব্রডকাস্ট করে একবার সকালে ৮.৩০ থেকে ৯.১০ পর্যন্ত এবং দুপুরে একটা থেকে মাঝে মাঝে ক্ষান্ত দিয়ে রাত্রি প্রায় দশটা অবধি ওইসব ভাষায়। এরই যে কোনও একটা শুনে নিয়ে জর্মন প্রোগ্রাম শুনে নিলে ভালো হয়। কিছুদিন পূর্বে একটি তাজ্জব খবর পেলুম। জর্মনি মাসে দুই বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা থেকে ১.৩৫ পর্যন্ত সংস্কৃতে ব্রডকাস্ট করবে! তবে ওয়েভ লেন্থটা জানিনে। আশা করছি, খুঁজে-পেতে পেয়ে যাব।… বর্ষাকালে এদেশে জর্মনি ভালো পাওয়া যায় না। বরঞ্চ ১২.১৫ থেকে ১৫.০০ অবধি জর্মনি যে বেতার অস্ট্রেলিয়ার জন্য ২৫, ১৯, ১৬ মিটারে ছাড়ে তার ১৬টা ভালো পাওয়া যায়। জর্মনি একদা ইংরেজির মাধ্যমে জর্মন শেখাত এখনও শেখায় কি না অনুসন্ধান করা যেতে পারে।

এছাড়া পূর্বোক্ত সুইজারল্যান্ড অনেকক্ষণ ধরে জর্মনে ব্রডকাস্ট করে। এককালে পূর্ব জর্মনিও (DDR) শুনতে পেতুম। দুপুরবেলা জাপানও উত্তম জৰ্মনে (১৯ মি.) এবং রাত ঘনিয়ে এলে মস্কো, বুখারেস্ট, প্রাগ, সোফিয়া ইত্যাদি শহরও ফরাসি জর্মনে ব্রডকাস্ট করে। এদের সকলেরই প্রায় এক সুর, কিন্তু আমাদের তাতে কিছুটি যায়-আসে না। আমাদের ভাষা শেখা নিয়ে কথা।

দুঃখের বিষয়, ভিয়েনা– জর্মন ভাষার বড় কেন্দ্র এখনও এক্সপেরিমেন্টাল স্টেজে, এবং ফরাসি কৃষ্টির বৃহৎ কেন্দ্র ব্রাসস্ আমি কখনও পাইনি।

মস্কো একদা অতি সযত্নে রুশ ভাষা শেখাত। আরবি, ফারসিতে যাদের দিলচসপি, তাঁরা অনায়াসে বাগদাদ, কাইরো এবং তেহেরান খুঁজে পাবেন। কাবুল ফরাসি ও ইংরেজিতে অল্পক্ষণের জন্য ব্রডকাস্ট করে। ফারসি এবং পশতু প্রচুর।

আমি শুধু সেসব স্টেশনের কথাই উল্লেখ করেছি, যেগুলো এদেশে মোটামুটি ভালোই পাওয়া যায় এবং বিদেশি ভাষা-জ্ঞান সড়গড় রাখতে সাহায্য করবে।

———

*সব স্টেশনই কোনও না কোনও সময় আপন ঠিকানা দেয়। সে ঠিকানায় চিঠি লিখলে তারা প্রোগ্রাম ফ্রি পাঠায়। যারা ভাষা শেখায় তারা কেউ কেউ ফ্রি চটি পাঠ্যবইও পাঠায়, কোনও কোনও স্থলে পয়সা দিতে হয়। কখন কোন মিটারে কে ব্রডকাস্ট করে তার সবিস্তর বর্ণনা পাওয়া যায় World Radio Handbook, Lindorffs, Allee1, Hellerup, Denmark বইয়ে। দাম পাঁচ টাকার মতো। এবং সকরুণ নিবেদন, আমাকে দয়া করে চিঠি লিখবেন না। আমি অসুস্থ। সেক্রেটারি নেই।

 অর্থমর্থম

বিশ্বের অন্যতম অসাধারণ লেখক, প্রত্নতাত্তিক, যোদ্ধা টমাস এডওয়ার্ড লরনস (Lawrence) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আরব জগতে যে সুখ্যাতি অর্জন করেন তার কিংবদন্তি আজও সে অঞ্চলে সুপ্রচলিত। সে যুদ্ধের সময় তুর্কি রাষ্ট্রের পরাধীন আরবভূমি তুর্কির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ মনোভাব দেখালে পর তাঁর ওপর ভার পড়ে আরবদের গেরিলা ও সাবোতাজ কর্মে পাকাপোক্ত করে তোলার। …একদা তুর্কি থেকে বেরিয়ে একখানা হজযাত্রী ট্রেন মদিনা যাবে। ওটাকে বিস্ফোরক দিয়ে কী করে ওড়াতে হয় তারই তালিম দিচ্ছেন লরন আরবদের। আসলে নিরীহ যাত্রীবাহী গাড়ি চুরমার করতে তাঁর মন মানছিল না কিন্তু নবগীতায় নাকি সান্ধ্যসংস্কৃতে আছে রণে চ প্রেমে চ দাক্ষিণ্য নৈব নৈব চ। এন্তের তোড়জোড় করে লরনস তো রেললাইনের তলায় বিস্ফোরক পোতার কায়দাকেতা আরবদের শেখালেন বিশেষজ্ঞের গাম্ভীর্য ও তাচ্ছিল্য সহকারে। তার পর সবাই বিস্ফোরকের আওতার বাইরে এসে আশ্রয় নিলেন মরুভূমির একটা বালির ঢিপির পিছনে। দেখা গেল, দূর থেকে আসছে খেলনার গাড়ির মতো হেলেদুলে মান্ধাতার আমলের ধাপামার্কা যাত্রীগাড়ি। সক্কলের চোখ গাড়িটার ওপর ডাকটিকিটের মতো সাঁটা। এই এল– এই এল– এই এসে গেল বিস্ফোরকের ভিসুভিয়াসটার উপর ওইয্য- কোথায়। কী! গাড়িখানা দিব্য ঝ্যাক ঝাক করে কাশতে কাশতে ফাঁড়াটা মোলায়েমসে পেরিয়ে গেল।… আরবরা বিশেষজ্ঞের দিকে আড়নয়নে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল কি না বলতে পারব না। লস্ বলেছেন, দ্য আরটিসট ইন মি ওয়োজ ফুরিয়স, দ্য ম্যান ইন মি ওয়োজ হ্যাপি। ইংরেজিটা আমার হুবহু মনে নেই, কিন্তু এটা পরিষ্কার এখনও যেন কানে বাজছে, ভাষাটি তাঁর ছিল চমৎকার আর বলার ধরনটি সরেসেরও সরেস।… যেখানে লরস হুনুরির মতো ফাঁদ পাতছেন সেখানে তিনি আরটিস্ট পার-একসেলাস, সেখানে বেবাক বন্দোবস্ত বরবাদ-ভণ্ডুল হলে ভিতরকার আবৃটিস সত্তা তো চটে যাবেই। কিন্তু সেই আরটিসটের পাশেই যে দরদী মাটির মানুষটি রয়েছে সে তো কতকগুলো নিরীহ বালবৃদ্ধকে খুন করতে চায়নি। সে তখন বগল বাজিয়ে নৃত্য করছে।

ঘটনাটি যে এতখানি ফলিয়ে বললুম তার কারণ, এ ব্যাপারটা একটুখানি ভোল বদলে আমাদের জীবনে নিতা নিত্য ঘটে। যেমন মনে করুন, আপনি উদ্ভিদবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ, তদুপরি শখের বাগান করেছেন বহু বহু বছর ধরে। আপনার প্রতিবেশী একটা আস্ত জানোয়ার পাড়াটা অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনি একদিন দেখেন, পন্টকটার প্রাণে শখ জেগেছে, কোত্থেকে একটি অতি সুন্দর কামিনীর চারা জোগাড় করে সেটা পুঁততে যাচ্ছে এমনভাবে যে, সজ্ঞানে চেষ্টা করলেও এর চেয়ে বেশি ভুল করা যায় না। জায়গাটা বাছাই করেছে ভুল, গর্ত যা করেছে এবং সেটাতে জল আর কাঁচা গোবর যা রেখেছে তাতে দিল্লির মিঞা কুবৃমিনার একবার পা হড়কে পড়ে গেলে কাগজে বেরুবে মিঞা কুত্ত্ব জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছেন। পূর্বেই বলেছি– না বলিনি? –ফাঁসুড়েটার আশু পঞ্চত্ব কামনা করে আপনি কালীঘাটে শির্নি মানত করেছেন।… কিন্তু তখন আপনি আর থাকতে পারবেন না। আপনার ভিতরে যে হুনুরি, যে আটিস্ট ঘুমিয়ে আছে সে মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠে চিৎকার করে বলবে, ওরে, ও আহাম্মুখ, কামিনী এভাবে পেতে?– তার পর ইস্পাইট অব ইওর সেল অর্থাৎ আপনার ভিতরকার হুনুরি আপনার ভিতরকার দুশমন মানুষটাকে পরোয়া না করে তাকে বাৎলে দেবে চারা পোঁতার কায়দাকেতা!!!

ভূমিকাটা মাত্রাধিক দীর্ঘ হয়ে গেল; তা হবেই। কথায় বলে

বাইরে যাদের লম্বা কোঁচা
ঘরেতে চড়ে না হাঁড়ি।
খেতে মাখতে তেল জোটে না।
কেরোসিনে বাগায় তেড়ি।

কালোবাজারিকে আমি আমার দুশমন বলে বিবেচনা করি। কালোবাজারি মাত্রই ক্যাপিটালিস্ট; অবশ্য সর্ব ক্যাপিটালিস্টুই কালোবাজারি নয়। কম্যুনিসট্রা আবার সর্ব ক্যাপিটালিসটকেই দুশমন সমঝেন। অর্থাৎ কম্যুনিস্টরা আমার দুশমনের দুশমন। ফারসিতেও বলে,

দোসৎনিস্ত (নাস্তি), দুশমন-ই দুশমন অসৎ (অস্তি)- দোস্ত নয়, কিন্তু আমার দুশমনের দুশমন!…

পূর্বেই বয়ান দিয়েছি, মানুষের ভিতরকার আটিস্ট দুশমনকেও সাহায্য করে, আর আমি দুশমনের দুশমনকে করব না? কারণ আমার ভিতরেও একটা আবৃটিটু রয়েছে। আত্মশ্লাঘা? আদৌ না। কোন মানুষের রক্তে আটিসৃটের ছোঁয়াচ বিলকুল লাগেনি বলতে পারেন? এমনকি আমরা যাকে অভদ্র ভাষায় মিথ্যুক বলি সে-ও তো বেচারা সুযোগ থেকে বঞ্চিত-ইংরেজিতে যেমন দড়কচ্চা-মারা গাছের বেলা বলে এটার গ্রোৎ স্টানটিড়- ঔপন্যাসিক, কবি, এক, কথায়, আরটিস। নোট যে লোক জাল করে সে-ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত রবিবর্মা।

অতএব আমি যখন কম্যুনিস্ট ভায়াদের সদুপদেশ দিই তখন সেটা দম্ভজনিত আত্মশ্লাঘাবশত নয়। অবশ্য তারা সেটা নেবেন কি না, সেটা নিতান্তই তাদের বিবেচ্য। এবং আমি মনের কোণে এ আশাও পোষণ করি যে তথাকথিত ধর্মভীরুজনও এদিকে খেয়াল করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। অর্থনীতিবিদ শুমপেটার বলেছেন :- মার যখন বিশ্বশ্রমিক সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেন তখন অনুমান করতে পারেননি যে, পৃথিবীর যে কোনও স্থলে প্রথম ইনকিলাবের ফলস্বরূপ প্রথম প্রলেতারিয়া-রাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়া মাত্রই অন্যান্য দেশের ক্যাপিটালিস্ট্রা সেটা দেখে তার থেকে লে ড্র করে নিজেদের সেই অনুযায়ী এজাস্ট করে নেবে, মানিয়ে নেবে।(১) অর্থাৎ এযাবৎ যে যে বেধড়ক শোষণনীতি চালিয়েছে সেটাকে মডিফাই করে প্রলেতারিয়াকে কিছু পরিমাণে ব্যবসাতে হক দিয়ে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শেয়ার, পেনশন, বেকারির সময় ডোল, চিকিৎসার ব্যবস্থা, নানাবিধ ইনসিওরেনস দিয়ে এমনই তার স্বার্থ নিজের স্বার্থে জড়িয়ে ফেলবে যে একদিন সে দেখবে, হি হ্যাঁজ মোর টু লুজ দ্যান মিয়ারলি ফেটারজ অর্থাৎ ইনকিলাব এনে সে অর্থনৈতিক পায়ের বেড়ি হাতের কড়ার দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে বটে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার ইনসিওরেনসের সুবিধাও হারাবে। নবীন প্রলেতারিয়া রাষ্ট্র বিনা মেহন্নতে ফোকটে পয়সা কামানোটা বিলকুল বরদাস্ত করে না। ক্যাপিটালিস্টদের এই এড়জাস্ট করে নেওয়াটাকে শুমপেটার তুলনা করেছেন রোগের বীজাণুর সঙ্গে; তারা যেরকম প্রাণঘাতী ওষুধের ইনজেকশন খেয়ে খেয়ে কালক্রমে ওষুধের সঙ্গে নিজেদের এজাসট করে নেয় তার পর সহজে নি মূল হতে চায় না।

প্রশ্ন উঠবে, আমি কি তবে কম্যুনিস্ট ভায়াদের লেলিয়ে দিচ্ছি ধর্মের পিছনে, আর ওদিকে ধর্মানুরাগীজনকে বলছি, সাধু সাবধান!?

পাঠক যদি অনুমতি দেন, তবে এ প্রশ্নের উত্তরটি আমি উপস্থিত মুলতবি রাখব। কারণ শুধু এরই জন্য আমাকে পুরো এক কিস্তি পঞ্চতন্ত্র লিখতে হবে। উপস্থিত যেটা লিখছি তাতে এর স্থান সঙ্কুলান হবে না।

***

কম্যুনিসটা একটি মোক্ষম তত্ত্ব-কথা বলেন যেটা সকলেরই বিচার করে দেখা উচিত। বস্তুত এ অধম এ বাবদে গত ত্রিশ বছর ধরে চিন্তা করেছে, দলিল-দস্তাবেজ সন্ধান করেছে, ফের চিন্তা করেছে, এখনও করছে, উপকৃত হয়েছে ও হচ্ছে।

তাঁরা বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব প্রগতিশীল আন্দোলন–ইনকিলাব– যুগান্তকারী পরিবর্তন দেখতে পাই তার পিছনে থাকে অর্থনৈতিক কারণ– ইকনমি কনডিশন্।(২)

সকলেই স্বীকার করবেন, পৃথিবীতে সাতটি বড় বড় আন্দোলন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। তার ফলে সাতটি প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়, এবং তার পাঁচটি এখনও পৃথিবীতে নানা আলোড়ন সৃষ্টি করে।

সে সাতটি সচরাচর ধর্ম নামে পরিচিত। ধর্মের নাম শুনে পাঠক অসহিষ্ণু হবে না। আগে কহি।

তার তিনটির জন্ম এদেশে হিন্দু (সনাতন), বৌদ্ধ, জৈন। এ তিনটি আর্যধর্ম। শেষের জৈনধর্ম এখন পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে আর প্রায় দৃষ্টিগোচর হয় না। বৌদ্ধধর্মের রঙ্গভূমি বহু যুগ ধরে ভারতের বাইরে।

আর তিনটি আরব-প্যালেস্টাইন নিয়ে যে সেমিতি (সেমেটিক) ভূমি সেখানে : ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান ধর্ম (ইসলাম)। এ তিনটি সেমিতি ধর্ম। ইহুদিধর্মের বিশ্বাসীজন প্রায় দু হাজার বছর নিষ্ক্রিয় থাকার পর অধুনা সগৌরবে রঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছেন, বিশ্বলোক ভাবিছে বিস্ময়ে, যাহার পতাকা/ অম্বর আচ্ছন্ন করে, এতকাল এত ক্ষুদ্র হয়ে কোথায় ছিল ঢাকা।

সপ্তমটির জন্মস্থল ভারত এবং সেমিতি ভূখন্ত্রে মাঝখানে। এটিও খাঁটি আর্যধর্ম। প্রাচীন ইরানে এর জন্ম ও জরথুস্ত্রী বা জরথুস্ত্রের ধর্ম নামে পরিচিত। লোকমুখে এরা অগ্নি-উপাসক আখ্যায় পরিচিত। ভারতবর্ষে এখন এই পারসিদের একমাত্র না হলেও-প্রধান নিবাসস্থল। ইহুদিদের সাতশো বছর পূর্বে এঁরা রঙ্গভূমি থেকে বিদায় নেন। কিন্তু আজ যদি এঁরাও ইহুদিদের মতো দুই সেন– মারকিন জনসেন আর ইংরেজ উইলসেনকে হাত করে প্রাচীন ইরানে অধুনা আফগানিস্তানে অবতীর্ণ হয়ে বলুখ (সংস্কৃতে হিল) বদখশান দখল করে আরিয়ানা (আর্য) রাষ্ট্র প্রবর্তন করেন তবে অন্তত আমরা আশ্চর্য হব না। বলশ্য অঞ্চল রুশ সীমান্তের এ-পারে– মাঝখানে মাত্র আমুদরিয়া (নদী) এবং এশিয়ার বুকের মধ্যিখানে। এখানে মারকিন-ইংরেজের একটি কলোনি বা ঘাটির বড়ই প্রয়োজন!… লাওৎসে, কনফুৎসর নীতিবাদ ধর্ম নামে পরিচিত হয় না।

যে অর্থনৈতিক বাতাবরণের দরুন নবীন ধর্ম সৃষ্টি হয় তার অনুসন্ধান করতে গেলে ইসলাম নিয়ে আরম্ভ করাই প্রশস্ততম, কারণ এটি সর্বাপেক্ষা নবীন এবং ইসলামের পরে আর কোনও বিশ্বধর্ম জন্মগ্রহণ করেনি। তদুপরি আরবরা গোড়ার থেকেই জাত-ঐতিহাসিক। তারা হজরত সম্বন্ধে যতখানি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখে গেছে তার তুলনায় খ্রিস্ট বা বুদ্ধের জীবনী অনেক কাঁচা হাতে মহাপুরুষদের তিরোধানের প্রচুর সময়ের ব্যবধানে লেখা হয়েছে। ফলে তাঁদের ছবিগুলো আইডিয়ালাইজড– আরটিসট কল্পনার ওপর নির্ভর করেছেন বিস্তর।(৩)

হজরত যখন মক্কায় একেশ্বরবাদ প্রচার করলেন তখন মক্কাবাসী সাড়ে তিনশো দেবতা স্বীকার করত। আরেকটি বাড়লে আপত্তিটা কী? আর নামাজ-রোজাতেই-বা কী? পুজোপাট তারাও করে, আর উপোসটাও স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যুত্তম প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু যেই তিনি প্রচার করলেন, ধনীর উপর ট্যাকশো বসিয়ে সে ধন তিনি গরিবদের, হ্যাভনটদের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন তখনই লাগল গণ্ডগোল। ওদিকে হ্যাভনটরা জুটল তার চতুর্দিকে টাকাকড়ি নয়া করে ভাগাভাগি হলে তারাই হবে লাভবান! ধনী আদর্শবাদী জুটলেন অত্যল্পই, মক্কাবাসীরা তখন স্থির করল, একে খুন না করে নিষ্কৃতি নেই।

খ্রিস্টের বেলাও তাই।

তিনিও তার প্রচারকার্য আরম্ভ করেছিলেন সমাজের দরিদ্রতম স্তরের গরিব জেলেদের নিয়ে। আধ্যাত্ম জগৎ তথা নীতিশাস্ত্র সম্বন্ধে যেসব উপদেশ তিনি দিলেন সেগুলো আজও পূর্ণ জীবন্ত কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলছেন, কেউ তোমার জামাটি অন্যায়ভাবে কেড়ে নিলে তাকে স্বেচ্ছায় জোব্বাটিও দিয়ে দিয়ে। এক পুণ্যশীল ধনীকে বলছেন, তোমরা সব কিছু বেচে ফেলে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দাও।

জেরুসলমের ইহুদি পুঁজিপতির দল তবু এসব গ্রাহ্য করেনি। ইতোমধ্যে সুলেমানমন্দিরের ভগ্নস্তূপের উপর রাজা হেরড দ্য গ্রেট নির্মাণ করেছেন এক বিরাট নবীন ঐশ্বর্যমণ্ডিত য়াহতে-মন্দির। কিন্তু মন্দির হোক আর সিনাগগই হোক, জাত-ইহুদি ওটাকে দু দিন যেতে না যেতেই ব্যবসায়ের কেন্দ্রভূমি করে তুলেছে। সেখানে চলেছে গরু-বলদের কেনাবেচা এবং তার চেয়েও মারাত্মক সুদখোর ইহুদি মহাজনরা সেখানে চালিয়েছে টাকার লেনদেন, সররাফের (ক্ষুদে ক্ষুদে ব্যাঙ্কারের) বাট্টা নিয়ে টাকাকড়ির বদলাবদলি। বস্তুত এইসব পুঁজিপতিরাই তখন পুণ্যভূমির অধিকাংশ তাদের টাকার জোরে কজায় এনে ফেলেছে।

ইহুদিভূমির প্রত্যন্ত-প্রদেশ থেকে সহস্র-সহস্র শিষ্যশিষ্যা, বিশ্বাসী গ্রামবাসী অনুগতজনকে নিয়ে প্রভু যিশু সগৌরবে প্রবেশ করলেন জেরুসলমে। সেখানে গেলেন সেই সর্বজনমান্য মন্দিরে। ব্যবসায়ীদের কারবার দেখে তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন কি না বলা কঠিন, তবে তার আচরণ থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়।

মহাজন, ক্রেতা-বিক্রেতাদের তিনি ঝেটিয়ে বের করে দিলেন মন্দিরের বাইরে। চতুর্থ সুসমাচার-লেখক সেন্ট-জন্ বলছেন (St. John) তিনি সুতোর দড়ি পাকিয়ে চাবুক বানিয়ে তাদের চাবকাতে চাবকাতে সেখান থেকে তাড়ালেন। টাকার থলেগুলো উজাড় করে ঢেলে দিলেন মাটিতে, ব্যাঙ্কারদের টেবিল করে দিলেন চিৎপাত। বললেন, শাস্ত্রে আছে : আমার ভবনের নাম হবে উপাসনা ভবন; আর তোরা এটাকে করে তুলেছিস চোরের আড্ডা (ডেন্ অব থিভজ )।

সেই সময়েই স্থির করল পুঁজিপতি ও তাদের ইয়ার যাজকসম্প্রদায়– যিশুকে বিনষ্ট করতে হবে, ক্রুশবিদ্ধ করে মারতে হবে।

***

ধনদৌলত-টাকাকড়ি।

অর্থমনর্থম্ বলেন গুণীজন। কিন্তু এ-ও সত্য– অর্থের সন্ধানে বেরুলে অর্থ (টাকাকড়ি) না-ও পেতে পারেন, কিন্তু অর্থ পেয়ে যাবেন অর্থাৎ অর্থটা– মানেটা বুঝে যাবেন। তাই অর্থমর্থমও বটে।

১. আমার বাড়ির সামনে দিয়ে গত সপ্তাহে বিড়িওলাদের মিছিল গেল– বিড়ির পুঁজিপতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে। তারা ইনকিলাব দোহাই পেড়ে বলছিল ইনক্লাব জিন্দা বাদ। শিক্ষিত লোককেও আমি ইনক্লাব উচ্চারণ করতে শুনেছি। আসল উচ্চারণ ইনকিলাব। –লাটা যতদূর চান দীর্ঘ করবেন। তার পর জিন্দাটা হ্রম্বে হ্রস্বে সারবেন। তার পর বাদটা বাদ যতদূর খুশি দীর্ঘ। অর্থাৎ ইন্। কী লা। ব!! জি। দা। বা। দ ॥

২. সর্ব ইনকিলাবের পিছনে যে অর্থনৈতিক কারণ থাকে সেটাই বিপ্লবের একমাত্র কারণ কি না, কিংবা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কারণ কি না, সে আলোচনা এস্থলে থাক।

৩. আমি এস্থলে বুদ্ধ-যিশুর একমাত্র চিন্ময় রূপের মধ্যেই (অর্থাৎ আমরা যে কল্পনার বা আইডিয়ালাইজড বর্ণনার বুদ্ধ-যিশুর ধারণা করি) নিজেকে সীমাবদ্ধ করছি। ওয়েস্ মৃন্ময় দিকটা নিয়ে মন্তব্য করেছেন—

Jesus was a penniless teacher, who wandered about the dusty sun-bit conutry of Judea, living upon casual gifts of food; yet he is always represented as clean, combed and sleek in spotless raiment, erect and with something motionless about him as though he was gliding through the air. এর পর ওয়েলস্ দেখাচ্ছেন, এই মৃন্ময় ছবির ওপরও চিন্ময় ছবির প্রভাব ফেলেছে This alone has made him unreal and incredible to many people who cannot distinguish the core of the story from the omamental and unwise additions of the unintelligently devout. বুদ্ধের সম্বন্ধেও তিনি অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। এ বাবদে হজরত অতিশয় সাবধান ছিলেন।

অল্পে তুষ্ট

০১.

আমার পরিচিত জনৈক সমাজসেবী ভদ্রসন্তান রাত করে বাড়ি ফিরছিলেন। শরট কট করার জন্য যে গলি ধরেছিলেন সেটা প্রায় বস্তি অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে এসেছে। হঠাৎ শুনতে পেলেন, পরিত্রাহি চিৎকার– যা এ অঞ্চলে রাতবিরেতে আকছারই শোনা যায়। সমাজসেবীটি একটু কান পাততেই বুঝতে পারলেন, যুগ যুগ ধরে সমাজ স্বামীকুলকে যে হক দিয়েছে এস্থলে সে কুলেরই জনৈক বস্তি-সন্তান সেটি তার স্ত্রীর উপর কিঞ্চিৎ পশুবলসহ প্রয়োগ করছে। এস্থলে সুবুদ্ধিমান মাত্রই তিলার্ধ কাল নষ্ট করে না, কিন্তু আমাদের সমাজসেবীটি একালের যারা সেবার নামে মস্তানি করে তাদের দলে পড়েন না। দরমার ঝাঁপ ধাক্কা মেরে খুলে হুঙ্কার ছাড়লেন, ব্যস, থামো। এসব কী বেলেল্লাপনা হচ্ছে। আমাদের পাবৃলিক স্পিরিটেড ইয়ংম্যানটি নাটকের এর পরের দৃশ্যে অবশ্যই আশা করেছিলেন সেই অবলা মুক্তি পেয়ে তার সামনে নতজানু হয়ে অঝোরে কৃতজ্ঞতাশ্রু ঝরাবে, এবং তিনিও তার দক্ষিণ হস্ত দ্বারা অদৃশ্য বাতাসের একাংশ অবহেলে দ্বিখণ্ডিত করে, বিলক্ষণ, বিলক্ষণ (ইংরেজিতে যাকে বলে নটেটোলনটেটোল) বলতে বলতে আত্মপ্রসাদাৎ ডগমগ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। ও হরি। কোথায় কী? স্বামী-স্ত্রী দু-জনাই প্রথমটায় একটুখানি থতমতিয়ে তার পর বিপুল বিক্রমে হামলা করল তার দিকে। তিনি প্রায় পালাবার পথ পান না। ইতোমধ্যে বস্তির আরও দু-পাঁচজন জড়ো হয়ে গিয়েছে। সমাজসেবী সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন ওদেরও দরদ যুযুধান দম্পতির প্রতি।

এটা কিছু একটা উটকো ফ্যাচাং নয়। পরবর্তী যুগে আমি দেশবিদেশে এস্তেক অতিশিক্ষিত মধ্য ও পশ্চিম ইয়রোপেও এহেন কীর্তন একাধিকবার শুনেছি। দু-জনার কাজিয়া মেটাতে গিয়েছ কি মরেছ। দু-জনা একজোট হয়ে তোমাকে মারবে পাইকিরি কিল।

এ তো গেল সাদামাটা পশুবল প্রয়োগের বর্বরতা ঠেকাবার প্রচেষ্টা। কিন্তু যে স্থলে দুই পক্ষই সাতিশয় শিক্ষিত বলতে কী, যেন দেশমাতৃকার উচ্চতম অনবদ্য শিক্ষিত সন্তান এবং যা হচ্ছে সেটি মার্জিততম বাকযুদ্ধ, সেস্থলেও আপনি যদি ফৈসালা করে দিতে চান তবে ফল একই। উভয়পক্ষ একে অন্যের প্রতি নিক্ষিপ্ত আপন আপন বাক্যবাণ তন্মুহূর্তেই সংবরণ করে আপনাকে করে তুলবেন এজমালি চাঁদমারির টারগেট।

এ তো হল সে-দুর্দৈবের কীর্তন যে স্থলে আপনার নিজস্ব আপন বিশ্বাস অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তৃতীয় মত আপনি পোষণ করেন না; আপনি সে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক সুবিবেচনাসহ প্রণিধান করে সুলে-সুপারিশসহ একটা মধ্যপন্থা বাতলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যেস্থলে আপনি তৃতীয় মত পোষণ করেন সেখানে– ঈশ্বর রক্ষতু!–আপনার অকালমৃত্যু অনিবার্য।

ভূমিকাটি আমার অনিচ্ছায় দীর্ঘ হয়ে গেল, কিন্তু প্রয়োজনাতীত বৃহল্লাঙুল নয়। কারণ ভবিষ্যতেও বহু-বহুবার বহু বাদানুবাদের সম্মুখে আমাকে ঠিক এইভাবেই সরকারি প্রাণ (আজকালে ফ্যামিলি প্ল্যানিঙের জমানায় ওটা আর পৈতৃক নয়, এবং জন্মের পরও দুগ্ধাভাবে, অন্নাভাবে ওটা সরকারের হাতেই সমর্পিত) হাতে নিয়ে এগোতে হবে।

***

একদল গুণীজ্ঞানী বলছেন প্রত্যেক আমি প্রত্যেক শব্দটির ওপর বিশেষ জোর দিতে চাই– অধমের যা কিছু বক্তব্য সে ওই প্রত্যেক (বা তাবত্, কুল্লে) শব্দটি নিয়ে ছাত্রটিকে শিখতে হবে নিদেন দুটি ভাষা। কেউ কেউ বলেন, সে শিখবে (ক) আপন মাতৃভাষা ও ইংরেজি, কেউ কেউ বলেন (খ) মাতৃভাষা এবং হিন্দি। এঁরা ইহলোকের তাবল্লোককে দোভাষী বানাতে চান– একেবারে শব্দার্থে নয় (ইহসংসারে কটা লোকের মাত্র একবারের তরেও প্রফেশনাল দোভাষীর প্রয়োজন হয়?}, ভাবার্থে। তফাত এঁদের মধ্যে এইটুকু : একদল মাতৃভাষা ও তদুপরি ইংরেজি শেখাতে চান, অন্য দল ইংরেজির বদলে হিন্দি। (আর যাদের মাতৃভাষাই হিন্দি তাঁদের কী হবে? সেটা এখনও স্থির হয়নি। তাঁরাই স্থির করবেন। অবশ্যই। কই সে মরদ যার মাতৃভাষা হিন্দি নয় এবং তৎসত্ত্বেও সে হিন্দিভাষীদের সামনে কোনও বাত্ প্রস্তাবও করবে? হায়, আপসোস! কেন হিন্দিভাষী হয়ে জন্মালুম না?)

এ তো গেল দোভাষীর দল।

অন্য দল ত্রিভাষী। এঁরা বলেন, অত ঝগড়া-ফ্যাসাদের কী প্রয়োজন? বিদ্যার্থী তিনটে ভাষাই শিখবে। (গ) মাতৃভাষা, হিন্দি এবং ইংরেজি অর্থাৎ মাতৃভাষা শিখতেই হবে, তার পর কেউ বলছেন সেকেন্ড ল্যানগুইজ হবে হিন্দি, কেউ বলছেন, না, ইংরেজি, আর এই ত্রিভাষীর দল মাতৃভাষা তো খাবেনই, তদুপরি ডুডুও খাবেন, টামাকও খাবেন।

এই দোভাষী ও ত্ৰিভাষীতেই ঝগড়া।

এ ছাড়া আরও বহুবিধ আছেন। যেমন কেউ কেউ বলেন, ভারতীয় সংস্কৃতি, বৈদগ্ধ্য সভ্যতার প্রধান ভাণ্ডার সংস্কৃতে। সেই সংস্কৃতই যদি বিদ্যার্থী না শিখল তবে সে নিজেকে ভারতীয় বলে কোন মুখে? যে বেদ উপনিষদ ষড়দর্শন নিয়ে আমরা নিজে গর্ব অনুভব করি, বিশ্বজনের সামনে তুলে ধরি, সেসবই তো সংস্কৃতে। এবং এই সংস্কৃতই একমাত্র বিদগ্ধ ভাষা যে ভাষা একদা আসমুদ্র হিমাচল আর্য-অনার্য সকলকে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করে রেখেছিল। আজ যদি আমরা সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় আমাদের কারিকুলামে সংস্কৃতকে স্থান না দিই এবং ফলে তার মৃত্যু ঘটে তবে ঐতিহ্যবিহীন হটেন্টটে ও ভারতীয়তে একদিন আর কোনও পার্থক্য থাকবে না। যুক্তিগুলো যে খুবই সত্য এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ সম্প্রদায় রণাঙ্গন থেকে ক্রমেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। সংগ্রামে পরাজিত হওয়ার ফলে নয়। কারণ এঁদের বিরুদ্ধে কেউই সংগ্রাম ঘোষণা করে না– দেশের কর্তাব্যক্তিরা এদের সে অবহেলা করে, just by ignoring এদের hors de combat, রণাঙ্গন থেকে অপসারিত করেন। কারণ সংস্কৃত বাবদে এইসব কর্তাব্যক্তিদের বৃহত্তমাংশ ১০০% ignoramus 1… এরই পিঠ পিঠ মুসলমানরা বলেন, তাজমহল (কোনও মারকিন টুরিস্ট যখন তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে কোনও ভারতীয় হিন্দুকে ওই ইমারতের প্রশংসা করে অভিনন্দন জানায় তখন সে তো মুখ বাঁকিয়ে বলে না, না মশাই এটা আমার দেশের মাটিতে আছে বটে কিন্তু আমার ঐতিহ্যগত সম্পদের অংশ নয়, এটা মোচলমানদের ইউ আর বারকিং আপ দি রঙ ট্রি!), মোগল চিত্রকলা, খেয়াল, ঠুংরি, ফারসিতে লিখিত ভূরি ভূরি ইতিহাসাদি অমূল্য গ্রন্থরাজি ভারতীয় সংস্কৃতির অংশবিশেষ এদের সম্যক চর্চার জন্য ফারসি শেখানো উচিত, এবং ধর্মচর্চার জন্য যে আরবি ভাষা শিক্ষা ভিন্ন নান্য পন্থা বিদ্যতে সে তো স্বতঃসিদ্ধ। সংস্কৃতওলাদের মতো এরাও বারোয়ারিতে কল্কে পান না–উপরে উল্লিখিত একই কারণে …এর পরে আছেন জৈন ধর্মাবলম্বী। এদের ধর্মগ্রন্থ অর্ধমাগধীতে। পার্সিদের ধর্মগ্রন্থ প্রধানত আবেস্তার প্রাচীন পারসিকে। এদেশে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর সংখ্যা নগণ্য কিন্তু তাদের শাস্ত্রীয় ভাষা পালিকে নিরঙ্কুশ উপেক্ষা করলে আমরা বৃহত্তর ভারতে মুখ দেখাতে পারব না। আমার এ নগণ্য জীবনে যে দুটি বিদেশির সঙ্গে আমি একই ডরমিটরিতে কিছুকাল বাস করি তাদের উভয়ই ছিলেন সিংহলের বৌদ্ধ শ্ৰমণ। শ্ৰমণ ধর্মপাল ও শরণাঙ্কর : এদেশে এসেছিলেন পালি ও সংস্কৃত অধ্যয়নের জন্য। এছাড়া শ্যামের রাজগুরুও বার্ধক্যে এদেশে এসেছিলেন তথাগতের আপন দেশে নির্বাণ লাভার্থে। হিন্দুর বার্ধক্যে বারাণসির ন্যায় … এবং আছেন খ্রিস্টসম্প্রদায়, যদ্যপি বাইবেলের আদিমাংশ (পূর্ব মীমাংসাঃ) হিবরুতে ও নবীনাংশ (উত্তম মীমাংসাঃ) গ্রিকে, তথাপি খ্রিস্টানদের সর্বজনমান্য বাইবেলের অনুবাদ ভুলগাতে লাতিন ভাষায়। লাতিন ভিন্ন খ্রিস্ট পাদরির শিক্ষাদীক্ষা অসম্পূর্ণ।

হালফিল বিজ্ঞানের জয়জয়কার! এ বিদ্যা ষোল আনা রপ্ত করতে হলে নাকি জরমন ভাষা অবর্জনীয়।

অতি অবশ্য এখানে একটি কথা বলে রাখা উচিত। নিতান্ত কট্টর ভিন্ন কোনও মহামহোপাধ্যায়ই বিধান দেন না যে সর্ববিদ্যার্থীকে ঘাড়ে ধরে সংস্কৃত শেখাতে হবে, কট্টর ভিন্ন কোনও মোল্লা বল্লোকের কল্লা ধরে বিসমিল্লা শেখাতে চায় না। প্রাগুক্ত দোভাষী এবং ত্রিভাষীরা কিন্তু যেসব ভাষা শেখাতে চান, সেগুলো ঘাড়ে ধরে শেখাতে চান। অতএব এই ভাষার রেস্-এ সংস্কৃত ফারসি পালিওয়ালাদের উপস্থিত also ran বলে খারিজ করে দেওয়া যেতে পারে। আমি শুধু নির্ঘণ্ট নিরঙ্কুশ করার জন্য এদের উল্লেখ করলুম।

***

কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী শ্রীযুক্ত ত্রিগুণা সেন আসলে বৈজ্ঞানিক বটে, কিন্তু হিউম্যানিটিজেও তার আবাল্য অনুরাগ। তদুপরি তার কমনসেন্স আছে। অতএব তিনি সার্থকনামা ত্রিগুণধারী (সেন-এর বহুবচন সেন্স বা sense)।

দোভাষী-ত্রিভাষীদের সামনে আরেকটি জীবনমরণ সমস্যা : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম কী হবে? ইংরেজি, হিন্দি, আঞ্চলিক ভাষা– তিনটেরই সমর্থক আছেন।

এই সুবাদে আঞ্চলিক ভাষার সমর্থন করতে গিয়ে শ্রীসেন বলেন (হুবহু বাক্যগুলো আমার মনে নেই বলে শ্রীসেন তথা পাঠকের প্রতি যদি অবিচার করে ফেলি তবে কোনও সজ্জন যেন আমার মেরামতি করে দেন), পৃথিবীর কোন সভ্য স্বাধীন দেশে মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়? শিক্ষামন্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে আমাদের নিবেদন :

একশো বছরও হয়নি কবি হেম বাঁড়ুয্যে লিখেছিলেন–

চীন ব্রহ্মদেশ অসভ্য জাপান।
তারাও স্বাধীন, তারাও প্রধান।

সেই জাপানেও কি কখনও জাপানি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়েছে? বস্তুত পাঠক প্রত্যয় যাবেন না, মাত্র কিছুদিন হল ক্যান্সার রোগের এক স্পেশূলিস আমাকে বলেন, ওই রোগের গবেষণা জাপানে যা হয়েছে সেটা না জেনে সে সম্বন্ধে আপটুডেট হওয়া যায় না। এবং ওর সবকিছুই হয় জাপানি ভাষাতে।… কিন্তু অত দূরে যাবার কী প্রয়োজন? আফগানিস্তানের জনসংখ্যা কত? দেশটা কি খুবই মডারুন? না তো। আমি যখন সেদেশে পৌঁছই (১৯২৭) তখন সেখানে সবে প্রথম কলেজের প্রথম বর্ষ আরম্ভ হব-হব করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অরুণোদয় হতে ঢের ঢের দেরি। অথচ পরের বছর যখন ওই ফার্স্ট ইয়ার চালু হল তখন তার মাধ্যম হল ফারসি। কিন্তু বৃথা বাক্যব্যয়। পাঠক একটু অনুসন্ধান করলেই জানতে পারবেন ক্ষুদ্র ফিনল্যান্ডই বলুন আর বলিভিয়াই বলুন, শিক্ষার বাহন সর্বত্রই মাতৃভাষা।

***

এইবারে আমরা পৌঁছলুম রণাঙ্গনের কেন্দ্রভূমিতে।

এই যারা দোভাষী-ত্রিভাষী হয় ইংরেজি নয় হিন্দি কিংবা উভয়ই নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করছেন তাঁদের শুধোই–শিক্ষামন্ত্রীর মন্ত্র এবং যন্ত্রের সঙ্গে টায় টায় গলা মিলিয়ে পৃথিবীর কোন সভ্য স্বাধীন দেশে ক-জন উচ্চশিক্ষিত লোক মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য একটি ভাষা– উত্তমরূপে না হোক মধ্যম বা অধমরূপেই— জানে?

আমি জনপদবাসী বা নগরের অর্ধশিক্ষিতদের কথা তুলছিনে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রীতিমতো বিএ পাস করেছে, তাদেরই ক-জন মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য আরেকটি ভাষা পড়তে পারে, শুনলে বুঝতে পারে, লিখতে পারে এবং মোটামুটি সাদামাটা কথাবার্তা বলতে পারে? বলা বাহুল্য, যারা কোনও বিদেশে বেশ কিছুকাল কাটিয়েছে তাদের কথা হচ্ছে না। সেস্থলে সম্পূর্ণ অশিক্ষিত লোকও বিদেশি ভাষা অনেকখানি রপ্ত করে ফেলে আপন আপন মেধা অনুযায়ী।

এদেশের কথাও হচ্ছে না। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি মাত্র সেদিন। যদ্যপি এই কুড়ি বছরেই আমরা কী তীব্র গতিতেই না ইংরেজির খোলস বর্জন করছি– এ বর্জনের জন্য কোনও মেহনত-কেরামতি করতে হয় না, আমাদের চৌকশ গোপখেজুরে আলস্যই এর পরিপূর্ণ ক্রেডিট পায়।(১) এবং এই দেশেই প্রায় সাতশো বছর ফারসি ছিল স্টেট ল্যান্গুইজ– সেইটে একদম পালিশ করে ভুলতে আমাদের একশো বছরও লাগেনি।

ফরাসি দেশের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির কত পারসেন্ট ইংরেজি বই পড়তে পারে? বলতে পারে? এক পারসেন্টও না। মারকিন উচ্চশিক্ষিত লোক– স্কুল-কলেজে আট বছর ফরাসি শিখেছে–ক পারসেন্ট ফরাসি পড়তে-বলতে পারে? ঠিক বিএ পাসের পর? তার দশ বছর পর?

অর্থাৎ স্বাধীন দেশের শিক্ষিত লোককেও দোভাষী করা যায় না। এটা একটা ফ্যাশান স্কুল-কলেজে সেকেন্ড ল্যানগুইজ পড়ানো।

পেটের ধান্ধায় অনেকে দোভাষী হয়– স্কুলে না গিয়েও। মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী তামাম আসাম চষে খায়। ও! মারওয়াড়ের গ্রামে গ্রামে বুঝি সুবোম স্কুলে স্কুলে আসামি ভাষার দিগগজ পণ্ডিত বানানো হয়।

তাই বলি, দোভাষী-ত্রিভাষী– এদেশের শিক্ষিত লোকও হবে না। থাকবে একভাষী। এবারে দোভাষী-লিভাষীর দল আপসের চুলোচুলি ভুলে গিয়ে একজোট হয়ে আমাকে আমি, একভাষীকে মারবেন পাইকিরি কিল। এখন বলুন, আমার ভূমিকাটি কি অতি দীর্ঘ হয়েছিল?

.

০২.

ব্যক্তি-বিশেষের বেলা পুরুষকারই যেরকম শেষ কথা নয়, একটা জাতি বা দেশের বেলাও তাই। আমরা যতই ভেবেচিন্তে পারলিমেনটে তর্কাতর্কি করে, কাগজে কাগজে পাবলিসিটি দিয়ে আটঘাট বেঁধে একটা প্রোগ্রাম বা প্ল্যান চালু করি না কেন, শেষ পর্যন্ত তার ফল যে কী উতরাবে সে সম্বন্ধে আগের থেকে দৃঢ়নিশ্চয় হওয়া যায় না। একটা দেশের ধর্ম, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এগুলো এমনই বিরাট বিরাট ব্যাপার যে এগুলোকে মানুষ আদৌ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কি না সে নিয়ে আমার মনে গভীর সন্দেহের উদয় হয়; মনে হয় কী যেন এক অদৃশ্য নিয়তি মানবসমাজকে শাসন করে চলেছে, তার ওপর আমাদের কর্তৃত্ব যদি-বা থাকে সে অতিশয় যৎসামান্য। তা হলে প্রশ্ন উঠবে, এসব বিষয় নিয়ে আমাদের কি তবে চিন্তা করবার কিছুই নেই? অন্ধ নিয়তিই সব? তার নাম অদৃষ্ট, কর্মফল, কিসমতু যে নামেই তাকে ডাকুন।

হজরত মুহম্মদ একদিন বেদুইনদের সামনে পুরুষকার ও অদৃষ্ট সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়ার পর এক বেদুইন তাঁকে শুধাল, তবে কি, হজরত, উটগুলোকে আমরা দড়ি দিয়ে না বেঁধে আল্লার ভরসায় (কিসমতের ওপর ছেড়ে দেব? হজরত বললেন, না, দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে তার পর আল্লার ওপর ভরসা রাখবে। অর্থাৎ আমরা আটঘাট বেঁধে যতই প্ল্যানিং করি না কেন, সকালবেলা বেদুইনের মতোই হয়তো দেখব, উট হাওয়া, প্ল্যান ভণ্ডুল। কিন্তু তবু উট বাঁধতে হয়, প্ল্যানিং করতে হয়।

বৌদ্ধধর্মও নাকি বলেন, মানুষের জীবন নদীস্রোতে নিচের দিকে চলমান গাছের গুঁড়ির মতো; ধাক্কাধাক্কি করে সেটাকে খানিকটে ডাইনে-বাঁয়ে সরানো যায় কিন্তু স্রোতের উল্টোদিকে চালানো যায় না।

এবং কার্ল মারও নাকি বলেছেন, ইতিহাসের নিয়তি নানা সামাজিক প্যাটার্ন পরিবর্তন করতে করতে সর্বশেষে প্রলেতারিয়া-রাজ আনবেই আনবে। মানুষ সজ্ঞানে আপন চেষ্টা দ্বারা তার গতি দ্রুততর করে দিতে পারে মাত্র।

অতএব তর্কবিতর্ক করি, চেষ্টা দিই– কিন্তু জানি, শিক্ষার্থী আজ দোভাষীই হোক, আর ত্ৰিভাষীই বলুক আখেরে সে একটি ভাষাই শিখবে, তাই দিয়ে জ্ঞানার্জন করবে, কাজকর্ম চালাবে।

পাঠককে ফের বলছি, এখানে আমি বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলছি। অর্থাৎ জোর করে দেশের তাবৎ স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীকে দুটো বা তিনটে ভাষা শেখাবার চেষ্টা পণ্ডশ্রম। তারা নিছক পরীক্ষা পাস করার জন্য ভাষা শিখবে কিন্তু পরবর্তী জীবনে দ্বিতীয় বা/এবং তৃতীয় ভাষার চাবি দিয়ে ওইসব ভাষার জ্ঞানভাণ্ডার খুলে ওই জ্ঞান জীবনে সঞ্চারিত করে চিন্তাধারাকে বহুমুখী করবে না– অথচ বিদেশি ভাষা শেখার প্রধান উদ্দেশ্য তো ওইটেই।

এবারে একটা উদাহরণ নিই।

নরমানরা ইংল্যান্ড জয় করে সেখানে চালাল ফরাসি ভাষা। শুধু যে রাজদরবারেই ভাষা ফরাসি হয়ে গেল তাই নয়, শিক্ষাদীক্ষার বাহন, সংস্কৃতি বৈদগ্ধের মাধ্যম, নাট্যশালা সঙ্গীতের ভাষা– সবকিছুই তখন ফরাসি এবং ফরাসির মাধ্যমে তার জননী লাতিন। পাকা তিনশোটি বছর চলল ফরাসি ভাষার একচ্ছত্রাধিপত্য। ইংরেজিতেও যে কোনও প্রকারের চিন্তা বা অনুভূতি প্রকাশ করা যায় সেকথা দেশের ভদ্রজন সম্পূর্ণ ভুলে গেল। ফরাসি ভাষা নাকি আল্লাতালা স্বয়ং এমনই মধুর পরমপ্রিয় করে নির্মাণ করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি (এদেশেও আমরা সংস্কৃতকে দেবভাষা খেতাব দিয়েছি এবং সন্ত তুকারাম তাই বক্রোক্তি করেছিলেন, সংস্কৃতি যদি দেবভাষা হয়, মারাঠি কি তবে চোরের ভাষা?।… পুরো তিনশোটি বছর পর ইংল্যান্ডের রাজার মাতৃভাষা আবার হল ইংরেজি কিন্তু হলে কী হয়, ফরাসি যদিও ক্রমে ক্রমে হটে যেতে লাগল তবু দেখা যাচ্ছে এই সেদিন–১৭ শতাব্দী অবধি আইন-আদালতের ভাষা ছিল ফরাসি।(২)

ইংরেজি একদিন পদ পেল বটে, তাই বলে কি ফরাসি কর্তার ভূত কাঁধ থেকে অত সহজে নামে? ইংল্যান্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত M. Ed.-রা বলতে পারবেন কবে বিলেত থেকে ফরাসি কমপালসরি সবজেকটরূপে লোপ পেল। কিন্তু তার পরও, আজ অবধি, ওই ফরাসি অপশনাল হিসেবে পড়াবার জন্য বিলেত প্রতি বছর কত খরচা করে?

এবং আজও ইংরেজ মুখে ফরাসিকে নিয়ে যতই মশকরা করুক না কেন, জেবে দুটো কড়ি জমামাত্রই হলিডে করার জন্য পরানভয়ে হরিণের মতো ছুট লাগায় প্যারিস পানে– মনে আশা সেইসব কুকীর্তি করবে, যেগুলো আপন দেশে করা যায় না–সিম্পলি নট ডান্। ইংরেজি সাহিত্য যে ফরাসি সাহিত্যের কাছে কতখানি ঋণী তার জরিপ করা আমার কর্ম নয়। শব্দবিদ না হয়েও বেপরোয়া আন্দাজে বলি, ইংরেজির শতকরা নব্বইটি চিন্ময় শব্দ (আবস্ট্রাক্ট ভকাবুলারি) হয় ফরাসি নয় ওরই মারফত লাতিন গ্রিক থেকে নেওয়া।

আরও কত শত বাবদে আজও ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য, রান্নাবান্না (মেনুটা এখনও ৮০% ফরাসিস; বিফ, মাটন, পর, ভিল, ভেজ = গরু, ছাগল, শুয়োর, বাছুর, হরিণের মাংস– সবকটা শব্দ ফরাসি থেকে এসেছে), আদব কায়দা (R. S. V. P থেকে P PC), মদ্যাদি (কন্যাক থেকে শ্যামপেন) ফরাসির কাছে ঋণী বস্তুত বিলেতে, আজও সভ্যতা ভদ্রতার কোন না বস্তু ফরাসি প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল বা আছে?

***

একদা কতিপয় শিক্ষাবিদ ইংরেজের মনে প্রশ্ন জাগল, সেই যে আমরা ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য শেখানোর জন্য আমাদের দেশে প্রায় হাজার বছর ধরে এত টাকা ঢেলেছি, দেখি তো, তার ফলটা কী হয়েছে? জনৈক ফরাসি ভদ্রলোককে নাবানো হল লন্ডনের রাস্তায়। যারই বেশভূষা আচার-আচরণ দেখে মনে হল লোকটি মার্জিত উচ্চশিক্ষিত তাকেই ফরাসি ভদ্রলোক ফরাসিতে শুধলো, আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, বলতে পারেন, কোনদিকে গেলে সবচেয়ে কাছের টুব স্টেশনে পৌঁছব? কথিত আছে ৯৩ না ৯৭ নম্বরের ভদ্রলোক প্রশ্নটা বুঝতে পারলেন বটে কিন্তু ফরাসিতে উত্তর দিতে পারলেন না। ১০৩ না ১০৭ নম্বরের জনা বুঝি কোনওগতিকে অতি ভাঙা-ভাঙা ফরাসিতে উত্তরটা দিলেন।

এর পর আরও নানা উদাহরণ, নানা যুক্তি দেখিয়ে প্রাগুক্ত গবেষকগণ অতিশয় ন্যায্য প্রশ্ন শুধিয়েছেন, তা হলে ওই পোড়ার ফরাসি শেখাবার জন্য এদেশে অত কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালার কী প্রয়োজন?

***

এ বিষয়টি আরও সবিস্তর আরও উদাহরণ দিয়ে গুছিয়ে বলতে হয়। আমার শক্তি অতিশয় সীমাবদ্ধ। তদুপরি যখন জানি, যা হবার তা হবেই, তখন কেমন যেন উৎসাহের অভাবে কলমের কালি শুকিয়ে যায়। তবু লিখছি, এলোপাতাড়ি হাবিজাবি বিস্তর বেহুদা এক্সপেরিমেন্ট করার পর মার খেয়ে খেয়ে যখন মাত্র একটি ভাষাই বাধ্যতামূলক করা যায় এ তত্ত্বটি আবিষ্কার করব, যা অন্যান্য স্বাধীন দেশ করে ফেলেছে, তখন কেউ যেন না বলে, এ যুগের, অর্থাৎ আমাদের বর্তমান যুগের লোকের বিন্দুপরিমাণ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা শক্তি ছিল না।

ইংরেজি তো এদেশে একশো বছর ধরে কমপালসারি ছিল। ইংরেজি শিখলে আর্থিক সামাজিক উন্নতি হবে বলেই লোকে ইংরেজি শিখেছে। জ্ঞানার্জন করে চিত্তপ্রসারের জন্য ইংরেজি শিখেছে একথা বললেও আমি বিশ্বাস করব না। এখন বলুন কটা লোক অবসর সময় ইংরেজি বই পড়ে, ইংরেজি বই কেনে? এ তো সাধারণ জনের কথা, কিন্তু প্রত্যয় যাবেন না, আমার পরিচিত একটি ছোকরা ইংরেজির লেকচারার সর্বক্ষণ বাঙলা বাঙলা করছে, রবীন্দ্রসাহিত্যে তার সুন্দর দখল, কৌতূহল প্রশংসনীয়। ওদিকে ইংরেজির বেলা সেখানে পড়াশুনো করে আরও চৌকশ হবার কোনও চাড় নেই। জানে যেটুকু ইংরেজি রপ্ত আছে সেইটে ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে সে একদিন রিডার ও যথারীতি প্রফেসরও হবে।

এই সেমি-কমপালসরি সংস্কৃত, ফারসি, আরবি (বা পালি লাতিন) নিন। সায়েনসে সিট পায়নি বলে, বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, প্রায় অনিচ্ছায় বিএ পাসের সময় সংস্কৃত ছিল। হয়তো-বা অনার্সও ছিল। তাদেরও কজনকে আপনি অবসর সময় সংস্কৃত (বা ফারসি) পড়তে দেখেছেন, তার শেলফে নতুন কেনা সংস্কৃত বই দেখেছেন? ফারসি তো অতি সরল ভাষা– কজন ফারসি অনার্সওলা গ্রাজুয়েট ফারসি আউট-বুক পড়ে?

অবশ্য যারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় দুই বা তিনটি ভাষা শেখেন– বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, তাঁদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। অধ্যাপক সত্যেন বোস স্বেচ্ছায় ফরাসি-জরমন শিখেছেন। এখনও ওই দুই ভাষায় বই পড়েন।

***

অগুনতি দফে প্রশ্ন শুনতে হয়েছে, ইংরেজিতেই চলবে তো? অন্য কোনও ভাষা না জানলেও চলবে–না? কনটিনেনটে তো সবাই ইংরেজি বোঝে না?

হু, বোঝে। খুব বোঝে! তবে শুনুন। গল্পটি অবশ্য প্যারিস সংক্রান্ত নয়– যদিও খুদ প্যারিসেরই কোনও একটা মুদির দোকানে তেল-নুন কেনার চেষ্টা করে দেখুন না ইংরেজির মারফত তবে এটি পৃথিবীর যে কোনও জায়গা সম্বন্ধে প্রযোজ্য, সেটা পৃথিবী প্রদক্ষিণ না করেও বলা যায়।

প্রভাঁসের একটি দোকানের সামনে বেশ মোটা মোটা হরফে লেখা : ENGLISH SPOKEN। এটার উদ্দেশ্য মারকিন টুরিস্টকে আকর্ষণ করা। ইংরেজকে নয়। কারণ ফরাসি জাত বিস্তর মার খেয়ে খেয়ে ভালো করেই জানে, ইংরেজ কিপটেমিতে প্রায় তাকেও হার মানায় এবং জাতটার আগাপাশতলা বেনেদের হাড্ডি দিয়ে তৈরি বলে দোকানের প্রত্যেকটি জিনিসের পাইকিরি ভাও, খুচরো দর, কমিশন, সেল ট্যাক্স দফে দফে জানে। তা সেকথা থাক গে … এস্থলে ঢুকেছে এক মারকিন। খাজা মারকিন ড্রল (আড়) সমেত একাধিকবার মারকিনি জবানে বলে গেল তার প্রয়োজন অথচ কাউন্টারের পিছনে ফরাসি দোকানউলি শুধু মিটমিটিয়ে মৌরি হাসি চিবোয়–মাল কাড়বার কোনও নিশানাই নেই। মারকিন বার বার একই কথা বলতে বলতে হঠাৎ বুঝতে পারল, মাদাম তার কথা এক বর্ণও বুঝতে পারছে না। বিরক্ত হয়ে তখন সে সেই সাইনবোর্ড-টার দিকে আঙুল তুলে বলল, তবে ওটা ওখানে ঝুলিয়েছ কী করতে? ইংরেজি যখন বোঝে না এক বর্ণও? এবারে যেন মাদাম ব্যাপারটা বুঝেছে নিশ্চয়ই এ ফারুস্ আকছারই হয়– একগাল হেসে তার ইংরেজিভাষা ভাণ্ডারের শেষ শব্দটি খরচা করে বলল, উই, উই, ইয়েস ইয়েস, এঙলিশ স্পোকেন! সারতেনলি। আওয়ার কসতোমারস স্পিক–উই নত স্পিক— হ্যাঁ, যা, ইংরেজি বলা হয় বইকি! আমাদের খদ্দেররা বলেন। আমরা বলি না।

এটি মনে রাখবেন। আপনার অন্য কোনও কাজে না লাগলেও এটি দিয়ে ব্যাকরণের প্যাসিভ ভইস এবং তস্য প্রসাদাৎ কী কী সুখ-সুবিধে হয় সেটা বাচ্চাদের শেখাতে পারবেন। মাদাম তো আর নোটিশে বলেনি, উই স্পিক ইংলিশ, বলেছে ইংলিশ স্পোকেন এবং ইহসংসারে কে কোথায় ইংরেজি বলে কি না বলে, সেটা কুইনজ ইংলিশ না সাউথ ক্যারোলাইনার নিগার ইংলিশ সে খতিয়ান দেবার জিম্মেদারি তো বেচারি প্রভাসিনী দোকানউলির নয়!

খোদ প্যারিসের মুদির কথা বলছিলুম। আপনি হয়তো বিরক্ত হয়ে বলবেন, তুমিও য্যামন! আমি কি প্যারিস যাচ্ছি ঘৃতলবণতৈলতণ্ডুলের জন্য! এস্থলে আমাকে একটু কথা কাটতে হল। বলতে কী, আমার মনে হয়, এইসব বস্তু আপনি যদি প্যারিসে কিনে এদেশে চালান দিতে পারেন– অবশ্য অম্মদেশীয় সদাশয় সরকার যদি তার ওপর বেদরদ ট্যাকশো না চাপান তবে আপনার প্যারিস ভ্রমণের খরচটাই উঠে যাবে। আর ইতালির ব্রিদিসি, বারি অঞ্চলে চালের কিলো নিশ্চয়ই আড়াই/ তিন টাকা নয়! সর্বোপরি অলিভ তেল! লাল হয়ে যাবেন, মোয়াই, লাল হয়ে যাবেন। ফ্রান্‌সের মার্সেই অঞ্চলের পাঁচসিকের তেল হেলায়–কালোবাজারে নিদেন পঞ্চবিংশতি তঙ্কা! তা সে যা গে! ইংরেজের সঙ্গে দুশো বছর ঘর করে আমি– সৈয়দের ব্যাটা–আমিও বেনে বনে গিয়েছি– প্যারিস পৌঁছে কোথায় না সন্ধান নেবো উবিগা কোতির ভুরভুরে খুশবাই তা না, ত্যালের কেলো, চেলের ভাও! লাও!

প্যারিসের প্যারিসের কেন– পৃথিবীর পয়লা নম্বরি সর্ব হোটেলের ওয়েটার, রুমবয়, কাউন্টারের কেরানি এরা সবাই অল্প-বিস্তর ইংরেজি বলতে পারে। কিন্তু আপনি সেসব হোটেলে উঠবেন না– গ্যাটে আপনার অত রেস্তো নেই, থাকলে আমার লেখা পড়তেন না। আর যদি বলেন, না, আপনার সে রেস্তো আছে, তা হলে আর ভাবনা কী? আপনি কোন দুঃখে প্যারিস বালিনে কে কতখানি ইংরেজি বোঝে না বোঝে তাই নিয়ে মাথা ঘামাবেন? রেখে দিন হাজার দুই-আড়াইয়ের মাইনের একজন প্রাইভেট সেক্রেটারি– সে নিদেন আধা ডজন কটিনেন্টাল ভাষা ঝাড়তে পারে, আপনাকে আর দেখতে হবে না। স্বপ্নেই যখন খাচ্ছেন তখন পোলাই খান, ভাত খাচ্ছেন কেন, আর সে পোলাওয়ে ঘি ঢালতেই-বা কসি কচ্ছেন কেন? বরদার মহারাজাকে দিনের পর দিন অনায়াসে মিশরে চলাফেরা করতে দেখেছি। কবীন্দ্র রবীন্দ্র যখন প্রাগ বা বুডপেশটে বক্তৃতা দিতেন তখন সেখানকার য়ুনিভারসিটির সবচেয়ে সেরা ইংরেজিবাগীশ অধ্যাপক হতেন তার দোভাষী। এদের কথা আলাদা। আপনি যদি সে পর্যায়ে হন তবে আমার লেখা পড়ছেন কোন বদকিসমতের গেরোতে?

পক্ষান্তরে দেখুন, জলপাইগুড়ি থেকে বেরিয়ে অন্ধ খঞ্জ শ্রীধামে পৌঁছয় না, কেদার-বদরির পুণ্যসঞ্চয় করে না! ভারতীয় কত কালা বোবা কপর্দকহীন প্রতি বছর মক্কায় গিয়ে হজ করে! রাখে আল্লা, মারে কে!

চলে যাবে, প্যারিসে ইংরেজি জানা না থাকলেও চলে যাবে, জানা থাকলে অল্পস্বল্প সুবিধে হতে পারে। লন্ডনে যদি শতেকে একজন লোক ফরাসি বলে, তবে দ্বিতীয় যুদ্ধের পূর্বে প্যারিসের রাস্তায় হাজারে একজন ইংরেজি বলত কি না সন্দেহ। তাই আঁদ্রে মোরোয়া যিনি এই হালে গত হলেন, বা ল্যগুই কাজাৰ্মা ফ্রান্স দেশের আজব চিড়িয়া। প্যারিসবাসী তাজ্জব মেনে শুধোবে ওরা ইংরেজি শিখেছিল! কী করতে মরতে?

জরমনিতে অবশ্য আপনার ইংরেজিজ্ঞান একটু বেশি কাজে লাগবে। যদ্যপি ওই দেশ ইংরেজের প্রতিবেশী নয়। তার অনেকগুলো কারণ আছে। তার একটা কারণ আমাদের মূল বক্তব্যের সঙ্গে বিজড়িত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জরমনির আপন ভূমির উপর কোনও সগ্রাম হয়নি, অর্থাৎ কোনও বিদেশি সৈন্য সেখানে পদার্পণ করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারকিনিংরেজ লড়াই করতে করতে, কদম কদম এগোতে এগোতে জরমনির এক বৃহদংশ দখল করে সেখানে থানা গাড়ে এবং কয়েক বছর সেখানে বাস করে। গোড়ার দিকের মারকিনিংরেজ চালিত মিলিটারি শাসনকর্তাদের ভাষা তখন যে অতি সামান্যও বলতে পেরেছে সে-ই রেশন সহজে পেয়েছে, ফালতো রুটিটা-আণ্ডাটাও তার কপালে নেচেছে। আমার এক জরমন সতীর্থ ধরা পড়ে মারকিন দল জরমন সীমান্তে প্রবেশ করা মাত্রই। ইংরেজি বলাতে তার ভালো অভ্যাস ছিল বলে (তার জন্য আমি স্বয়ং কিছুটা দায়ী। আমাদের পরিচয়ের গোড়ার দিকে আমি জরমন জানতুম না বলে সে তার টুটিফুটি ইংরেজি চালিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে আমার জরমন খানিকটে সড়গড় হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে পুরনো অভ্যাস ছাড়েনি) মারকিনরা তাকে পত্রপাঠ দোভাষীর শব্দার্থে নোকরি দিয়ে দেয়। ফলে তার বাচ্চাদের দুধের অভাব হয়নি, বৃদ্ধা রুগ্‌ণ শাশুড়ির ওষুধপত্রের অভাব হয়নি। আর সে ভসভস করে অষ্টপ্রহর হাভানা সিগার ফুকেছে যা ইতোপূর্বে তার জীবনে কখনও জোটেনি। মার্কিন সৈন্য চলে যাওয়ার পর মনোদুঃখে সে ধূমপান সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছে। আমি তার জন্য গেল বারে বিড়ি নিয়ে গিয়েছিলুম। তার পুনরপি সেই মনস্তাপ। তবে আমি মাঝে-মধ্যে এখনও তাকে দু-পাঁচ বান্ডিল পাঠাই। ভয়ে বেশি পাঠাতে পারিনে– জরমন কসটস আমাদের চেয়ে কম যান না।

১৯৪৪ থেকে জরমনির যা দুর্দিন গেছে বিশ্বের অর্বাচীন ইতিহাসে সেটা উল্লেখযোগ্য। মারকিনিংরেজ সেখানে থানা গাড়ার পর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কাকে না রেশনের সন্ধানে ছুটতে হয়েছে ওদের পিছনে? সবাই পড়িমরি হয়ে তখন শিখেছে ইংরেজি। কবে কোন ঠাকুদ্দা একবার বেখেয়ালে একখানা গাইডবুক টু ইংলিশ কিনেছিলেন, এ আমলে ঠাকুন্দা তারই গা থেকে সন্তর্পণে ধূলি ঝেড়ে এক-পরকলাঙলা চশমা নাকে চড়িয়ে লেগে গেলেন ইংরেজি অধ্যয়নে– ছাপাখানা আবার কবে বসবে, চশমার দোকান কবে খুলবে কে জানে?

এর পর আর কী আশ্চর্য যে প্রথম স্কুল ফের খোলামাত্রই আণ্ডাবাচ্চারা ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করল, তার তুলনায় আমাদের ঊনবিংশ সালের ইংরেজি শেখার প্রচেষ্টা ধূলির ধূলি।

একমাত্র পরাধীনতাই মানুষকে মাতৃভাষা ভিন্ন দ্বিতীয় ভাষা শেখায়। চোখের জলে নাকের জলে শেখায়।

এই পরাধীনতার পিঠ পিঠ আসে আর্থিক পরাধীনতা। আজ জগৎজোড়া মারকিনি ডলারের গরমাই। ইংরেজের তম্বি কমেছে, কিন্তু তিনিও আছেন। উভয়ের ভাষা মোটামুটি একই–ইংরেজি।

তাই আমরা আজ কল্পনাও করতে পারিনে ইংরেজি না শিখে গুষ্টিসুদ্ধ দোভাষী না হয়ে আমাদের চলবে কী করে?

একথা খুবই সত্য, ইংরেজি নিরঙ্কুশ বর্জন করা অনুচিত।

কিন্তু দুনিয়াসুদ্ধ লোককে ঘাড়ে ধরে দোভাষী বানিয়ে সে সমস্যার সমাধান নয়।

———–

১. গোপখেজুরের গল্পটি প্রাচীন ক্ল্যাসিক পর্যায়ের : খেজুরগাছতলায় একটা লোক শুয়েছিল। একটা খেজুর কপালে পড়ে গড়াতে গড়াতে তার গোঁপে এসে ঠেকল। কিন্তু লোকটা এমনই হাড়-আলসে যে জিভ দিয়ে সেটা টেনে নিয়ে মুখে না পুরে অপেক্ষা করতে লাগল। দিনশেষে পদধ্বনি শুনে বিড়বিড় করে বলল, দাদা, এদিকে একটু ঘুরে যাবার সময় যদি দয়া করে তোমার পা দিয়ে ওই খেজুরটা আমার মুখের ভিতর ঠেলে দাও! থ্যাঙ্কয়ু!

২. আইন ব্যবসায়ীদের মতো রক্ষণশীল প্রাণী ত্রিলোকে দুর্লভ। ইংরেজি অবহেলিত বা বিতাড়িত হলে এই বেহেশতি ভারতভূমি যে কোন দোজখে পরিণত হবে তারই কল্পনায় অধুনা শ্ৰীযুত ছাগলা [ওটা ছাগলাই, স্যর, চাগলা নয়। পরপর পুত্রসন্তান মারা গেলে যেরকম আমরা এককড়ি ফকির নফর নাম রাখি গুজরাতিরা তেমনি ছাগলা (ছাগল), মাকড় (পিঁপড়ে, ক্রিকেটার), ঝিড়া (জিন্না, ছোট) রাখে] করুণ আর্তনাদ করে বলেছেন : এই একশো বছর ধরে আইন ব্যবসা যে (পর্বতপ্রমাণ) আইনের কেতাবপত্র ইংরেজিতে রচনা করেছেন সেটা লোপ পাবে, তার ব্যবহার থেকে ভারতবাসী বঞ্চিত হবে। এর ওপর দীর্ঘ মন্তব্য না করে শুধু বলব, এদেশ থেকে ইংরেজিকে নিরঙ্কুশ বিতাড়িত করার জন্য এই একটি মোক্ষম যুক্তি পাওয়া গেল বটে! এবং ছাগলা সম্প্রদায়কে সবিনয় প্রশ্ন : তবে কি প্রলয়াবধি এদেশে আইনের বাহন ইংরেজিই থাকবে? কারণ যত দিন যাবে, পর্বত যে পর্বততর হতে থাকবে! মায়া যে মায়াতর মায়াতম হতে থাকবে! অবশ্য আমি ইংরেজি বিতাড়নের জন্য হন্যে হয়ে উঠিনি, একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী সম্প্রদায়ের মতো।

৩. এস্থলে বক্ষ্যমাণ রচনাটি যদি আমাকে কপালের গর্দিশবশত ইংরেজিতে লিখতে হত তবে পরানভয়ে হরিণের ছোটাটা হুবহু ফরাসি ইডিয়মে লিখতুম–Ventre a terre– অর্থাৎ with belly to ground; এমনি সামনের দিকে ঝুঁকে প্রাণপণ ছুটছে যে মনে হয় মানুষটার পেটটা বুঝি মাটি ছুঁয়ে ফেলেছে! (ফরাসি শব্দতাত্ত্বিকদের জন্য ভাত্র ভেনট্রিলোকুইস, পেট থেকে যে কথা বের করে; তের টেনেট্রিয়াল = পার্থিব তুলনীয়)

আঁদ্রে জিদ

দুনিয়ার লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে প্যারিস যায়, এবং প্যারিসের ধনীদরিদ্র সকলেরই কামনা, কী করে গ্রামাঞ্চলে একখানা কুটিরাবাস নির্মাণ করা যায়। প্যারিসের ফ্ল্যাটখানাও থাকবে এবং সেখানে মাঝে-মধ্যে আসবেন থিয়েটার অপেরা দেখবার জন্য, বন্ধুজনের (বান্ধবী তো নিশ্চয়ই) সঙ্গে মিলিত হবার জন্য।

খাঁটি স্ট্যাটিস্টিক্স দেওয়া কঠিন– বক্তিগতভাবে বলতে পারি, যে ক-জন মহৎ ফরাসি লেখক আমার প্রিয় তাদের প্রায় সকলেই জীবনের অধিকাংশ ভাগ কাটিয়েছেন মফস্বলে। যারা নিতান্তই কোনও না কোনও কারণে পেরে ওঠেননি– যেমন আলফাস দোদে– তাঁরা সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন গ্রামাঞ্চলে, কোনও সখার বাড়িতে।

প্রভাঁসের যে জায়গাটিতে দোদে বারবার গেছেন সেখানে দিন পাঁচেক কাটানোর পর এক অপরা বসে আছি, যে ইটিতে উঠেছিলুম (এসব ই এমনই গাইয়া যে এগুলো না হোটেল, না ডাক-বাঙলো, না সরাই, না চটি– সবকটিরই অল্প-বিস্তর সুবিধে-অসুবিধে দুই-ই এগুলোতে পাবেন। তারই জানালার কাছে বাইরের দিকে তাকিয়ে। ঢেউখেলানো উঁচু-নিচুর টক্করে ভর্তি জনপদ ধরিত্রীর দূরত্ব যেন আরও বাড়িয়ে দেয় আপন দৃষ্টি যে কত দূরান্তে যেতে পারে সে সম্বন্ধে মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং আশ্চর্য, সমুদ্র যদ্যপি দিগন্ত বিস্তৃত তার পারে বসে মানুষের এ অভিজ্ঞতা হয় না।

ইনকিপার, পত্র (Patron), মালিক– যে নামে খুশি ডাকুন–কাছে এসে দাঁড়াতেই আমি প্রসন্ন বদনে বললুম এ বাঁ, আল– এ শব্দগুলোর মানে অভিধানে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই, যেমন এই যে, হেঁ হেঁ বেশ বেশ– শব্দগুলো নিশ্চয়ই কোনও না কোনও মানে ধরে কিন্তু আসলে এগুলো ফারসি ভাষাতে যাকে বলে তাকিয়া-ই-কালাস অর্থাৎ কথার তাকিয়া অর্থাৎ যার উপর ভর করে কথাবার্তা আরাম পায়– জমে ওঠে।

তার পর বললুম, বসবে না? একটা কিছু খাও।

বলল, এ বাঁ, আমি আপনাকে দেরাজ (ডিসএরেঞ্জ শব্দার্থে অর্থাৎ ডিসটার্ব বা বদার) করছি না তো?

আমি প্রসন্নতর বদনে বললন, পা দ্য তু– বিলকুল না!

বলল, মসিয়ো, আমি আদৌ নোজি না। বিশেষত যখন দেখতে পাচ্ছি, আপনি যখন আপন মনে, মনের সুখে আছেন। ও লা লা–কাল সন্ধ্যায় আমাদের আড্ডাটি যা জমেছিল। আর আপনি যা হাসাতে পারেন

একদম গুল। হাসাতে পারার মতো তেমন কোনও স্টা আমার নেই। আসলে ব্যাপারখানা হয়েছিল এই যে, আমাদের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত কতকগুলি গল্প, গোপালভাড় ইত্যাদি আমি তাদের শুনিয়েছিলুম আপন ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে। তাদের কাছে লেগেছে এপাতা (ভয়ঙ্কর মজাদার) এবং অরিজিনাল। অবশ্য এসব গল্প যখন প্যারিস-লন্ডনেই পৌঁছয়নি তখন প্রভাঁসের পা-বর্জিত অজপাড়াগায়ে যে অরিজিনাল মনে হবে তাতে আর বিচিত্র কী? গোপালের দু-একটি রিসৃকে (risky আদিরসাত্মক) গল্প বলতেও ছাড়িনি, এবং তখন গাঁয়ের পাদ্রি সাহেবই এবং তিনিই ছিলেন আসরের চক্রবর্তী সবচেয়ে বেশি চোখের ঠার মেরে আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন।

বললেন, মসিয়ো, আমাদের গ্রামে কজন বিদেশি এসেছে সে আমি এক আঙুলে বলতে পারি- তা-ও তারা পাশের দেশ স্পেন বা ইতালির বাউণ্ডুলে– আর আপনি তো এসেছেন কোথায় সেই সুদূর লাদ (L Inde) থেকে। এখানে আপনি কী মধু পেলেন, বলুন তো!

আমি বললুম, তুমি তো বলেছিলে, তুমি কখনও প্যারিস ত দেখোনি। তোমাকে বোঝানো হবে শক্ত। তবে সংক্ষেপে বলতে পারি, এটা অনেকটা রুচির কথা। আপন দেশেও আমি গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে, বাস করতে ভালোবাসি। তা ছাড়া এটা কবি মিসালের দেশ।… আচ্ছা, অন্য লোক আসে না এখানে মিসত্রালের জন্মভূমি দেখতে?

বেশ গর্বভরে বলল, নিশ্চয়ই, মসিয়য়া, তবে তারা সবাই ফরাসি–

তার পর কী যেন মনে পড়ে যাওয়াতে হঠাৎ থেমে গিয়ে এবারে সে উৎসাহভরে বলল, ও লা লা। সে এক কাণ্ড!

দুই লেখকের লড়াই। সে হল গিয়ে ১৯৪৪-এর শেষের দিকের কথা। মার্কিনিংরেজ নরমাদিতে নেমে প্রায় সমস্ত ফ্রান্স দখল করে ফেলেছে, ওই সময় কী কারণে, কী করে যেন দুই লেখক–হ্যাঁ খাঁটি ফরাসি–এসে উঠেছেন আমার এখানে। আর এই ঘরেই, আমরা কাল যেখানে দুপুররাত অবধি কত আনন্দে হইহুল্লোড় করলুম, এসে বসেছেন, সেই দুই লেখক; কিন্তু তাঁরা তাঁদের চতুর্দিকে যে আবহাওয়া নির্মাণ করলেন সেটি ঠিক তার উল্টো। অ্যাব্বড়া বড়া গেরেমভারি হাঁড়িপানা গম্ভীর একজোড়া মুখ দেখে আমার গাইয়া খদ্দেররা তো আশ্রয় নিল ঘরের অন্য কোণে।

ওঁরা গুরুগম্ভীর আলোচনা করে যাচ্ছেন নিজেদের ভিতর– আমরা ওদিকে কান দিইনি। কিছুক্ষণ পরে তাদের গলা চড়তে লাগল, তার পর আরম্ভ হল রীতিমতো ঝগড়া। তার পর আরম্ভ হল আমাদের ওই পাহাড়ি বকরিতে করিতে যেরকম লড়াই হয়।(১) তার পর বলদে বলদে। অবশ্য আমাদের বলদ প্রতিবেশী স্প্যানিশদের বলদের তুলনায় তেমন কিছু না।(২)

কী নিয়ে ঝগড়া, মসিয়য়া? জান কী নিয়ে–ঘুড়ি নিয়ে? তা হলেও তো বাঁচতুম। সে তো হর-হামেশাই হচ্ছে। এ ঝগড়া সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস নিয়ে। বলি :

ওই সময় অর্থাৎ তখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি, অবশ্য হিটলারের পরাজয় সম্বন্ধে তখন সবাই নিঃসন্দেহ– এক ফরাসি লেখক লিখেছেন, এই যে আমরা, ফরাসিরা পাত্রি(স্বদেশ), পাত্রি, লিবেরতে লিবেরতে বলে চেঁচাই তার মূল্য কতটুকু? তিনি নাকি, তার পর লিখেছেন, ফরাসি চাষা যদি তার গম দু পয়সা বেশি দামে বিক্রি করতে পারে তবে সে থোড়াই পরোয়া করে দেকার্ত আপন জাতভাই ফরাসি না দুশমন জরমন।

এই নিয়ে লেগেছে তুলকালাম ঝগড়া! এক লেখক বলছেন, যারা ফরাসি জাতের দেশপ্রেম নিয়ে এরকম বিদ্রূপ করে তাদের ফাঁসি হওয়া উচিত। অন্য লেখক বলছেন, কথাটা টক হলেও হক। এবং যে ফরাসি লেখক একথা বলেছেন তিনি তো জর্মন বা তাদের দোস্ত পেতাঁর সহযোগিতা করতে রাজি হননি। তাঁর সততা সম্বন্ধে যারা সন্দেহ করে তাদের হওয়া উচিত ফাঁসি। তখন প্রথম জন বললেন, আজ যদি আমাদের ক্লেমাসে বেঁচে থাকতেন তবে ওই যে ব্যাটা ফরাসির দেশপ্রেম নিয়ে মশকরা করেছে তাকে তার নোংরা বন্দুকটা দিয়ে পরিষ্কারটা দিয়ে নয়, যেটা দিয়ে তিনি বুনো শূয়ার মারেন– গুলি করে মারতেন।

এতক্ষণ মালিক ভায়া যে গম্ভীর সুরে কথা বলছিলেন, তার থেকে আমার মনে হচ্ছিল যেন স্বয়ং ক্রেমাসেই লিগ অব নেশনসে প্রতিবেদন পাঠ করছেন।

এবারে হঠাৎ হেসে উঠে বলল, তার পর যা হল, মসিয়য়া, সে সত্যি যাকে বলে কু দ্য তেয়াৎর(৩)-নাটকীয় ব্যাপার–ইতোমধ্যেই যে আমাদের পাদ্রি সাহেব কখন এখানে এসে এক কোণে দাঁড়িয়ে এঁদের তর্কাতর্কি শুনছিলেন সেটা আমি লক্ষই করিনি।

তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন, মেসিয়ো, আমি আপনাদের দোজ করতে চাই নে; সামান্য একটি বিষয়ের উল্লেখ করে আপন পথে চলে যাব। আপনারা শহুরে সজ্জন শুনেছি, আপনারা বঁ দিয়োর (ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। আমার শুধু বক্তব্য, আপনাদের একজন বলছিলেন, আজ ক্লেমাসে বেঁচে থাকলে তিনি নাকি কাকে যেন গুলি করে মারতেন। এ-ভভাওয়ালা, মেসিয়ো– আজই সন্ধ্যায় এই কাগজখানা আমার কাছে এসেছে আমাদের কলোনি ট্যুনিস থেকে। তাতে প্রকাশিত হয়েছে একখানি চিঠি। ইটি লিখেছেন মসিয়ো ক্রেমাসের ভ্রাতুস্পুত্রী তার বয়স, এখন চুরাশি। তিনি লিখেছেন–শের মসিয়ো জিদ, আমি আমার জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে বহু বছর বাস করেছি। আমি বলতে পারি, আজ তিনি বেঁচে থাকলে আপনার পক্ষ নিতেন। তাঁকে কতবার বলতে শুনেছি, জমি! জমি!! শুধু জমি!! আর টাকা। ব্যস, মাত্র এ দুটো বই আমাদের চাষিরা চেনে!

পাদ্রি সায়েব বললেন, তা সে যাক! কিন্তু এটা কী বঁ দিয়োর মিরাকল নয় যে, আজই আমি এ কাগজখানা পাব, আজই আপনারা এ আলোচনা তুলবেন, আজই আমি সেই পত্রিকাটি পকেটে করে আজই এখানে আসব এবং আপনাদের দ্বন্দ্বের সমাধান করে দেব!…ও রভোয়া মসিয়ো! কাল রোববার গির্জেয় দেখা হবে।

কাহিনীটি শেষ করে মালিক মিটমিটিয়ে হেসে বলল, এই যে বিরাট ফ্রান্সভূমি– এদেশের কারও বিশ্বাস, প্রভাঁসের লোক বড় সরল, বিশ্বাসী, ধর্মপ্রাণ আর কারও-বা বিশ্বাস তারা কুসংস্কার কুণ্ডে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।… আপনার কী মনে হয়? আপনি তো এসেছেন ধর্মের দেশ LInde থেকে।

আমি তার মিটমিটে হাসি থেকে তারই বিশ্বাস কোন দিকে বুঝতে পারলুম না।(৪)

———–

১. প্রভাঁসের বকরি সম্বন্ধে লিখেছেন দোদে– Le Chevre de M. Seguin.

২. এ-ও পাঠক পাবেন পুস্তকে।

৩. Coup detat, cout de palais তুলনীয়। আজকাল পৃথিবীর সর্বত্র নানারকম কু (অনেক সময়ই কিন্তু সেগুলো শিব্রামীয় সু!) হচ্ছে বলে এটা উল্লেখ করলুম।

৪. আঁদ্রে জি-এর ডাইরি, Journal 1939-42, 1942-42, Appendice, 200ff.

আড্ডা

কী বললেন স্যার? বাড়ি বিক্রি করতে এসেছেন? আমি কিনব? আমি! বাড়ি নিয়ে করবটা কী আমি? জন্ম নিলুম হাসপাতালে, পড়াশুনো করলুম হস্টেলে, প্রেম করেছি ট্যাক্সিতে, বিয়ে হল রেজিস্টারের আপিসে। খাই ক্যানটিনে–কিংবা যারে কয় ভোজনং যত্রতত্র–সকালটা কাটে কর্তাদের তেলাতে, তেনাদের তরে বাজার করে দিতে…হাটে-র্যাশনে, দুপুরটা আপিসে, মাঝে মিশেলে সিনেমা হলে সন্ধেটা। পটল তুললে শুইয়ে দেবে নিমতলায়। বাড়ি নিয়ে কি আমি গুলে খাব? তার চেয়ে বলি, আসলে আমার দরকার একটি আড্ডার। একটি অত্যুকৃষ্ণ আড্ডার। তার খবর দিতে পারেন? তবে বুঝব, আপনি একটি তালেবর ব্যক্তি!

কথাটা ন সিকে খাঁটি। অত্যুকৃষ্ণ কৃষ্ণ যদি কিষ্ট বা কেষ্ট হয় তবে উৎকৃষ্ণ-ই-বা হবে না কেন?) আড়া প্রতিষ্ঠানটি হালফিল পুরো-হাতা ব্লাউজের মতো ডাইইং ইনডাস্টরি–মৃতপ্রায়।

এহেন অবস্থায় অকস্মাৎ বিনা মেঘে পুষ্পঘাত! দিল্লি থেকে খবর এসেছে সদ্যভূমিষ্ঠ শিক্ষামন্ত্রী প্রতিজ্ঞা করেছেন, বাঙালিকে তিনি আড্ডাবাজ করে ছাড়বেন!

দিল্লি থেকে আসা খবরের সঙ্গে আমি প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ি না– বয়স হয়েছে। খবরটা ফলাও করে প্রকাশিত হবে, সঙ্গে সঙ্গে দেমাতি (dement) বেরুবে, ফের তস্য দেমাতি বেরুবে দলিলপত্রসহ, চোপরা-ভাটিয়া আফটার এডিট লিখবেন, পারলিমেনটে গোটা তিনেক মন্ত্রী নাকুনি-চুবুনি খাবেন, ওই নিয়ে খানদানি খানদানি আয় (আমাদের যৌবনে) তর্কাতর্কির ফলে গোটা তিনেক পেয়ারে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হবে– তবে আমি ব্যাপারটার মোটামুটি আবছা-আবছা ধুয়াশাপারা একটা উমান্ (অনুমান নয়, তার আউটলাইন বড় ধারালো) করে নিই যে, ব্যাপারটা কী হয়ে থাকতে পারে। গোলনদাজদের কায়দা-করিনা নাকি এই দস্তুরেই হয়। প্রথম বোমা তাগ করবে লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরে, পরেরটা কাছে, তার পর দুটোতে যোগ দিয়ে হাফাহাফি করে মোক্ষম মধ্যিখানে।

কিন্তু এ সংবাদখণ্ডটি নিয়ে কিঞ্চিনমাত্র দেমতি ডুয়েল হয়নি। দিল্লির লালাজি, মিয়াসাহেবরা খবরটা পরিবেশন করা সত্ত্বেও ব্যাপারটির গুরুত্ব এহমিয়ৎ সম্বন্ধে বিলকুল বে-খবর। আড্ডা? সো ক্যা বলা? মজলিস, মহফিল, মুশারা, জলসা, বয়েৎ-বাজি– আলবৎ লেকিন আ? সো ক্যা আফৎ, গজব? ওদের আড্ডা ভিন্ন বাথানের গরু– ওদের ভাষায় ভিন্ন ঝোঁপের চিড়িয়া– যেমন ওদের গোলাব জামুন আর আমাদের গোলাপ জাম।

তা সে যাই হোক যাই থাক, খবরটা যদি গুজব বা আফওয়া না হয় (হলে আগের থেকেই কলমে খৎ দিচ্ছি!) তবে বড় দুঃখের সঙ্গে শ্রীযুক্ত ত্রিগুণা স্যানকে তাঁরই দ্যাশ করিমগঞ্জের একটি পদাবলি ঘেঁষা লোকসঙ্গীত স্মরণ করিয়ে দেব :

দেখা হইল না রে, শ্যাম
আমার এই নতুন বয়সের কালে—

রসরাজের স্মরণে শ্রীমতী বলছেন, ঠাকুর! তুমি নির্দয় নও; আমাদের সাক্ষাৎ একদিন না একদিন হবেই হবে। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার এই নতুন (নতুন) বয়সে যে দেখা হল না, সে-ই আমার মর্মবেদনা।

ডাক্তারেতে বলে যখন মরেছে এই লোক
তাহার তরে বৃথাই করা শোক
কিন্তু যখন বলে জীবত
তখন শোনায় তিতো।

খানদানি আড্ডা এখন জীবন্ত। তার নতুন বয়স বহু কাল হল গেছে। এখন আর তার কোন্ গুণ আছে, তিন-গুণী?

আড্ডা সম্বন্ধে আমার যা বক্তব্য সে আমি বহুবার বহু স্থলে নিবেদন করেছি। বহু সিন্ধু পেরিয়ে বহু দেশ ঘুরেছি আড্ডার সন্ধানে পাপমুখে কী করে বলি, গিয়েছিলুম লবুজো কপচাতে; আখেরে সর্বত্র সর্ব পরীক্ষাতে নাগাড়ে ফেল মেরে মেরে বিলক্ষণ বুঝে গেলুম, আমার যদি জ্ঞানগম্যি কখনও হয়–তা সে ঝুটাই হোক আর সাচ্চাই হোক সেটা হবে আড্ডাতে শিক্ষামন্ত্রী যে তত্ত্বটি কনফারম করলেন এই অ্যাদ্দিন পরে … ফের বহু সিন্ধু পেরিয়ে দেশে এসে দেখি, সেই আড্ডার বিন্দুটি খরতাপে বাম্পপ্রায়।

খানদানি আড্ডা যে জীবন্ত সে তথ্য তর্কাতীত। এই যে কলকাতা শহরে ঝাঁকে ঝাঁকে পস্তলা-দস্তলা হামেহাল উঠছে তো উঠছেই এর কটাতে রক থাকে, বৈঠকখানা আছে? রক উঠেছেন ডাক-এ, আর বৈঠকখানার বদলে ড্রয়িংরুম। এদিকে ক্ষুদে একটি পেগটেবিলের উপর অতি পাতলা ডিমের খোলস-পরা পরসেলেনের প্লেটে স্ন্যাক, অন্যদিকে ফঙ্গবেনে টিপয়ের উপর বেলজিয়াম কাঁচের ঢাউস ফ্লাওয়ার ভাজ। সোফাতে আরামসে হেলানও দিতে পারবেন না, পাছে মাথার তেল লেগে সোফাভরণ চিটচিটে হয়ে যায়। বত্রিশটি দাঁতের মধ্যিখানে বেচারি জিভকে যেরকম অতিশয় সন্তর্পণে হাফিজ, খবরদার হয়ে নড়াচড়া করতে হয়, আপনাকেও করতে হবে তাই। তবে সান্ত্বনা, ভুগন্তি বাড়ির মালিকেরই সবচেয়ে বেশি। পাছে মহামূল্যবান কোনও জোড়াবাধা বস্তুর একটি ভেঙে যায়! বিলিতি মাল– এখন আর বাজারে পাওয়া যায় না।

গালগল্প যে একেবারেই হয় না, সেকথা বলা যায় না। তাকে সোয়ারে, মাতিনে (ম্যাটিনি) কনভেরজাৎসিয়োনে(১) যা খুশি নাম দিতে পারেন, এমনকি আজকের দিনের ভাষায় সেমিনার বললেও দোষ নেই কিন্তু একে আড্ডা নাম দিলে আমাদের নকিষ্যি কুলীন আড্ডার মেম্বরগণ একবাক্যে বলবেন, কঁহা আসমানকা তারা, আর কঁহা পিঠকা (আসলে ভদ্রসমাজে মূল শব্দটা অচল) পাঁচড়া!

গঙ্গাস্নান কমে যাচ্ছে কেন? পুণ্যবানরা নতুন নতুন ঘাট বানাচ্ছেন না তাই।

আড্ডা কমে গেল কেন? মডার্নরা রক বানান না বলে। পাল্লায় পড়ে কেউ কেউ-বা প্রাচীন দিনের অগোছালো বৈঠকখানাকে ড্রয়িংরুমের সাত চাপের কারবন কপি বানাচ্ছেন—- দিল্লিতে বলে বুড়ো ঘোড়ার গোলাপি ন্যাজ কিংবা বুড়ি দাদিমার হাতে বাহারে মেহদি।

কিন্তু এহ নিরতিশয় বাহ্য।

গুহ্য সমস্যা অপিচ সরলতম প্রশ্ন : এই যে আমাদের মন্ত্রীবর তরুণদের আড্ডাবাজ করে তুলবেন বলে যমুনা পুলিনে দাশরথির শপথ গ্রহণ করলেন সেটা কি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে কিংবা প্রকৃত আড্ডাবাজের ন্যায় ধ্যত্তর ত্তোর অগ্রপশ্চাৎ হুঙ্কার ছেড়ে?

ঝাড়া আঠারোটি দিন আমাদের আড্ডাটি এই নিয়ে কুস্তি করেছে। নানা প্রশ্ন, বহুবিধ সপলিমেনটরি, ততোধিক এফিডেভিট– সর্বশেষে এন্তের বুলু পিরিন্ট (আমাদের মন্ত্রীমশাই এ বস্তুটি বিলক্ষণ চেনেন ভাই ভাই তৈরি হল, অবশ্য আড্ডাধারী মাত্রই জানেন, আমাদের হাইজাম্প লঙ-জাম্প মুখে মুখে।

প্রতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধেই পাল্টা প্রস্তাব উঠেছিল; তবে একটি বিষয়ে সকলেই একমত হয়েছেন।

যদ্যপি মন্ত্রী মহাশয় এলেমদার ব্যক্তি তথাপি এ-হেন কঠিন গুরুভার তিনি যেন ভিক্ষুণীর অধম সুপ্রিয়ার মতো এজমালি বা বারো-ইয়ারি পদ্ধতিতে উত্তোলন করেন। বিগলিতার্থ; — তিনি যেন।

১। একটি কমিশন নিয়োগ করেন।

এস্থলে আমার অতিশয় গোপনীয় একটি অভিজ্ঞতা থেকে জানাই, হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত জজকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অন্তরঙ্গরূপে চিনি, যিনি একবার একটি আড্ডাবাজ ছোকরাকে অধ্যাপক পদের জন্য সুপারিশ করে জনৈক ভাইস-চ্যানসেলারের কাছে হুট হয়েছিলেন। ভি সি যখন জিভ কেটে বললেন, ছোকরা পাড় আড্ডাবাজ তখন তিনি জরডন জলে ধোয়া তুলসিপাতা-পানা মুখ করে নাইফ উত্তর দিয়েছিলেন ওই তো তার আসল এলেম।

একে কমিশনের চ্যারম্যান করতে পারলে সর্বরক্ষা– সকলং হস্ততলং!

২। ইতোমধ্যে দেখা গেল আরেকটি বিষয়ে আমাদের দশদিশি শিরদ্বন্দ্বী প্রকৃত আদ্যপ্রাণ ব্যক্তিকে কাটা ফালাইলেও সে কোনও কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে যেতে পারবে না। হরহামেশা হাজামৎ করছি আমরা উইলসন জনসনের, আর আমরা যাব কমিশনের সম্মুখে!

আড্ডাযজ্ঞের আমরা অভিশপ্ত (পুত, যাই বলুন) ভস্ম। আমরা যেতে পারব না, নীলকণ্ঠের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জটার ভিতর গঙ্গার সন্ধানে।

তিনিই আসতেন। আমি যার প্রতি দু লহমা পূর্বে ইঙ্গিত করেছি তিনিই আসবেন, স্বেচ্ছায় সানন্দে। শ্যামবাজার থেকে শুরু করে আড্ডা মেরে মেরে তিনি হেসেখেলে পৌঁছে যাবেন টালিগঞ্জে। রিপোর্ট যা লিখবেন সে এক অভিনব মেঘদূত! শ্যামবাজার-রামগিরি থেকে টালি-অলকা!

কিন্তু আমরা কমিশনকে বিভ্রান্ত বা প্রেজুডিস করতে চাই নে বলে অত্যধিক বাগবিস্তার থেকে নিরস্ত হচ্ছি। তবে একটি বিষয়ে তাবৎ গৌড়ভুমি যখন বিলক্ষণ সচেতন, সেটি যেন কমিশন বিস্মৃত না হন।

আড়া জীবন্মৃত কি না, যদি হয় তবে তার অমরুতাঞ্জন সঞ্জীবনী সুধা কী, সে নিয়ে তো কমিশন চিন্তা করবেনই যথেষ্ট সুযোগ পাবেন, আজকাল প্রায়ই বিজলি ভ্রষ্টা রমণীর মতো সাঁঝের বেঁকে চোখ মারতে মারতে আঁধারে গায়েব হয়ে যায়, তখন আত্ম-অন্বেষণী, বিশ্বভাবনা ভিন্ন গতি কী?–কিন্তু আমরা আগেভাগেই বলে রাখছি;–

বঙ্গসন্তান চাহে না অর্থ, চাহে না মান, চাহে না জ্ঞান– সে চায় ডিগ্রি!

আড্ডাবাজরূপে সে যদি স্বীকৃতি পায় এবং উমেদার মাত্রেই জানেন–খানদানি আড্ডাতে সিট পাওয়াটাই কী কঠিন কর্ম– তবে সে ডিগ্রি না নিয়ে ছাড়বে না।

এবং ওইসব বস্তাপচা পি-এইচডি, ডিফিল, হনোরিস কাউজা, সুমমা কুম লাউডে, দকত্যোর অ্যাস লেত্র, ফার্জিল-অল-মুহদিসিন, শমশির-ই-জমশিদই আলিমান, সাংখ্যবেদান্ততর্কচুক্ষু– এসব উপাধি-খেতাব-ডিগ্রি বিলকুল না-পাস।

তা হলে সে ডিগ্রির নাম কী হবে?

এ বাবদে ইহসংসারে সর্বাভিজ্ঞ মহাজনকে আমরা চিঠি লিখেছি।

ইনি স্ট্রাসবুরগ শহরের সরকারি উপাধিদাতা।

শহরের সদর দেউড়ি দিয়ে ঢুকলেন এক অশ্বারোহী–ইয়া মোছ, ইয়া তলোয়ার।

সামনেই সদররাস্তা-বুলভার জোড়া একটা টেবিলের পিছনে দাঁড়িয়ে ফ্রক কোট, টপ-হ্যাট, আতশি-কাঁচের চশমা পরা এক স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে- সরকারি কর্মচারী। আমাদের আই এ এস গোছ।

হুঙ্কারিলেন, তিষ্ঠ!

? ? ?

আপনি ডক্টরেট উপাধি ধরেন?

অশ্বারোহী অবতরণ পূর্বক সবিনয় : আজ্ঞে না।

গম্ভীর নিনাদ : এ শহরে ডক্টরেট না থাকলে প্রবেশ নিষেধ।

কাতর রোদন : তা হলে উপায়?

মোলায়েম সান্ত্বনা : উপায় আছে বইকি। এই তো হেথায় টেবিলের উপর রয়েছে সর্ব গোত্রের উপাধিপত্র। আপনার দেশ?

আশাভরা কণ্ঠ :এজ্ঞে, লুকসেমবুরগ।

নুড়ি-চাপা ভিন্ন ভিন্ন ডাই থেকে একখানা করকরে কাগজ তুলে নিয়ে : আ–সুন, আসুন, স্যর (বিতে শ্যোন, প্লিজ!)। দক্ষিণা : পঞ্চাশত্রুদ্রা।

বিগলিত আপ্যায়িত কণ্ঠ : বিলক্ষণ, বিলক্ষণ (ডাংকে শ্যোন, মেনি থ্যাংকস)। এই যে।

অশ্বারোহী নগরকেন্দ্রে প্রবেশ করতে করতে ভাবল, আমার এই অশ্বিনীটি আমার বিস্তর সেবা করেছে। এর জন্য একটা হনোরিস কাউজা ডক্টরেট আনলে মন্দ হয় না। ঘোড়া ঘুরিয়ে উপাধিদাতার কাছে এসে তার সদিচ্ছা জানাল। আই এ এস দুঃখ-ভরা কণ্ঠে বললেন, ভেরি ভেরি সরি, হের ডকটর! এ শহরে ডকটরেট দেওয়া হয় শুধু গাধাদের। ঘোড়ার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেই।

আমরা এরই উপদেশ চেয়ে পাঠিয়েছি। আমেন।

———

১. প্রথম দুটো শব্দ ফরাসি, তৃতীয়টি ইতালীয়। অর্থাৎ রসালাপ করার তত্ত্বটি বরঞ্চ লাতিন জাত কিছুটা জানে। শুনেছি, অ্যাংলো সেশনদের এমন ক্লাবও নাকি আছে যেখানে কোনও মেম্বার কথাটি বলামাত্র তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। একদা একজন মেম্বার নাকি আগুন লাগা মাত্রই আগুন আগুন বলে চেঁচিয়ে ওঠাতে ক্লাববাড়ি রক্ষা পায়। তাকে অনেক ধন্যবাদ জানাবার পর (অবশ্য লিখিতভাবে) খাতা থেকে তার নামটি কিন্তু কেটে দেওয়া হয়।

 আড্ডা–পাসপরট

এত দেরিতে যে?

শোনো কথা! আড্ডাতেও আসতে হবে পাঙট্যুয়ালি?

হ্যাঁ, সেই কথাই তো হচ্ছে। তুমি তো হামেশাই পাঙট্যুয়ালি অন-পাঙটুয়াল।

আড্ডা প্রতিষ্ঠানের কাশীবৃন্দাবন কাইরো শহরে। এ সম্বন্ধে আমার গভীর গবেষণামূলক একাধিক গেরেমভারি প্রবন্ধ খানদানি অকসব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাত্মক বনেদি ত্রৈমাসিকে বেরুবার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ কর্তাদের খেয়াল গেল যে আমার ওই সাতিশয় উচ্চপর্যায়ের লেখাগুলো যদি একবার তাঁদের কাগজে বেরোয় তবে সে-কাগজের মান বা স্ট্যান্ডারড চড়াকসে এমনই সুপুরিগাছের ডগায় উঠে যাবে যে, আর পাঁচজন লেখক সে মগডালে উঠতে পারবে না। অথচ পয়লা নম্বরি পাঠকমাত্রই আমার উচ্চাঙ্গ লেখায় পেয়ে গেছেন তাজা রক্তের সন্ধান, হয়ে গেছেন ম্যানইটার। সম্পাদকমণ্ডলী তখন আর পাঁচজনের লেখা বাসি মড়া পাচার করবেন কী প্রকারে! একবার ভাবুন তো, স্বয়ং কবিগুরু যদি কোনও সপ্তাহের দেশ পত্রিকায় ট্রামেবাসে, সুনন্দর জারনল এবং পঞ্চতন্ত্র সব কটাই লেখেন, তার পর আমাদের তিনজনের–এককথায় সৈয়দ সুনন্দ করের কী হাল হবে? পচা ডিম ছুড়বে আমাদের মাথায় পাঠকগুষ্টি কাগজ হয়ে যাবে বন্ধ। সম্পাদক, প্রকাশক, মুদ্রাকর, লেখক। সবাইকে বসতে হবে রাস্তায়। আমাদেরও তো কাচ্চাবাচ্চা আছে। ডাল-ভাত যোগাতে হয়।

আমার অত্যুৎকৃষ্ট রচনার মূল্য অকসব্রিজের কর্তৃপক্ষ বুঝুন আর না-ই বুঝুন–এটা কিন্তু ভুললে চলবে না তারা ইংরেজ। ইংরেজ ব্যবসা বোঝে। নেপোলিয়ন একদা বলেছিলেন নেশন অব শপ-কিপারজ–এখন বলা হয় নেশন অব শপ-লিফটারজ(১) (ভদ্রবেশী দোকান-লুটেরা)। ব্যবসা বোঝে বলেই তারা আমার লা-জবাব প্রবন্ধগুলো ইনশিওর করে সবিনয়, সকাতর ফেরত পাঠায়–ছাপালে তারা, তাদের আণ্ডাবাচ্চারা বেবাক-আণ্ডাহীন হবে সেই কারণ দর্শিয়ে।

তখন করি কী?

কথিত আছে, একদা লন্ডনে মারকিন হেনরি ফোরড দাবড়ে বেড়াচ্ছিলেন খাসা রহিসি রোলস রইস। পঞ্চম জরজ তাঁকে শুধোলেন, সে কী মিসটার ফোরড! আপনি বিজ্ঞাপনে বলেন ফোরড গাড়ি দুনিয়ার চিপেস্ট এবং বেস্ট গাড়ি, তবে রোলস চড়েন কেন? ফোরড বাও করে বললেন, আমার ম্যানেজারকে বহুবার বলেছি, আমাকে একখানা ফোরড গাড়ি দিতে। তার মুখে ওই এক কথা–ফোরড গাড়ি তৈরি হতে-না-হতেই সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়; সে খদ্দের সামলাবে না মালিককে গাড়ি দেবে। খদ্দের মোর ইমপরটেনট দ্যান মালিক। অতএব, হুজুর বাধ্য হয়ে বাজারের সেকেন্ড বেস্ট মোটর–রোলস–কিনেছি।

গল্পটি মিশরের পিরামিডের চেয়েও প্রাচীন–যে পিরামিডের দিকে পিছন ফিরে আমরা কাইরোর কাফেতে বসি। কিন্তু ক্লাসিক্যাল কাহিনীর ভালে ওই তো চন্দন-তিলক! নিত্য নিত্য নব নব ফাড়া গরদিশে সাক্ষাৎ মুশকিলআসান।

আমি জানতুম, অকসব্রিজ ত্রৈমাসিকের পরেই সেকেন্ড বেস্ট কাগজ দেশ। সেখানে পাঠালুম। ছাপা হয়ে গেল (সম্পাদক-ম্যানেজার হয়তো সোল্লাসে ভেবেছিলেন, ওটা পয়সা কামানেওলা বিজ্ঞাপন), বই হয়েও বেরুল। পাঠক সাবধান! চীনেবাদামের ঠোঙা কদাচ অবহেলা করবেন না। একমাত্র ওই কাগজেই একখানা তাবল্লোক মল্লিখিত কাইরোর কাফে আড্ডা সম্বন্ধে নিবন্ধগুলো পড়তে পায়।

অতএব কাইরোর কাফে-আড্ডার সবিস্তর বর্ণনা নতুন করে দেব না। শুধু এইটুকু বলব কাইরোর কাফের তুলনায় আমাদের আড্ডা, ইংরেজের ক্লাব, জরমানের পাব, কাবুলির চা-খানা, ফরাসির বিরো–এস্তেক অবিমুক্ত ক্ষেত্র কাশীর জমজমাট ঘাট–সব শিশু শিশু। বৈজ্ঞানিক বলেন, আমাদের জীবনের এক-তৃতীয়াংশ কাটে শয্যায়–ন্দ্রিায়। কাইরোর কাফে হাসবে–কুট্টির ঘোড়ার মতো–আস্তে বলুন। তাদের জীবনযাত্রা একপ্রকার :

সকাল ৬টা থেকে ১০টা কাফে = ৪ ঘণ্টা। ১০টা থেকে ১টা দফতর। ১টা থেকে ২টা কাফে =১ ঘণ্টা। ২টা থেকে ৫টা দফতর, ৫টা থেকে ১২টা রাত কাফে = ৭ ঘণ্টা। ১২টা থেকে ৬টা ভোর নিদ্রাযোগে গৃহবাস অতিশয় অনিচ্ছায়।

একুনে, সর্বসাকুল্যে কাফেতে ১২ ঘণ্টা। জীবনের এক-তৃতীয়াংশ না ঘন্টা! হোলি রাশার সেই ফাটা ঘণ্টা যেটা কখনও বাজেনি।

কাইরো সজ্জনের জীবনের হাফ কাটে কাফেতে–অবশ্য বেটার হাফ-কে বাড়িতে রেখে! আর ছুটিছাটা, স্ট্রাইক রাজা ফারুকের মেহেরবানিতে হরবকৎ লেগেই আছে(২)–লটারি উত্তোলন দিবসচয় যদি হিসাবে নেন তবে সেই প্রথম প্রবন্ধের প্রথম তত্ত্বে ফিরে যাই : বাড়ি নিয়ে কি গুলে খাব, পারেন তো দিন একটি ননস্টপ-আড্ডার সন্ধান। তা হলে অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে, কাইরোতে লোকে বাড়ি বানায় কেন? মিশরবাসী তখন বিদেশিকে বুঝিয়ে বলে, প্রাচীন যুগে তারা আদৌ বানাত না, বানাত গোরের জন্য স্রেফ পিরামিড–চোখ মেললেই এখনও চতুর্দিকে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কই সে যুগের বাড়ি বাড়ি বানানোর বদ-অভ্যাস বাজে-খরচা তারা শিখেছে হালে, ইংরেজের কাছ থেকে, তার হোম নাকি তার কাসল (অ্যান্ড হি ইজ দ্য টাইরেন্ট ইনসাইড) আর বাড়ি বানানোটাই যদি এমন কিছু জব্বর মহষ্কর্ম, বাবুইকেই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলা উচিত, ওর মতো নিটোল, নিখুঁত বাড়ি বানিয়েছে আর কেউ? ছাত ধসে না, ট্যাকশো দিতে হয় না।–ইত্যাদি। (৩)

তা সে থাকগে, কোন্ কথা থেকে কোন্ কথায় চলে এলুম, ওই তো আড্ডার দোষ।

কাইরোর কাফে আমাকে বোঝাচ্ছিল, আমি পাঙটুয়াল, অর্থাৎ কথা দিয়ে থাকি ঘণ্টায় আসব বলে, আর আসি কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ঘণ্টায় অর্থাৎ পাঙট্যুয়ালি… ইত্যাদি।

এর পর কাফে বলে কি না, আমি নাকি অন্-পাঙট্যুয়ালও বটে!

সেটা কী প্রকারের?

টুটেনখামেন-এর আমল থেকে এদেশের অলিখিত আইন, মিটিং যদি ধার্য হয়ে থাকে সাতটায়, তবে শুরু হয় আটটায়, দিল-হামেশাই হচ্ছে। আমি নাকি উপস্থিত হই কাঁটায় কাঁটায় সাতটায়। এটা নাকি অন-পাঙট্রয়াল পাঙট্যুয়ালিটি।

সেটা নাকি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার একচেটে কারবার। নীলনদে কখনও প্রচুর জল আসার ফলে কাফের সকলে গায়ে রেশমের স্যুট চড়ায়, কখনও মাত্র কঞ্জিনটুকু সম্বল; কখনও সাহারায় ঝড়ের ঠেলায় ছ ফুট বালি জমে বাড়ির দেউড়ি বন্ধ হয়ে যাবে এবং তারই ফলে সর্বাপেক্ষা মারাত্মক পরিস্থিতি–কাফেতে আসার জো-টি নেই–এসবের হদিসান্বেষীরা নাকি পরবর্তীকালে আবহাওয়া দফতরের ডিরেকটার জেনরেল হয়।

ইতিমধ্যে আমাদের টার্ক–(তুর্কি বললে মানুষটাকে ভুদ্র বলে মনে হয়)–ইংরেজি অর্থে। টার্ক, সদস্য তওফিক এসে উপস্থিত।

পয়লা নম্বরের ধুরন্ধর এবং গোঁয়ার। আমাকে শুধোলে, কী বাবাজী, খানিকক্ষণ আগে তোমাকে দেখলুম এক আজব চিড়িয়ার সঙ্গে–ওহেন মাল কস্মিনকালে বাবা, এই বহুতর চিড়িয়ার শহর কাইরোতেও দেখিনি! ব্যাপারটা কী?

আমি বললুম, আর কও কেন? সেই কথাই তো এদের বোঝাতে যাচ্ছিলুম। সমস্ত বৈকেলটা কেটেছে ব্রিটিশ কনসুলেটে-বুনোহাঁস ধরার চেষ্টা কখনও করেছ? তাইতেই হেথায় হাজিরাতে দেরি?

বুনো হাঁস! সে আবার কী?

নয় তো কী? কিন্তু আমার সঙ্গে যে চিড়িয়া দেখেছিলে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিজ। আমার দেশের লোক।

কাফে অবাক। সে কী? আমরা তো জানতুম, তুমি কোথাকার সেই বাঙ্গালা না, কী যেন বলে, সেই দেশের একমাত্র লক্ষ্মীছাড়া এসেছ এদেশে।

সে কথা পরে হবে। উপস্থিত থোই, বিদেশে-বিভুঁইয়ে কেউ কখনও পাসপরট হারিয়েছে সকলেই একসঙ্গে শিউরে উঠলেন, কারও কপালে ঘাম দেখা দিল, কেউ-বা দেখি বন্ধ করে আল্লারসুলের নাম স্মরণ করছেন।

পাঠককে বুঝিয়ে বলি, এ সংসারে নানান ভয়াবহ অবস্থা আমরা দেখি, কাগজে পড়ি, শ্রবণ বা স্বল্পলব্ধ জ্ঞান না-হয় বাদই দিলুম। কিন্তু এ সবকটাকে হার মানায় মাত্র একটি নিদারুণ দুর্দৈব–বিদেশে পাসপটটি হারানো।

ছুটুন কনস্যুলেটে। তারা কানই দেবে না। লিখুন আপন দেশে। নো রিপলাই। কিংবা শুধোবে, পাপরূটের নম্বর ইস্যুর তারিখ গয়রহ জানাও। সেগুলো আপনি ডাইরিতে টুকে রাখেননি। আবার কনস্যুলেটে ধন্না। সঙ্গে নিয়ে গেছেন দু-পাঁচজন ভারতীয়। তাঁরা হলপ খেলেন, আপনি যে ভারতীয় সে বাবদে তাদের মনে কোনও সন্দেহ নেই। কনস্যুলেট বলবে, মাডাগাসকারের বিস্তর লোক ভারতীয় ভাষায় কথা কয়; তাই বলে তারা ভারতীয় ইনডিয়ান নেশনালিটির প্রমাণ কোথায় যে আমরা নয়া পাসপ দেব? বের করুন বার্থ সারটিফিকেট, এবং প্রমাণ করুন সেটা আপনারই।

হাজারোগণ্ডার হাবিজাবি হেনাতেনা চাইবে। এবং তাদের চাওয়াটা সম্পূর্ণ ন্যায্যতঃ হকৃতঃ। না চাইলে দুনিয়ার যত ভাগাবন্ড ব্লাডিভসটক থেকে আলসকা–এসে কিউ লাগাবে একখানা করকরে, ঝা চকচকে, সোঁদা সোঁদা গন্ধওলা ইনডিয়ান পাসপরুটের লোভে। এক ঝটকায় হয়ে যাবে ইনডিয়ান ন্যাশনাল, সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে গিয়ে মহারানির মোলাকাৎ চাইবে। যে বেচারাকে টারক তওফিক দেখেছিল পথিমধ্যে, সে সত্যি সিলেটের লোক।

আমি গিয়েছিলুম কনস্যুলেটে, প্যালেসটাইন যাবার জন্য অনুমতির (ভিজার) সন্ধানে। সেই জরাজীর্ণ লোকটাকে জবুথবু হয়ে এককোণে বসে থাকা অবস্থাতে দেখেই বুঝে গেলুম লোকটা সিলেটি।

এবং তাই। আমার মুখে সিলেটি শুনে ভ্যাক করে কেঁদে ফেলল। আমি একপাল লোকের সামনে মহা-অপ্রস্তুত।

ব্যাপারটা সরল, কিন্তু পরিণামে হয়ে গেছে বেজায় জটিল। মাসখানেক পূর্বে আলেকজান্দরিয়া বন্দরের কিছু দূরে একটা জাহাজডুবি হয়–ও-ই কোনও গতিকে বেঁচেছে, সম্পূর্ণ উলঙ্গাবস্থায়, গায়ের চামড়াও কিছুটা পুড়েছে। পাসপর তো সাপের মণি–রত্তিভর ডকুমেন্ট তার কাছে নেই। আর ওই একমাত্র সিলট্যা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষায় একটি শব্দও সে বুঝতে পারে না।

কুল্লে কাফে মাথা নেড়ে সায় দিলে, ব্যাপারটা সঙিন।

ভাগ্যিস, ডেপুটি কনসালটি ছিলেন আমার পরিচিত–অতিশয় অমায়িক খানদানি ইংরেজ ভদ্রলোক। আমার আপন কাজ শেষ হয়ে গেলে খালাসিটার কথা পাড়লুম। সায়েব মাথা নেড়ে বললেন, বিলকুল হুম্বগ। আমি কলকাতায় কাজ করেছি পাঁচটি বছর। বাঙলা শুনলে বেশ বুঝতে পারি। ও যা বলল সে তো বাঙলা নয়।

মনে মনে আমাকে বলতে হল, পোড়া কপাল আমার। সাহেবকে বললুম, ওকে একটু ডাকলে হয় না? সায়েব সদাশয় লোক, বললেন, আলবৎ।

লোকটা আসামাত্রই আমি চালালুম তোড়সে সিলেটি। কিঞ্চিৎ কটুকাটব্যের কাঁচা লঙ্কা মিশিয়ে। উদ্দেশ্য তাকে একটু অতিশয় তাতিয়ে দেওয়া, নইলে যেরকম নসিকে ভিলেজ ইডিয়ট, পেটে বোমা মারলেও–। দাওয়াই ধরল। কাইকুঁই করে বলে গেল অনেক দুঃখের কাহিনী–চোখে সাত দরিয়ার নোনাজল। মিনিট পাঁচেক চলল রসালাপ। সায়েব খালাসিকে বললেন, টুম যাও। আমাকে শুধোলেন, এ-ও বাঙলা? আমি বললুম, লন্ডনের সঙ্গে উত্তর স্কটল্যান্ডের ভাষায় যে মিল–এ বাঙলার মিল কলকাত্তাইর সঙ্গে তার চেয়েও কম।

এর পর সায়েব যা বলল, তার থেকে পরিষ্কার বুঝে গেলুম, লোকটি সত্যকার ডিপলমেট। বললেন, দু-একটা শব্দ যে একবারেই বুঝতে পারিনি তা নয়। তবে কি জানো, ব্যাবু, ব্যাপারখানা আসলে কী? কোনও বিশুদ্ধ স্ট্যান্ডার্ড ভাষা–যেমন মনে করো প্যারিসের ফরাসি, কিংবা ধরো লন্ডনে প্রচলিত খানদানি ঘরের ইংরেজি সেটা শেখা কিছু অত্যধিক কঠিন কর্ম নয়। হাজার হাজার রুশ, পোল, হাঙগেরিয়ান চোস্ত ইংরেজি বলে খাসা ফরাসি কপচায়–কার সাধ্যি বলে কোনটা কার মাতৃভাষা নয়–এবং প্রসঙ্গত বলি, এরাই হয় বেস্ট স্পাই। কিন্তু মশাই, বিশুদ্ধ গাইয়া ডায়লেকট রপ্ত করাটা বড়ই কঠিন, প্রায় অসম্ভব। লন্ডনের কটা খানদানি ইংরেজই বলতে পারে খাঁটি ককনি?

সায়েবটি ছিল একটু দুঁদে টাইপ। খালাসিটার জন্মভূমির গ্রাম থানায় চিঠি না লিখে রেডটেপিজেমের মূর্ত প্রতীক এনকোয়ারি না করেই আপন জিম্মায় ছেড়ে দিল একখানা পাসপরুট।

নইলে ওই হতভাগা ক মাস ধরে কে জানে, হয়তো বারো বছর ধরে আপিসে দফতরে ধন্না দিত, রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা-ফ্যা করে করে বেড়াত, খেত কী, মাথা গুঁজত কোথায়?

আর ইতিমধ্যে যদি কোনও সমধিক কর্মনিষ্ঠ তথা অত্যুৎসাহী উৎকোচাশ্রয়ী মিশরি পুলিশম্যানের নজরে পড়ে যেত? কাঁধে খাবলা মেরে শুধোত, তুমি তো বিদেশি বলে মনে হচ্ছে হে–নিকালো বাসবর (আরবিতে প নেই বলে ব আদেশ, এবং শব্দটি আরবরা ফরাসি থেকে নিয়েছে বলে শেষের টি উচ্চারিত হয় না–একুনে পাসপ উচ্চারিত হয় বাসবর, বা বাসাবর) তা হলে?

শ্রীঘর। তাতে যে আমাগো সিলট্যা মোতিমিয়ার খুব একটা ভয়ঙ্কর আপত্য (আপত্তি শব্দের সিলেটি রূপ) আছে তা নয়; জাহাজের কয়লাঘরের কারবালায় কারবার করছে যে লোক তার পক্ষে কাইরোয় কারাগার করীমা বখশায় বর হাল-ই-মা–আল্লার কৃপা তার ওপরে এসেছে।

কিন্তু ততোমধ্যে তার নয়া বাসবরের জন্যে যেটুকু ধরনা দেওয়া, তদবির করা সেটুকুনই-বা করবে কে? অবশ্য আখেরে এস্থলে তদবির করা-না-করা–বরাবর। বসুন্ধরা সর্বত্রই তদ্বির-ভোগ্যা নন–এখানে প্রকৃতি তার আপন গতি নেয়।

সাঁইমুরশিদ কবুল, আমি সব নই। কিন্তু আপনার-আমার মতো ক্ষীণকায় মধ্যশ্রেণির ভদ্রসন্তানকে যদি বিদেশের জেলে ঠেসে দেয় তবে কেঁসে যেতে কতক্ষণ? না-হয় সপ্রমাণ হল, কাইরোর জেলকে আপনি হার মানিয়ে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু বেরুনো মাত্রই তো আপনি সেই ক্রাইমটি ফের করে ফেলেছেন, বিদেশে বিনা পাসপটে আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

অবশ্য আপনি তর্ক তুলতে পারেন, মিশর সরকারই আপনাকে রাস্তায় নামিয়ে ক্রাইমটি করছে, সেই কাজের আপনি ইফেকট মাত্র। ততোধিক কুতর্ক করতে পারেন, আজ যদি মিশর সরকারের প্রতিভূ পুলিশম্যান আপনাকে চোদ্দতলা বাড়ির ছাদ থেকে পেভমেন্টে ফেলে দেয় তবে সেটা আত্মহত্যা নয়।

***

কাফেতে এ নিয়ে বিস্তর মাথা-ফাটাফাটি হয়।

একমাত্র তওফিক আফেন্দি চরম অবহেলাভরা সুরে পরম তাচ্ছিল্যসহ মাঝে মাঝে বলছিল, যত সব! কিংবা আদিখেত্তায় মানওয়ারি অথবা ডিমের খোসায় কালবৈশাখী!

শেষটায় বলল, ছোঃ! আমার কাছে নিয়ে এলে না কেন?

নিবেদন করলুম, জানি তুমি একদা ছিলে মুস্তাফা কামালের বিবেকরক্ষক অধুনা ইসমেৎ ইনেনুর অমনিবাস এমবাসেডর, কিন্তু তথাপি।

বলল, যাহঃ! এইটুকু মশা মারতে বাঘের উপরে টাগ! না। কিনে দিতুম। কী আর এমন ক্লেওপাতার গুপ্তধন প্রয়োজন ওই সাসিটুকুর জন্য?

আমি অবাক হয়ে শুধোলুম, সে কী? পাসপর কি হাটের বেসাতি, যে–।

গম্ভীরকণ্ঠে বলল, দেখো, বৎস! তুমি আজহর মাদরাসার ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করো; নাই-বা জানলে এসব জাল-জঞ্জুরির কায়দা-কেতা।

———–

১. পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিবেদন : আশকথা পাশকথা (আর সেটা প্রাণধর্ম) না-শুনে যেসব বে-আড্ডাবাজ অথচ গুণী পাঠক মূল গল্পের খেই ছিনেজোঁকের মতো আঁকড়ে ধরে রাখতে চান তারা যেন ফুটনোটগুলো না পড়েন; কণামাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। অবশ্য তার অর্থ এ-ও নয় যে, মূল লেখা না পড়লে তার সর্বনাশ হবে।

শপ-লিফটারজ কথাটা ইংরেজের ওপর প্রথম আরোপ করেন ছদ্মনামধারী সরস লেখক সাকি।

২. আমার কাইরো-কাফে আশ্রম ওই সময়ে।

৩. ভারতের বাইরের বেদে মাত্রেরই বিশ্বাস তাদের আদিমতম পিতৃভূমি ভারতবর্ষ। তা হতেও পারে। এবং তাদের আর একটি বিশ্বাস, ভারতবর্ষ আগাপাশতলা বেদেদের দেশ, সবাই ঘুরে বেড়ায়, সুতরাং কেউ বাড়ি-ঘরদোর বাঁধে না!

আবার আবার সেই কামান গর্জন!

খুন করার পরেই খুনির প্রধান সমস্যা, মড়াটা নিশ্চিহ্ন করবে কী প্রকারে? সমস্যাটা মান্ধাতার চেয়েও প্রাচীন। আমাদের প্রথম পিতা আদমের বড় ছেলে কাইন তার ছোট ভাই আবেলকে খুন করেন। তাঁর সামনেও তখন ওই একই সমস্যা, মৃতদেহটা নিয়ে করবেন কী? সাধারণ সাদামাটা বুদ্ধি খাঁটিয়ে তিনি সেটাকে পুঁতে ফেললেন মাটির ভেতর। কিন্তু মাটিকে আমরা মা-টিও বলি; তিনি সইবেন কেন এক পুত্রের প্রতি অন্য পুত্রের এরকম নৃশংসতা। তাই পরমেশ্বর কাইনকে বললেন, এ তুমি করেছ কী? মাটির (মা ধরণীর) তলা থেকে তোমার ভাইয়ের রক্ত যে আমাপানে চিৎকার করছে। অর্থাৎ মাটিতে পুঁতেও নিস্তার নেই। তাই পৃথিবীর একাধিক ভাষাতে এটা যেন প্রবাদ হয়ে গিয়েছে। সন্দেহবশত গোর খুঁড়ে লাশ বের করে পোস্টমর্টেমের ফলে যখন ধরা পড়ে লোকটার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল তখন ওইসব ভাষাতে বলা হয়, মৃতের রক্ত বা মা ধরণী মাটির তলা থেকে চিৎকার করছিল প্রতিশোধের জন্য। (১,২)

খুন-খারাবির ইতিহাস যারা পড়েছেন তারাই জানেন লাশ গায়েব করার জন্য যুগ যুগ ধরে খুনি কত-না আজব-তাজ্জব কায়দাকে বের করেছে। অবশ্য খুনি যদি ডাক্তার হয় (না পাঠক, ডাক্তার-বদ্যি-হেকিম চিকিৎসার অছিলায় যে খুন করে তার কথা হচ্ছে না) তবে তার একটা মস্ত বড় সুবিধা আছে। বছর বিশেক পূর্বে বিলাতবাসী এক কালা-আদমি সারজন তার মেম বউকে খুন করে। বাথটাবে লাশ ফেলে সেটাকে ডাক্তারি কায়দায় টুকরো টুকরো করে কেটে ড্রইংরুমের চিমনিতে ঢুকিয়ে দিয়ে সচহ্ লাশটা পুড়িয়ে ফেলে। কিন্তু পাক প্রণালীতে করল একটা বেখেয়ালির ভুল। তখন ভর গ্রীষ্মকাল– ড্রইংরুমে আগুন জ্বালাবার কথা নয়। দু-একজন প্রতিবেশী ওই ঘরের চিমনি দিয়ে যে ধুয়ে উঠেছে সেটা লক্ষ করল। ডাক্তারের বউ যে হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়, সে যে মাঝে মাঝে ডাইনে-বাঁয়ে সাইড-জাম্প দিত, স্বামী-স্ত্রীতে যে ইদানীং আছারই বেহদ্দ ঝগড়া-ফসাদ হত এসব তত্ত্ব পাড়াপড়শির অজানা ছিল না। পুলিশ সন্দেহের বশে সার্চ করে চিমনিতে ছোট্ট ছোট্ট হাড় পেল, চানের টাটা যদিও অতিশয় সযত্নে ধোওয়া-পোছা করা হয়েছিল তবু সূক্ষ্ম পরীক্ষা করে মানুষের রক্তের অভ্রান্ত চিহ্ন পাওয়া গেল।… মোদ্দা ডাক্তারকে ইহলোক ত্যাগ করার সময় মা ধরণীর সঙ্গে সমান্তরাল (হরাইজনটাল) না হয়ে লম্বমান (পারপেনডিকুলার) হয়েই যেতে হয়েছিল।

অবশ্য ডাক্তারের ফাঁসি হওয়ার পর তার আপন লাশ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না– কারওরই। যে সরকারি কর্মচারী, অশ্লীল ভাষায় যাকে বলে ব্যাঙম্যান, ডাক্তারের গলার প্রয়োজনাতীত দীর্ঘ প্রয়োজনাধিক দৃঢ় একটি নেটাই সযত্নে পরিয়ে ডাক্তারের পায়ের তলায় টুলটি হঠাৎ লাথি মেরে ফেলে দেয় সে এই অপকর্মটি করেছিল জজ-সাহেবের আদেশে, সামনে ওই ডাক্তারেরই পরিচিত আরেক ডাক্তারকে এবং জেলার সায়েবকে সাক্ষী রেখে। শুনেছি, এদেশের সরকারি ফাঁসুড়ে আসামির গলায় দড়ি লাগাবার সময় তাকে মৃদুকণ্ঠে বলে, ভাই, আমার কোনও অপরাধ নিও না; যা করছি সরকারের হুকুমে করছি। ইয়োরোপীয় ফাঁসুড়েদের এরকম ন্যায়ধর্ম-জাত কোনও সূক্ষ্মানুভূতি নেই। সেখানে ফাঁসুড়ে তার মজুরির ওপর ফাঁসির দড়াটা বকশিশ পায়, এবং সে সেটা ছোট ছোট টুকরো করে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে আক্ৰাদরে বেচে ফাঁসির দড়ি নাকি বড় পয়মন্ত।

কিন্তু সরকার, রাজা বা ডিটেটর যেখানে বেআইনি খুন করে সেখানে এদের সামনেও সেই সমস্যাই দেখা দেয়। যখন পাইকিরি হিসেবে খুন করা হয় তখন দেখা দেয় আরও দুটি সমস্যা :

১. যাদের খুন করা হবে তাদের মনে সন্দেহ না জাগিয়ে কী প্রকারে তাদের একজোট করা যায়?

২. খুন করার জন্য অল্প খরচে অল্প সময়ে কী প্রকারে বিস্তর লোকের ভবলীলা সাঙ্গ করা যায়?

জর্মন মাত্রই স্ট্যাটিস্টিকসের ভক্ত। একশোটি মেয়েছেলের মধ্যে যদি নব্বইটি কুমারী হয়, এবং দশটি গর্ভবতী হয় তবে তারা টরেটক্কা হিসাব করে বলে এই একশোটি মেয়ের প্রত্যেকটি নব্বই পারসেন্ট অক্ষতযোনি কুমারী এবং দশ পারসেন্ট গর্ভবতী।

হিটলার এই ন্যায়শাস্ত্র অবলম্বন করে বললেন, নব্বই পারসেন্ট তো ইহুদি বাদবাকি দশ পারসেন্ট জিপসি, পাগল (বসে বসে শুধু খায়, লড়াইয়ের ব্যাপারে কোনও সাহায্যই করে না) ইত্যাদি। ওই হল!–জিপসি ও নব্বই পারসেন্ট ইহুদি। হিসাবে মিলে গেল।

দেখা গেল, হিটলারের তাঁবেতে ১৯৪১-৪২ সালে যেসব রাষ্ট্র এসেছে এবং আসছে তাতে আছে প্রায় আশি লক্ষ ইহুদি এখানে আমি জিপসি, পাগল, রুশ, হিটলারবৈরী ফরাসি-জর্মন-রুশ ইত্যাদিকে বাদ দিচ্ছি। হিটলার ডাকলেন হিমলারকে। ইনি পুলিশ, সেকুরিটি, ইনটেলিজেন্স, হিটলারের আপন খাস সেনাদল (এরা দেশের সরকারি সৈন্য-বিভাগের অংশ নয়) কালো কুর্তিপুরা এস এস এবং আরও বহু সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিকারী ফুরার। হিটলার একেই হুকুম দিলেন চালাও, ক-ই-আম্! অর্থাৎ পাইকারি কচুকাটা! নাদির-তিমুর যখন দিল্লিতে এই পদ্ধতির প্রবর্তন করেন তখন কৎল-ই-আমই করেছিলেন। আম= সাধারণ (দিওয়ান-ই-আম তুলনীয়) আর কৎল= কতল। অবশ্য নাদির-তিমুর কল-ই-আম্ করেছেন প্রকাশ্যে, হিটলার-হিমলার করলেন অতিশয় সঙ্গোপনে।(৩) বস্তুত হিমলার ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ যে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন সেটা যেমন অভিনব এবং জটিল তেমনি ক্রুর এবং মোক্ষম। তদুপরি বাইরের থেকে তাবৎ ব্যাপারটা যেন করুণাময়ের স্বহস্তে নির্মিত নিষ্পাপ কবুতরটি; ভিতরে ছিল শয়তানের সাঙাৎ কালকূটে-ভরা বেইমান, অশেষ পাপের পাপী পঞ্চম পাতকী তার চেয়ে বেশি পাপী বিশ্বাসঘাতকী, কালনাগিনী। এ এক অভিনব সমন্বয় : বাইরে কবুতর, অন্তরে বিষধর।

পূর্বেই বলেছি, প্রথম সমস্যা : তাবৎ ইহুদি একত্র করা যায় কোন পদ্ধতিতে? এই মর্মে একটি গোপন সভা আহ্বান করলেন হিমলারের ঠিক নিচের পদের কর্তা হাইডেরিষ বার্লিনের উপকণ্ঠে তার সৌখিন ভিলা ভানজে-তে। এ-সভায় আইষমানকেও ডাকা হয়, যদিও পদগৌরবে তিনি এমন কেষ্টবিষ্ট ছিলেন না। কিন্তু হাইডেরিষ ছিলেন সত্যিকার আদম-শনাস মানুষের জৌরি তিনি জানতেন আইষমান তালেবর ছোকরা, যতই ঝুটঝামেলার ঝকমারি ব্যাপার হোক না কেন, সেটার বিলিব্যবস্থা করে সবকিছু ফিটফাট করে নিতে সে পয়লা নম্বরি। সেই সুদূর স্তালিনগ্রাদ থেকে ফ্রান্সের পূর্ব উপকূল, ওদিকে নরওয়ে থেকে উত্তর আফ্রিকা অবধি সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ইহুদিগোষ্ঠী। আইষমানের ওপর ভার পড়ল আড়কাঠি হয়ে এদের কয়েকটি কেন্দ্রে জড়ো করা।

আইষমান সম্বন্ধে বাংলাতেও বই বেরিয়েছে; কাজেই তার সম্বন্ধে আমাকে বিশেষ কিছু বলতে হবে না। শুধু একটি কথা এখানে বলে রাখি; বাংলা বইয়ে আছে আইষমান পাঁচ লক্ষ ইহুদির মৃত্যুর জন্য দায়ী। এটা বোধহয় স্লিপ। পাঁচ লক্ষ নয়, হবে পাঁচ মিলিয়ন অর্থাৎ পঞ্চাশ লক্ষ।

শব্দার্থে ছলে বলে এবং কৌশলে আইষমান যেভাবে ইহুদিদের জড় করেছিলেন সেটা এত সুচারুরূপে আর কেউ সম্পন্ন করতে পারত না একথা তাবৎ নাৎসি, অ-নাস সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন।

অনেকেই প্রশ্ন জিগ্যেস করেন, আড্ডা–ইহুদিদের প্রতি হিটলারের এই যে আক্রোশ এর তো তুলনা পাওয়া ভার। এর কারণটা কী?

এর উত্তর দিতে হলে তিনভলুমি কেতাব লিখতে হয়। খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তনের কিছুকাল পর থেকেই আরম্ভ হয় খ্রিস্টান কর্তৃক ইহুদি নিপীড়ন (এবং এরাই সর্বপ্রথম নয়– সেই খ্রিস্টজন্মের হাজার তিন বছর আগে থেকে পালা করে, মিশর, আসিরিয়া, ব্যাবিলনিয়া, রোমান সবাই এদের ওপর অত্যাচার করেছে)। মধ্যযুগে স্পেনে একবার এক লক্ষ ইহুদিকে খেদিয়ে আফ্রিকায় ঠেলে দেওয়া হয়, এবং হাজার হাজার ইহুদিকে স্রেফ ধর্মের নামে খুন করা হয়।

কিন্তু হিটলার তো খ্রিস্টান কেন, কোনও ধর্মেই বিশ্বাস করতেন না। পারলে তিনি এ সংসারে কোনও ধর্মেরই অস্তিত্ব রাখতেন না।

হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে মাঝে-মিশেলে যুক্তিতর্কের অবতারণা করতেন কিন্তু সেগুলো আকছারই পরস্পরবিরোধী। একদিকে বলতেন, ইউরো-আমেরিকার অধিকাংশ ক্যাপিটাল ইহুদিদের হাতে–যত বেকার সমস্যা, যত রক্তাক্ত বিপ্লব, যত যুদ্ধ ইউরোপে হচ্ছে তার পিছনে রয়েছে ইহুদি পুঁজিপতি। আবার একই নিশ্বাসে বলতেন, যে রুশ-কম্যুনিজম ইউরোপের সভ্যতা সংস্কৃতি ধনদৌলত সমূলে বিনাশ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে তার আগাপাশতলা ইহুদি প্ররোচনায়। অর্থাৎ ইহুদি একাধারে কম্যুনিস্ট এবং ক্যাপিটালিস্ট। এবং যারা তার একমাত্র বই মাইন কাপ (মাই স্ট্রাগল-এর ঠিক ঠিক অনুবাদ নয়– আমার জীবনসংগ্রাম বললে অনুবাদটা মূল জর্মনের আরও কাছাকাছি আসে। মোদ্দা আমি আমার জীবন আদর্শ বাস্তবে পরিণত করার জন্য সর্বপ্রকার বাধা-বিপত্তি সর্ব দুশমনের সঙ্গে যে লড়াইয়ের পর লড়াই যুঝেছি তার ইতিহাস) পড়েছেন তারা জানেন তিনি তার সিদ্ধান্তে দলিলপত্র পেশ করে কখনও সপ্রমাণ করেননি, করবার চেষ্টা দেননি। এর কারণটি অতিশয় সরল।

ইহুদি যে এ পৃথিবীর সর্ব দুঃখের কারণ এটা হিটলারের কাছে স্বতঃসিদ্ধ টেনেট অব ফেৎ (অন্যতম মৌলিক বিশ্বাস)। খ্রিস্টান-মুসলমান যেরকম যুক্তি-তর্কের অনুসন্ধান না করে সর্ব সত্তা দিয়ে বিশ্বাস করে ইহসংসারের সব পাপ সর্ব দুঃখ সর্ব অমঙ্গলের জন্য শয়তানটাই দায়ী, হিন্দু যেমন বিশ্বাস করে মানব-জাতির সর্ব যন্ত্রণার জন্য তার পূর্বজন্মকৃত কর্মই দায়ী, ঠিক তেমনি হিটলার তার সর্ব অস্তিত্ব দিয়ে বিশ্বাস করতেন বিশ্বভুবনজোড়া সর্ব অশিবের জন্য ইহুদি জাতটা দায়ী– অন্ধ খঞ্জ বৃদ্ধ অবলা শিশু ইহুদি, সব সব, সবাই দায়ী। তার অন্তরঙ্গ জনকে তিনি অসংখ্যবার বলেছেন ইহুদিকুল ছারপোকা-ইঁদুরের মতো প্রাণী (ভারমিন), ছারপোকা ধ্বংস করার সময় তো কোনও করুণা-মৈত্রীর কথা ওঠে না, ইঁদুরের বেলাও কোনটা ধেড়ে কোনটা নেংটি সে প্রশ্নও অবান্তর।

এ-কথা সত্য আমরা ছারপোকা নির্বংশ করার সময় কোনও বাছবিচার করিনে; এবং যে কোনও প্রকারের প্রাণীহত্যা করলেই যে এদেশের কোনও কোনও সম্প্রদায় আমাদের খুনি বলে মনে করেন সে তত্ত্বও আমাদের অজানা নয়। তৎসত্ত্বেও প্রশ্ন থেকে যায়, সত্যিই মানুষে-ছারপোকাতে কোনও পার্থক্য নেই? এদিকে আবার বহু খ্রিস্টান সাধুসজ্জন ইহুদি-ছারপোকাতে পার্থক্য করতেন বটে কিন্তু সেটা সামান্যই। আমি কাইন এবং আবেলের যে বাইবেল কাহিনী দিয়ে এ নিবন্ধ আরম্ভ করেছি সেটাকে রূপকার্থে নিয়ে ওইসব সাধুসজ্জন কাইনকে ধরেন ইহুদিদের সিনাগগ (ধর্ম প্রতিষ্ঠান) রূপে এবং আবেলকে খ্রিস্ট চার্চরূপে অর্থাৎ ইহুদি তার আপন ধর্মবিশ্বাস দ্বারা প্রবুদ্ধ হয়ে যেখানে খ্রিস্টানকে খ্রিস্টধর্মকে পায় সেখানেই তাকে নিধন করে। ইহুদি ভ্রাতৃহন্তা, সে বিশ্বগ্ন।…পাঠক স্বপ্নেও ভাববেন না, আমি হিটলারের ইহুদি নিধন সমর্থন করছি। আমি এ প্রবন্ধ লিখছি অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে এবং এ স্থলে আমি শুধু তার বিশ্বাসের পটভূমিটির প্রতি ইঙ্গিত করছি; তার মতো আরও বহু বিশ্বাসী যে পূর্ববর্তী যুগেও ছিলেন তারই প্রতি ইঙ্গিত করছি।

তা সে যাই হোক, এইসব ইহুদিদের এক জায়গায় জড় করতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি— ছারপোকাতে-ইহুদিতে ওইখানেই তফাৎ, ছারপোকা এক জায়গায় জড় করতে পারলে তো আর্ধেক মুশকিল আসান! গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে ইহুদি মুরুব্বিদের বলা হত, তাবৎ ইহুদি পরিবার যেন এক বিশেষ জায়গায় জড় হয়। তাদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কলোনি পত্তন করা হবে। তার পর ট্রেনে-মোটরে করে কন্‌সেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তাদের দিয়েই একটা লম্বা নালা খোঁড়ানো হত। তার পর আদেশ হত, নালার প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াও। একদল এস এস (ব্ল্যাক শার্ট–হিটলারের খাস সেনাবাহিনী) পিছন-থেকে গুলি করত। অধিকাংশ ইহুদি গুলির ধাক্কায় সামনের নালাতে পড়ে যেত। বাকিদের লাথি মেরে মেরে ঠেলে ঠেলে নালাতে ফেলা হত। সবাই যে সঙ্গে সঙ্গে মরে যেত তা নয়– সবসময় তাগ অব্যর্থ হয় না। এদের কেউ কেউ নালা থেকে হাত তুলে বোঝাবার চেষ্টা করত তারা মরেনি–উদ্ধার লাভের জন্য চিৎকারও শোনা যেত। ওদিকে দৃপাত না করে তাদের উপর নালার মাটি ফের নালাতে ফেলা হত এবং সর্বশেষে তার উপর স্টিমরোলার চালিয়ে দিয়ে মাটিটা সমতল করা হত।

নালা খোঁড়া, তার উপর ফের মাটি ফেলা এ-সব কাজের জন্য ইহুদিই জোগাড় করার জন্য কোনও বেগ পেতে হয়নি। একদল ইহুদিকে এই নিধনকর্মটি দাঁড় করিয়ে দেখানোর পর বলা হত তারা যদি গুলি করা ছাড়া অন্য সর্ব কার্যে, সহায়তা করে তবে তারা নিষ্কৃতি পাবে।… বলাই বাহুল্য এরা নিষ্কৃতি পায়নি। আখেরে ওরা ওই একই পদ্ধতিতে প্রাণ হারায়– সাক্ষীকে ছেড়ে দেওয়া কোনও স্থলেই নিরাপদ নয়।

এইসব নিহতজনের অধিকাংশই বুড়োবুড়ি, ছেলেমেয়ে, কোলের শিশু এবং রুগ্‌ণ অসমর্থ যুবক-যুবতী। সমর্থদের বন্দিদশায় একাধিক বড় বড় কারখানায় বেগার খাটার জন্য নিয়ে যাওয়া হত। আখেরে, অর্থাৎ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে, যুদ্ধশেষের কিছুদিন পূর্বে এদেরও মেরে ফেলা হয়। যুদ্ধপূর্ব জর্মনিতে ছিল ৫,৫০,০০০ ইহুদি, যুদ্ধশেষে রইল ৩০,০০০। পোলান্ডের সংখ্যা বীভৎসতর; যুদ্ধপূর্বে সেখানে ছিল তেত্রিশ লক্ষ, যুদ্ধশেষে মাত্র ত্রিশ হাজার। এবং আশ্চর্য এই, ত্রিশ হাজারের চোদ্দআনা পরিমাণ লোক আপন দেশ ছেড়ে পুণ্যভূমি ইহুদি স্বর্গ ইজরাএলে যেতে রাজি হয়নি। অনেকেই বলে, জর্মনি আমার পিতৃভূমি (ফাটেলান্ট), এদেশ ছেড়ে আমি যাব কেন? যে পিতৃভূমিতে সে তার অধিকাংশ আত্মজন হারাল তার প্রতি এই প্রেম প্রশংসনীয় না কাণ্ডজ্ঞানহীন একগুঁয়েমির চুড়ান্ত– জানেন শুধু সৃষ্টিকর্তা!

আমি বর্ণনাটা সংক্ষেপে সারলুম, কারণ ইহুদি নিধনের এটা অবতরণিকা মাত্র চলি চলি পা পা মাত্র। যেমন এস এস-দের নিধনকর্মে অভিজ্ঞতা বাড়তে লাগল, হননকর্ম তেমন তেমন সূক্ষ্মতর, বিদগ্ধতর ও ব্যাপকতর হতে লাগল।

ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্পের অধিকর্তা, যারা গুলি মারার আদেশ দিতেন তাদের কয়েকজন যুদ্ধশেষে ধরা পড়েন। তাঁদের একজন ওলেন। মিত্রশক্তি কর্তৃক জর্মনির নরবের্গ শহরে সাক্ষ্যদানকালীন ওলেনডর আসামিপক্ষের উকিল আমেনের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমি এই পদ্ধতির সমর্থন করিনি।

উকিল আমেন : কেন?

ওলেনডরফ : এ পদ্ধতিতে নিহত ইহুদি এবং যারা গুলি ছুড়ত উভয় পক্ষেরই মাত্রাহীন অসহ মানসিক যন্ত্রণা বোধ হত। ইহুদিদের প্রতি কসাই ওলেনডফের এই দরদ অভিনব, বিচিত্র। এই কুম্ভীরাশ্রুর একমাত্র কারণ তিনি তখন নিজেকে ফাঁসিকাঠ থেকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা দিচ্ছেন।

কিন্তু এ-কথা সম্পূর্ণ সত্য, যে-সব এস এস সৈন্য গুলি ছুড়ত তাদের অনেকেই এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার ফলে হঠাৎ সাতিশয় মনমরা হয়ে যেত, মদ্যমৈথুন ত্যাগ করত, অবসর সময়ে সঙ্গীসাথী বর্জন করে এককোণে বসে বসে শুধু চিন্তা করত। হিটলারের আদেশে তাদের গুলি ছুঁড়তে হবে– এ-কথা তাদের স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে। কাজেই তার আদেশ লঙ্ঘনের কোনও প্রশ্নই ওঠে না–বছরের পর বছর তারা ট্রেড় হয়েছে বশ্যতা মন্ত্রে– অবিডিয়েনস্ এবাভ অল– ফুরারের আদেশে কোনও ভুল থাকতে পারে না, আপ্তবাক্যের ন্যায় তাঁর আদেশ অভ্রান্ত, ধ্রুব সত্য।

কিন্তু ওই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটাও তো নির্মম সত্য!

হাল বয়ান করে হিমলার-যমকে জানানো হল। ইস্পাতের তৈরি সাক্ষাৎ যমদূত-পারা কুচিৎ এস এস-এর নার্ভাস ব্রেক-ডাউনের খবর পেয়ে তিনি উম্মা প্রকাশ করেছিলেন কি না সে খবর জানা নেই। তবে একটা কেলেঙ্কারির খবর অনেকেই জানত; ইহুদি নিধনযজ্ঞের গোড়ার দিকে হিমলারের একবার কৌতূহল হয়, ম্যাস-মারডার– পাইকারি কচুকাটা দেখার। একশো জন ইহুদি নারী-পুরুষকে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি চালানো হল। সে দৃশ্য দেখে স্বয়ং শ্রীমান হিমলার ভিরমি যাচ্ছিলেন। সঙ্গীরা তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল! স্বয়ং যম যদি মৃত্যু দেখে চোখে-মুখে পাঙাস মারেন তবে বালখিল্য যমদূতেরাকোজ্জাবে মা? এবং আশ্চর্য স্বয়ং হিটলারও চোখের সামনে রক্তপাত সহ্য করতে পারতেন না। এবং প্রাণীহত্যা আদৌ বরদাস্ত করতে পারতেন না বলে তিনি ছিলেন কড়া নিরামিষভোজী। মাংসাশীদের বলতেন শবাহারী।

হিমলারের আদেশে দু খানা বিরাট মোটর ট্রাক তৈরি করা হল। দেখতে এমনি সাধারণ ট্রাকের মতো, তবে চতুর্দিক থেকে টাইট ঢাকা এবং বন্ধ। শুধু বাইরের থেকে একটা পাইপ ভিতরে চলে গেছে। মোটর চালানোমাত্র বিষাক্ত গ্যাস ভিতরে যেতে থাকে, এবং দশ-পনেরো মিনিটের ভেতর অবধারিত মৃত্যু। ততক্ষণ অবধি ভেতর থেকে চাপা চিৎকার আর দরজার উপর ধাক্কা আর ঘুষির শব্দ শোনা যেত। প্রাচীন পাপী ওলেনডর্ফকে আদালতে শুনো হল, ওদের তোমরা ট্রাকে তুলতে কী করে?

ওয়েলডরফ : ওদের বলা হত তোমাদের অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

কিন্তু এ পন্থাতেও এস এস-দের কেউ কেউ সেই প্রাচীন চিত্তাবসাদে ভুগতে লাগল। ট্রাক থেকে বের করার সময় দেখা যেত মৃতদের মুখ বীভৎসরূপে বিকৃত। গাড়িময় রক্ত মলমূত্র। একে অন্যের শরীরে জামা-কাপড়ে পর্যন্ত। একে অন্যকে এমনই জড়িয়ে ধরে আছে যে লোহার আঁকশি আর ফাঁস দিয়ে ছাড়াতে শরীর ঘেমে উঠত, মুখ চকের মতো ফ্যাকাসে হয়ে যেত, মগজে ভূতের নৃত্য আর চিন্তাধারায় বিভীষিকা।

অকল্পনীয় এই খুনে গাড়ি দুটোর অভাবনীয় মৌলিক আবিষ্কারক ডক্টর বেকারকে জানানো হল। আসলে ইনি এস এস-দের চিকিৎসক (এবং স্বয়ং এস এস)। ইনি কিন্তু আমাদের সেই স্ত্রীহন্তা ডাক্তারের মতো নন। তিনি একমেবা করেই প্রসন্ন। ইতি ভূমার সন্ধানে আবিষ্কারক হয়ে গিয়েছিলেন।

ঈষৎ বিরক্তির সুরে তিনি লিখলেন, আমি যে ব্যবহার পদ্ধতি লিখে দিয়েছিলুম (ঠিক যেভাবে তিনি ওষুধের প্রেসক্রিপশনে সেবন পদ্ধতি; ডাইরেকশন ফর ইউজ লিখে থাকেন!) সেভাবে কাজ করা হয়নি। অপ্রিয় কর্ম তড়িঘড়ি শেষ করার জন্য গ্যাসযন্ত্র পরিচালক গ্যাস ছাড়ার হ্যাঁন্ডিলটা একধাক্কায় সর্বশেষ ধাপে নিয়ে যায়; ফলে ইহুদিরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। হ্যাঁন্ডিল ধীরে ধীরে চালালে এরা আস্তে আস্তে আপন অলক্ষে মৃদুমধুর নিদ্রায় প্রথম ঘুমিয়ে পড়ে, শেষনিদ্রা আস্তে আস্তে এবং এতে করে আরও কম। সময়ে এদের মৃত্যু হয়। দরজায় ঘুষি, মলমূত্র ত্যাগ, বিকৃত মুখভঙ্গি, একে-অন্যে মোক্ষম জড়াজড়ি– এসব কোনও উৎপাতই হয় না।

অত্যুত্তম প্রস্তাব। কিন্তু তা হলেও তো বিরাট সমস্যার সমাধান কণা পরিমাণও হয় না। কারণ ফি ট্রাকে মাত্র পনেরো থেকে পঁচিশ জন প্রাণী লাদাই করা যায়। এদিকে হিটলার যে বিরাট সংখ্যার দিকে ঊর্ধ্বনেত্রে তাকিয়ে আছেন, এসব গাড়ি গণ্ডায় গণ্ডায় বানিয়েও তো সেখানে পৌঁছনো যাবে না। ওই সময়েই রাশার কিয়েফ শহরের কাছে প্রায় চৌত্রিশ হাজার প্রাণীকে এদের অধিকাংশই ইহুদি-মাত্র দু দিনের ভেতর খতম করার হুকুম এল, জর্মন কর্মতৎপরতা সে কর্ম সম্পূর্ণ করলও বটে। গ্যাসভ্যান দিয়ে এত লোক অল্পসময়ে নিশ্চিহ্ন করা যেত না।

হিটলার-হিমলারের আদেশে জর্মনির ভিতরে-বাইরে বিশেষ করে পোলানডে অনেকগুলো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পূ (কক) নির্মাণ করা হয়। সর্ব-বৃহৎ ছিল আউশভিৎস্-এ। তার বড়কর্তা ছিলেন শ্রীযুক্ত হয়ে। হিমলার তাকে ডেকে বললেন, ফুরার (হিটলার) হুকুম দিয়েছেন, ইহুদিদের খতম করতে হবে, প্রথমত খুব তাড়াতাড়ি, দ্বিতীয়ত গোপনতম গোপনে। কী পরিমাণ ইহুদিকে খতম করতে হবে মোটামুটি হিসাব হিমলার দিলেন। ইউরোপে তখন এক কোটি ইহুদি; অবশ্য বহু জায়গা হিটলারের তাবেতে নয় বলে অসংখ্য ইহুদিকে পাকড়াও করা যাবে না।

ইতোমধ্যে ছোটখাটো দু-চারটি ক ক-তে ইহুদি সমস্যার খানিকটে সমাধান হয়ে গিয়েছে। মাঝারি রকমের একটা নিরন্ধ্র হলঘরে ইহুদিদের চাবুক মেরে মেরে ঢোকানো হয়। দরজা বন্ধ করে ছেড়ে দেওয়া হয় মনো-অক্সাইড গ্যাস। আধঘণ্টার ভেতর এদের মৃত্যু হয়। কিন্তু এসব জায়গায় ছ মাসে আশি হাজারের বেশি প্রাণী নিশ্চিহ্ন করা যায় না। তা হলে তো হল না।

হয়েস খাঁটি জর্মনদের মতো পাকা লোক। কাজ আরম্ভ করার পূর্বে সব কটা ক ক দেখে নিলেন। (যুদ্ধশেষে হয়ে এক চাষাবাড়িতে আশ্রয় নেন; সেখানে ধরা পড়েন। নরবে শহরে গ্যোরিঙ, হেস, রিবেট্রপ ইত্যাদির বিরুদ্ধে যখন মিত্রশক্তি মোকদ্দমা চালাচ্ছেন তখন হয়ে সাক্ষীরূপে যা বলেন তার নির্গলিতাৰ্থ-)

আমি ক ক-গুলো পরিদর্শন করে আদপেই সন্তুষ্ট হতে পারলুম না। প্রথমত মনো-অক্সাইড গ্যাস যথেষ্ট তেজদার গ্যাস নয়, দ্বিতীয় চাবুক মেরে মেরে গ্যাস-ঘরে লোক ঢোকাতে হলে বিস্তর লোকের প্রয়োজন, তৃতীয় সেই প্রাচীন সমস্যা– লাশগুলোর সর্বোত্তম ব্যবস্থা কী হতে পারে?

কারণ ইতোমধ্যে দেখা গেল, গ্যাস-ভর্তি লাশ পুঁতলে তারই ঠেলায় গোরের উপরের মাটি ফুলে ওঠে কয়েকদিন অপেক্ষা করে তবে স্টিমরোলার চালানো যায়। তদুপরি লক্ষ লক্ষ লাশের বেশাতি! অতখানি জায়গা কোথায়? আউশভিৎস জায়গাটি ছিল নিকটতম গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে, নির্জনে এবং কাছেপিঠে লোক চলাচলের কোনও সদর রাস্তাও তার গা-ঘেঁষে যায়নি। তবু কেউ সেদিক দিয়ে যাবার সময় সেই বিরাট প্রতিষ্ঠানের দেউড়ির উপরের দিকে তাকালে দেখতে পেত লেখা রয়েছে স্নান প্রতিষ্ঠান, গেট দিয়ে দেখতে পেত, প্রতিষ্ঠানের প্রবেশপথের দু পাশে কাতারে কাতারে শৌখিন মরসুমি ফুলের কেয়ারি। দূর থেকে নৃত্যসম্বলিত হালকা গানের কনসারট সঙ্গীত ভেসে আসছে। কে বলবে সেখানে পৃথিবীর অভূতপূর্ব বিরাটতম নর-নিধনালয়!

মেন রেললাইন থেকে একটা সাইড লাইন করিয়ে নিলেন হের হয়ে তাঁর ক ক পর্যন্ত। যেদিন যে সংখ্যার নরনারী শেষ করা সম্ভব সেই সংখ্যার ইহুদি গরুভেড়ার মালগাড়ির ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয়েছে পোল্যান্ড থেকে, হাঙ্গেরি থেকে, সুদূর রুশ থেকে। এদের খেতে দেওয়া হয়নি; ট্রাকে পানীয় জলের, শৌচের ব্যবস্থা নেই। ট্রাক খোলা হলে দেখা যেত শতকরা আট থেকে দশ-জনা– বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে মরে আড়ষ্ট হয়ে আছে। শীতকালে শুধু জমে গিয়েই এর সংখ্যা দেড়া হয়ে যেত।

এদের নামানো হত রেলকর্মচারীদের বিদেয় দেওয়ার পর।

ইহুদিদের বলা হয়েছে, এখানে এদের বিশেষ ওষুধ মাখানো জলে স্নান করিয়ে গা থেকে উকুন সরানো হবে (ডিলাউজিং)। তারাও দেউড়িতে দেখতে পেত লেখা রয়েছে স্নান প্রতিষ্ঠান। ফুলের কেয়ারি, ঘনসবুজ লন, আর আবহাওয়া উত্তম হলে সেই লনের উপর বসেছে সুবেশী তরুণীদের কনসারট। চটুল নৃত্য-সঙ্গীত শুনতে শুনতে তারা এগুতে রেসেপসনিস্ট-এর কাছে। ইতোমধ্যে দু জন এস এস ডাক্তার ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কারা কর্মক্ষম আর কারা যাবে গ্যাস চেম্বারে। শতকরা পঁচিশ জনের মতো কর্মক্ষম যুবক-যুবতীকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হত অন্যদিকে। যুবতী মা-দের কেউ কেউ আপন শিশু হতে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না বলে আপন স্কার্টের ভেতর লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করত কিন্তু হয়ে বলেছেন, এস এস-দের তারা ফাঁকি দিতে পারত না। এদিকে যারা গ্যাস চেম্বারে যাবে তাদের বলা হয়েছে তাদের টাকাকড়ি, গয়না, ঘড়ি, মণিজওহর– মূল্যবান যাবতীয় বস্তু আলাদা আলাদা করে রাখতে, যাতে করে স্নানের শেষে যে যার মূল্যবান জিনিস ঠিক ঠিক ফিরে পায় (দেশ থেকে এদের নিয়ে আসার সময় তাদের বলা হয়েছে, তারা ভিন দেশে নতুন, কলোনি (দণ্ডকারণ্য?) গড়ে তুলবে; আপন দেশে ফিরবার কোনও সম্ভাবনা নেই, তাই–হীরাজওহর টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়ে যেতে)। ওদিকে কনসারটে পলকা নৃত্যসঙ্গীত বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। তামাশাটা পরিপূর্ণ করার জন্য কোনও কোনও দিন এদের ভেতর আবার স্থানীয় নৈসর্গিক দৃশ্যের পিকচার পোস্ট কারড় দেওয়া হত– আত্মীয়স্বজনকে পাঠাবার জন্য, তাতে ছাপা রয়েছে আমরা মোকামে পৌচেছি এবং চাকরি পেয়েছি; এখানে খুব ভালো আছি; তোমাদের প্রতীক্ষা করছি। ইতোমধ্যে কয়েকজন অফিসার হন্তদন্ত হয়ে বলতেন, একটু তাড়াতাড়ি করুন; নইলে পরের ব্যাচকে খামখা বসে থাকতে হবে যে! তার পরই সবাই সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় গিয়ে ঢুকত সেই গ্যাস চেম্বারে।

হয়েস বলছেন, ব্যাপারটা যে কী কখনই কেউই বুঝতে পারত না তা নয়। তখন ধুন্ধুমার, প্রায় বিদ্রোহের মতো লেগে যেত। তখন অন্যান্য ছোটখাটো ক ক-তে যে-রকম বেধড়ক চাবুক মেরে মেরে ঢোকানো হয় তাই করা হত।

একটা হল-এ প্রায় দু হাজারের মতো লোক ঠাসা যেত।

এত লোককে একসঙ্গে শাওয়ার বাথে ঢোকানো হয় তাই দেখে অন্তত তখন, অনেকেরই মনে ভীষণ সন্দেহ জাগত। কিন্তু ততক্ষণে টু লেট। ফ্রিজিডেরের দরজার মতো নিরন্ধ্র বিরাট দু পাট দরজা তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেয়ালের কাছে যারা দাঁড়িয়েছে তারা শাওয়ারের চাবি খুলে দেখে জল আসছে না।… এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আসতে লাগল অন্য জিনিস… দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর লন-এ উপস্থিত একজনের দিকে ইশারা দেওয়া হত। সঙ্গে সঙ্গে সেই এস এস সেখানে একটা পাইপ খুলে ছেড়ে দিত এক টুকরো নিরেট ক্রিসটেলাইজড সাইক্লন বি গ্যাস।৬ এই বস্তুটি অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসামাত্রই মারাত্মকভাবে গ্যাসে পরিবর্তিত হয়ে পাইপের ভেতর দিয়ে উন্মুক্ত শাওয়ারের ছিদ্র দিয়ে বেরুতে থাকত। এক নিশ্বাস নেওয়া মাত্রই মানুষ ক্লরফরম্ নেওয়ার মতো সংজ্ঞা হারায়। যাদের নাকে তখনও গ্যাস ঢোকেনি তারা তখন চিৎকার আর ধাক্কাধাক্কি করত বন্ধ দরজার দিকে এগোবার জন্য আর যারা দরজার কাছে, তারা আপ্রাণ ঘুষি মারত বন্ধ দরজার উপর। সেই মৃত্যুভয়ে ভীত প্রাণাতঙ্কে উন্মত্ত জনতা দরজার দিকে ঠেলে ঠেলে সেখানে মনুষ্য-পিরামিডের আকার ধারণ করত।

মোক্ষম পুরু কাঁচের ছোট একটি গবাক্ষের ভেতর দিয়ে করুণাসাগর এস এস্-রা (তিন থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যেই সব শেষ– আবহাওয়া ও মৃত্যোৎসর্গিত প্রাণীর ওপর নির্ভর করত সময়ের তারতম্য।) যখন দেখত অচৈতন্য শরীরগুলো আর থেকে থেকে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছে না, তখন ইলেকট্রিক পাম্প দিয়ে ভেতরকার গ্যাস শুষে নেওয়া হত। বিরাট দরজা খোলা হত।

গ্যাস ম্যাসক্ (ছিদ্রহীন মুখোশ), রবারের হাঁটু-ছোঁয়া বুট পায়ে পরে হাতে হৌস-পাইপ নিয়ে ঢুকত একদল ইহুদি পূর্বেই বলেছি এদের লোভ দেখানো হয়েছে, প্রয়োজনীয় কাজ করে দিলে এদের মুক্তি দেওয়া হবে।

দরজা খোলামাত্র লাশের পিরামিড, এমনকি যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরেছে তারাও, মাটিতে পড়ে যেত না। একে অন্যকে তখনও তারা জাবড়ে আঁকড়ে ধরে আছে। নাকমুখ দিয়ে বেরোনো রক্ত, ঋতুস্রাবের রক্ত, মলমূত্র সব লাশ ছেয়ে আছে, মেঝেতেও তাই। ইহুদিদের প্রথম কাজ হত হৌস দিয়ে সব কিছু সাফসুৎরো করা। তার পর আঁকশি আর ফাঁস দিয়ে মৃতদেহগুলো পৃথক করা। এর পর লাশগুলোর হাত থেকে আংটি সরানো হত, ডেনটিসট্রা এসে সাঁড়াশি দিয়ে মুখ খুলে সোনার, সোনা বাঁধানো দাঁত– দরকার হলে হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে বের করে নিত। মেয়েদের মাথার চুল দু-চারবার কাঁচি চালিয়ে কেটে নিয়ে বস্তায় পোরা হত– পরে কৌচসোফা এই দিয়ে তুলতুলে করা হবে এবং যুদ্ধের অন্যান্য কাজে লাগবে। সর্বশেষ ইহুদি জমাদাররা স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের গোপনস্থলে পরীক্ষা করে দেখে নিত হীরকজাতীয় মহা মূল্যবান কোনও বস্তু লুকোনো আছে কি না।

ন্যুরনবের্গ মোকদ্দমায় বলা হয় যে, কোনও কোনও ক ক-তে লাশের চর্বি ছাড়ানো হত সাবান ইত্যাদি তৈরি করার জন্য, এবং কোনও এক বিশেষ ক কর প্রধান কর্মচারীর শৌখিন পত্নী মানুষের চামড়া দিয়ে ল্যাম্পশেড় তৈরি করাতেন। কিন্তু এগুলো সপ্রমাণ হয়নি। অধমের নিবেদন, অনাহারে অত্যাচারে রোগব্যাধি তথা অসহ মানসিক ক্লেশে ইহুদিদের দেহে তখন যেটুকু চর্বি অবশিষ্ট ছিল, তা দিয়ে একটি কবরেজি বড়িও হয় না।

মণিমাণিক্য অলঙ্কারাদি জর্মন স্টেট ব্যাংকে পাঠানো হত। এ পদ্ধতিতে স্টেট ব্যাংক কী পরিমাণ মাল পেয়েছিলেন তার হিসাব যুদ্ধশেষে নির্ধারিত করা যায়নি। তবে ব্যাংক বেশিরভাগ বিক্রি করে দেওয়ার পরও যা পাওয়া গিয়েছিল তাই দিয়ে যুদ্ধশেষে মার্কিনরা তিনটে বিরাট ভলট কাঁঠাল-বোঝাই করেছিল। এবং একখানা চিঠি থেকে কী পরিমাণ মাল জোগাড় করা হয়েছিল তার কিছুটা হদিস মেলে। স্টেট ব্যাংক সরকারি লগ্নী প্রতিষ্ঠানকে সে চিঠিতে লেখেন, এই দুসরা কিস্তিতে আমরা যা পাঠাচ্ছি তার মধ্যে আছে, ১৫৪ সোনার পকেট-ঘড়ি, ১৬০১ সোনার ইয়ারিং, ১৩২ ডায়মন্ড আংটি, ৭৮৪ রুপোর পকেটঘডি, ১৬০ বিশুদ্ধ ও মিশ্রিত সোনার দাঁত, ইত্যাদি ইত্যাদি অতি দীর্ঘ সে ফিরিস্তি। চিঠি লেখা হয় ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪২-এ। বরং ইহুদিনিধন চালু ছিল ফুল (গ্যাস) স্টিমে ১৯৪৪-এর শেষ পর্যন্ত এবং তার পর মন্দাগতিতে। মার্কিনরা এখনও তাই ঠিক ঠিক মোট-জমা প্রকাশ করতে পারেননি।

কিন্তু এসব জিনিস থাক। যে জিনিসটা জনৈক মার্কিন অফিসারকে অত্যন্ত বিচলিত করেছিল (এবং আমাকেও করেছে) সেটা নিবেদন করার পূর্বে বলি, এই অফিসারটি রীতিমতো হারড় বয়েল্ড ঝাণ্ড– বিস্তর লড়াই লড়েছেন, বীভৎস সব বহু বহু দৃশ্য দেখেছেন, গণ্ডায় গণ্ডায় গুপ্তচরকে তাঁর সামনে তার আদেশে গুলি করে মারা হয়েছে (যুদ্ধের সময় গুপ্তচর নিধন আন্তর্জাতিক আইনে বাধে না); সে-সবের ঠাণ্ডামাথা হিমশীতল বর্ণনা পড়ে মনে হয়, এসব ক্ষেত্রে ভদ্রলোকের নেকটাইটি পর্যন্ত এক মিলিমিটার এদিক-ওদিক হয়নি কিন্তু তার ওয়াটারলু এল যুদ্ধের পর, আউশভিৎস দেখতে গিয়ে, টুরিস্ট রূপে (এখনও এটি সে অবস্থাতেই রাখা আছে– পাঠক নেকট ট্রিপে সেটা দেখে নেবেন। আমি হিম্মৎ করতে পারিনি)। মার্কিন অফিসার গ্যাস চেম্বার, পোড়াবার জায়গা, বন্ধ চুল্লি, খোলা চুল্লি সব– সব দেখলেন। সর্বশেষে গাইড নিয়ে গেল একটা গুদামঘরে, সেখানে নিহত ইহুদিদের অপেক্ষাকৃত কমদামি জামা-কাপড়, জুতো-মোজা সারে সারে সাজানো ছিল।

তারই এক অংশে তিনি দেখতে পেলেন চল্লিশ হাজার জোড়া জুতো। ক্ষুদে ক্ষুদে। নিতান্ত কাঁচা-কচি শিশুদের।

.

এবারে আমরা যে প্রসঙ্গ নিয়ে এ নিবন্ধ আরম্ভ করেছি সেখানে ফিরে যাই।

মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ড. গিলবারট আউশভিৎস ক্যাম্পের কর্তা হয়েকে আশ্চর্য হয়ে শুধোন, এত অসংখ্য লোককে তোমরা মারতে কী করে? হয়ে বাধা দিয়ে শান্তকণ্ঠে বললেন, আপনি তাবৎ জিনিসটাকে ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। মারাটা তো সহজ। মিনিট পনেরো লাগে কি না লাগে, দু হাজার লোককে মেরে ফেলতে (হয়ে বোধকরি জানতেন না যুদ্ধের শেষের দিকে এক জর্মন ডাক্তার চমৎকার একটি ইনজেকশন বের করেন, এবং মোদ্দা কথা তার দাম ফিনলের চেয়েও কম, ঘাড়ের কাছে সে ইনজেকশন আনাড়িতেও দিতে পারে, শিকার খতম হয় মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভেতর)। কিন্তু আসল সমস্যা, লাশগুলো নিশ্চিহ্ন করা যায় কী করে। বিরাট বিরাট চুল্লি তৈরি করে এবং সেগুলো চব্বিশ ঘণ্টা চালু রেখেও আমরা ওই সময়ের ভেতর দশ হাজারের বেশি লাশ নিশ্চিহ্ন করতে পারতুম না। মনে রাখতে হবে চুল্লি থেকে মাঝে মাঝে হাড় আর ছাই বের করতে হত। হাড়গুলো মেশিনে গুঁড়ো করে ছাইসুদ্ধ পাশের নদীতে ফেলে দেওয়া হত (শুনেছি তো হাড়ের গুঁড়ো আর ছাই উত্তম সার– তবে জর্মনরা এটা বরবাদ করত কেন?– যেস্থলে চুল পর্যন্ত কাজে লাগানো হচ্ছে– লেখক) মোটামুটি বলতে গেলে আমরা আউশভিৎসে ২৭ মাসে ২৪,৩০,০০০ (প্রায় সাড়ে চব্বিশ লক্ষ) লোক মেরেছি।

আইষমান গর্ব করে বলেছিলেন, সব কটা ক ক-তে মিলে সবসুদ্ধ পঞ্চাশ লক্ষ প্রাণী খতম করা হয়। হয়ে স্বীকার করেছেন, শত চেষ্টা সত্ত্বেও লাশ নিশ্চিহ্ন করার কাজটা গোপন রাখা যায়নি। অর্থাৎ গ্যাস চেম্বারের নিধনকর্মটি গোপন রাখা যায় কিন্তু মাটিতেই পেতো আর পুড়িয়েই ফেল– সেটা কিন্তু গোপন রাখা যায় না। লাশ-পোড়ানোর তীব্র উৎকট গন্ধ, আর চিমনির চোঙা থেকে যে ধুয়ো বেরুচ্ছে তার ছাই ছড়িয়ে পড়ত কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত চতুর্দিকের গ্রামে। তারা বুঝে যেত ওই নিরীহ স্নান-প্রতিষ্ঠান কোন বিশ্বপ্রেমের খয়রাতি রাজকার্যে লিপ্ত আছেন এবং শুধু সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করত বাতাস যেন তাদের আপন বসগ্রামের দিকে না যায়! এটা কিছু নতুন নয়। যুদ্ধের গোড়াতেই এই নিধনযজ্ঞ হিটলার আরম্ভ করেন জর্মনির পাগলাগারদগুলো দিয়ে পাগলদের ভেতর অবশ্য কিছু ইহুদিও ছিল, কিন্তু অধিকাংশই খাঁটি জর্মন। নামকা ওয়াস্তে একটা কমিশন বসল– এতে অল্পসংখ্যক পাগল রেহাই পেল, যদি আদৌ কেউ পেয়ে থাকে, যে সেটার কোনও উল্লেখ পর্যন্ত নেই– এবং পাগলদের কতকগুলো কেন্দ্রে জড় করে গ্যাস মারফত মেরে ফেলে পুড়িয়ে দেওয়া হল। এটা স্রেফ খুন। জর্মন আইনে নিকটতম তিনজন আত্মীয়ের অনুমতি ভিন্ন পাগলকে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে সরানো পর্যন্ত যায় না– নিধন করার (যাকে ভদ্রভাষায় বলা হয় মারসি কিলিং= অন্তত যন্ত্রণা থেকে রেহাই দেবার জন্য দয়াবশত কাউকে হত্যা করা, কিংবা অনারোগ্য ক্যানসারের অসহ্য যন্ত্রণায় রুগী যখন বিষ খেতে চায় তাকে বিষ এনে দেওয়া। ডাক্তারি আইনে একে বলা হয়– Euthanasia, গ্রিক সমাস) তো কোনও কথাই ওঠে না। পাগলদের মেরে পুড়িয়ে ফেলার প্রধান কেন্দ্র ছিল হাডামার নামক গ্রামে। তারই পাশে লিম্বুর শহর। সেখানকার বিশপ জর্মনির আইনমন্ত্রীকে একখানা চিঠিতে জানান, স্কুলের ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত সেই বন্ধ বাসগুলো চেনে, যার ভিতরে করে পাগলদের হাডামারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এর কোনও একটাকে দেখলেই ছেলেরা বলে ওঠে– ওই যাচ্ছে খুনের বাস= মারডার বক্স। তাচ্ছিল্যভরে কথায় একে অন্যকে বলে ক্ষেপলি নাকি?– যাবি নাকি হাডামারের বেকিং বসে (যাতে কেক বানানো হয়; এস্থলে লাশ পোড়াবার চুল্লি?) হাডামারের চিমনি ছাড়ে ধুয়ো আর সেখানকার অধিবাসীরা are tortured with the ever-present thought of depending on the direction of the wind. 099 কথা সত্য এ-সব খুন-খারাবি, লাশ পোড়ানোর খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। যারা জানত, তারা জানত। অন্য কাউকে বলতে গিয়ে কেউ গেস্তাপোর (গোপন পুলিশ–এদের প্রধানতম কর্ম ছিল রাজনৈতিক, অনেকটা রুশের ওগপুর মতো– এদের কাহিনী ক ক-র চেয়েও বীভৎসতর) হাতে ধরা পড়লে প্রথমে তার ওপর কল্পনাতীত নানা অত্যাচার এবং এতেও যদি সে না মরে তবে সর্বশেষে তাকে কোনও একটা ক ক-তে সমর্পণ এবং সেখানে গ্যাস-চেম্বারে মৃত্যু। কাজেই হাডামার বা ক ক-গুলোতে কী হচ্ছে সে সম্বন্ধে মুখ খুলে কেউ রা-টি কাড়ত না! তাই ওই আমলে একটা চুটকিলা রসিকতা সৃষ্ট হয়–

তুই নাকি, ভাই, ডেনটিসটরি পড়া ছেড়ে দিয়েছিস?

বাধ্য হয়ে ছাড়তে হল। কেউ যে মুখ খুলতে রাজি হয় না।

লিমবুরগ-এর বিশপের চিঠি পেয়ে আইনমন্ত্রী হিটলারের আপন আইন উপদেষ্টার কাছে এ বাবদে অনুসন্ধান করলেন। আইন-উপদেষ্টা হিটলারের সেই চিঠি দেখালেন। আইনমন্ত্রী বললেন, এটা তো তাঁর নির্দেশ। এটা তো আইন নয়। আপনারা তা হলে এটাকে আইনের রূপ দিন, সেটাকে তার পর দেশে প্রবর্তিত করুন।…তা হলেই তো চিত্তির! কারণ, জর্মন পার্লিমেন্ট আইন করার সক্ষমতা সর্ব অধিকার হিটলারকে দিয়েছিল বটে, কিন্তু আইন মাত্রই সরকারি গেজেটে প্রকাশ করতে হয়। তার পর এক বছর কেটে গেল, আইনমন্ত্রী কোনও উত্তর পেলেন না। ইতোমধ্যে দেশের সব পাগল খতম। সমস্যাটার সুচারু সমাধান হয়ে গেল আপসে আপ। কোনও কোনও দেশে যেরকম দুর্ভিক্ষের সমস্যা আপৃসে আপ সমাধান হয়ে যায় কয়েক লক্ষ লোক না খেয়ে মরে যাওয়ার পর।

লাখ তিরিশ বা পঞ্চাশেক ইহুদিকে যে ওপারে পাঠানো হল তার জন্যও কোনও আইন বিধিবদ্ধভাবে তৈরি করা হয়নি। কিন্তু সে মামলা নিয়ে কখনও কোনও লেখালেখি হয়নি,– ফরিয়াদ করবে কে?– হলেও সেটা লোকচক্ষুগোচর হয়নি। পবিত্র পিতা পোপের কাছে কোনও নিধনই অজানা ছিল না। তিনি থেকে থেকে বিশ্বজন তথা সুস্পষ্ট ইঙ্গিতে হিটলারের কাছে এপিল করতেন ক্রিসটিয়ান চ্যারিটি দেখবার জন্য। এর বেশি তিনি কিছু করে উঠতে পারেননি। (৭)

হিটলার ক ক-তে কত লক্ষ ইহুদি, রুশ, বেদে ইত্যাদিকে নিহত করেন সেই সংখ্যা নিয়ে যখন নরবের্গ মোকদ্দমায় তুমুল তর্কাতর্কি হচ্ছে তখন আসামিদের একজন ছিলেন ফ্রান্। (এরই আদেশে অসংখ্য ইহুদিকে আইষমানের হাতে সমর্পণ করা হয় এবং বিচারে এঁর ফাঁসি হয়। ওই বিচারে উনিই একমাত্র আসামি যিনি নিজেকে দোষী বলে স্বীকার করেন)। সেই তর্কাতর্কির ভেতর আসামিদের কাঠগড়ার পিছনে যে মার্কিন সান্ত্রি দাঁড়িয়ে ছিল সে শুনতে পেল (যে সব মার্কিন জোয়ান উত্তম জর্মন জানত তাদেরই এ কাজে নিয়োজিত করা হত এবং এরা ভাবখানা করত যেন জর্মন বিলকুল বোঝে না– ফলে আসামিরা নিজেদের ভিতরে এমন সব কথা বলে ফেলত যেগুলো সান্ত্রিরা ফরিয়াদি পক্ষের মার্কিন উকিলকে জানিয়ে দিত। আমার মনে হয় এটা অত্যন্ত বে-আইনি ব্যাপার। কিন্তু মার্কিন আইনকানুন যেন শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইনকানুন সর্বনেশে ॥) ফ্রানু ফিসফিস করে তাঁর সহআসামি হিটলারের অন্যতম মন্ত্রী রোজেনবেরককে বলেছেন, এরা—-অর্থাৎ মার্কিনিংরেজসহ মিত্রশক্তি চেষ্টা করেছে আউশভিৎসে দৈনিক যে দু হাজার ইহুদি মারা হত তার কুল্লে গুনাহ্ কালটেন ব্রুনারের ওপর চাপাবার।(৮) কিন্তু ওই যে মার্কিনিংরেজের বোমাবর্ষণের ফলে ঘন্টা দুয়েকের ভেতর হামবুর্গ বন্দরে ত্রিশ হাজার লোক মারা গেল তার কী? এদের বেশিরভাগই তো ছিল শিশু এবং অবলা। তার পর ওই যে জাপানে এটম বম ফেলে আশি হাজার লোক মারা হয় তার কী? এই বুঝি ন্যায়, এই বুঝি ইনসা?

রোজেনবেরক হেসে উত্তর দিলেন, আমরা যুদ্ধে হেরেছি যে!(৯)

ইতোপূর্বে যে মনস্তত্ত্ববিদ মার্কিন ডাক্তার গিলবারটের উল্লেখ করেছি, তিনি এই কথোপকথনের ওপর ফোড়ন দিয়ে বলেছেন, এ হল গে টিপিকল নাৎসি যুক্তিপদ্ধতি।

বট্ট্যে? তা সে যাকগে আমরা এস্থলে আউশভিৎস-হিরোশিমার তুলনামূলক আলোচনা করব না।(১০) শুধু একটি সামান্য খবর পাঠককে দিই।

হিরোশিমায় এটম বম্ ফাটানো হয় ৬ আগস্ট ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। এর পক্ষাধিক কাল পূর্বে মহাভারতের সঞ্জয়ের ন্যায় জাপান জয়াশা ত্যাগ করে যুদ্ধে নিরপেক্ষ দেশ সুইডেনের মারফত যুদ্ধবিরতি কামনা করে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠায় (এর মাস তিনেক পূর্বে হিটলারের দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ হিমলার তার প্রভু হিটলারকে না জানিয়ে ওই সুইডেনের মারফতেই মিত্রশক্তির নিকট সন্ধিপ্রস্তাব পাঠান, কিন্তু দুই মহাপ্রভুর কেউই খ্রিস্টের উপদেশ মানতেন না বলে বাম হস্তটি অর্থাৎ হিটলার খবরটা জানতে পান এবং আত্মহত্যার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে হিমলারকে পদচ্যুত করেন) কিন্তু মার্কিন তখন হন্যে হয়ে উঠেছে, নবাবিষ্কৃত এটম বম্ একটা ঘনবসতিওলা শহরে ছাড়লে তার প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা জানবার জন্য। জাপানদত্ত সন্ধিপ্রস্তাব গ্রহণ করলে তো আর বোমাটার এক্সপেরিমেন্ট চালানো যায় না– এতএব, চালাও যুদ্ধ আরও কয়েকদিন, বোমা ফাটিয়ে দেখা যাক ক হাজার লোক স্রেফ পুড়ে মরে, শহর কতটা ধ্বংস হয়। বলা নিতান্তই বাহুল্য হিটলারের ক ক-তে গ্যাসে মৃত্যু ছিল সম্পূর্ণ যন্ত্রণাহীন, এটম বমে জাপানিরা জ্বলন্ত জামাকাপড় নিয়ে ছুটোছুটি করে মরেছে বহু সহস্র, এবং অসংখ্য জন মরেছে বোমার ফলে নানাবিধ অজানা-অচেনা রোগের যন্ত্রণায় বছরের পর বছর জীবন্ত হয়ে।…এবং কর্তারা একটা বোমা ফেলেই প্রসন্ন দক্ষিণং মুখং ধারণ করেননি। আমরাও জানি, এক সংখ্যাটাই বড়ই অপয়া নিদেন দুটো বাতাসা খেতে হয়।

স্পর্শকাতর পাঠক এতক্ষণে হয়তো কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু হয়ে ভাবছেন, আমি এসব পুরনো কাসুন্দি ঘাটছি কেন। তবে কি আমি মডার্ন লেখকদের পাল্লায় পড়ে বীভৎস রসের অবতারণা করে শিঙ ভেঙে বাছুরের দলে ভিড়তে চাই! ঈশ্বর রক্ষতু। আমার সেরকম কোনও উচ্চাশা নেই। বরঞ্চ বলব, মর্ডানদের এই যে নতুন টেকনিক আগেভাগে সব কিছু বলে দিয়ে কোনও প্রকারের সারপ্রাইজ এলিমেন্ট না রেখে পাসে মারা ধূসর মারকা প্লট-বিবর্জিত গল্প লেখা (এদের বক্তব্য : বাস্তব জীবনে সারপ্রাইজ নেই– আছে একঘেয়েমির ধূসরিমা, পান্তাভাতের পানসেমি, মরা ইঁদুরে পাঙাশ-মারা পেট)–এটা আমি রপতো করতে পারব না … আমার যেটা মূল বক্তব্য সেটাতে আসি সর্বশেষে।

এই মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ১৯৩৮, আজকের ঠিক ২০ বছর পূর্বে শ্রীযুক্ত চেম্বারলেন ও ফরাসি প্রধানমন্ত্রী দালাদিয়ে, দুজনাতে, গণতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবে চেকোশ্লোভাকিয়াকে হিটলারের করকমলে সমর্পণ করেন।

গুণ্ডামি আরম্ভ হয় সেই সময় থেকে। ক ক তার শেষ।

আজ আবার এরা গণতন্ত্র দেশের লক্ষ্মীছাড়া সব পলিটিশানরা চেকোশ্লোভাকদের তাতাচ্ছে।

অথচ, পাঠক, দেখো, চেকোশ্লোভাকদের সাহায্য করার রত্তিভর ক্ষ্যাতা ওদের নেই।

তাই তারা জর্মনির দুই লক্ষ সৈন্যকে তিন লক্ষ, না পাঁচ লক্ষে ওঠবার অনুমতি দিয়েছেন।

একদা যে রকম গণতন্ত্রের মুনিব চেম্বারলেন-দালাদিয়ে চেকোশ্লোভাকদের হিটলারের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন, আজ ঠিক তেমনি তাদের বংশধররা, চেকোশ্লোভাকদের তাড়িয়ে দিয়ে, রুশদের হাতে ছেড়ে দেবেন।

আবার শুরু হবে ক ক।

গ্যাস চেম্বার!

শা-লা!

———–

১. মূল গল্পের ধারা অনেক ক্ষেত্রে ফুটনোটের আধিক্যবশত বাধা পায়। অধম কিন্তু ফুটনোট শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে দেয়– অর্থাৎ কোনও পাঠক যদি ফুটনোট আদৌ না পড়েন তবে তিনি মূল গল্পের (টেক্সটের) কোনও প্রকারের সারবস্তু থেকে বঞ্চিত হবেন না। ফুটনোটে থাকবার কথা মূল গল্পের বক্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত নানাপ্রকারের আশ-কথা পাশ-কথা, যেগুলো অত্যধিক কৌতূহলী পাঠক পড়েন যাতে করে কিঞ্চিৎ ফালতো জ্ঞান সঞ্চয় হয় কিংবা এবং যারা বইখানা পয়সা দিয়ে কিনেছেন বলে বিজ্ঞাপনত বাদ দেয় না। অন্যদের জন্য মিষ্টান্নই যথেষ্ট- অর্থাৎ আটপৌরে পাঠক টেক্সট পড়েই সন্তুষ্ট। ফুটনোটে এমন কিছু দেওয়া যেটা না পড়লে মূল কাহিনী বুঝতে অসুবিধা হয় লেখকের পক্ষে অমার্জনীয় অপরাধ।

২. ভ্রাতৃহত্যার চিহ্নস্বরূপ সদাপ্রভু কাইনের কপালে একটি লাঞ্ছনা এঁকে দেন। লেখকের প্রেম অনুবাদ দ্রষ্টব্য।

৩. হিটলারের খাস ভালে ছিলেন লিঙে। তিনি এতই বিশ্বাসী ভৃত্য ছিলেন যে হিটলার-প্রিয়া (পরস্ত্রী) এফা ব্রাউনের বিছানা পর্যন্ত করে দিতেন। যুদ্ধশেষে দশ বছর রুশদেশে বন্দিজীবন কাটিয়ে জমনি ফিরে হিটলার সম্বন্ধে একখানি চটিবই লেখেন। হিটলারের প্রেম ও হিটলারের শেষ দশ দিবস (পুস্তকাকারে প্রকাশিত) প্রবন্ধে এর পূর্ণ পরিচয় দেওয়া হয়েছে। লিঙেকে যখন পরবর্তীকালে শুধানো হয় ইহুদিনিধন সম্বন্ধে বহু জর্মন কিছুই জানত না কেন, তিনি বলেন, হিটলার-হিমলার বহুবার সম্পূর্ণ একলা একলা গোপন সলাপরামর্শ করতেন। সে সময়ে সেখানে লিঙের চা-কফি নিয়ে যাওয়াও মানা ছিল।

৪. এই একশো জনের ভেতর এক যুবতীকে দেখে হিমলার রীতিমতো বিস্মিত হন। চেহারা, চুল নাক আদৌ ইহুদির মতো নয়। যে নরডিক (বিশুদ্ধতম আর্যরক্তের জৰ্মন) জাত হিটলার-হিমলার আদর্শ বলে ধরতেন তাদেরই মতো ব্লনড চুল, নীল চোখ, ব্রিজহীন সোজা নাক ইত্যাদি। হিমলারের ডাকে সে এগিয়ে এলে হিমলার তাকে বললেন, তুমি ইহুদি নও। গর্বিত উত্তর; না, আমি ইহুদি। তুমি বল, তুমি ইহুদি নও, আমি তোমাকে নিষ্কৃতি দেব। গর্বিততর কণ্ঠে, না, আমি ইহুদি। তার পর দৃঢ় পদক্ষেপে ফিরে গিয়ে আপন জায়গায় দাঁড়াল।

৫. ইনি হিটলারের ডেপুটি রুডলফ হেস (Hess) নন, যিনি সন্ধিপ্রস্তাব নিয়ে ইংলন্ডে যান। এর নাম Hoess।

৬. কোন্ প্রকারের গ্যাস, কেমিকেল ইত্যাদি সম্বন্ধে এ-লেখকের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। জর্মন এনসাইক্লোপিডিয়া বলেন Zyklon (ৎসাইক্লন) এক প্রকারের অতি মারাত্মক বিষাক্ততম প্রাসিক (হাই সায়েনিক) এসিড। হয়েস-এর উৎসাহে এক বৈজ্ঞানিক সাইক্লন বা Zyklon B আবিষ্কার করেন। এরই অন্য নাম Zyanwass erstoffkrisatle অর্থাৎ Zyankale

৭. যুদ্ধের পর হিটলারের প্রতি পোপের আচরণ নিয়ে তুমুল বাগবিতণ্ডা হয়– তামাম ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে। পোপবৈরীরা তাঁকে যে পরিমাণে দোষী সাব্যস্ত করেছেন সেটা সাধারণ রাজনৈতিকের পক্ষে মারাত্মক হত। এঁরা স্মরণ করিয়ে দেন, ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে হিটলার জর্মন রাষ্ট্রের চ্যানসেলর (সর্বাধিকারী) হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পোপ জর্মনিতে আপন রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও তস্য বিশ্বাসীগণকে নাৎসি নিপীড়ন থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে হিটলারের সঙ্গে একটি চুক্তি (কনকরডাট) করেন। এতে করেই বিশ্বজনসমাজ মাঝে হিটলারের জল চল হয়ে যায়। তার পর আর সে পাগল জগাইকে আর ঠেকায় কে? এই তাবৎ মামলা নিয়ে মধ্য-ইউরোপে ফিলমফ এবং নাট্যও দেখানো হয়। ক্যাথলিক সমাজ স্বভাবতই অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। কলকাতাবাসীদের মনে থাকতে পারে, বহু বছর পূর্বে অংশতম পোপ-বিরোধী মারটিন লুথার নামক একটি ফিল্ম দেখবার সময় তথাকার ক্যাথলিকগণ ফিল্মটির বিরুদ্ধে রচিত ছাপা হ্যান্ডবিল বিতরণ করেন, এবং সেটাকে বয়কট করার জন্য অনুরোধ জানান।

৮. নাৎসি রাজত্বে ক্ষমতার ধাপগুলো ছিল : হিটলার হিমলার কালুটেন ব্রুনার আইষমান। হিটলার-হিমলার আত্মহত্যা করেন– আইষমান তখন ফেরার। ফলে সব চাপ গিয়ে পড়ে কালটেন ব্রুনারের ওপর। এরও ফাঁসি হয়। নিষ্ঠুরতায় এর সমকক্ষ লোক পাওয়া কঠিন।

৯, রোজেবেরুককে নাৎসি দলের চিন্ময় নেতা= স্পিরিচুয়াল ফুরার আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তার প্রখ্যাততম গ্রন্থ বিংশ শতাব্দীর মিথ গ্রন্থে তিনি উঠেপড়ে লাগেন, আর্যরাই যে পৃথিবীর সর্বোকৃষ্ট জাতি সেইটে প্রমাণ করার জন্যে।

১০. হিরোশিমার এটম বম্ বর্ষণ বাবদে জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী জাপানি চিকিৎসকের একটি বয়ান আমার হাতে এসে পৌচেছে– inspite of the sharks, popularly and mistakenly known in Calcutta as Foreign Book-seller সুযোগ পেলে সেটি পাঠকের হস্তে সমর্পণ করব। ডাক্তারটি বোমা পতনের ফলে আহত হয়ে কয়েক বছরের ভিতরেই অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে মারা যান।

ইস্ট ইজ ইস্ট অ্যানড–

ইজরাএল (ইসরাইল) নিমিত্ত মাত্র। অর-রইস জমাল আবদুন নাসিরও নিমিত্ত মাত্র। দুজনের পিছনে রয়েছে দ্বিধা বসুন্ধরা–যাকে আমরা এতদিন প্রাচী তথা প্রতীচী নামে চিনেছি। ইংরেজ-ফরাসি গয়রহ বলেছে, অরিএনট এবং অকসিডেন্ট। জরমনরা এ দুটো শব্দ ব্যবহার করে বটে, কিন্তু খাঁটি জরমনে বলা হয় মরগেলান্ট (উদয়াচল) ও আবেনট্রলান্ট (অস্তাচল অবশ্য লানট = ভূমি, দেশ); আরবরা হুবহু ওইরকমই মশরি ও মগরিব (মগরিব(১) বলতে আবার দক্ষিণ আফরিকাকেও বোঝায়) বলে থাকে।

এই দুই ভূখণ্ড নিজেদের ভিতর প্রায় সম্মিলিত হয়ে একে অন্যের সম্মুখীন হয়েছে– যুদ্ধং দেহি।

এ লেখা বেরুবার পূর্বেই হয়তো উভয়পক্ষ অস্ত্রসংবরণ করে নেবেন। কিন্তু এর শেষ অতি অবশ্যই এখানে নয়। এ শুধু আরম্ভ মাত্র।

প্রতীচীর শক্তিশালী যুযুধান বলতে উপস্থিত বুঝি জনসন, উইলসন(২) ও দ্য গল। প্রাচীর ভীষ্ম-কর্ণ বলতে বুঝি কসিগিন-মাও।

ইজরাএলের পিছনে দাঁড়িয়েছেন মারকিন ও ইংরেজ। আরব রাষ্ট্রপুঞ্জের পশ্চাতে রুশ ও চীন।

দ্য গল ব্যত্যয়। অনেকটা শ্রীকৃষ্ণের মতো। অনেকটা শ্রীকৃষ্ণেরই মতো তিনি একটা শান্তিসভার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন এবং সে প্রস্তাবের পশ্চাতে তার কোনও অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না, কিন্তু কূট কসিগিন সঙ্গে সঙ্গেই অনুমান করে নিলেন যে ধড়িবাজ মারকিন ইংরেজ এই সভাটাকেই মুষলে পরিবর্তিত করে আরব বংশ ধ্বংস করতে চাইবে। তাই কসিগিন যা বললেন, যার ব্যঞ্জনা দিলেন, এবং যা বললেন না কিন্তু মিন করলেন তার সবকটা একুনে দাঁড়ায় : শান্তির প্রস্তাব তো উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু প্রশ্ন, তুমি জনসন, এবং উনি উইলসন যে দুটি আপন আপন খাসা নৌবহর ভূমধ্যসাগরে রোদ মারিয়ে ফেরাচ্ছ, দুনিয়ার সর্বত্র ছড়ানো বাদবাকিগুলোকে নোঙর ভেঙে ফেলে ফুল ইস্টিমে ওদিক-বাগে ধাওয়া করতে হুকুম দিচ্ছ (মুখে যদিও বলছ, ওরা তো চলাফেরা করছে কবেকার সেই ইস্যু করা প্রাচীন দিনের টাইম-টেবিল অনুযায়ী) তারা কি ওখানে আসছে ফেরেস্তাদের প্যাটারনে পিঠে ড্যানা গজিয়ে, হাতে হারপ যন্ত্র নিয়ে হাল্লেলুইয়া কীর্তনসহ যিশুদত্ত আপ্ত আপ্ত শান্তিসঙ্গীত গাইতে :

অগ্রসর হও আজি খ্রিস্টসেনাগণ।
সবে মিলি আইস–

থাক না, বাছারা, ওসব সন্-ডে ইস্কুলের মোলায়েম মোলায়েম মধুরসের মোরব্বা! আর সেই যদি কইছ, ভূমধ্যসাগরে, ইজরাএলের ধারে ধারে, মিশরের বন্দরে বন্দরে মানওয়ারিদের কোনওপ্রকারের ভালোমন্দ মতলব নেই তবে একটা সরল কর্ম করলেই তো হয়। বেচারি খালাসিমাল্লারাও লক্ষ-হস্ত তুলে তোমাদের আশীর্বাদ করবে আপন আপন দেশের বন্দরে দারাপুত্ৰপরিবারসহ সম্মিলিত হয়ে যাক না এরা ফিরে আন্ক স্যামের সোনার দেশে, ডিফেন্ডার-অব-ফেত-রুল-ব্রিটানিয়ার অক্ষয় স্বর্গে আহা! ন ইয়রক সাউত্যামটনে ফুল কত না অজস্র, আসব কত না সুলভ, আর ললনারা কতই না উন্মুক্ত হৃদয় (পাঠক, আমি শব্দার্থে বলছি না!– খেয়াল থাকে যেন লেখক)। শান্তি সম্মেলনে তো যাব, ওদিকে যারা তোমাদের দলে নয়, তাদের প্রত্যেকের পিছনে থাকবে ছোরা-হাতে একটি একটি করে মানওয়ারি গুণ্ডা (হিটলার রাইষটাগে এই ব্যবস্থা করাতেন গোড়ার দিকে, বিপক্ষ দল নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত)। ওই আনন্দেই থাক।

সরল পাঠক হয়তো এই বলে প্রশ্ন শুধোবেন, আমরা তো জানি, রুশরাও ইউরোপীয়, অকসিডেন্টাল, প্রতীচ্য জাত। আদৌ নয়। রুশ কেন, চেক-পোল ইত্যাদিকেও অনেকে ইয়োরোপীয় ইসটারন বলে থাকে। এই তো সেদিন জরমনির কষ্টাস্ শহরে এক সাহিত্য সম্মেলন হয় তাতে ইসটের প্রতিভূ হয়ে আসেন এক চেক, অন্যজনা পোল বা রাশান। আর হিটলার তো যুদ্ধ লড়তে লড়তে বরাবর চিৎকার করে গেছেন, এ সংগ্রামে এক পক্ষে সভ্য ঐতিহ্যশীল ইউরোপীয়, অন্যপক্ষে বর্বর ইসটারন– রুশ। মৃত্যুবরণের পূর্বে বলেন, আমি ছিলুম ইউরোপের শেষ আশা। কিন্তু সপ্রমাণ হল, প্রাচী আমার চেয়ে শক্তিশালী।

সরল পাঠককে বোঝাই, তারই মতো সরল–অবশ্য এদেশে বিরল-ইয়োরোপীয় মাত্রই একটি অতি বাস্তব, ধরা-ছোঁওয়ার জিনিস দিয়ে প্রতীচী-প্রাচীর তফাত করে। জামার সামনের দিকটা পাতলুনের ভিতর যে গুঁজে দেয় সে ইয়োরোপীয়, যে বাইরে ঝুলিয়ে রাখে সে প্রাচ্যদেশীয়। রুশরা যখন তাদের খাঁটি দিশি পোশাক–বাতুশকা, স্তালিন যা পরতেন–গায়ে চড়ায় তখন তাদের কারুকার্য করা শারটটি (ব্লাউজও বলা হয়) পাতলুনের উপরে ঝুলিয়ে দেয়, আমরা যেরকম পাঞ্জাবির সামনের দিকটা (দামন, অঞ্চল) ধুতির উপর ঝুলিয়ে রাখি। এখানে বুশ-শারটের রেজে দেত্র নিয়ে আলোচনা করাটা সমীচীন, কিন্তু তা হলে মূল বক্তব্য থেকে অনেক দূরে চলে যাব; তবে পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, উত্তম বুশ-শারটের দামন ভিতরে খুঁজে টাই পরা যায়, আবার বাইরে ঝুলিয়ে মি-টাই হওয়াও যায়।

মধ্যপ্রাচ্য উপলক্ষ মাত্র।

একদিকে জনসন-উইলসন চালিত ইয়োরোপ– লক্ষ করেছেন চ্যাংড়া ডেনমারক তক বাঁদরনাচ নেচে রুশের কাছে ধমক খেয়েছে?– অন্যদিকে রুশ-চীন চালিত এশিয়া, এবং আফরিকাও এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। অর্থাৎ একদিকে সাদা, অন্যদিকে কালো বা রঙিন বলতে পারেন। সাদার পাল এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে, ইউরোপের বাইরের সবাইকে কলরড় নাম দিয়ে কী থানডারিং ব্লানডারই না সে করছে! পিলা চীন, কালা নিগ্রো, তাঁবাটে আরব, আধা-পিলা রুশ (ইংরেজাদির দৃঢ় সংস্কার, রুশের গায়ে প্রধানত মনগোল-তাতার রক্ত) হয়েছে এক-জোট ওদিকে মার্কিন নিগ্রো মুহম্মদ আলী (কেসিয়াস ক্লে) বলছে, মারকিনের হয়ে লড়তে তার বিবেক-জাত ঘোরতর অধর্মবোধ রয়েছে–পিছনে রঙ-বেরঙের ভারতীয়-পাকিস্তানিও সায় দিয়ে মাথা নাড়ছে; এস্তেক যে, লেবানন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কারণ সে আধা ক্রিশ্চান আধা মুসলমান– যে কি না এতদিন সর্বসংঘাতে গা বাঁচিয়ে দেহ রক্ষা করেছে, সে-ও আব্দুন নাসিরের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। শুধু লক্ষ করার মতো দেশ, জাপান। পশ্চিমের দ্য গলের মতো ইনিও এতাবৎ নিরপেক্ষ। তা, এরকম দু-একটা ব্যত্যয় না থাকলে মাথাভরা চুলের প্রকৃত বাহার মালুম হয় না।

হাজার চার-পাঁচেক বছর পূর্বে ঠিক এই প্যাটারটিই ভারতবর্ষে রূপ নিয়েছিল যার প্রতি ইঙ্গিত, যার সঙ্গে বর্তমান সমস্যা– প্যাটারূনের তুলনা আমি এই ক্ষুদ্র লেখায় এতক্ষণ দিলুম : বিরাট দেশ ভারতবর্ষ, নানা বর্ণ(৪)–বিশুদ্ধ সংমিশ্রিত– নানা জাতি, নানা সভ্যতার লোক একদা কুরুক্ষেত্রে সমবেত হয়েছিল। একদিকে দুর্যোধনের পশুবল; অন্যদিকে ধর্মরাজের ধর্মবল।

আজ সেই প্যাটারনই বোনা হচ্ছে গোটা বিশ্বের নানারঙের সুতো নিয়ে।

হয়তো শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ লাগবে না। কিন্তু সে শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

তেইশ বছর পূর্বে তখন স্বরাজ হয়নি– আনন্দবাজারে আমি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করি– মারকিন-ইংরেজের এই বে-আদপি বেতমিজিকে ধবলদম্ভ নাম দিয়ে। ইংরেজ যেরকম একটা চীনকে পীতাতঙ্ক (ইয়েলো পেরিল) নামে ডাকত, আজ বিশ্বজুড়ে তারই পুনরাবির্ভাব।

হাজার পাঁচেক বছর পূর্বে হয় মহাভারত; আজ না হোক, দু-দিন বাদে হবে বিশ্বভারত।

———–

১. বাঙলা গরিব শব্দ ও মগরিব মূলে একই ধাতু থেকে। গরিব আরবিতে বিচিত্র অদ্ভুত অর্থ ধরে।

২. একদা এদেশে বলা হতো বাঙালির জাত মারছে তিন সেন-এর মিলে। উইলসেন-এর হোটেলে বাঙালি খেত নিষিদ্ধ মাংস, কেশব সেন তাদের করে ফেলত বেম্মজ্ঞেনী, আর ইস্টিসেনে বাহান্ন জাত-বেজাতের সঙ্গে মেলামেশা এড়ানো যেত না। এখন পৃথিবীর জাত মারার জন্য এসেছেন অন্য তিন সেন। মার্কিন জনসেন, ইংরেজ উইলসেন এবং কানাডার পিয়ারসেন। তৃতীয়োক্ত ব্যক্তিটি নিতান্তই চুনোপুঁটি। কিন্তু স্বয়ং জনসেন মুক্তকচ্ছ হয়ে এঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে এঁকে বেজাতে তুলেছেন, কিংবা বলব এর জাত মেরেছেন।

৩. মধ্য বা পশ্চিম ইয়োরোপে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বেরুলে একাধিক সজ্জন আপনার কানে কানে ফিসফিস করে বলবে, স্যার! শার্টটা খুঁজতে ভুলে গিয়েছেন। তার মনে হয়েছে, আপনি শৌচাগারে প্রয়োজনীয় কর্মটি করার পর দামনটি খুঁজতে ভুলে গেছেন– বুড়া অধ্যাপকরা যেরকম ক্ষুদ্রতর কর্মের পর পাতলুনের বোতাম লাগাতে ভুলে যান।

৪. অনেকের বিশ্বাস, কৃষ্ণের যদুবংশ ছিল কালো, কৌরবেরা ছিলেন গোরা, আর পাণ্ডবরা ছিলেন পাণ্ডু, অর্থাৎ পিলা, হলদে। পাণ্ডবরা নাকি আসলে তিব্বতের মঙ্গোলীয়ান। (Winternitz পশ্য। এ বাদ বা বিবাদে যোগ দেবার শাস্ত্রাধিকার আমার নেই।) মহাভারতের যুদ্ধ নাকি কৃষ্ণ-পাণ্ডু বনাম গোরা-কৌরব।

কনরাট আডেনাওয়ার

চার্চিল নাকি একদা বলেছিলেন, বিসমার্কের পরবর্তী যুগে জর্মনিতে মাত্র একটি রাষ্ট্রবিদ (স্টেটসম্যান, রাষ্ট্রনির্মাতা) জন্মেছেন– তিনি কটু আডেনাওয়ার।

এ প্রশস্তি আডেনাওয়ারের পক্ষে অবশ্যই আনন্দদায়িনী (এবং আমরাও চার্চিলের সঙ্গে একমত) যদ্যপি এ তথ্যটি সর্বজনবিদিত যে স্বয়ং আডেনাওয়ার ইংরেজ জাতটাকে আদৌ নেকনজরে দেখতেন না।

চার্চিলের মন্তব্যে একটি সুলাঙ্গুলির রূঢ় ইঙ্গিত রয়ে গিয়েছে।

তিনি বলতে চান, বিসমার্ক এবং আডেনাওয়ারের মাঝখানে রাজনীতির (স্টেটসম্যানশিপের) শস্যশ্যামল ভূখণ্ড নেই, আছে সাহারার মরুভূমি। অর্থাৎ বহু বহু বছর ধরে জর্মন দেশে রাষ্ট্রনির্মাতার বড়ই অভাব। বিসমার্কের জন্ম ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে, রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হন ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে, ও মৃত্যু ১৮৯৮। যদি ধরা হয়, তিনি রাজনীতি সংগ্রামে নামেন ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে তা হলে বলতে হয় প্রায় একশো বছর ধরে জর্মনিতে একমাত্র রাষ্ট্রপিতা ছিলেন বিসমার্কই। জর্মনির মতো চিন্তাশীল তথা শক্তিশালী দেশের পক্ষে এক শতাব্দীতে মাত্র একজন রাষ্ট্রস্রষ্টা– এ যেন অবিশ্বাস্য। জর্মনি না কান্ট, হেগেল, কার্ল মার্কসের দেশ! তাদের পরিকল্পনা কেউই বাস্তবে পরিণত করতে পারল না?

এবং হিটলার?

এর উত্তর সুদীর্ঘ, কিন্তু সংক্ষেপে সারি। যে ডিকটেটারের মৃত্যুকালে তাঁর দেশের অধিকাংশ ভস্মস্তূপে পরিণত, যার সংগ্রামনীতির ফলে লক্ষ লক্ষ সৈন্য দেশে-বিদেশে নিহত হয়েছে; যুদ্ধে বোমারু আক্রমণে আরও লক্ষ লক্ষ আহত রক্তাক্ত নরনারী চিৎকার করছে– তাঁকে নিশ্চয়ই অতিমানব, নরদানব সবই বলা যেতে পারে; শুধু বলা যায় না রাষ্ট্রনির্মাতা, পতন-অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থার যুগযুগ-ধাবিত যাত্রীর চিরসারথি তাঁকে কিছুতেই বলা যায় না।

বিনষ্ট রাষ্ট্রের ভস্মতূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যে লোক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় তাকে রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রনির্মাতা বলা চলে না।

এমনকি কোনও রাষ্ট্রাদশও তিনি রেখে যেতে পারেননি যেটা ভবিষ্যদ্বংশীয়রা মৃন্ময় করে তুলতে পারে। তার রাষ্ট্রাদর্শ : পররাজ্য জয় করে সে দেশের বর্বর (উটরমেনুষ) জনসাধারণকে দাসস্য দাস রূপে পরিণত করে যে সুপরিকল্পিত পৈশাচিক শোষণ-সংহার পদ্ধতি দর্শনে আন্কল টম পর্যন্ত গোরশয্যায় চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান হবেন- আপন দেশের বিলাসব্যসনের জন্য অধিকতর শূকরমাংস, সূক্ষ্মতর চীনাংক, অগণিত স্বতশ্চলশকট সগ্রহ– সাতিশয় বস্তুতান্ত্রিক জড়ত্বের চরম আরাধনা।

এ প্রসঙ্গে তাই বলে নিতে পারি যদিও এটা সর্বশেষের কথা, হিটলার বারো বছরে যে জর্মনিকে বিনাশ করেন, আডেনাওয়ার তার ১৯৪৯-১৯৬৩ ব্যাপী রাজত্ব কালে সেটি পুনর্নির্মাণ করেন। শুধু পুনর্নির্মাণ নয় এবং চৌদ্দ বছরও নয়, আডেনাওয়ার দশ বছরেই জর্মনিতে যে সুখসমৃদ্ধি গড়ে তুললেন সেটা হিটলারের ভস্মস্তূপে দাঁড়িয়ে ১৯৪৫ সালে বাতুলতম আশাবাদীও কল্পনা করতে পারেনি। এবং বলতে কি, এহ বাহ্য, তিনি দিলেন এমন ধন যার উল্লেখ করে খ্রিস্ট একদা বলেছিলেন, শুধু রুটি খেয়েই মানুষ জীবনধারণ করে না। সে কথা পরে হবে, আগেই বলেছি।

***

কলন(১) শহরের নাম বিশ্ববিখ্যাত। আর কিছু না হোক পৃথিবীর সর্বত্রই Eau de Cologne জিনিসটি পাওয়া যায়, এবং আজকের দিনেও দ্য কন পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই নির্মিত হয়। কলন শহর যে কলন-জলের (Eau=Water, de= of, Cologne= Colojne=Koeln) আবিষ্কারক তা-ও নয়, কিন্তু কলনের ও দ্য কলনই এখন পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কলন-জল।

কলন জর্মনির অন্যতম বৃহৎ নগর। এর গির্জাটি স্থাপত্যশিল্পের অত্যুকৃষ্ট নিদর্শন। গম্ভীর এবং মধুর উভয় রস এই বিরাট গির্জাতে সম্মিলিত হয়েছে। দূর-দূরান্ত হতে গির্জার শিখরদ্বয় পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

এ নগরের সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি তার ওবারবুরগারমাইস্টার বা প্রধান লর্ড মেয়ার। কলন শহরের ওপর তার প্রভাব অসীম। বস্তুত তাঁকে কলনের রাজা বললে কিছুমাত্র বাড়িয়ে বলা হয় না। ভাইমারের পূর্ববর্তী যুগে কলনের লর্ড মেয়ার প্রতি পরবে কাইজার কর্তৃক নিমন্ত্রিত হতেন।

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে আডেনাওয়ারের জন্ম এই কলন শহরে। আইন অধ্যয়ন করার পর তিনি এ শহরের লর্ড মেয়ারের দফতরে ঢোকেন এবং ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে স্বয়ং ওবারবুরগারমাইস্টার নিযুক্ত হন। ১৯৩৩ পর্যন্ত তিনি ওই পদে থেকে তার আপন শহরের সেবা করেন। এরকম একাগ্র সেবা তার পূর্বে বা পরে কোনও মেয়ারই করেননি। ১৯৩৩-এ হিটলার জর্মনির প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েই তাকে সরাসরি ডিসমিস করে দেন।

আডেনাওয়ারের দীর্ঘ একানব্বই বছরের জীবনকে যদি দুই পর্যায়ে ভাগ করা যায় তবে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম পর্যায় সমাপ্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ের আরম্ভ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে এবং সমাপ্তি ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে।

জর্মনি, হিটলার তথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্বন্ধে যাঁদের কৌতূহল আছে তাদের সকলের মনেই প্রশ্ন জাগবে, হিটলার এঁকে ডিসমিস করলেন কেন? নাৎসি আন্দোলন যখন ১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তখন আডেনাওয়ার তার ওপর কি কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি।

জীবনের প্রথম পর্যায়ে, অর্থাৎ ১৯৩৩ অবধি আডেনাওয়ার প্রকৃত পলিটিশিয়ান বলতে যা বোঝায় তা ছিলেন না। লর্ড মেয়রের পদ ছাড়াও তিনি কাইজারের রাজত্বে ও পরবর্তী ভাইমার রিপাবলিকে একাধিক সর্বোচ্চ আসন গ্রহণ করেন বটে কিন্তু কখনও রাইসটাগ বা জর্মন পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার জন্য জনসমাজের সম্মুখে প্রার্থী হয়ে দাঁড়াননি। তিনি ক্যাথলিক সেন্টার পার্টির সদস্য ছিলেন বটে এবং সে দলের ওপর তার প্রভাব ছিল প্রচুর কিন্তু সেটা প্রধানত তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের বলে ও প্রখ্যাত কলন শহরের লর্ড মেয়ারের পদমহিমায়। এবং ক্যাথলিক সেন্টার পার্টির প্রতি হিটলারের ছিল ক্রোধ ও ঘৃণা।

কিন্তু ১৯২৯-৩০ থেকে ১৯৩৩ অবধি ক্ষমতালাভের জন্য যখন নাৎসি পার্টি শহরে গ্রামে, রাস্তায় রাস্তায়, মদের দোকানে লড়াই চালাচ্ছে তখন যেসব নাসিবিরোধী রাজনৈতিকদের নাম শোনা যায়, যেমন ফন পাপেন, হুগেনবুর্গ, স্লাইষার, ক্রনিঙ, ট্যালমান, টলার, শ্রোডার– এদের ভেতর আডেনাওয়ারের নাম নেই। ১১৭৪ পৃষ্ঠা জুড়ে শ্রীযুক্ত শাইরার নাৎসি আন্দোলনের উদয়াস্ত সম্বন্ধে যে বিরাট গ্রন্থ লিখেছেন তাতে আডেনাওয়ারের নাম নেই।

অথচ আডেনাওয়ার ছিলেন ধর্মভীরু লোক– হিটলার যে ধর্ম মাত্রকেই এবং বিশেষ করে খ্রিস্টধর্মকে জর্মন টিউটন চরিত্রের সর্বনাশা শত্রুরূপে ঘৃণা করতেন সে তত্ত্ব তিনি কখনও গোপন রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি।২ হিটলারের করাল ছায়া যে ক্যাথলিক গির্জা ক্রমেই ছেয়ে ফেলেছে সেটা আডেনাওয়ারের দৃষ্টি এড়ায়নি।

কিন্তু আডেনাওয়ার ছিলেন ধর্মভীরু, শিক্ষিত, বিদগ্ধ নাগরিক।

একটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে। কলন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে; নেপোলিয়নের নেতৃত্বে যখন ফরাসি সেনা জর্মনিতে ঢুকল তখন সারা জর্মনির শিক্ষাদীক্ষার ওপর নামল দুর্দিনের অন্ধকার। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে কলন বিশ্ববিদ্যালয়েরও দরজা বন্ধ হয়ে গেল ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে।

আপ্রাণ চেষ্টা করে, লর্ড মেয়ারের সর্ব প্রভাব সর্ব কর্তৃত্ব বিস্তার করে কাট আডেনাওয়ার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কলনে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। ১২৩ বছর পরে।

বন্ শহর কলনের অতি কাছে। বন্-এর বিশ্ববিদ্যালয় বিখ্যাত। আডেনাওয়ার বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি বন্-কলনের পথে র্যোনডরফে তাঁর আবাস নির্মাণ করেন। এখান থেকেই তারও পরবর্তীকালে হিটলারের পতনের পর তিনি মোটরে করে রাজধানী বন্-এ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য সমাধা করতে যেতেন।

সেই ১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে, বস্তুত প্রায় ষাট বছর ধরে বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন সুপরিচিত।(৩) বন্-এর এত কাছে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলাতে বন্-এর কিছুমাত্র দুশ্চিন্তা হয়নি, কারণ বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আড়েনাওয়ারের সখ্য ছিল অবিচল। বস্তুত উত্তর রাইন অঞ্চলের (বন্-কলন-ডুসেড) প্রায় সব রকমের কৃষ্টি আন্দোলন তথা ক্যাথলিক ধর্মজীবন এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আডেনাওয়ার তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

হিটলারের জন্মভূমি যদিও অস্ট্রিয়ায় তবু তিনি বেভেরিয়ার মুনিক শহর বেছে নিয়েছিলেন তার রাজনৈতিক কর্মকেন্দ্ররূপে। সেখানে বিরাট বিরাট মিটিঙে হিটলার লম্বা লম্বা লেকচার ঝাড়তেন, রাস্তায় রাস্তায় কমুনিস্টদের ঠ্যাঙাবার ব্যবস্থা করাতেন, এমনকি গুমখুন করতেও তাঁর বাধত না– এসব পাঠকমাত্রই জানেন।

বেভেরিয়া প্রদেশের পরেই হিটলারের জনপ্রিয়তা ছিল রাইনের কয়লা ও লোহা ব্যবসার জায়গা রুর অঞ্চলে এবং কলনের পাশে এই উত্তর রাইনের ডুসেলডর্ফ শহরে বিশ্বপ্রপাগান্ডা সরদার ডক্টর গ্যোবেলসের জন্ম। রুরের গা-ঘেঁষে কলন শহর এবং এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নগর। গ্যোবে স্বভাবতই চাইতেন তার বাড়ির পাশের কলন শহরে যেন প্রভু হিটলারকে উৎকৃষ্ট আসন তৈরি করে দিতে পারেন– হিটলারের কাশী যদি হয় মুনিক তবে কলন হবে বৃন্দাবন।

কিন্তু বাদ সাধতেন আডেনাওয়ার। পূর্বেই বলেছি, ওবারবুরগারুমাইস্টারের ক্ষমতা অসীম। তাই নামমাত্র আইন বাঁচিয়ে তিনি কলন অঞ্চলে এমন সব কলাকৌশল করে রাখতেন যে, হিটলার এমনকি রাইনের ছেলে স্বয়ং গ্যোবেলসও সেখানে সুবিধে করে উঠতে পারতেন না।

নাৎসি পার্টির ক্ষমতা সঞ্চয় করে উদ্দেশ্য সফল করাতে বাধা দিয়েছিল প্রধানত দুইটি সঙ্ : ক্যাথলিক এবং দ্বিতীয়ত প্রটেস্টান যাজক সম্প্রদায়। কিন্তু ক্যাথলিক সম্প্রদায় প্রটেস্টানদের তুলনায় শতগুণে সবদ্ধ এবং পোপকে কেন্দ্র করে তাদের বিশ্বজোড়া প্রতিষ্ঠান। হিটলারও বার বার তার সাঙ্গোপাঙ্গকে বলেছেন, ওই ক্যাথলিকদের সমঝে চল– প্রটেস্টানরা এমনিতেই টুকরো টুকরো হয়ে আছে, তাদের খানখান করা এমন কিছু কঠিন কর্ম নয়।

কলন শহরে পোপের অন্যতম আর্চবিশপের বিরাট প্রতিষ্ঠান। আডেনাওয়ার সেখানে সুপ্রিম লর্ড মেয়ার। ক্যাথলিক রাজনৈতিক দলের ওপর তার প্রচুর প্রভাব– যদিও, পূর্বেই বলেছি, তিনি সে রাজনৈতিক দলের টিকিট নিয়ে ভোটমারে কখনও নামেননি। তাঁর জীবনের প্রথম পর্যায় কেটেছে মনিসিপাল বা করপোরেশন পলিটিসে। ক্যাথলিক সংগঠনের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তিনি নাৎসিদের প্রচারকর্মে বাধা দিলেন কলন তথা উত্তর রাইনের সর্বত্র। অথচ হিটলার তাঁকে ধরা-ছোওয়াতে পান না, কারণ তিনি রাজনৈতিক কোনও দলের নেতা, এমনকি চারআনি সক্রিয় নিষ্ক্রিয় কোনও মেম্বারও নন। তিনি যদি ভোটমারে নামতেন তবে তাকে ভোটে হারিয়ে বিপর্যস্ত করা যেত। নাৎসি ডন কুইন্সট্‌ তলওয়ার হানবার মতো ড্রাগন খুঁজে পায় না পায় উইড় মিল!

গ্যোবেলস্-এর প্রচারকমের একটা প্রধান উর্বরা জমি ছিল স্কুল-কলেজ-ইউনিভারসিটি। কলনের অধিকাংশ স্কুল ক্যাথলিকদের তাঁবেতে সেকুলার ভাইমার রিপাবলিক জর্মনির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সেকুলার করে তুলতে পারেনি কিংবা হয়তো সত্য সত্য তা করতে চায়নি সেখানে আডেনাওয়ারের ধর্মবল অর্থবল দুই-ই রয়েছে। আর ইউনিভারসিটির তো কথাই নেই।

সোয়াশো বছরের হারানো মানিক তার বিশ্ববিদ্যালয় ফের ফিরে পেয়েছে– আডেনাওয়ারের তপস্যায়, তখনও পুরো দশ বছর হয়নি। এটাকে কলনবাসী বাঁচিয়ে রাখবে সর্বপ্রকার কট্টরপন্থীর র‍্যাডিকাল ছোঁয়াচ থেকে। গ্যোবেলস্ কলনের কলেজে কল্কে পেতেন না।

ওদিকে বেকার সমস্যা দিন দিন তার চরম সঙ্কটের দিকে দ্রুতপদে এগিয়ে চলেছে– এবং সবচেয়ে বেশি মার খাচ্ছেন রুর কয়লাখনির শ্রমিকদল। তাই দেখা যায়– হিটলারের খাস পাইলট তার পুস্তকে এর বর্ণনা দিয়েছেন—(৪) হিটলার প্রচারকর্মের জন্য প্লেনে উড়ে যাচ্ছেন রুরের এসে শহরে। পাশেই বিরাট কলন। কিন্তু তিনি সেটি বাদ দিয়ে চলে যাচ্ছেন বন-এর কাছে তার প্রিয় গোডেসবের্গে নামক গগ্রামে (এখন শহর এবং এখানেই পরবর্তী যুগে হিটলার প্রাথমিক কথাবার্তা বলেন চেম্বারলেনের সঙ্গে চেকোস্লোভাকিয়ার সুডেটেন বাবদে)। নিশ্চয়ই হিটলারের এই কলন-বর্জনে প্রতিবারেই গ্যোবেলস লজ্জায় মাথা নিচু করেছেন। তাঁর সান্তনা এইটুকু– এসে তথা রুর তার প্রতিবেশী, সেখানে তিনি প্রতিবারেই হিটলারকে রাজাসনে বসাতেন।

হিটলার চ্যানসেলার হয়েই আডেনাওয়ারকে ডিসমিস করলেন। এটা হবে আমরা জানতুম। কারণ নাৎসিরা বহুদিন ধরে তাঁর নিন্দা-কুৎসা গেয়ে বেড়াচ্ছিল। তার একটা : আডেনাওয়ার তনখা টানেন বিরাট (রিজে)! তার মাইনে ঢের ঢের কম হওয়া উচিত। এবং সবচেয়ে মজার কথা, হিটলার যাঁকে লর্ড মেয়ার করলেন, তিনি তাঁর মাইনে এক পাই তক না কমিয়ে টানতে লাগলেন আডেনাওয়ার যে তনখা নিতেন সেইটেই। এই মহাশয়ের নাম ছিল রিজে (বাঙলায় আমরা বলব বিরাট বাবু)। তখন কলন-বন-এ একটা শিবরামীয় পান চালু হল :- আডেনাওয়ার নিতেন বিরাট তনখা; এখন (মিস্টার) বিরাট নিচ্ছেন আডেনাওয়ার-তনখা!

***

হিটলার কীভাবে জৰ্মনিকে বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তার অবশ্যম্ভাবী শেষ ফল যে দেশের সর্বনাশ, সে সত্য আডেনাওয়ার দিব্যদৃষ্টি দিয়েই দেখেছিলেন কিন্তু শান্ত-সমাহিত স্বভাব ও আচরণসম্পন্ন আডেনাওয়ার জানতেন, চীনা ঋষি লাওৎসের মতোই জানতেন, জর্মন-নিয়তি রহস্যাবৃত তারই কোনও এক মানববুদ্ধির অগম্য কারণে। জর্মনির উপর দিয়ে যে টরনাডো বন্ধামুক্ত করেছেন, সে যেন;

লক্ষ লক্ষ উন্মাদ পরান বহির্গত বন্দিশালা হতে
মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি ফুৎকারে উড়ায়ে চলে পথে

তার সামনে দাঁড়ালে সেটাকে বন্ধ করা তো দূরের কথা, তিনিও মহাশূন্যে বিলীন হবেন। এটা ফরাসি সম্রাটের আপ্রে মোয়া ল্য দেলুজ (আমি মরে যাওয়ার পর বন্যা) নয়, এটা দেলুজ পুর শাক আ ল্যাসতা (বন্যা এখনই, এবং সবাইকে নিয়ে যাবে ভাসিয়ে, কহাঁ কহা মুলুকে!)

বরঞ্চ বন্যার পর ফের ঘরবাড়ি তুলতে হবে, খেতখামার করতে হবে– শিবের তাণ্ডব শেষ হলে অন্নপূর্ণার আবাহন।

পরাজয় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল বুদ্ধিভ্রষ্টের ন্যায় হিটলার ততই অবিচারে, নির্বিচারে শক্ৰজন, নিরপেক্ষজন, এমনকি মিত্ৰজনকেও মরণ-থানায় (কন্‌সেট্রেশন ক্যাপে) পাঠাতে লাগলেন–হ্যাঁ, ইব্রাহিম তাঁর প্রিয় পুত্রকে, আগামেন তাঁর প্রিয় কন্যা এফিগেনিয়েকে দেবতার তুষ্টির জন্য বলি দিয়েছিলেন কিন্তু আডেনাওয়ারের অদৃষ্টে মরণ-থানার দুর্দৈব লেখা ছিল না। যুদ্ধের শেষের দিকে তাকে কিছুদিন কারাগারে, পরে তার আপন গৃহে নজরবন্দি করা হয়েছিল মাত্র। কিন্তু তিনি শক্ৰমিত্রনির্বিশেষে এতই অসংখ্য জনের উপকার করেছিলেন, যে তাঁরা কলাকৌশলে ছলে (হিটলারকে) বলে আডেনাওয়ারকে কারামুক্ত করেন।

সাঙ্গ হয়েছে রণ,
অনেক যুঝিয়া অনেক খুঁজিয়া শেষ হল আয়োজন
The fight is ended!
Cries of loss bewilder the sky

১৯৪৫ সালের মে মাসে প্রথম সপ্তাহে জর্মনি বে-এক্তেয়ার আত্মসমর্পণ করল। ওই বছরেই জুলাই মাসে প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক স্টিভ স্পেন্ডারকে ব্রিটিশ সরকার পাঠাল জর্মনিতে, সেখানকার ঝড়তিপড়তি ইনটেলেছুঁয়েলদের চিন্তাধারা সম্বন্ধে খবর নিতে। সে-কর্ম সমাধান করে তারই বিবরণী তিনি প্রকাশ করেন ইয়োরোপিয়ান উইটনিস নামক পুস্তকে।(৫)

বীভত্স বই। কলনের রাস্তার পর রাস্তা, দু দিকে একটিমাত্র বাড়ি নেই–ধ্বংসপ, ভগ্ন্যুপ। তার তলায় এখনও হাজার হাজার মড়া পচছে গলছে। শহর-জোড়া দুর্গন্ধ থেকে নিষ্কৃতির উপায় নেই। একরকম ক্ষুদে সবুজ পোকা এইসব হাজার-পচা লাশ থেকে জন্ম নিয়েছে এবং শহরময় এমনই ঘন স্তরে ছেয়ে আছে যেন মনে হয় লন্ডনের ধুয়াশা। হাত দিয়ে মুখের সামনে থেকে তাড়াতে গেলে মুখে লেগে গিয়ে পিছলে আঠার মতো চোখেমুখে সেঁটে যায়।

লড়াইয়ের শুরুতে কলনে বাস করত প্রায় আট লক্ষ লোক। তারা ক-হাজার বাড়ি, ভিলা ফ্ল্যাটে বাস করত তার হিসাব স্পেন্ডার দেননি। শুধু বলেছেন, মাত্র তিনশো খানা(!) তখনও বাসের উপযোগী। Actually there are a few habitable buildings left in Cologne, Three hundred in all (!)

এ শহর তথা গোটা দেশের আর আর শহর গড়ে তুলবে কে, কারা?

দুষ্ট হোক শিষ্ট হোক, যেসব নাৎসি একদা নরওয়ে থেকে ইটালি, অতলান্তিক থেকে ককেশাস পর্যন্ত অধিকার করেছিল তারা কৃতবিদ্য, করিল্কর্মা ও অভিজ্ঞ নির্মাণ-ধ্বংস উভয় কর্মেই সিদ্ধহস্ত। তাদের কিছু মারা গেছে, অধিকাংশ মিত্রশক্তির শিবিরে শিবিরে বন্দি, কিছু পলাতক, অনেকে আন্ডারগ্রাউন্ড।

হিটলারের বৈরীপক্ষের অধিকাংশ অন্যলোকে। হিটলার তার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। আডেনাওয়ার গোত্রের নির্মাণতৎপর নেতা অতিশয় বিরল–মুষ্টিমেয়।

আডেনাওয়ার ভগ্নস্তূপের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। একদা চার্চিল যে রকম লন্ডনের ভাঙাচোরার মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলেন। যদিও সে বিনাশ কলনের সহস্রাংশও ছিল না।

এখানে আমাকে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিতে হবে। এটি পড়ে নিলে আডেনাওয়ারের চরিত্রগুণটি পাঠকের সামনে স্পষ্ট রেখায় ধরা দেবে। বিশেষত স্পেনডারের মতো লোক যখন এ ছবিটি এঁকেছেন।

দু দফে অনুবাদ করে লাভ নেই, এবং বিবেচনা করি এ প্রবন্ধের পাঠক অন্তত আমার চেয়ে ভালো ইংরেজি জানেন।

এটা যুদ্ধবিরতির দু তিন মাস পরের কথা। স্পেন্ডার বলেছেন :

Adenauer is a prominent Catholic in the Rheinland, who was Mayor of Cologne before Hitler came to power. It is now with a special personal emotion that he takes up the restoration of that Cologne which was a broken trayload of crokery when it was taken out of his hands. When he was last Lord Mayor he was in his fifties, he is now a man of seventy. He has an energetic, though some what insignificant appearance; a long lean oval face, almost no hair, small blue active eyes, a little button nose and a reddish complexion. He looks remarkably young and he has the quietly confident manner of a successful and attentive young man.

There are two aspects of reconstruction which we consider of equal importance, he said, one, the material rebuilding of the city. But just as important is the creation of a new spiritual life. You cant have failed to notice that the Nazis have laid German culture just as flat as the ruins of the Rheinland and the Ruhr. Fifteen years of Nazi rule have left Germany a spiritual desert, and perhaps it is more necessary to draw attention to this than to the physical ruins, for the spiritual devastation is not so apparent. There is hunger and thirst now for spiritual values in Germany. This is especially true of Cologne because here, in the past, we have had such a significant spiritual life and activity. Here it is possible today to do a great deal. Only the best should be our aim. We should have in Cologne the best education, the best books, the best newspapers, the best music.

The point Adenauer came back to again and again–his whole position rested on it was that the Germans were really starving spiritually, and that it was therefore of the utmost importance to give their minds and souls same food.

এ বই যখন আমি পড়ি তখনও আমরা স্বাধীনতা পাইনি।

সে দুর্দিনে কি কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল, দশ-বারো বছর যেতে না যেতেই তিনি কলন তথা সারা জর্মনিতে এমন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, শিল্পোন্নতি, আত্মচর্চা ও ধর্মজীবনে নবজাগরণ এনে দেবেন, যে হিটলার তার গৌরবের মধ্যগগনেও সুদ্ধমাত্র সাংসারিক দিক দিয়েও এতখানি উন্নতি করতে পারেননি?

কেউ কল্পনা করতে পারবে না, এ তত্ত্বটা আডেনাওয়ার জানতেন বলেই স্পেন্ডারকে বিদায় নেবার বেলা তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, The imagination has to be provided for.

কবিগুরুর কথা মনে পড়ে, স্বদেশী আন্দোলনের সময় ও পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি বারবার বলেছেন, আত্মার দিকটা অবহেলা করো না। অধিকাংশ রাজনীতিকরা তখন মুচকি হেসে বলতেন, আগে তো ইংরেজকে খেদাই।

ইংরেজ তো বহুকাল হল গেছে। তবে?

আসলে আমাদের imagination, চরিত্র, আত্মা দেউলে।

এর পরের ঘটনাবলি হালে কাগজে কাগজে বেরিয়েছে। সেগুলো সংক্ষেপে সারি।

যুদ্ধশেষের পরই মার্কিন সেনাপতি আডেনাওয়ারকে কলনের লর্ড মেয়ার করে দিল। কিছুদিনের মধ্যেই পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী মার্কিনরা কলন ইংরেজের হাতে দিয়ে সরে পড়ল। যে ইংরেজ সেনাপতির হাতে কলনের ভার পড়ল তিনি ছিলেন একটি আস্ত গণ্ডমূর্খ গাড়োল। আডেনাওয়ারকে নগর পুনর্নির্মাণ বাবদে এমন সব সর্বনেশে অবাস্তব জঙ্গিলাটী অর্ডার দিতে লাগলেন যে, পরাজিত জর্মনির নগণ্য সরদার আডেনাওয়ার বিজয়মদেমত্ত প্রভুর আদেশ পালন করতে কিছুতেই সম্মত হলেন না। এই নয়া হিটলার তখন তাকে স্রেফ ডিসমিস করে দিলেন। বিবেচনা করি সিপাহিবিদ্রোহের আমল হলে তাকে বাহাদুর শার মতো বাকি জীবন জেলে কাটাতে হত!

অনেকের বিশ্বাস, এই যে আডেনাওয়ার ইংরেজের ওপর চটে গেলেন তার পর তিনি জর্মনির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গড়তে লাগলেন মার্কিন ও ফরাসির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে– ইংরেজিতে যাকে বলে কাট হিম ডেড, ইংরেজকে তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেলেন।

জর্মনির নব সংবিধান নির্মাণের জন্য যে বৈঠক বসল বছর তিন পরে ১৯৪৮ সালে, তিনি হলেন তার প্রেসিডেন্ট। ১৯৪৯-এ যে নবীন রাষ্ট্র নির্মিত হল তার প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন আডেনাওয়ার। কিন্তু তখন বিশ্ববাসীর মনে প্রশ্ন, জর্মনির জন্মবৈরী ফ্রান্স কি এ রাষ্ট্রকে স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্যরূপে স্বীকার করবে?

আডেনাওয়ার আজীবন ফ্রান্সের প্রতি ভ্ৰাতৃভাব পোষণ করতেন। তিনি হাত এগিয়ে দিলেন ফ্রান্সের দিকে। যে-ফ্রান্স চিরকাল জর্মনিকে অবিশ্বাস করেছে সে পর্যন্ত বুঝে গেল যুগের পরিবর্তন হয়েছে। দম্ভী দ্য গল আলিঙ্গন করলেন বৃদ্ধ আডেনাওয়ারকে। ইংরেজ মর্মাহত হল। জর্মনি-ফরাসিকে বিভক্ত রেখে অস্ত্রসগ্রহার্থে দু দলকে লড়িয়ে দিয়ে, সে দাবড়াত ইয়োরোপময়।

জর্মনি ইয়োরোপ-আমেরিকার জাতিসমাজে আসন পেল।

যে জর্মন জনসাধারণকে বিশ্বজন নরাধম দানব বলে ধরে নিয়েছিল তারা দ্রজনরূপে স্বীকৃত হল।

পশ্চিম ইয়োরোপ তথা আমেরিকা যে-সব অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক সন্ধিচুক্তি তৈরি করছিল তার সর্বোচ্চ স্তরের সবকটিতেই জর্মনি আসন পেল।

এবং আমরা যারা এ-দেশে বাস্তুহারা সমস্যা নিয়ে উদভ্রান্ত– অবিশ্বাস্য বলে মনে করি যে, আডেনাওয়ারের নেতৃত্বে পশ্চিম জর্মনি স্থান করে দিল তার আপন শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে, পূর্ব জর্মনি থেকে আগত এক কোটি বিশ লক্ষ বাস্তুহারাকে তাদের জীবনমানে ও পশ্চিম জর্মনির জীবনমানে আজ আর এতটুকু পার্থক্য নেই, আমি স্বচক্ষে ১৯৫৮ এবং পুনরায় ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে দেখে এসেছি। কোনও লক্ষ্মীছাড়া দণ্ডকারণ্যে গিয়ে বাস্তুহারাদের বাস্তুভিটে-ঘুঘু-রূপ ধারণ করতে হয়নি।

এবং বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়, এই আপাতদৃষ্টিতে নৈরাশ্যপূর্ণ গুরুভার আডেনাওয়ার এগিয়ে গিয়ে আপন স্কন্ধে তুলে নিলেন তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে, রাষ্ট্রজনকরূপে, তেয়াত্তর বছর বয়সে।

এ যুগকে সমসাময়িক জর্মন ইতিহাসে বলা হয়, আডেনাওয়ার অ্যারা আডেনাওয়ার যুগ।

এবং এ যুগের এখনও শেষ হয়নি। বিসমার্ককে বিতাড়িত করার পর কাইজার তার রাজনীতি সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিলেন, ৮৭ বছর বয়সে বৃদ্ধ(?) অবসর গ্রহণ করার পর যে দুজন চ্যানসেলার পর পর নিযুক্ত হলেন তারাও বৃদ্ধের কর্মাদর্শ কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে চলেছেন।(৬)

অবসর গ্রহণের পর তিনি বৃহৎ তিন খণ্ডে লেখেন তাঁর জীবনস্মৃতি। তৃতীয় খণ্ড প্রেসে পাঠানোর কয়েক সপ্তাহ পর তিনি গত হন।

মৃত্যুর আট দিন পূর্ব পর্যন্ত তাঁর কর্মক্ষমতা অটুট ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিজিংগার আডেনাওয়ারের শোকসভাতে বলেন, কয়েক দিন পূর্বেও তিনি র্যোনডর গ্রামে যান, বৃদ্ধের কাছ থেকে পথনির্দেশ গ্রহণ করতে। এই শেষ দর্শনের সময় তিনি কিজিংগারকে বিভক্ত জৰ্মনি সম্বন্ধে দুঃখ প্রকাশ করেন। শেষ কথা বলেন, আজ যে ধুলো আর কুয়াশাতে পৃথিবী ঢাকা সেটা যখন পরিষ্কার হবে তখন যেন কেউ না বলে, আমি আমার কর্তব্য করিনি।

***

বিশ্বজন সম্পূর্ণ একমত যে :

১. আনোওয়ার পদদলিত জৰ্মনিকে লুপ্ত-আত্মসম্মানবোধ এনে দেন ও ইউরোমেরিকার রাষ্ট্রসমাজে তার জন্য গৌরবের আসন নির্মাণ করেন,

২. চিরবৈরী ফ্রান্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন,

৩. এক কোটি বিশ লক্ষ বাস্তুহারাকে পরিপূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।

তিনি মাত্র একটি আশা সফল করতে পারেননিঃ

দ্বিখণ্ডিত জৰ্মনিকে একত্র করতে পারেননি।

***

এস্থলে আমি শুধু দুটি বিষয় উল্লেখ করব :

হ্যার ভাইমার স্বৰ্গত আডেনাওয়ারের উত্তম জীবনী লিখেছেন। আর পাঁচখানা বিদেশি বইয়ের মতো এটিও আমার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হয়নি বিদেশি মুদ্রা ও বিদেশি পুস্তক-বিক্রেতাদের কৃপায়।

জর্মন বেতার এই উৎকৃষ্ট পুস্তক থেকে একাধিক অনুচ্ছেদ পড়ে শোনায়।

তারই একটিতে আছে, আডেনাওয়ারের পুত্র উক্ত লেখককে বলেন, আমার পিতার মাথার ওপর যখন সমস্ত জৰ্মনির দায়িত্ব তখন আমার মা গত হন। সঙ্গে সঙ্গে পিতা তাঁর দৈনন্দিন রুটিন আমূল পরিবর্তন করে দিলেন, যাতে করে আমরা আরও বেশি সময় ধরে তাঁর সঙ্গলাভ করতে পারি। এর পর থেকে কোথাও সফরে গেলে আমাদের জন্য প্রতিটিবার সওগাৎ আনতে কখনও তার ভুল হত না।

আডেনাওয়ার আপন দেশকে বঞ্চিত করেননি, পরিবারের প্রিয়জনকেও বঞ্চিত করেননি।

যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্বার্থপরতা তথা আত্মম্ভরিতার বিকৃত রূপ ধারণ করে সে কখনওই কোনও প্রকারের ত্যাগ বরণ করতে পারে না, কিন্তু যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আদর্শবাদ অঙ্গাঙ্গী বিজড়িত সেখানে প্রকৃত মহাপুরুষ সামান্য শিশুটির দাবির মূল্যও দিতে জানেন। রাজকার্য, সমাজসেবা, রাষ্ট্রের আহ্বান– এসব গালভরা কথার দোহাই দিয়ে যারা শিশু, বৃদ্ধ, আতুর-অকর্মণ্য জনকে অবহেলা করে তাদের আদর্শবাদ-এর অস্থিমজ্জা তাদের আপন স্বার্থপরতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়ে গঠিত।

শিষ্যসমাবৃত হয়ে প্রভু যিশু ইহজীবনের উচ্চতর আদর্শ, পরজীবনের চরম কাম্য নিয়ে যখন আলোচনা করছেন, উপদেশ দিচ্ছেন, তখনও তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি যে, শিশুরা তাঁর কাছে আসতে চায়। আদেশ দিলেন– শিশুদের আসতে দাও আমার কাছে।

শিষ্যেরা যিশুকে জিগ্যেস করলেন, Who is the greatest in the Kingdom of heaven?

And Jesus called a little child unto him, and set him in the midst of them.

***

হিটলারের আত্মহত্যার কাহিনী আমি অন্যত্র লিখেছি। তার আত্মহত্যার পর কী হয়েছিল সেটা তার চেয়ে কিছুমাত্র কম বিস্ময়জনক ও কৌতূহলোদ্দীপক নয়, বিশেষত নরদানব মারটিন বরমান তার সঙ্গে বিজড়িত আছেন বলে। কিন্তু সে কাহিনী ভিন্ন এবং এখানেও আমি মাত্র সেইটুকুরই সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করব, যেটুকু আডেনাওয়ারের ব্যক্তিত্ব হৃদয়ঙ্গম করার জন্য নিতান্তই প্রয়োজন।

হিটলার যে সময়ে আত্মহত্যা করেন (বেলা ১৫.৩০/৪৫, ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫), সে সময়ে রুশবাহিনী মাত্র কয়েকশো গজ দূরে তার বাসভবনের চতুর্দিকে বৃহ নির্মাণ করেছে। এ ব্যুহ ভেদ করে মার্কিন অধিকৃত অঞ্চলে পৌঁছাবার চেষ্টা করেন তার নিতান্ত অন্তরঙ্গ সাঙ্গোপাঙ্গ এবং কর্মচারীবৃন্দ যাঁরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেননি। এঁদের ভেতর ছিলেন। সেক্রেটারি বরমান, দুই মহিলা স্টেনো, পাচিকা, খাসচাকর লিঙে, দেহরক্ষী-দল, সার্সন, শোফার ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁদের অন্যতম হিটলারের খাস পাইলট বাওর-সৈন্যবাহিনীতে তার র‍্যাঙ্ক ছিল জেনারেলের। ইনি পালাবার সময় শুধু যে ধরা পড়েন তাই নয়, মেশিনগানের গুলিতে একখানা পা এমনই জখম হয় যে পরে সেটা কেটে ফেলতে হয়।

দীর্ঘ দশটি বছর রাশার খ্যাত-কুখ্যাত বহু প্রকারের জেল, সেল, বন্দি-শিবিরে অবর্ণনীয় কষ্টযন্ত্রণা ভোগ করার পর ইনি মুক্তি পান। পূর্বেই বলেছি দেশে ফিরে একখানা বই লেখেন যার নাম, হিটলারজ পাইলট। পূর্ণ দশটি বছর বাওর এবং অন্যান্য জর্মন বন্দিরা কী নিদারুণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরতে সক্ষম হন তার বর্ণনা দেবার মতো কল্পনাশক্তি, স্পর্শকাতরতা, কলমের জোর আমার কিছুই নেই। যে নিপীড়নে মানুষ হাঙ্গার স্ট্রাইক করে, ছুটে গিয়ে দেয়ালে মাথা ঠুকে আত্মহত্যার চেষ্টা দেয় তার বর্ণনা দিয়েছেন বাওর। আমার কাছে যেটা নিদারুণতম বলে মনে হয় সেটা পরিপূর্ণ নৈরাশ্যের তমিস্র অন্তহীন রজনী– এ বন্দিদশা থেকে ইহজন্মে আমার মুক্তি নেই।

এবং আমার মনে হয়, তার চেয়েও কষ্টের বিকৃত ভান ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যদি কিছু থাকে তবে সেটাও ওই অন্ধকারে ছলনার ভূমিকা! কী সে ছলনা? মাঝে মাঝে খবর গুজব রটে বন্দিদের হয়তো-বা মুক্তি দেওয়া হবে। আলেয়ার আলো দপ করে জ্বলে ওঠে ক্ষণতরে– আবার আবার সেই সুদীর্ঘ নিরস্ত্র অমানিশা।

জর্মনিতে চিরকালই দুটি দল। একদল পূর্বপন্থী রাশার সঙ্গে মৈত্রী কামনা করে। আডেনাওয়ার পশ্চিমপন্থী, রুশবৈরী। বিশেষত যে রুশ হাজার হাজার যুদ্ধবন্দি জর্মনদের দশ বছর পরেও কিছুতেই মুক্তি দেবে না।

রুশ ঘোড়া-বিককিরির ব্যবসা করতে চায়। যুদ্ধবন্দি বাওর ইত্যাদি ঘোড়ার বদলে সে চায় আডেনাওয়ার কর্তৃক রুশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদান, এবং পূর্ব জর্মনিকেও সে পশ্চিম জর্মনির সঙ্গে সম্মিলিত হতে দেবে না। হয়তো এটা অন্যায় নয়। হিটলার রুশ দেশে যা করে গেছেন তার বদলে এ তো সামান্যই। কিন্তু আডেনাওয়ার তো আর হিটলারের প্রিয় পুত্র যুবরাজ প্রিন্স অব্ ওয়েলস্ রূপে পিতার সিংহাসনে বসেননি যে, হিটলারের সর্ব অপকর্মের জন্য তার মূল্য দেবেন। বরং হিটলার তাঁকে করেছিলেন লাঞ্ছিত, অপমানিত, কারারুদ্ধ।

এবং তার চেয়েও বক্র পরিহাস- যে নাৎসি পার্টির মারফত তিনি আডেনাওয়ারকে কারারুদ্ধ করেছিলেন সেই পার্টিরই বহু গণ্যমান্য সদস্য, জাঁদরেল, অ্যাডমিরাল, হিটলারের আপন বয়স্যসখা রয়েছে এই যুদ্ধবন্দিদের ভেতর! আডেনাওয়ারকে নতিস্বীকার করতে হবে এদেরও মুক্তির জন্য। এবারে শুনুন বাওর কী বলেছেন :

But the-then the much-abused (অর্থাৎ নাৎসি কর্তৃক অপমানিত– লেখক) : Adenauer came to Moscow, and our camp was wild with rumours. Our hopes rocketed from zero to feverpoint-and then fell back again. This latter was when Bulganin publicly proclaimed that we were the scum of the earth, and that our crimes had robbed us of all human semblance. We cautiously but closely followed the course of Adenaures hard-fought negotiations, and we could sense that even the Russians respected the determination and integrity of the old man. (বৃদ্ধ সাদরে বলা হল- লেখক)

সৃষ্টিকর্তার লীলা বোঝে কে? একদিন সত্য সত্যই খবর এল বাওরাদি অনেকেই মুক্তিলাভ করবেন। একদল বন্দি যাবেন মস্কো থেকে পশ্চিম জর্মনির মুনিক যেখানে বাওরের মা-বউ আছেন। এ মুক্তির যাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বলেছেন, The memory of that journey is like a film that keeps breaking off. fola 17010 Mars foose দিয়ে ট্রেন যাবার সময় উল্লাসে উত্তেজিত জনতা ছুটে আসছে ট্রেনের দিকে, বাচ্চাদের হাতে রঙিন ফানুসের ভেতর জ্বলন্ত মোমবাতি, গির্জায় গির্জায় চলেছে অবিরত হর্ষোল্লাসের ঘণ্টাধ্বনি। নার্সরা ছুটে আসছে খাবার নিয়ে

থাক। আমার কলমফ অতি সাধারণ; এসবের সার্থক বর্ণনা দিতে পারেন যাদের লেখনী অসাধারণ, কিংবা বাওরের মতো লোক যারা লেখক নন কিন্তু অভিজ্ঞতাটা আছে।

এবং এর করুণ দিকটা বাওর চেপে গেছেন। যেসব পিতা-মাতা-জায়া এসেছিল আপন আত্মজনের প্রত্যাশায়– যদিও তাদের বলা হয়েছে যে, সেসব আত্মজনের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত, কিংবা মুক্তি পাবে কি না স্থির নেই– এবং যারা ফিরেছে তাদের নাম উচ্চকণ্ঠে পড়া শেষ হয়ে গেলে যখন বুঝল তাদের আত্মজন ফেরেনি, তখন—

***

আডেনাওয়ারের কীর্তিকলাপ একদিন হয়তো বিশ্বজন ভুলে যাবে, কিন্তু বহু বহু জর্মন পরিবার কি বংশপরম্পরায় স্মরণে আনবে না, কে তাদের পিতা, পিতামহ, বা প্রপিতামহকে একদা ফিরিয়ে এনেছিল তার বিস্মৃতপ্রায় সুখী নীড়ে, দারাপুত্র পিতামাতার মাঝখানে? যার অবশ্যম্ভাবী গোর ছিল সুদূর সাইবেরিয়ার অন্তহীন তুষারান্তরণের নিম্নে, সে কার দৈববলে হঠাৎ একদিন ফিরে এসে মুছে দিল জননীজায়ার আঁখিবারি!

[জুন, ১৯৬৭।]

———–

১. এখানে রোমান জাত একটা কলোনি স্থাপন করে ও নেরোর (যিনি রোম পুড়িয়েছিলেন) মা, মহারানি (Colonia) Claudia Ara Agrippinesis-এর (Colony) Colonia নাম দেয়। এই Colonia থেকে ফরাসি ইংরেজি Cologne, জর্মনে Koeln.

২. হিটলারের বিশ্বাস ছিল, ইহুদি ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত নির্বীর্য কাপুরুষের আশ্রয়স্থল খ্রিস্টধর্ম ইয়োরোপের সর্বনাশ করেছে, এবং এ ধর্ম ইয়োরোপে ছড়ানোর পিছনে রয়েছে ইহুদিদেরই (!) এক অভিনব কৌশল। আবার হিটলার মনে করতেন খ্রিস্টজন্মের পূর্বে যেসব রোমান সৈন্য প্যালেস্টাইনে মোতায়েন ছিল খ্রিস্ট তাদেরই কোনও একজনের জারজ সন্তান।

৩. ওই সময়ে আমি বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি ও আডেনাওয়ারের খ্যাতি-প্রতিপত্তি সম্বন্ধে সতীর্থদের কাছ থেকে বহু প্রশস্তি শুনতে পাই। তার সম্বন্ধে যেসব সংবাদ খবরের কাগজে ও লোকমুখে এসে পৌঁছত সেগুলো ১৯৩৩ পর্যন্ত যাচাই করে নেওয়া যেত। ওই বছরে হিটলার ক্ষমতা গ্রহণ করার ফলে প্রেসের স্বাধীনতা লোপ পায়। কাজেই যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত হিটলার-বৈরীদের সম্বন্ধে কোনও পাকা খবর পাওয়া যেত না। যুদ্ধের পর শ্রীযুক্ত ভাইমার আডেনাওয়ার সম্বন্ধে একখানি প্রামাণিক গ্রন্থ লেখেন। সেখানা জোগাড় করতে পারিনি বলে আমার জানা তথ্য ও তত্ত্ব যাচাই করে নিতে পারছিনে। বিশেষ করে ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত আডেনাওয়ার গোপনে নাৎসিদের বিরুদ্ধে কী কী করেছিলেন সেসব খবর নিশ্চয়ই এই বইয়ে আছে। আডেনাওয়ারের মৃত্যুর পর থেকে কলন রেডিও মাঝে মাঝে ওই বই থেকে কিছু কিছু পড়ে শোনায়। এ প্রবন্ধে আমি তার সাহায্য নিয়েছি।

৪. বাত্তর, হিটলারজ পাইলট।

৫. Stephen Spender, European Witness; ১৯৪৬ মাসখানেক পূর্বে যখন কেলেঙ্কারি কেচ্ছা বেরুল যে মারকিন গুপ্তচর বিভাগ Encounter কাগজকে গোপনে অর্থ সাহায্য করে, তখন তিনি কাগজের সম্পাদকপদ ত্যাগ করেন।

৬. জর্মনগণ বৃদ্ধ আডেনাওয়ারকে ভক্তি ও ভালোবাসাসহ ডাকনাম দেয় ড্যার আলটে, (ওল্ড ম্যান), তার পরের চ্যানসেলারকে সহাস্যে ডাকনাম দেয়, ড্যার ডিকে (ফ্যাট ম্যান)।

৭. আডেনাওয়ার গত হন ভারতীয় সময় অনুযায়ী বিকেল ৫.৫১ মিনিটে। যে জর্মন বেতার ভারতের জন্য প্রোগ্রাম দেয় সেটি আডেনাওয়ারের প্রিয় কলনেই অবস্থিত সে ভারতের প্রোগ্রাম আরম্ভ করে বিকেল ৬.৫০ মিনিটে। আমি তখনই খবরটা শুনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এর পর, পরপর কয়েকদিন সন্ধ্যায় কালবৈশাখীর দরুন হয় বিজলি বন্ধ হয়ে যায় বলে, নয় রিসেপশন খারাপ ছিল বলে বকে, গার্সটেনমায়ার তথা চ্যানসেলার কিজিংগারের বক্তৃতা ভালো করে বোঝা যায়নি। ২৫ এপ্রিল গোরের দিনও আবহাওয়া খারাপ ছিল।

গেলির আত্মহত্যায় হিটলারের শোক

হিটলারের চরিত্রবল ছিল অসাধারণ এবং তাঁর ভেঙে পড়াটাও ছিল অসাধারণ। তবে যে দুটো ভেঙে পড়ার কারণ ইতিহাসের জানা আছে তার শেষটা আত্মহত্যা করার কয়েক দিন আগে থেকে তার খাস-চাকর (ভ্যালে) লিঙে সেটির কিছুটা বর্ণনা দিয়েছেন, এবং গেলির মৃত্যুর পর। দুটো প্রায় একই প্রকারের।

প্রথম দু দিনের খবর কেউ ভালো করে লেখেননি, তবে তখনকার দিনের অন্যতম প্রধান নাৎসি নেতা গ্রেগর স্ট্রাসার পরে বলেন যে, এ দু দিন তিনি এক মুহূর্ত হিটলারের সঙ্গ ত্যাগ করেননি, পাছে তিনিও আত্মহত্যা করেন।(১)

এর পর তাঁর সঙ্গে ছিলেন, একমাত্র সাক্ষীরূপে, আমাদের পূর্বপরিচিত হন। এবার তাকে অক্ষরে অক্ষরে অনুবাদ ভিন্ন গত্যন্তর নেই। এটা সত্যই ওয়ান ম্যান্স স্টোরি। তিনি বলছেন, মুনিকে ফেরার পর দু দিন পর্যন্ত হিটলারকে আমি আদৌ দেখতে পাইনি। তার স্বভাব আমি ভালো করেই জানতুম, এবং বর্তমান শোচনীয় পরিস্থিতিতে আমি উত্তমরূপেই হৃদয়ঙ্গম করেছিলুম যে, তিনি হয়তো নির্জনে একা একা থাকাটাই বেশি পছন্দ করবেন– আমিও তাই তাঁর পাশ ঘেঁষিনি। তার পর হঠাৎ মাঝরাতে টেলিফোনের ঘণ্টা বাজল। নিদ্রাজড়িত অবস্থায় আমি গেলুম উত্তর দিতে।

হিটলারের গলা। হফমান, এখনও জেগে আছ কি? কয়েক মিনিটের তরে আমার এখানে আসতে পার কি? হিটলারের গলা বটে কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত অচেনা। সে কণ্ঠ ক্লান্ত আর সর্ব অনুভূতি গ্রহণে জড়ত্বে চরমে গিয়ে পৌচেছে। পনেরো মিনিট পরেই আমি তার কাছে পৌঁছলুম।

দরজা তিনি নিজেই খুলে দিলেন। অভ্যর্থনাসূচক কোনও কথা না বলে নীরবে তিনি আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন তাঁকে দেখাচ্ছে বিরস; যেন সর্ব আত্মজন বিবর্জিত। বললেন, হফমান, আমাকে তুমি সত্যিকার একটি মেহেরবানি করবে কি? আমি এ বাড়িতে আর টিকতে পারছিনে, যেখানে আমার গেলি মরে গেছে; মুলার টেগার্নজে হ্রদের উপর তার সেন্ট কুইরিনের বাড়ি আমাকে থাকতে দিতে চেয়েছে; তুমি আমার সঙ্গে আসবে? গেলির কবর না হওয়া পর্যন্ত সে কটা দিন আমি সেখানে থাকতে চাই। ম্যলার কথা দিয়েছে। সে ও-বাড়ির চাকর-বাকর সব কটাকে ছুটি দিয়ে ওখান থেকে সরিয়ে দেবে। একমাত্র তুমিই সেখানে থাকবে আমার সঙ্গে। আমাকে এ অনুগ্রহটা তুমি করবে কি? তাঁর কণ্ঠস্বরে ছিল সনির্বন্ধ মিনতির অনুনয়; বলা বাহুল্য আমি তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানালুম।

সেন্ট কুইরিন বাড়ির প্রধান ভূত্য বাড়ির চাবিটা আমার হাতে তুলে দিল। বিস্ময় এবং সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে শোকাঘাতে ভেঙেপড়া হিটলারের দিকে একবার তাকিয়ে সে চলে গেল। শোফার শ্রে আমাদের সে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেওয়ার পর তাকেও ফেরত পাঠানো হল। চলে যাওয়ার আগে সে কোনও গতিকে সুযোগ করে আমাকে কানে কানে বলে গেল, সে হিটলারের রিভলবার সরিয়ে নিয়েছে, কারণ তার ভয় পাছে নৈরাশ্যের চরমে পৌঁছে তার আত্মহত্যা করার প্রলোভন হয়। এবারে রইলুম সুন্ধুমাত্র আমরা দুজন– আর একটিমাত্র জনপ্রাণী নেই। হিটলার উপরের ঘরে আর আমি ঠিক তার নিচের ঘরটায়।

সে-বাড়িতে হিটলার আর আমি মাত্র এই দুজন। আমি তাঁকে তাঁর ঘর দেখিয়ে বেরিয়ে যেতে না যেতেই তিনি দু হাত পিছনে নিয়ে এক হাতে আরেক হাত ধরে পায়চারি করতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। আমি জিগ্যেস করলুম, তার খেতে ইচ্ছে করছে কি না, একটিমাত্র শব্দ না বলে তিনি শুধু মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালেন। আমি তবু এক গেলাস দুধ আর কিছু বিস্কুট উপরে নিয়ে তার ঘরে রেখে এলুম।

আমি আপন কামরার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে শুনলাম উপরের পায়চারির তালে তালে ওঠা ভারি শব্দ। ঘন্টার পর ঘন্টা চলল সেই পায়চারি– একবারও ক্ষান্ত দিল না, একবারও জিরুল না। রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে এল– আমি তখনও শুনছি তার একটানা পায়চারি ঘরের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত, ফের ওই প্রান্ত থেকে এ প্রান্ত। সেই একটানা শব্দের মোহে আমি অল্প কিছুক্ষণের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্নই হয়ে গিয়েছিলুম। হঠাৎ কী যেন আচমকা ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ সচেতন করে দিলে। পায়চারি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আর যেন মৃত্যুর নীরবতা চতুর্দিকে বিরাজ করছে। আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালুম। তবে কী করছেন হিটলার এখন…? অতি সন্তর্পণে এবং মৃদু পদক্ষেপে আমি যেন লুকিয়ে উপরের তলায় গেলুম। উঠবার সময় কাঠের সিঁড়ি অল্প অল্প কাঁচ ক্যাচ শব্দ করল। আমি দরজায় পৌঁছতেই– ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আবার পায়চারিটা আরম্ভ হল। বুকের বোঝা যেন অনেকটা হালকা হয়ে গেল; আমি চুপিসারে আপন ঘরে ফিরে এলুম।

এবং এইভাবে চলল সমস্ত দীর্ঘ রাত ধরে সেই পায়চারি– ঘণ্টার পর ঘণ্টা, অন্তহীন দীর্ঘ ঘণ্টা। আমার মন চলে গেল আমাদের বিগত একাধিকবার এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-পরিপূর্ণ টেগার্নজে হ্রদের কোলে লালিত বাড়িতে আসার স্মরণে। তখন সবকিছু কতই-না সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।

গেলির মৃত্যু আমার বন্ধুর গভীরতম সত্তাকে নাড়া দিয়ে কাঁপিয়ে তুলেছে। তবে কি তিনি নিজেকে তার জন্য দায়ী অনুভব করছিলেন। তিনি কি অনুতপ্ত আত্ম অভিযোগ দিয়ে আপন সত্তাকে কঠোরতম যন্ত্রণা দিচ্ছিলেন। তিনি এখন করবেনই-বা কী? এ ধরনের অনেক প্রশ্ন আমার মাথার ভেতরে ক্রমাগত হাতুড়ি পেটাচ্ছিল, আর আমি খুঁজে পাচ্ছিলুম না একটারও উত্তর।

উষার প্রথম আবির্ভাব অন্ধকার আকাশকে আলোকিত করে তুলছিল, এবং আমি আমার জীবনে উষাগমনে হৃদয়ের ভেতর কখনও এতখানি কৃতজ্ঞ অনুভব করিনি। আমি আবার উপরে গিয়ে তার দরজায় মৃদু করাঘাত করলুম। কোনও উত্তর এল না। আমি ভিতরে গেলুম কিন্তু হিটলার আমার উপস্থিতি সম্বন্ধে বিস্মৃতিতে নিমগ্ন হয়ে আমাকে লক্ষমাত্র করলেন না। দেহের পিছনে এক হাত দিয়ে অন্য হাত ধরে সুদূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে কিন্তু কোনও জিনিস না দেখে, তিনি তাঁর অন্তহীন পায়চারি চালিয়ে যেতে লাগলেন। যন্ত্রণায় তার মুখের রঙ পাশুটে, ক্লান্তিতে সেটা ঝুলে পড়েছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি চেহারাটাকে করে দিয়েছে বিষদৃশ, চোখদুটো ডুবে গিয়েছে কোটরের গভীরে, সেগুলোর নিচের অংশ কালো কৃষ্ণমসীলিপ্ত আর ঠোঁটদুটো একটা আরেকটাকে চেপে ধরে এঁকেছে যেন তিক্ত অভিশপ্ত একটি রেখা। দুধ আর বিস্কুট স্পর্শ করা হয়নি।

চেষ্টা করেও সামান্য একটা কিছু খাবেন না তিনি, প্লিজ? আমি শুধালুম। আবার কোনও উত্তর এল না, শুধু সামান্য একটু মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন। আমি মনে মনে ভাবলুম, অন্তত অল্প কিছু একটা ওঁকে খেতেই হবে, নইলে তিনি যে হুমড়ি খেয়ে ভিরমি যাবেন। আমি মুনিকে আমার বাড়িতে ফোন করে শুধালুম গেত্তি কী করে রাঁধতে হয়? হিটলারের অন্যতম প্রিয় খাদ্য এটি। সেখান থেকে পাক-প্রণালীর যে দিকনির্দেশ পেলুম বর্ণে বর্ণে সেই অনুযায়ী আমি রন্ধনকলায় আমার নৈপুণ্য আছে কি না সেই পরীক্ষাতে প্রবেশ করলুম। আমার নিজের মতে ফলটা ভালোই ওত্রালো। কিন্তু আবার আমার ভাগ্য বাম। যদিও এই ধরনের গেত্তি তাঁর প্রিয় খাদ্য, যদিও আমি আমার রন্ধন-নৈপুণ্য প্রশংসায় প্রশংসায় সপ্তম স্বর্গ অবধি তুলে দিয়ে তাঁকে অনুনয়-বিনয় করলুম, চেষ্টা দিয়েও অতি অল্প একটুখানি মুখে দিতে–আমার মনে হল আমি যা কিছু বলেছি, সে তার দু পাশ দিয়ে চলে গেছে, তিনি তার এক বর্ণও শোনেননি।

ধীরে মন্থরে দিনটা তার সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলল, তার পর এল আরেকটা রাত্রি, সেটা আগেরটার চেয়েও বিভীষিকাময়। আমি আমার সহ্যশক্তি, আত্মকর্তৃত্বের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছি। জেগে থাকা আমার পক্ষে এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে; ওদিকে উপরে সেই পায়চারি চলেছে তো চলেছে অবিরাম, আর তার শব্দ যেন কেউ তুরপুন দিয়ে আমার খুলি ফুটো করে ভেতরে ঢোকাচ্ছে। যেন এক ভয়াবহ উত্তেজনা তাঁকে তার পায়ের উপর রেখে চলেছে এবং কিছুই তাঁকে ক্লান্ত করতে পারে না।

তার পর এল আরেকটা দিন। আমি নিজেই তখন যে কোনও মুহূর্তে আপন সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় জড়ন্দ্রিায় অভিভূত হয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতে পারি। আমার নড়াচড়া, আমার কাজকর্ম করা সবকিছু যন্ত্রচালিত বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত অন্ধশক্তির প্রকাশ মাত্র। কিন্তু মাথার উপরে পদধ্বনি কখনও থামেনি।

সন্ধ্যা ঘনানোর পর আমরা শুনলুম, গেলির গোর হয়ে গিয়েছে, এবং হিটলারের সে গোরের দিকে তীর্থযাত্রারম্ভ করতে কোনও অন্তরায় নেই। সেই রাত্রেই আমরা রওনা দিলুম। নিঃশব্দে হিটলার ড্রাইভার শ্রেকের পাশে বসলেন। আমার উপরে যে অসহ্য চাপ আমাকে ধরে রেখেছিল সেটা যেন হঠাৎ ছিঁড়ে দু-টুকরো হয়ে গেল আর আমি গাড়ির ভেতর সেই অবসাদজনিত অঘোর নিদ্রায় ঘণ্টাখানেক কিংবা দুই ঘুমিয়ে নিলুম। ভোরের দিকে আমরা ভিয়েনা পৌঁছলুম, কিন্তু এই সমস্ত দীর্ঘ চলার পথে হিটলার একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করেননি।

আমরা সোজা নগরের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে কেন্দ্রীয় গোরস্তানে পৌঁছলুম। এখানে এসে হিটলার একা গোরের দিকে গেলেন। সেখানে পেলেন তাঁর নিজস্ব দুই এডিকং শ্বাস এবং শাউব– তারা সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আধঘণ্টার ভেতরই তিনি ফিরে এলেন এবং গাড়ি ওবের-জালসূবের্গে চালিয়ে নিয়ে যেতে হুকুম দিলেন।

গাড়িতে উঠতে না উঠতেই তিনি কথা আরম্ভ করলেন। উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে তিনি স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে যেন আত্মচিন্তা করছিলেন, কিন্তু স্পষ্ট কথা বলে বলে। আচ্ছা! তাই সই! বললেন তিনি। আরম্ভ হোক তবে সংগ্রাম– যে সগ্রাম শিরোপরি কৃতকার্যতার বিজয়মুকুট পরবেই পরবে, পরতে বাধ্য। আমরা সকলেই বিধির এক বিরাট আশীর্বাদ-প্রাপ্ত স্বস্তি অনুভব করলুম।…

এর পর হিটলার আঁপিয়ে পড়লেন তাঁর বক্তৃতাসফরে। আজ এখানে কাল সেখানে এমনকি একই দিনে দু-তিন ভিন্ন ভিন্ন নগরে বক্তৃতা দিয়ে যেতে লাগলেন। সেগুলো আগের চেয়ে যেন শ্রোতাদের করে দেয় অনেক বেশি আত্মহারা, যেন তাদের চিন্তাধারাকে তিনি হুকুম দিয়ে বাধ্য করছেন তারা যাবে কোন পথে। এবং শ্রোতাকেও বক্তৃতা দিয়ে আপন মতে টেনে আনার শক্তি যেন তার বেড়ে গেছে শতগুণে। হফমান বলছেন, এই শহর থেকে শহর ছুটোছুটি, প্রথমে জর্মনির সবচেয়ে শক্তিশালী মোটর মেসেডেজে করে, পরে আপন অ্যারোপ্লেনে (অনেকেই বলেন রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার জন্য ইওরো-আমেরিকায় হিটলারই সর্বপ্রথম নিজস্ব হাওয়াই জাহাজ ব্যবহার করেন এই ব্লিস্ প্রোপাগান্ডা যেন পরবর্তী যুগের ব্লিৎসক্ৰিগের পূর্বাভাস।); এখানে বিরাট বিরাট জনসভা, শ্রোতাদের চিৎকার করতালি, মিটিংশেষে উন্মত্ত জনতার প্ল্যাটফর্ম আক্রমণ– ফুরারকে কাছের থেকে দেখার জন্য এসব হট্টগোল ধুন্ধুমারের ভেতর হিটলার যেন গেলির শোক নিমজ্জিত করে দিতে চাইছিলেন।

এর তিন সপ্তাহ পরে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ আলাপ-আলোচনার জন্য হিটলারকে ডেকে পাঠান, সে কথা পূর্বেই বলেছি; যারা বলেন, সে আলোচনা নিষ্ফল হওয়ার কারণ গেলির শোকে হিটলার এমনই মোহাচ্ছন্ন ছিলেন তাঁর দাবি তিনি যথোপযুক্ত ভাষা ও দৃঢ়তার সঙ্গে প্রকাশ করতে পারেননি, ব্যক্তিগতভাবে আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। আমি বরঞ্চ হফমান যা বলেছেন তার সঙ্গে একমত। আমার মনে হয়, তখনও হিডেনবুর্গ তাঁর চিরপরিচিত প্রাচীনপন্থী আপন চক্রের ভেতরকার নেতাদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিরাশ হননি। তখনও হিটলারের সময় হয়নি।

***

গেলির জীবন, তার মৃত্যু, তার স্মৃতি সবকিছু ধর্মে উদাসীন হিটলারকে যেন এক নতুন অনুষ্ঠানবেষ্টিত সংস্কার-বিশ্বাসী করে তুলল। তিনি স্বহস্তে গেলির কামরা চাবি বন্ধ করে দিয়ে হুকুম দিলেন, একমাত্র গৃহরক্ষিণী ফ্রাই ভিন্টারেরই সেখানে প্রবেশাধিকার। বহু বছর ধরে তিনি প্রতিদিন গেলির প্রিয় ফুল তাজা ক্রিসেনথিমাম সে ঘরে রাখতেন। বেৰ্ষটেশগাডেনের বাড়িতে এবং পরবর্তী যুগে ফুরার যখন দেশের সর্বাধিকারী (তিনি প্রথমে চ্যানসেলর বা প্রাইম মিনিস্টাররূপে রাজ্যভার গ্রহণ করেন, এবং বছর দেড়েক পর প্রেসিডেন্ট গত হলে তিনি সে পদ পূর্ণ না করে নিজেই গ্রহণ করে পরিপূর্ণ ডিকটেটর নিরঙ্কুশ নেতা ফুরার হন) তখন রাজভবনে গেলির ছবি বিরাজ করত সর্বত্র। বছরে দুই দিন তার জন্মদিন আর মৃত্যুদিন রুচিসম্মত আড়ম্বরে উদযাপিত হত। সর্বোকৃষ্ট চিত্রকর ও ভাস্করদের দেওয়া হল গেলির নানা অবস্থায় তোলা নানাবিধ ফোটোগ্রাফ। সেগুলোর ওপর নির্ভর করে উত্তম ওয়েলপেন্টিং মূর্তি নির্মিত হল। জর্মনির অন্যতম উক্তৃষ্ট শিল্পী, তখনকার দিনের সর্বোকৃষ্টদের একজন– গেলির একটি অনবদ্য ব্রোঞ্জু মূর্তি নির্মাণ করেন। এদের একটা না একটা হিটলারের প্রতি বাসভবনে সর্বোচ্চ সম্মানের স্থানে রাখা হত।

এর প্রায় তেরো বছর পর এই আর্টিস্টদের অন্যতম, সিলার যখন যুদ্ধে পরাজয় মনোবৃত্তি প্রকাশের ফলে নাৎসি গেস্তাপো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দীর্ঘ কারাবাসের পর মুক্তির আশা সম্বন্ধে নিরাশ হয়ে গিয়েছেন তখন তিনি যে একদা গেলির ছবি এঁকেছিলেন (যদিও কারও কারও মতে তিনি আর্টিস্ট হিসেবে ছিলেন অতিশয় মামুলি) সে কথা হিটলারকে স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি তাঁকে তদ্দশ্যেই মুক্তি দেন।

হফমানের বিশ্বাস, গেলির সঙ্গে হিটলারের যদি পরিণয় হত তবে হিটলারের জীবন এরূপ শোচনীয় পরিসমাপ্তি পেত না। তাঁর মতে, শতধাবিভক্ত জৰ্মনিকে একাঙ্গ করে তাকে নব জীবনরস দিয়ে তিনি পুনরুজ্জীবিত করতেন নিশ্চয়ই, কিন্তু জর্মনির বাইরে যেসব বিবেচনাহীন অভিযানে বেরুলেন, সেখানে পারিবারিক শান্তি এবং তৃপ্তি– হিটলার যেটাকে অসীম মূল্য দিতেন– তথা গেলির তীক্ষ্ণবুদ্ধি, হিটলারের ওপর তার অসীম প্রভাব তাঁকে সংযত করে নিরস্ত করত– তাঁর অন্তিম নিশ্বাস বীভৎসতাময় পরিবেশে ত্যাগ না করে শান্তিতেই ফেলতে পারতেন।

হফমান বলেন, তার পরে যখনই গেলির কথা উঠেছে, হিটলারের চোখ জলে ভরে যেত। এবং একাধিক পরিচিতজনকে হিটলার স্বয়ং বলেছেন, জীবনে ওই মাত্র একবারই তিনি ভালোবেসেছিলেন।

***

গেলির মৃত্যুর চৌদ্দ বছর পর, হিটলার, আত্মহত্যা করার প্রায় দেড় দিন পূর্বে, এফা ব্রাউনকে বিয়ে করেন এবং তাঁর সম্বন্ধে কৌতূহল পৃথিবীবাসীর এখনও যায়নি। কিন্তু তার বর্ণনা এর সঙ্গে যায় না।

আমি হিসাব করে দেখেছি, হিটলারের জীবনে তিনটি দুর্দৈব দেখা দেয়। প্রথম দুটিতে তিনি প্রায় ভেঙে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যেতেন পাঠক আদৌ ভাববেন না, গ্যাস-চেম্বার নির্মাতার অন্য কোনও দিকে কোনও প্রকারের স্পর্শকাতরতা থাকে না, (তা হলে কসাইয়ের ছেলে মরলে সে কাঁদত না) এবং এঁরা অসাধারণ জীব বলে সে-সব স্থলে তাঁদের স্পর্শকাতরতা হয় অসাধারণ সূক্ষ্ম, তাঁদের বেদনানুভূতি প্রায় অনৈসর্গিক তীব্র–তৃতীয়বারের ঘটনা সকলেই জানেন। সেবার তিনি নিষ্কৃতি পাননি। আত্মহত্যা ছাড়া তখন তার আর অন্য কোনও গতি ছিল না। প্রথম দুর্দৈব তাঁর মাতার মৃত্যু। হিটলার তখন বালক, কিন্তু সেই বালকই তার মাকে যা সেবা করেছে সেটা অবর্ণনীয়, অবিশ্বাস্য– শুধু বলা যেতে পারে, স্বর্গজাত ভক্তি-প্রেমরস যেন ওই মাত্র একবার পৃথিবীতে হিটলার-জননীর মৃত্যুশয্যাপাশ্বে অবতীর্ণ হয়েছিল। তাঁর বাল্যবন্ধু তখনকার দিনের হিটলার ও মাতার মৃত্যুর পর তাঁর অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। এরকম বর্ণনা আমি আর কোথাও পড়িনি। সেবারে তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িতা মাতার শয্যাপার্শ্বে টুলের উপর বসে বসে কাটিয়েছিলেন দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি, সেবা করেছেন সমস্ত হৃদয় ঢেলে দিয়ে।

দ্বিতীয় দুর্দৈব– গেলির আত্মহত্যা।

তৃতীয়বারে– এবং শেষবারের মতো তিনি সুযোগ পেলেন সেই পায়চারি করার।

তার খাস চাকর লিঙে তার বর্ণনা দিয়েছেন। শুধু লিঙে দেখেছিলেন কাছের থেকে বলে তন্ন। তন্ন করে বর্ণনা দিতে পেরেছেন, আর হফমান নিচের তলা থেকে শুনতে পেয়েছিলেন শুধু!

কিন্তু হায়, তাঁর শেষ পদচারণার পূর্বেই তার স্বাস্থ্য সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। তার শরীরের সম্পূর্ণ বাঁ দিকটা সমস্তক্ষণ কাপে (পার্কিনসন ব্যাধি কিংবা সেন্ট ভাইরাসের নৃত্য রোগ) বা হাতটা এত বেশি স্বেচ্ছায় স্বাধীনভাবে ঘন ঘন ওঠে নামে যে পায়চারি না করার সময়ও সেটাকে প্রায়ই তিনি ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে শান্ত করার চেষ্টা দিতেন। বাঁ পা-টাকে ঘষ্টে ঘষ্টে টেনে টেনে তাঁকে চলাফেরা করতে হয়, আর দু চোখের উপর কখনও-বা ফিমের মতো বাম্পাভাস, আর কখনও-বা অস্বাভাবিক তীব্র, উজ্জ্বল জ্যোতির মতো।

এই বেদনাদায়ক অবস্থায় যখন সাধারণ জন শুয়ে-বসেও শান্তি পায় না, তখন হিটলার দু হাত পিছনে নিয়ে সজোরে ডান হাত দিয়ে বা হাত চেপে ধরে বাঁ পা টেনে টেনে– যেন কোনও জড়পদার্থ, তিনি আপন দেহ দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন– আরম্ভ করলেন সেই প্রাচীন দিনের পায়চারি। মাঝে মাঝে দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে তার উপর মুষ্ট্যাঘাত করেন– কারাবাসী-জন যে-রকম করে থাকে; তবে কি তিনি শহরের চতুর্দিকে শত্রুসৈন্য বেষ্টিত হয়ে কারাবন্দির অনুভূতিই অনুভব করেছিলেন? কিন্তু হায়, এখন তিনি শক্তিহীন জরাজীর্ণ। প্রহরের পর প্রহর, দিনের পর দিন পদচারণা করার দৈহিক শক্তি আর নেই। তাই মাঝে মাঝে বসেন চেয়ারের উপর আর শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন দেওয়ালের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

কিন্তু এখন আর কী প্রয়োজন পদচারণের?

সেদিন গেলির মৃত্যুর পর উত্তেজিত হয়ে তুমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়চারি করে সে উত্তেজনা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলে। এবার যে ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার! শত্রুর হাতে অসীম যন্ত্রণা, অশেষ অপমানের পর হয়তো ফাঁসি। এবার তোমার আত্মহত্যার পালা।

তবু পদচারণ করো, হিটলার।

একদা গেলি চলে যাওয়ার পর করেছিলে অস্থির পদক্ষেপ, এবার গেলির সঙ্গে পুনর্মিলনের প্রাক্কালে অবশ্য দেহ টেনে টেনে।

———–

১. বোধহয়, তারই কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ স্ট্রাসারকে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন জোলাপের (এটার উল্লেখ আমরা একাধিকবার করেছি) সময় মেরে ফেলা হয়।

২. ইতালীয়দের স্টেপলফুড– আমাদের ভারতের মতো নিত্য খাদ্য। মাক্কারনি, মাগেত্তি, ভেরমিচেল্পি ইত্যাদি। সবই ময়দার তৈরি, অনেকটা মুসলমানদের সেঁওইয়ের মতো। রান্না করা হয় নানা পদ্ধতিতে, তার শত শত রেসিপি (পাক-প্রণালী) আছে।

গেলির প্রবেশ

সম্পূর্ণ অচিন্তনীয়, অবিশ্বাস্য অতিপ্রাকৃত বা মিরাই বলা যেতে পারে।

নিতান্ত একটি চিংড়ি (চ্যাংড়ার স্ত্রীলিঙ্গ) মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এলেন হিটলার তাঁর অন্যতম ক্যাফেতে। অতি দ্রভাবে সে সবাইকে নমস্কারাদি করল। সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু তাজ্জব। কি বাৎ। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতে তাবৎ কথাবার্তা সে-ই বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে ওদিকে এতই বিবেচনা ধরে যে একে কথা বলতে দেয়, ওকেও কথা বলতে দেয়, কাউকে অস্বাভাবিক আড়ষ্ট হতে দেয় না– সবাই, ইংরেজিতে যাকে বলে ভেরি মাচ্ অ্যাট ইজ– কিন্তু সব মন্তব্য, সব আলোচনা ঘুরেফিরে যায় ওই মেয়েটিরই কাছে।

আর অতিপ্রাকৃত, মিরা হল এই যে, স্বয়ং হিটলার চেয়ারে আরামসে হেলান দিয়ে সুমধুর পরিতৃপ্তির মৃদুহাস্য বদনমণ্ডলে ছড়িয়ে দিয়ে বসে আছেন।

হিটলারকে যখনই তার চেয়ে বয়সে বড় মুরুব্বিস্থানীয় পার্টি মেম্বরেরা শুধোতেন, বয়েস তো হল, বিয়ে-শাদির কথা–

হিটলার বাধা দিয়ে বলতেন, জর্মনি আমার বধূ!

ঠাট্টাছলে বললেও এর ভেতর যে অনেকখানি সত্য লুক্কায়িত আছে সে তত্ত্বের কিছুটা সে-সব মুরুব্বিরা জানতেন। নইলে এ-জাতীয় প্রশ্ন ব্যক্তিগত জীবনে দ্বিরদরদ-নির্মিত শিখরবাসী হিটলারকে জিগ্যেস করবে কে? কারণ তারা এবং পার্টির অন্য সবাই জানতেন, হিটলার জাত-ব্যাচেলার। তা সে ভিয়েনিজ কেতায় সুন্দরীদের সামনে যতই গ্যালানট্রি, শিভালরি দেখান না কেন, রমণীদের কথা উঠলে টেবিলে দু হাত রেখে, সুমুখের দিকে ঝুঁকে যতই সিরিয়াসলি তিনি কোথায় কোন সুন্দরী রমণী দেখেছেন, যে বেভারিয়াকে তিনি এত ভালোবাসেন যে আপন মাতৃভূমি ত্যাগ করে এখানে এসে স্থায়ী আবাস নির্মাণ করেছেন সেই বেভারিয়া মায় তার মুনিক সুন্দরীর ব্যাপারে যে ভিয়েনার কাছেই আসতে পারে না– এসব নিয়ে যত ধানাইপানাই তিনি করুন না কেন, পার্টির উঁচু মহলের প্রায় সবাই জানতেন যে হিটলারের পক্ষে কোনও সুন্দরীকে নিয়ে পার্টির অতি সঙ্কীর্ণ গণ্ডির ভেতর কিছুটা ঢলাঢলি বরঞ্চ সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়, কিন্তু বিয়ে করে বউ কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে ঘর বাঁধবার মতো মানুষ হের হিটলার নন। মাঝে মাঝে তাকে এ মন্তব্যও করতে শোনা গেছে : সুন্দরীদের ভালোবাসব না– সে কী? আমি কি এতই রসকষ বর্জিত আকাট! যা বলুন, যা কন্ আপনারা তো জানেন, আমার সত্তার অন্তস্তলে যে পুরুষ লুকানো আছে তিনি আর্টিস্ট! এবং আমি ফুলও ভালোবাসি কিন্তু তাই বলে কি আমাকে বাগানের মালী হতে হবে? প্রায় এ সত্যটিই চার্লস ল্যাম্ বলেছেন, আমার ঘরে ফুল নেই কেন, শুধদচ্ছেন? আমি কি ফুল ভালোবাসিনে? নিশ্চয় বাসি। আমি শিশুদেরও ভালোবাসি তাই বলে তাদের মুণ্ডুগুলো কেটে ঘরের ভেতর ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখিনে। আর এ বিষয়ে পরিপূর্ণ সত্যের শেষ শব্দটি বলতে হলে বাংলা প্রবাদেরই শরণাপন্ন হতে হয়;– বাজারে যখন দুধ সস্তা তখন গাই পোর কি প্রয়োজন?

পূর্বেই বলেছি, সত্যকার অন্তরঙ্গ বন্ধু হিটলারের কেউ ছিল না। তবু মোটামুটি যাকে বন্ধু বলা যেতে পারে তিনি তার ফোটোগ্রাফার হফমান। একে তিনি এই প্রসঙ্গে খাঁটি বৈষয়িক তত্ত্বকথাটি বলেন, জর্মনিকে গড়ে তোলা আমার জীবনের একমাত্র কাম্য, আদর্শ! একবার আমার জেল হয়েছে, আবার যে কোনও মুহূর্তে আমার ছ বছরের জেল হতে পারে। তখন বউ-বাচ্চা বাইরে, আমি গরাদের ভেতর। এটা কি খুব বাঞ্ছনীয় পরিস্থিতি?

তবু বেশিরভাগই এই নবাগতা সুন্দরী, ব্লন্ডিনী, মধুরভাষিণী, আত্মসচেতন, অথচ বিনয়ী মেয়েটিকে দেখে, (এবং বিশেষ করে লক্ষ করে যে হিটলার কফি-চক্রের চক্রবর্তীর সম্মানিত আসন সানন্দে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। ভাবলেন, তবে কি হিটলারের জর্মনি আমার বধূ নীতিটি পরিবর্তন করার সময় এসেছে?

মেয়েটির নাম আঙেলিকা রাউবাল। হিটলারের সৎবোনের মেয়ে ভাগ্নি। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে কিঞ্চিৎ অসুবিধা আছে সত্য কিন্তু তেমন কোনও অলঙ্ঘ্য আপ্তবাক্যপ্রসূত নিষেধ নেই।(১) মেয়েটির মা বিধবা, সামান্য যে পেনশন পায় তাতে দুই কন্যাসহ জীবনযাপন সহজ নয়; এদিকে যে ছোট বৈমাত্রেয় ভাই অ্যাডলকে তার বহু দোষ– তার মারাত্মক গোটা তিনেক পূর্বেই নিবেদন করেছি– থাকা সত্ত্বেও তাকে ছেলেবেলা থেকেই গভীরভাবে স্নেহ করেছে, সেই অ্যাডলফ এখন সচ্ছল হওয়ার দরুন আপন জন্মভূমি অস্ট্রিয়ার কাছেই সীমান্তের লাগোয়া অঞ্চলে মুনিক থেকে একশো মাইল দূরে বেৰ্ষটেশগাডেনে বাড়ি কিনে তাঁকে অনুরোধ করেছে সীমান্তের এপারে এসে সে বাড়ির জিম্মা নিতে। বেচারা অ্যাডলফুকে বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয় মুনিক শহরে রাজনীতি নিয়ে, সময় পেলে ওই গ্রামের নতুন বাড়িতে গিয়ে যেন একটুখানি আরাম পায়। তদুপরি এ তথ্য সর্বজনবিদিত যে, আঙেলিকা রাউবালের মা, হিটলারের এই সৎবোনটি যেমন বাড়ি চালাতে জানে, অতিথিসজ্জনের সেবা করাতে নিপুণা, তেমনি পাচিকারূপে সমস্ত নগরীতে অতুলনীয়া।(২) স্বভাবতই সঙ্গে নিয়ে এলেন দুই মেয়েকে। এদের বড়টিই আঙেলিকা বা গেলি।

মেয়েটি যে অসাধারণ সুন্দরী ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এর সম্বন্ধে এবং মামা অ্যাডফের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল সে সম্বন্ধে একাধিক লেখক আপন আপন মতামত দিয়েছেন। এর ভেতর দুজন দুই মত পোষণ করেন, এবং পঁয়ত্রিশ বছর পর আজ সত্য নিরূপণ করা অসম্ভব। তবে দু-জনাই একমত যে, ওই গেলি-ই হিটলারের ওয়ান গ্রেট লাভ! এঁদের একজন হিটলারের ফোটোগ্রাফার বন্ধু হাইনরিষ হন। হিটলারের মৃত্যুর দশ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইনি হিটলার সম্বন্ধে একখানা বই লেখেন। বইখানার নাম হিটলার উয়োজ মাই ফ্রেন্ড ইংরেজি অনুবাদে। বলা বাহুল্য যে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দেও তিনি সব কথা প্রাণ খুলে বলতে পারেননি। তবে একথা সত্য, সব তত্ত্ব গ্যাস-চেম্বারে ইহুদি পোড়ানো ইত্যাদি জেনে-শুনেও তিনি হিটলারের নিন্দার চেয়ে প্রশংসাই করেছেন বেশি– তবে এ কথাও বলে রাখা ভালো, রাজনৈতিক ব্যাপারে হফমানের কোনও চিত্তাকর্ষণ ছিল না, ওই বিষয়, যুদ্ধবিগ্রহ, কনসেট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদি নিয়ে দুই বন্ধুতে আলোচনা হত খুবই কম। ফটোগ্রাফার হলেও হফমান উত্তম উত্তম ছবির কদর ও সন্ধান জানতেন, এবং হিটলারেরও রুচি ছিল স্থাপত্যে, চিত্রে ও ভাস্কর্যে। দু-জনার আলাপ-আলোচনা হত আর্ট নিয়ে।

অন্যজনের নাম পুৎসি হানফস্টেঙেল। এঁর বইয়ের নাম আনহার্ড উইটনেস্। হিটলার যখন মুনিকে তার দল গড়ে তুলতে আরম্ভ করেন তখন উভয়ের পরিচয় হয়। পুৎসি বিত্তশালী খানদানি ঘরের ছেলে বলে তিনি হিটলারকে নানাভাবে সাহায্য করতে সক্ষম হন। হিটলার ফুরার হওয়ার পরও বেশ কিছুকাল তিনি দরবারে আসা-যাওয়া করতেন এবং প্রায়ই নিভৃতে হিটলারকে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাতেন। শেষ পর্যন্ত তিনি দরবারের কূটনৈতিক মারপ্যাঁচে হেরে যান এবং সুইটজারল্যান্ডে পালিয়ে গিয়ে সেখানেই ঘর বাঁধেন। ইনি তাঁর পুস্তকে হিটলার এবং গেলি উভয়েরই বিরুদ্ধে প্রচুর বিষোদগার করেছেন। তাঁর মতে গেলি অতিশয় সাধারণ আর পাঁচটা মেয়ের মতো ফ্লার্ট করার জন্য আকুল, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রসিদ্ধ ইংরেজ ঐতিহাসিকরা হিটলার সম্বন্ধে আপন আপন বই লেখার পর, এই দু-জনার বই বেরিয়েছে এবং ইংরেজ ঐতিহাসিকদের ধারণা হফমানের কাছাকাছি। তা সে যা-ই হোক, এ কথা সত্য হিটলার তার ভাগ্নিকে নিয়ে ক্যাফেতে যেতেন এবং আগে কাজের চাপে সিনেমা, থিয়েটার, অপেরায় অল্প যেতেন– এখন গেলির চাপে সেগুলো বেড়ে গেল। কিন্তু আসলে হিটলার সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন গেলিকে মোটরে করে নিয়ে পিকনিক করতে–মুনিকের চতুর্দিকে পিকনিকের জন্য অত্যুৎকৃষ্ট স্থল বিস্তর। পাহাড়, উপত্যকা, হ্রদ, নদী, বনফুলে ভর্তি মোলায়েম ঘাসের ঢালু মাঠ, মহান বনস্পতি–কোনও বস্তুরই অভাব নেই। হফমান পরিবার প্রায়ই সঙ্গে যেতেন।

সোজা বাংলায় বলতে গেলে হিটলার এই কুমারীকে যেন দেবতার আসনে বসিয়ে পুজো করতেন। এবং তাই লোকজনসমক্ষে তিনি কখনও বে-এক্তেয়ার হয় এমন কোনও আচরণ করেননি যা মুগ্ধ প্রণয়ী ইয়োরোপে মাঝে মাঝে করে থাকে। গেলির কণ্ঠস্বর মিষ্ট ছিল, হিটলার সে স্বর তালিম দিয়ে অপেরার জন্য গেলিকে তৈরি করতে চাইলেন এবং উপযুক্ত গুরু নিয়োগ করলেন। পুৎসি বলেন অন্য কাহিনী। তিনি বলেন, মেয়েটা ছিল অত্যন্ত বাজে ফ্লার্ট টাইপের। অপেরায় উপযুক্ত কণ্ঠস্বর প্রস্তুত করতে হলে যে রেওয়াজ এবং বিশেষ করে যে কঠোর অধ্যবসায়ের প্রয়োজন ছিল, গেলির চরিত্রে তার কণামাত্র উপাদান ছিল না। প্রায়ই গুরুকে ফোন করে রেওয়াজ নাকচ করে দিত এবং এই ফাঁকে ফ্লার্ট করার তালে লেগে যেত। পুৎসির মতে শেষ পর্যন্ত গানের ক্লাস সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

তবে এ-কথা সর্বদীসম্মত যে, ভিয়েনায় যে গুরুর কাছে গেলি সর্বপ্রথম গান গাইতে শেখা আরম্ভ করে সে তার কাছে ফিরে যেতে চাইত। জনশ্রুতি এ-কথাও বলে, সেখানে নাকি গেলির দয়িত বাস করত।

এবং ঠিক এইখানেই ছিল হিটলারের ঘোরতর আপত্তি। শুধু তাই নয়, যদিও গেলিকে খুশি করার জন্যে হিটলার সবকিছুই করতে রাজি ছিলেন– যেমন গেলির সঙ্গে টুপিজুতো কিনতে যাওয়ার মতো মারাত্মক একঘেয়ে ঘষ্টানিও তিনি বরদাস্ত করে নিতেন (হিটলার নিজেই বলেছেন, গেলির সঙ্গে হ্যাট টুপি কাপড় কিনতে যাওয়ার চেয়ে কঠিনতর অগ্নিপরীক্ষা ত্রিসংসারে আর নেই। আধঘণ্টা একঘণ্টা ধরে দোকানের মেয়েকে দিয়ে বস্তার পর বস্তা কাপড় নামাবে, তার সঙ্গে সে-সব নিয়ে প্রাণ ঢেলে দিয়ে আলোচনা করবে। এবং শেষ পর্যন্ত কিছুটি না কিনে গট গট করে বেরিয়ে চলে যাবে অন্য দোকানে। হিটলার ততক্ষণ বোধহয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে বসে আঙুলের নখ কামড়াতেন, কিন্তু যাই করুন আর নাই করুন, তার পরের বারও বাছুরছানাটির মতো গেলির সঙ্গে কেনা-কাটা করতে যেতেন ঠিকই) কিন্তু একটা বিষয়ে তিনি অচল অটল। তার অনুমতি ভিন্ন গেলি যার-তার সঙ্গে আলাপচারী করতে পারবে না। এমনকি পরিচিতজনের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কিও চলবে না। এবং এই ফরমান যে কত সুদূরপ্রসারী সেটা স্বয়ং গেলিও জানত না।

গেলি অবশ্যই জানত হিটলার তাকে ভালোবাসেন, তার প্রেমমুগ্ধ, সে প্রেম যে কত অতল গভীর সে সম্বন্ধে বেচারীর কোনও ধারণাই ছিল না। একদিন সেটা সে বুঝতে পারল রীতিমতো ভীতশঙ্কিত হয়ে।

হিটলারের পার্টির সদস্যগণ যে যে কাজই করুন না কেন, সমাজে তাদের যে স্থানই হোক না কেন, পার্টির ভেতর একটা প্রশংসনীয় সাম্যবাদ ছিল। হিটলারের মোটর ড্রাইভার এমিল মরিস ছিল প্রাচীন দিনের পার্টি মেম্বার। সে একদিন কাঁপতে কাঁপতে হফমানের সামনে এসে বলল, সে গেলির সঙ্গে ঠাট্টাটুটি করছিল, এমন সময় হঠাৎ হিটলার ঘরে ঢুকে রেগে, জিঘাংসায় যেন সর্ব আত্মকতত্ত্ব হারিয়ে চিৎকারের পর চিৎকারে মরিসকে গালাগাল দিতে আরম্ভ করেন। মরিস তো রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে ভাবল, হিটলার যে কোনও মুহূর্তে পিস্তল বের করে গুলি চালাতে পারেন। ঘটনাটি হফমানকে বলার সময় সে তখনও ভয়ে কাঁপছে।

হফমানের মতে গেলি ছিল পূত, পবিত্র, পুষ্পটির মতো। তিনি বলেন, অপরাধ তার দিক দিয়ে নিশ্চয়ই কিছু ছিল না। কিন্তু মরিসটি ছিলেন ঈষৎ নটবর। কিন্তু সে-ও যে ফুরারের ভাগ্নির সঙ্গে বাড়াবাড়ি করবে সেটা অবিশ্বাস্য। করতে গেলে বহু পূর্বেই মরিসের বন্ধুবান্ধব তাকে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন করে দিত।

হিটলারের শত্রুর অভাব কোনওকালেই ছিল না। এমনকি তাঁর প্রধান শত্রু কম্যুনিস্ট দলের কিছু কিছু সদস্য পার্টির আদেশ অনুযায়ী নাৎসি মেম্বারশিপ নিয়ে হিটলারের কার্যকলাপ লক্ষ করে যথাস্থানে তাদের রিপোর্ট পাঠাত। এদের তো কথাই নেই, আরও কেউ কেউ বলেন, সমস্ত ব্যাপারটা এতখানি ধোয়া তুলসীপাতা ছিল না।(৩) তা সে যাই হোক, হিটলার আত্মকর্তৃত্ব ফিরে পেলেন বহু কাল পরে–ইতোমধ্যে মরিস গা-ঢাকা দিয়ে থাকত– হঠাৎ সামনে পড়ে গেলে তুলকালাম কাণ্ড লেগে যেত।

ইতোমধ্যে আরেকটা কাণ্ড ঘটে গেল। হিটলার প্রপাগান্ডা-সফরে বেরুলে গেলি মায়ের কাছে, হিটলারের গ্রামের বাড়িতে চলে যেত। বোধহয় তারই কোনও এক সময়ে হিটলার প্রিয়া গেলিকে একখানা চিঠি লেখেন– সেটাতে নাকি যৌনসম্পর্ক সম্বন্ধে হিটলার অতিশয় প্রাঞ্জল শত্রুপক্ষের অভিমতে– অশ্লীল ভাষায় আপন কাম্য আদর্শ যৌনসম্পর্ক সম্বন্ধে অভিমত প্রকাশ করেন। যৌনবিজ্ঞানীরা বলেন অত্যাচারী শাসকদের (টাইরেন্ট) অনেকেই নাকি মাজোকিস্ট হয়ে থাকেন–অর্থাৎ স্বাভাবিক যৌনসঙ্গমের পরিবর্তে উলঙ্গ রমণী সে স্থলে পুরুষকে তীব্র কশাঘাত করে, কিংবা তলায় সূক্ষ্ম লোহা লাগানো রাইডিং বুট পরে পুরুষের স্কন্ধোপরি ঘন ঘন বুটাঘাত করে, তবেই নাকি পুরুষ তার যৌনানন্দ পায়(৪) শত্রুপক্ষের মতে হিটলারের চিঠি মাজোকিস্ট দর্শন(!) বিবৃত করেছিল। সে চিঠি নাকি দুর্ভাগ্যক্রমে পড়ে যায় অন্য লোকের হাতে। অতি কষ্টে, বহু অর্থ নিয়ে (বলা হয় পার্টি ফান্ড থেকে) এক ক্যাথলিক পাদ্রি–ইনি তাঁর ইহুদি-বিদ্বেষ নাৎসি পার্টিতে যোগ দিলে কার্যে পরিণত করতে পারবেন এই আশায় পার্টিতে যোগ দেন- তারই বিনিময়ে চিঠিখানা কিনে নেন। (কথিত আছে, ৩০ জুন ১৯৩৪-এ হিটলার যখন বিনা বিচারে এক তথাকথিত বিদ্রোহী দলের নেতা র্যোম, হাইস্ ইত্যাদিকে গুলি করে মারবার আদেশ দেন তখন সেই মোকায় আরও জনা চারশোর সঙ্গে এই ফাদার স্টেমপফুলে-কেও খুন করা হয়। তার দোষ তিনি ওই চিঠির সারমর্ম স্বমস্তিষ্কে সীমাবদ্ধ না রেখে দু-একজন অন্তরঙ্গ পার্টি মেম্বারকে বলে ফেলেন। হিটলার-সখা হফমান অবশ্য এ চিঠির উল্লেখ করেননি বরঞ্চ স্টেপলে ও অন্যান্য নাৎসি নেতা নিহত হওয়ার কয়েকদিন পর হিটলারের সঙ্গে যখন দেখা করতে যান তখন তাকে দেখামাত্রই নাকি হিটলার বলে ওঠেন, জানো হফমান, শুয়োরের বাচ্চারা আমার প্যারা ফাদারকেও খুন করেছে! অবশ্য এ কথা সত্য যে, জুন ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে হিটলারের আদেশে যে পাইকারি খুন জুন পাৰ্জ বা জুন মাসের জোলাপ হয়–এ লেখক তখন জর্মনিতে ও ধুন্ধুমারের যতখানি আর পাঁচটা রাস্তার নাগরিক দেখতে পেয়েছিল, সে-ও পেয়েছে, কিন্তু সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর হিটলার জাতির সম্মুখে যখন আপন সাফাই গেয়ে বক্তৃতা করলেন, তখন আর পাঁচজন নাগরিকের মতো সে সেটা বিশ্বাস না করে অবিশ্বাস করেছিল এবং পরবর্তী ইতিহাস-উদঘাটন লেখককেই সমর্থন করে তখন গ্যোরিং, হিমলার আদেশদাতা হিটলারকে না জানিয়ে, পরে মিথ্যে অভিযোগ এনে, আপন আপন ব্যক্তিগত শত্রুও খতম করেন। কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলেন, ফুরারের গোপনীয় কেলেঙ্কারি বাবদে যখন ফাদার এতই অসতর্ক তখন এ মোকায় তাকে সরিয়ে ফেলাই ভালো– এই উদ্দেশ্য নিয়ে তাকেও খুন করা হয়। কিন্তু এই পার্জ বা জোলাপ গেলি-প্রেমের ছ বছর পরের কথা, আমরা ১৯২৮-এ ফিরে যাই)।

তা সে চিঠি আদৌ হিটলার লিখেছিলেন কি না সে তর্ক উত্থাপন না করলেও জানা যায়, ওই সময়ে পার্টিসদস্যদের ভেতর কানাঘুষা আরম্ভ হয়। কারণ ইতোমধ্যে হিটলার আরও ভালো রাস্তায় বৃহৎ ভবন কিনে সেখানে গেলির জন্য রাজরানির মতো আবাস নির্মাণ করে সেইটেকে আপন স্থায়ী আবাস-বাটি করেছেন, গেলিকে যত্রতত্র সর্বত্র সঙ্গে নিয়ে যান, এবং নিতান্ত সরল পার্টিসদস্যও দু-চারবার লক্ষ করলেই বলত, নিশ্চয়ই ফুরার এ মেয়েতে মজেছেন। তা তিনি মজুন, কিন্তু একে বিয়ে করলেই তো পারেন। নইলে শত্রুপক্ষ যে বলছে হিটলার রক্ষিতা পোষণ করেন, দু কান কাটার মতো স্বভবনে তার সঙ্গে বাস করেন, তিন কান কাটার মতো সগর্বে সদম্ভে তাকে নিয়ে সর্বত্র এমনকি পোলিটিক্যাল পার্টি মিটিঙেও যাতায়াত করেন, এবং আপন ভাগিনীর–তা হোক না কেন সৎবোনের মেয়ে– ভবিষ্যৎটি যে ঝরঝরে করে দিচ্ছেন সে বিষয়ে তাঁর কোনও বিবেকদংশন নেই; আর এতদিন ধরে প্রচার আর প্রচার যে, হিটলারের মতো সর্বত্যাগী, জিতেন্দ্রিয় পুরুষ আর হয় না, তিনি যে উনচল্লিশ বছর বয়সেও দারগ্রহণ করেননি তার একমাত্র কারণ, দারাপুত্ৰপরিবার দেশের জন্যে তার আত্মোৎসর্গে অন্তরায় হবে বলে। জিতেন্দ্রিয় না কচু!

এই কেলেঙ্কারিতে পার্টির কতখানি ক্ষতি হচ্ছিল বলা কঠিন, কিন্তু এ-কথা সত্য যে নাৎসি পার্টির ভরটেমূবের্গ অঞ্চলাধিপতি মুরুব্বি, পার্টির এক অতি প্রাচীন সদস্য যখন হিটলারের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করলেন তখন তিনি রাগে ক্রোধে চিৎকার করে তাকে পার্টি থেকে স্রেফ খেদিয়ে দিলেন।

এদিকে হিটলারের কড়া পাহারা গেলির ওপর। হফমানের মতে তিনি আদৌ জানেন না যে গেলি অন্যজনকে অতি গভীরভাবে ভালোবাসে– ভিয়েনায় নাকি দয়িতের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এবং এ কথাও সত্য, গেলি বার বার সঙ্গীতচর্চা করার জন্য তার প্রাচীন গুরুর কাছে ভিয়েনায় যেতে চায় এবং হিটলারের কবুল জবাব, নাই অর্থাৎ নো! যে মুনিকের সহস্র সহস্র নরনারী হিটলারের উচ্ছ্বসিত ভক্ত, সেই হিটলার যখন গেলির পদপ্রান্তে তাঁর প্রণয় রাখলেন তখন আর কিছু না হোক, এত বড় সর্বজনপ্রশংসিত একটি গ্রেটম্যানের বশ্যতা গেলিকে নিশ্চয়ই মুগ্ধবিহ্বল করেছিল। (প্রেমের প্রতিদান দিক আর না-ই দিক) এবং হয়তো হিটলার সেই বিহ্বলতাকেই প্রণয়ের প্রতিদান হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। হফমানের মতে, হিটলারের গ্রেট লভ ছিল স্বার্থপর প্রেম অনেক মুনিঋষিরাও বলেন, গ্রেট ল কখনও নিঃস্বার্থ হতে পারে না, সে লাভার অন্য সকলের প্রতি হয়ে যায় হিংসাপরায়ণ, তার বুভুক্ষা অসীম। বার্নার্ড শ-ও বলেছেন, গ্রেট লড় সামলে-সুমলে অল্প মেকদারে ধীরে ধীরে প্রকাশ করতে হয়। নইলে দয়িতার দম বন্ধ হয়ে আসে। যেন কোনও ম্যানিয়াক প্রেমোন্মাদ তাকে অষ্টপ্রহর আলিঙ্গনাবদ্ধ করে নিরুদ্ধনিশ্বাস করে তুলেছে।

মুনিকের বছরের সবচেয়ে বড় নাচের পরব এগিয়ে আসছে। প্রাণচঞ্চলা গেলি কেন, নিতান্ত অর্থাভাব না হলে, কিংবা প্রেমিকও দরিদ্র হলে, মুনিকের কোন তরুণী সে নাচ বর্জন করে? প্রথমটায় হিটলার তো কানই দেন না। আর গেলিও ছাড়বেন না। শেষটায় বাধ্য হয়ে হিটলার রাজি হলেন, কিন্তু শর্ত রইল দুটি। সঙ্গে যাবেন দুই গার্জেন এবং দুই গার্জেনদের প্রতিজ্ঞা করতে হল যে রাত এগারোটার ভেতর গেলিকে ফের বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে।

সেই ডানসের জন্য যে পারে সে-ই নতুন হালফেশানের ফ্রক তৈরি করায়। মুনিকের সর্বশ্রেষ্ঠ ডিজাইনার-দর্জি ডাই ভঁই অতি অরিজিন্যাল ডিজাইন রেখে গেল। হিটলার এক নজর বুলিয়েই সব কটা নামঞ্জুর করে দিলেন। এগুলো বড্ড বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বড় বেশি সালঙ্কার– যদ্যপি ফ্রক হিসেবে অত্যুকৃষ্ট। গেলি যাবে সাধারণ ইভনিং ড্রেস পরে।

তাই হল। স্বয়ং হফমান ও তার চেয়ে বুড়ো পার্টির প্রাচীন সদস্য আমান গেলির চরিত্ররক্ষকস্বরূপ তাকে মধ্যিখানে নিয়ে গেলেন নাচের মজলিশে। এক্ষেত্রে তরুণীরা প্রায় সর্বদাই আপন আপন লভারের সঙ্গে এ নাচে কেন– সব নাচেই যায়।

এবং ফিরতে হবে রাত ১১টায়। বলে কী? মাথা খারাপ।

হফমান বলেছেন এবং এ লেখকও আপন একাধিক অভিজ্ঞতা থেকে অসংকোচে সায় দেবে– এ-সব নাচে ফুর্তি ফষ্টি-নষ্টি এমনকি কিঞ্চিৎ বেলেল্লাপনা আসলে আরম্ভ হয় রাত বারোটার পর। আমার মতে জমে প্রায় দুটোয় এবং নাচ ভাঙে ছটায়।

অনুমান করা কঠিন নয় যে, গেলি অত্যধিক আপ্যায়িত বা সন্তুষ্ট হয়নি। নাচের মাঝে মাঝে ফাঁকে ফাঁকে কপোত-কপোতীরা জোড়ায় জোড়ায় ফটোগ্রাফ তোলায়। গেলির যথেষ্ট কাষ্ঠরস ছিল। সে-ও ছবি তোলাল ওই দুই প্রহরী ডালকুত্তার মাঝখানে। কপোত-কপোতীর এক হাতে থাকে সফেন শ্যাম্পেন গ্লাস, অন্য হাতে গোটাপাঁচেক বেলুনের সুতো, মাথায় ওই বলডাসেই কেনা রঙবেরঙের ফুস ক্যাপ, গাধার টুপি ইত্যাদি। গেলি ছবি তোলাল এমন কায়দায় যেন মনে হয় ফাঁসির আসামিকে তার দুই জল্লাদ তাকে ফাঁসিকাঠে নিয়ে যাবার সময় প্রেস ফটোগ্রাফার যেভাবে ছবি তোলে।

হফমান বিরক্তির সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় এগারোটার সময় হিটলারের গচ্ছিত মহামূল্যবান গেলিকে মালিকের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন।

পরদিন সকালবেলা সাড়ম্বরে সরকারি কায়দায় গেলি ফটোগ্রাফখানা মামাকে উপহার দিলেন। হিটলার এসব নাচ এককালে বিস্তর না হোক অল্প-বিস্তর নিশ্চয়ই দেখেছিলেন। তাঁর মতো তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি যে ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ না করাই ভালো।

বৈমাত্রেয় মামা হলেও গেলি পেয়েছিল হিটলারের একটি মহৎ গুণ; সে তার পেটের কথা কাউকে বলত না। যে-পুৎসি হাস্টেলে তাঁর পুস্তকে হিটলার ও গেলির বিরুদ্ধে প্রচুরতম বিষোদগার করেছেন তিনি সে সময়ে নিত্য নিত্য হিটলারের বাড়িতে আসতেন, এবং গেলির সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল। তৎসত্ত্বেও তিনি তাঁর পুস্তকে গেলিকে দিয়ে রামগঙ্গা কিছুই বলাতে পারেননি। শুধু একবার নাকি তিনজন যখন একসঙ্গে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন হিটলার কী একটি রূঢ় মন্তব্য করলে, পুৎসি শুনতে পেলেন, গেলি দাঁতে দাঁত চেপে অস্ফুট কণ্ঠে বলল, ব্রুট–পশু!

গেলির ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল হফমান পরিবারের প্রতি এবং সমস্ত মুন্যিক শহরে ওই পরিবারের কর্তী এনা হফমানের সঙ্গে তার ছিল অন্তরঙ্গতা। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত আগাপাশতলা কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি, স্বামীকেও বোঝাতে পারেননি। পুৎসি তার বিষোদ্গারের সময় গেলির যত নিন্দাই করে থাকুন না কেন, এনা পাঁচজনকে যা বলেছেন। তার থেকে বোঝা যায়, তিনি, এনা নিজে আর্টিস্ট ছিলেন বলে শুধু যে গেলির অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে মজেছিলেন তাই নয়, তার মানসিক ও চারিত্রিক একাধিক বিরল সৎগুণ তাঁকে সত্যই মুগ্ধ করেছিল। এমন যে বয়স্কা বান্ধবী যার কাছ থেকে সান্ত্বনা পাওয়া যায়, বিপদে-আপদে উপদেশ পথনির্দেশ চাওয়া যায় পাওয়া যায় তার কাছেও গেলি তার সুখ-দুঃখের কথা বলত না। শুধু একদিন মাত্র, কেমন যেন আত্মহারা হয়ে স্বীকার করে যে, সে যখন ভিয়েনায় ছিল তখন কোনও একজনকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিল। সামান্য এই, এইটুকু বলার পর সে হঠাৎ থেমে গেল, যেন সংবিতে ফিরে এসে বুঝতে পারল, বড় বেশি বলা হয়ে গিয়েছে, তাই সঙ্গে সঙ্গে বলল, আর যা আছে, সেটা আছেই। আপনিও কিছু করতে পারবেন না, আমিও কিছু করতে পারব না। অতএব অন্য কথা পাড়ি। এর্না দুঃখিনী গেলিকে অনেক সান্ত্বনা দিলেন, সর্বপ্রকারে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতি দিলেন এনা বাস্তবিকই দৃঢ় চরিত্রের রমণী ছিলেন, অনেকের জন্য অনেক কিছু করেছিলেন, নাৎসি পার্টিতে যোগ দেননি, এবং যদিও হিটলারকে সমীহ করে চলতেন তবুও অন্যান্য বাবদে দু-একবার তাঁকেও খাঁটি অপ্রিয় সত্যকথা শোনাতে কসুর করেননি কিন্তু গেলি আর শামুকের খোল থেকে বেরুতে রাজি হল না। পরবর্তী ঘটনা থেকে মনে হয়, সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল, সে যা চায় হিটলার তার ঘোরতর বিরোধী এবং এই নিরীহ হফমান দম্পতি এখনও হিটলারের স্বরূপ চেনেন না, হিটলার তার মর্জিমাফিক যেসব সম্ভব-অসম্ভব কার্য করতে ও করাতে পারেন সে সম্বন্ধে এদের কণামাত্র ধারণা নেই– হিটলারের যে-স্বরূপ সে তার প্রতিদিনের সান্নিধ্যে সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হয়েছিল।

এদিন এর্না শুধু এইটুকু জানতে পেরেছিলেন যে, গেলি ভিয়েনার একজন আর্টিস্টকে ভালোবাসে, কিন্তু সে কে, তাদের দু-জনার মধ্যে কী আদান-প্রদান হয়েছে, গেলি যদি তার ভালোবাসার প্রতিদান পেয়ে থাকে তবে উভয়ের বিবাহের প্রতিবন্ধকই-বা কী– এসব হফমানরা জানতে পারেননি, পরে অন্য কেউও জানতে পারেনি।

এদিকে গেলির মুখ সদা প্রফুল্ল, মামার বুড়ো বুড়ো প্রাচীন দিনের পার্টিসদস্যরা তার ওপর বড়ই প্রসন্ন, মামার বানানো সেই কাটাজালের ভেতরও তার বিধিদত্ত সরসতা লোপ পায়নি। পুস এটাকেই ঘৃণা করে বলেছেন ককেটরি– এর বাংলা প্রতিশব্দ কী? ঢলাঢলিপনা? কী জানি। হফমান বলেন তার মনে সন্দেহ নেই যে এটা ছিল তার বাইরের মুখোশ। এই প্রাণবন্ত, প্রকৃতিদত্ত সদা চঞ্চলা, আনন্দে হাসিতে যে কোনও মুহূর্তে কারণে-অকারণে শতধা হয়ে ফেটে যাওয়া যার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, তার চতুর্দিকে বিধিনিষেধের কাঁটার জাল! মুনিকের মতো স্বাধীন শহরে– যেখানে নর-নারী কীরকম অবাধে মেলামেশা করে সেটা এদেশে বসে কল্পনা করা সম্পূর্ণ অসম্ভব– গেলি কারও সঙ্গে কথা কইতে পারবে না মামার অজান্তে, কারও সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে পারবে না মামার পরিষ্কার অনুমতি ভিন্ন, এমনকি ওই বয়সের আর পাঁচটা মেয়ে যে সামাজিকতা করে থাকে, যে লোকাচারসম্মত ভদ্রতা-সৌজন্য করে পাঁচজনের সাহচর্য সঙ্গসুখ পায়– এর কোনও একটা সে করতে পারে না, মামাকে না জানিয়ে, মামার অনুমতি ছাড়া।

সেই ডালকুত্তা শব্দটা হফমান তিক্ততার সঙ্গে নিজেই ব্যবহার করেছেন– দুটিকে নিয়ে ডাসে যাওয়ার ফার্সের পরের দিন হফমান আর সহ্য করতে না পেরে হিটলারকে বলেন, আপনি গেলির চতুর্দিকে যে পাঁচিল খাড়া করে তুলেছেন তার ভেতর মেয়েটার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে! যে নাচে কাল রাত্রে তার ফুর্তি করার কথা ছিল সেটা শুধু তার অবরুদ্ধ জীবনের তিক্ততা তিক্ততর করে তুলেছিল।

হিটলার উত্তরে বললেন, আপনি জানেন, হফমান, গেলির ভবিষ্যৎ আমার কাছে এমনই প্রিয়, এমনই মূল্যবান যে তাকে সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখা আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করি। একথা খুবই সত্য আমি গেলিকে ভালোবাসি এবং আমি তাকে বিয়েও করতে পারি, কিন্তু বিয়ে করা সম্বন্ধে আমার মতামত কী আপনি ভালো করে জানেন, এবং আমি যে কদাপি বিয়ে করব না বলে দৃঢ় সিদ্ধান্ত করেছি সেকথাও আপনি জানেন। তাই আমি এটাকে আপন ন্যায়সম্মত অধিকার বলে ধরে নিয়েছি যে, যতদিন না গেলির উপযুক্ত বর এসে উদয় হয় ততদিন পর্যন্ত সে যার সঙ্গে পরিচয় করতে চায় এবং যারা তার পরিচিত তাদের ওপর কড়া নজর রাখা। আজ গেলি যেটাকে বন্ধন বলে মনে করছে সেটা প্রকৃতপক্ষে বিচক্ষণ আত্মজনের সুচিন্তিত সতর্কতা। আমি মনে মনে দৃঢ়তম সংকল্প করেছি গেলি যেন জোচ্চোরের হাতে না পড়ে বা এমন লোকের পাল্লায় না পড়ে যে গেলিকে দিয়ে আপন ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নেবার অ্যাভেঞ্চারের তালে আছে।

হফমান এস্থলে যোগ দিচ্ছেন, হিটলার অবশ্য জানতেন না যে, গেলি গোপনে গোপনে ভিয়েনাবাসী এক তরুণকে মনপ্রাণ দিয়ে গভীর ভালোবাসে।

হিটলার গিয়েছিলেন মুনিকের বাইরে গেলিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মায়ের কাছে আবার যাবেন দূর হামবুর্গে, মাঝপথে কয়েক ঘণ্টার জন্য মনিকে থামবেন এবং গেলিকে গ্রাম থেকে আনিয়েছেন। হামবুর্গের দীর্ঘ সফরে সহযাত্রী হওয়ার জন্য তিনি পূর্বেই হফমানকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এস্থলে হফমানের বিবরণী মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ১৭ সেপ্টেম্বর (অর্থাৎ মুনিক সমাজে হিটলার গেলিকে পরিচয় করিয়ে দেবার চার বছর পর কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি গেলিকে মুনিক সমাজে উপস্থিত করেন, তা হলে হবে সাত বছর পর, কিন্তু এ বাবদে আমি হফমানকেই বিশ্বাস করি, এবং এসব ঐতিহাসিকদের বই বেরিয়েছে হফমানের বই বেরুবার পূর্বেই) হফমান এলেন হিটলারের বাড়িতে। গেলি মায়েরই মতো ভালো ঘরকন্না করতে জানত, তাই সে তখন হিটলারের স্যুটকেস গুছিয়ে দিচ্ছে। হিটলার সখাসহ যখন সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নামছেন, তখন উপরের তলায় রেলিঙের উপর ভর করে, নিচের দিকে ঝুঁকে গেলি বলতে লাগল, ও রেভোয়া মামা অ্যাড়ল, ও রেভোয়া হার হফমান! হিটলার দাঁড়ালেন, তার পর উপরের দিকে তাকিয়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে চললেন। হফমান বাইরে এসে পেভমেন্টে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

হিটলার এলে পর মোটরে উঠে দুজন চললেন উত্তর দিকে নরবের্গ পানে। শহর থেকে বেরুবার সময় হিটলার বন্ধু হফমানকে বললেন, কেন জানিনে আমার মনটা যেন অস্বস্তিতে ভরে উঠেছে।

হফমান বিবেচক লোক। তিনি নিজেই ঠাট্টা করে বলেছেন, অনেকেই আমাকে আড়ালে হিটলারের কোর্টজেস্টার (গোপালভাড়) বলত, এবং হয়তো সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, এ সময়কার দখিনা ফ্যোন বাতাসটা সক্কলেরই বুকের উপর চেপে বসে সবাইকে মনমরা করে দেয়। কিন্তু হিটলার চুপ করে রইলেন, এবং দীর্ঘ নরবের্গের রাস্তা ড্রাইভ করার পর সেখানকার পার্টি-মেম্বারদের প্যারা হোটেলে উঠলেন।

পরের দিন ন্যুরনবের্গ শহর ছেড়ে যখন তারা বায়রট শহরের দিকে এগুচ্ছেন তখন হিটলার ড্রাইভিং সিটের সামনের ছোট্ট আয়নাটিতে লক্ষ করলেন, আরেকখানা মোটর দ্রুততর বেগে ক্রমশই তাদের গাড়ির কাছে এগিয়ে আসছে। নিরাপত্তার জন্য হিটলারের হুকুম ছিল কোনও গাড়ি যেন তার গাড়ি ওভারটেক না করতে পায়, কারণ ওই সময় দুটো গাড়িই কিছুক্ষণ পাশাপাশি চলে বলে অন্য গাড়ি থেকে হিটলারের উপর গুলি চালানো কঠিন নয়। হিটলার শোফার শ্ৰেককে সেই আদেশ দিতে যাচ্ছেন সেই সময় তিনিই লক্ষ করলেন, যে গাড়ি পশ্চাদ্ধাবন করছে সেটা ট্যাক্সি এবং ড্রাইভারের পাশে হোটেলের উর্দিপরা একটি ছোকরা ক্ষিপ্তের ন্যায় দু হাত নাড়িয়ে তাদের থামবার জন্য সঙ্কেত করছে। শ্ৰেক্‌ গাড়ি দাঁড় করালে ছেলেটি উত্তেজনায় হাঁফাতে হাঁফাতে বললে, হ্যার হেস (ইনি তখন এবং ১৯৪১-এ যখন অ্যারোপ্লেনে করে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে লন্ডন যান তখনও হিটলারের পরেই তাঁর স্থান ছিল) মুনিক থেকে ট্রাঙ্ককল করে অত্যন্ত জরুরি বিষয় নিয়ে হিটলারের সঙ্গে কথা বলতে চান। তিনি ফোনে না পৌঁছানো পর্যন্ত হেস লাইন ছাড়বেন না। দুই বন্ধু মোটর ঘুরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে চললেন নরবের্গ পানে।

গাড়ি ভালো করে থামতে না থামতেই হিটলার লাফ দিয়ে মোটর থেকে বেরিয়ে ছুটে ঢুকলেন হোটেলের ভেতর, এবং তার পর টেলিফোনের বাক্সে (বুথে বুথের দরজা পর্যন্ত তিনি বন্ধ করেননি। পিছনে পিছনে ছুটে এসেছেন হন এবং টেলিফোন বুথের দরজা খোলা বলে হিটলারের প্রত্যেকটি শব্দ শুনতে পেলেন।

এখানে হিটলার– কী হয়েছে? উত্তেজনায় হিটলারের গলা খসখসে কর্কশ হয়ে গিয়েছে। হে ভগবান! এ কী ভয়ঙ্কর! অপর প্রান্ত থেকে কী একটা খবর শুনে তিনি চিৎকার করে উঠলেন, এবং তাঁর কণ্ঠস্বরে পরিপূর্ণ হতাশা। তার পর দৃঢ়তর কণ্ঠে বলতে লাগলেন, এবং সে কণ্ঠস্বর শেষটায় প্রায় চিৎকারের পর্যায়ে পৌঁছল, হেস! আমাকে উত্তর দাও–হ্যাঁ, কিংবা না মেয়েটা এখনও বেঁচে আছে তো?… হে, তুমি অফিসার, সেই অফিসারের নামে দিব্যি দিচ্ছি– আমাকে সত্য করে বল– মেয়েটা বেঁচে আছে, না মরে গেছে? হেস!…হেস! এবার হিটলার তীব্রতম কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন। মনে হল তিনি অপর প্রান্ত থেকে কোনও সাড়া পাচ্ছেন না। হয় লাইন কেটে গেছে, নয় হেস উত্তর দেবার দুর্বিপাক এড়াবার জন্য রিসিভার হুকে রেখে দিয়েছেন। হিটলার টেলিফোন বুথ থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলেন, তার চুল নেমে এসে কপাল ঢেকে ফেলেছে (এ কথাটা তার খাস চাকর লিঙে একাধিকবার বলেছে যে, হিটলার তার মাথার চুল কিছুতেই বাগে রাখতে পারতেন না– অল্পতেই সেটা কপাল ঢেকে ফেলত), তার চাউনি ছন্নের মতো, তাঁর চোখদুটো যে উজ্জ্বল হয়ে ঝকঝক করছে সেটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক।

শ্ৰেকের দিকে মুখ করে বললেন, গেলির কী যেন একটা কি ঘটেছে। আমরা মুনিক ফিরে যাচ্ছি। গাড়ির যা জোর আছে তার শেষ আউনস্ পর্যন্ত কাজে লাগাও। গেলিকে জীবিত অবস্থায় আবার আমাকে দেখতেই হবে।

টেলিফোনে বুথ থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো টুকরো যেসব কথা ভেসে এসেছিল তার থেকে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলুম, গেলির কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু ঠিক ঠিক কী সেটা বুঝতে পারিনি, এবং হিটলারকে জিগ্যেস করার মতো সাহসও আমার ছিল না।– বলছেন স্বয়ং হফমান।

হিটলারের উন্মাদ উত্তেজনা যেন সংক্রামক। শ্ৰেক চেপে ধরেছে অ্যাকসিলিরেটর। মোটরের মেঝে পর্যন্ত তার গাড়ি তীব্র আর্তনাদ করে ছুটে চলেছে মুনিকের দিকে। হফমান মাঝে মাঝে মোটরের ছোট্ট আর্শিতে দেখছেন হিটলারের চেহারা– ঠোঁটদুটো চেপে তিনি উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে সম্মুখ পানে তাকিয়েও যেন কিছু দেখছেন না। তাদের মধ্যে একটিমাত্র বাক্য বিনিময় হল না– যে যার বিমর্ষ চিন্তা নিয়ে ডুবে আছে আপন মনের গহনে।

অবশেষে আমরা তাঁর বাড়িতে পৌঁছলুম এবং সেই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ জানতে পেলুম। চব্বিশ ঘন্টা আগে গেলি মারা গিয়েছে। সে তার মামার অস্ত্রভাণ্ডার থেকে একটি ৬,৩৫ পিস্তল নিয়ে হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি জায়গায় গুলি করেছে। ডাক্তারদের মতে যদি সঙ্গে সঙ্গে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা হত তবে হয়তো তাকে বাঁচানো অসম্ভব হত না। কিন্তু সে দরজা বন্ধ করে গুলি ছুঁড়েছিল, কেউ সে শব্দ শুনতে পায়নি এবং ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণে সে ইহলোক ত্যাগ করেছে।

ইতোমধ্যে পোস্টমর্টেম, করোনারের তদন্ত সবকিছু হয়ে গিয়েছে এবং পুলিশ মৃতদেহ ফেরত দিয়েছে। ডাক্তারের রিপোর্ট থেকে বোঝা গেল হিটলারের বিদায়ের অল্প পরেই গেলি আত্মহত্যা করে। সে দেহ তখন আনুষ্ঠানিকভাবে সুসজ্জিত করে কবরস্থানে রাখা হয়েছে তিন দিন পর গোর হবে– এ সময় আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব মৃতকে শেষবারের মতো দেখে নেন এবং আত্মার সদগতির জন্য আপন আপন প্রার্থনা জানান।

গেলির মা ইতোমধ্যে বেৰ্ষটেসগাডেন থেকে এসে গেছেন। পার্টির মুরুব্বিদের একাধিকজন ও হিটলার-ভবনের বন্ধু প্রাচীন দিনের গৃহরক্ষিণী ফ্রাউ ভিনটারও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। গেলির মা নির্বাক অশ্রুধারে সিক্ত হচ্ছিলেন।

***

গৃহরক্ষিণী ফ্রাউ ভিনটার যা বললেন তার সারমর্ম এই, হিটলার বাড়ি ছাড়ার পূর্বে সিঁড়ি দিয়ে আবার দোতলায় উঠেছিলেন– এর বর্ণনা আমরা হফমান মারফত আগেই দিয়েছি

গেলিকে আরেকটু আদর করার জন্য, কারণ তিনি সেদিনই মুনিক ফিরেছিলেন এবং সেদিনই আবার রবের্গ হয়ে হামবুর্গ চলে যাচ্ছিলেন বলে গেলির প্রতি যথেষ্ট যত্নবান হতে পারেননি। সেই অনিচ্ছাকৃত অবহেলাটা যেন খানিকটে দূর করার জন্য তিনি উপরে উঠে গেলির গালের উপর হাত দিয়ে আদর করতে করতে কানে কানে সোহাগের কথা কইছিলেন কিন্তু গেলি যেন কোনও সান্ত্বনা মানতে চায়নি, তার রাগও পড়েনি।

দু-জনার চলে যাওয়ার পর গেলি ফ্রাই ভিনটারকে বলে, সত্যি বলছি, আমার ও মামার মধ্যে কোনও জায়গায় মিল নেই (নাথিং ইন কন)।

ফ্রাই ভিনটার কিন্তু একথা বললেন না, হফমানও নীরব, যে সেদিনই হিটলারে গেলিতে তুমুল কথাকাটাকাটি হয়, এবং সেপ্টেম্বর মাসে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হলে এবং সেদিন আদৌ হয়নি– অনেকেরই জানালা খোলা থাকে বলে একাধিক প্রতিবেশী সে কলহের উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনতে পান। শাইরার প্রভৃতি ঐতিহাসিকেরা বলেন (Shirar A.; The Rise ও Fall of the Third Reich; Aufsting und Fall des dritten Reiches 1960/61) যে গেলি। ভিয়েনা গিয়ে গলা সাধবার জন্য আবার অনুমতি চাইছিল, এবং হিটলার পূর্বের ন্যায় দৃঢ় কণ্ঠে অসম্মতি জানাচ্ছিলেন।

এই ব্যথাটা অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত নয়, কারণ গেলির মৃত্যুর পর তার ঘরে ভিয়েনার শুরুর উদ্দেশ্যে তার লেখা একখানা অর্ধসমাপ্ত চিঠি পাওয়া যায়। সেটাতে সে গুরুকে জানাচ্ছে, সে আবার ভিয়েনায় এসে তার কাছে কণ্ঠসঙ্গীত শিখতে চায়।

ফ্রাই ভিনটার আরও বললেন যে, মিত্রসহ হিটলার চলে যাওয়ার পর গেলি তাঁকে বলে যে সে এক বন্ধুর (বা বান্ধবীর সঙ্গে সিনেমায় যাচ্ছে, এবং তার জন্য যেন রাত্রের কোনও খাবার তৈরি না করা হয়। সে রাত্রে তিনি তাই গেলিকে আবার দেখতে না পেয়ে বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা করেননি। গেলি ব্রেকফাস্ট খেত ভোরেই, এবং সে যখন তার অভ্যাসমতো ওই সময়ে ব্রেকফাস্ট করতে এল না, তখন ফ্রাউ ভিনটার তার ঘরে গিয়ে টোকা দিলেন। কোনও উত্তর না পেয়ে তিনি চাবির ফুটো দিয়ে ভিতরের দিকে তাকাবার চেষ্টা দিলেন, কিন্তু চাবি ফুটোতে লাগানো এবং ঘর ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে তিনি স্বামীকে ডাকেন। তিনি দরজা ভেঙে যখন ভেতরে ঢুকলেন, তখন সম্মুখে ভয়ানক দৃশ্য। গেলি একডোবা রক্তে পড়ে শুয়ে আছে, আর পিস্তলটা সোফার এক কোণে। ফ্রাউ ভিনটার তৎক্ষণাৎ গেলির মাকে খবর দেন, এবং হেস পার্টির কোষাধ্যক্ষ শ্বাসকে জানান।

অনেকেই এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু হফমানের আত্মচিন্তা এস্থলে বিশেষ মূল্য ধরে। তিনি বলছেন, হিটলার কি গেলির আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ জানতেন? তিনি যে শহর ছাড়ার সময় বলেছিলেন, কেন জানিনে, আমার মনটা যেন অস্বস্তিতে ভরে উঠেছে সেটা কি ইন্দ্রিয়াতীত কোনও অনুভূতিসঞ্জাত অস্বস্তিবোধ, অথবা কি গেলির কাছ থেকে শেষ বিদায় নেবার সময় এমন কিছু একটা ছিল যেটা তার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল?

তার চেয়ে যে জিনিস হফমানের কাছে একেবারেই দুর্বোধ্য ঠেকেছিল সেটা এই : ফ্রাউ ভিনটার বলেন, হিটলার এবং তিনি চলে যাওয়ার পর গেলি অত্যন্ত বিষণভাবে নুয়ে পড়ে। এ তথ্যটা বুঝতে তার কোনও অসুবিধা হল না, কিন্তু তার পর ফ্রাউ ভিনটার যা বললেন সেটা তার বিচার-বিবেচনাকে দিল একদম ঘুলিয়ে। ফ্রাই ভিনটার বার বার জোর দিয়ে বললেন, গেলি হিটলার একমাত্র হিটলারকেই ভালোবাসত; বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা, গেলির বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকিটাকি মন্তব্য ফ্রাউ ভিনটারকে দৃঢ়নিশ্চয় করেছিল, হিটলারকেই গেলি ভালোবাসে। হফমান বলছেন, কিন্তু আমার যতদূর জানা এবং ভালো করেই জানা, গেলি ভালোবাসত অন্য একজনকে।

এর সঙ্গে তা হলে আরেকটি তথ্য জুড়তে হয়, হফমানের ফোটো-কর্মশালায় তার কিছুদিন পূর্বে হিটলার শ্রীমতী এফা ব্রাউনের সঙ্গে পরিচিত হন(৫) যে এফাঁকে তিনি মৃত্যুর অল্প পূর্বে বিয়ে করেন, এবং হফমানের মতে তাঁদের বন্ধুত্ব নিবিড়তর হয় বেশ কিছুকাল পরে এবং গেলি মামাকে লেখা এফার একখানা চিঠি দৈবযোগে মামার কোটের পকেটে পেয়ে যায়। তা হলে বলতে হবে ফ্রাউ ভিটারের রহস্য সমাধান হয়তো সম্পূর্ণ ভুল না-ও হতে পারে।

একটা কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যদিও সেটা পরের এবং অনেক দিন ধরে চলেছিল। গেলির মা এমনিতেই এফা ব্রাউনকে পছন্দ করতেন না, এবং গেলির মৃত্যুর পর সে অপছন্দ পরিপূর্ণ ঘৃণায় গিয়ে পৌঁছল। হফমান এবং অন্যান্যরা তাঁকে যতই বোঝাবার চেষ্টা করতেন তিনি ততই অকুণ্ঠ ভাষায় জোর দিয়ে বলতেন, তাঁর মনে কণামাত্র দ্বিধা নেই যে, তাঁর মেয়ে হিটলারকেই ভালোবাসত এবং ওই এফা ব্রাউনের অস্তিত্ব ও হিটলারের ওপর তার প্রভাব গেলিকে গভীরতম নৈরাশ্যে নিমজ্জিত করে দেয়, এবং এইটেই গেলির অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধানতম কারণ।

***

এদেশে জোরালো গোটা দু-ত্তিন দল এবং তাদের বেপরোয়া আপন আপন দৈনিক নেই বলে বহু কেলেঙ্কারি-কেচ্ছা অনায়াসে চাপা পড়ে। ইয়োরোপের অধিকাংশ দেশে অবস্থাটা ভিন্ন প্রকারের। বিশেষত ভাইমার রিপাবলিক যুগে এই খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দশকে, হিটলার চ্যানসেলার না হওয়া পর্যন্ত (১৯৩৩) জর্মনির খবরের কাগজে কাগজে নরক ছিল গুলজার, বিশেষত জর্মনরা যখন ইংরেজি খবরওয়ালাদের চোরে চোরে মাসতুতো ভাই  থিক্স এগ্রিমেন্টে আদৌ বিশ্বাস করে না। তাই মুনিকের খবরের কাগজগুলোর ওপর গেলির অস্বাভাবিক মৃত্যু যেন মৌচাকের উপর ঢিলের মতো হয়ে এসে পড়ল। আর কাফে কাফে বারেতে বারেতে গুজবগুঞ্জরণের তো কথাই নেই। এমনকি নাৎসি পার্টির ভেতরও নানা মুনি নানা মত দিতে লাগলেন। যারা সরাসরি দুশমন তাদের এক দল বেশ জোর গলায় বলল, নাৎসি পার্টি তার প্রভাব ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে অটপসি আদৌ করাতে দেয়নি, করোনারের সামনে যা-কিছু ঘটেছে তার সমস্তটাই আগাগোড়া থাচ্ছো কেলাসি থিয়েডারের ফার্স, এবং এক দল বলল, তাই হবে, কারণ এটা আত্মহত্যা নয়, আসলে খুন, এবং খুনি স্বয়ং হিটলার। তিনি হামবুর্গ পানে রওনা হয়েছিলেন সত্য কিন্তু সেটা ছিল ফাঁদ পাতার মতো। সন্ধ্যার সময় ফের বাড়ি ফিরে আসেন, এবং গেলিকে অন্য পুরুষের সঙ্গে এমন অবস্থায় পান যে, তখন হিটলারের মতো হিংস্র প্রাণীর মাথায় যে খুন চাপবে তাতে আর বিচিত্র কী? অন্য দলের বক্তব্য, না, পরপুরুষ ছিল না, শুধু গেলির ভিয়েনা যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে কথা-কাটাকাটি এমনই চরমে পৌঁছয় যে হিটলার আত্মকর্তৃত্ব সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন এবং উন্মাদ অবস্থায় গেলিকে খুন করেন। আবার কেউ কেউ বললেন, না, খুন করেছেন হিমলার। পার্টির মুরুব্বিরা যখন দেখলেন যে হিটলারের খোলাখুলি বেলেল্লাপনার ঠেলায় পার্টির ইজ্জৎ যায়-যায় ( যদিও আমি যতদূর জানি জনসমাজে গেলির সঙ্গে হিটলারের আচরণ ছিল ভদ্র, সংযত, ইংরেজিতে যাকে বলে করেকটু; অন্যপক্ষের বক্তব্য আমরা যদি মিনিমাটাও নিই সেটাও যথেষ্ট খারাপ, কারণ এ-কথা তো আর মিথ্যে নয় যে তুমি মেয়েটাকে ভালোবাস এবং তাকে নিয়ে একই বাড়িতে বাস কর, আর তার মাকে রেখেছ দূরে গাঁয়ের বাড়িতে যখন তুমি তাকেও অনায়াসে এখানেই রাখতে পারতে–), ওদিকে হিটলার ছাড়া যে পার্টি দু দিনেই কাত হয়ে যাবে সেটাও অবিসংবাদিত সত্য, তখন তারা পার্টি বাঁচাবার জন্য হিমলারের ওপর গেলিকে সরাবার ভার দিলেন। কর্মটি করেছেন হয় স্বয়ং তিনি বা তার কোনও গুণ্ডাকে দিয়ে (পার্টিতে যে গুণ্ডার অভাব ছিল না সে তথ্যটি সবাই জানতেন, এবং না থাকলে নাৎসি পার্টি যে রাস্তায় কম্যুনিস্টদের ঠেলায় একদিনও টিকতে পারত না সেটা আরও সত্য)। ইত্যাকার নানাপ্রকারের গুজবে তখন জর্মনি ম-ম করছে, কারণ গেলির মৃত্যুর পূর্বেই নাৎসি পার্টি এমনই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে রাস্তার উপর কারণে-অকারণে যাকে-তাকে চ্যালেঞ্জ করে, এবং কমুনিস্টদের কাউকে একা পেলে তাকে পেটাতেও কসুর করে না; প্রতিদিন আবার কানে আসছে, এই বুঝি প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ নাৎসি নেতা হিটলারকে ডেকে পাঠাবেন, হয় আপন মন্ত্রিসভা গড়ে প্রধানমন্ত্রী-চ্যানসেলর হতে, কিংবা কোয়ালিশন সরকার নির্মাণ করতে।

আমি তখন মুনিকে বাস না করলেও জর্মনিতে, এবং প্রতিদিন লাঞ্চ টেবিলে বন্ধুদের আলোচনা, কথা-কাটাকাটি শ্রবণই ছিল আমার পক্ষে যথেষ্ট। আমাদের রিডিং রুম স্যুনিক তথা জর্মনের সব বড় বড় শহরের প্রধান প্রধান খবরের কাগজ রাখত, তদুপরি আমাদের কেউ না কেউ মুনিক আসা-যাওয়া করছে, আর একজন তো খাস মনিকবাসী– সে শহরের বিরাট ম্যাপ খুলে হিটলারের বাড়ি, তিনি যে যে কাফেতে যান, সবগুলো পিন্ ডাউন করতে পারত, কাজেই আমাদের লাঞ্চ টেবিলে গুজবেরও অনটন ছিল না। কিন্তু এটাও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক যে এতদিন পরে আজ আমি তার অধিকাংশই ভুলে গিয়েছি। তবে, ঘটনার প্রায় কুড়ি বছর পর থেকে যখন হিটলার সম্বন্ধে নানাপ্রকারের পুস্তক বেরুতে আরম্ভ করল (গেলি আত্মহত্যা করে ১৯৩১-এ; হিন্ডেনবুর্গ হিটলারকে ডেকে পাঠান তার তিন সপ্তাহ পরে এবং আলাপচারী যে নিষ্ফল হয় তার একমাত্র কারণস্বরূপ নাৎসিরা বলেন, হিটলার গেলির মৃত্যুশোক তখনও সম্পূর্ণ সামলে উঠতে পারেননি বলে সমস্ত চিন্তাশক্তি একাগ্রচিত্তে ব্যবহার করতে পারেননি– ঘন ঘন আনমনা হচ্ছিলেন; ১৯৩৩-এর জানুয়ারি মাসে হিটলার চ্যানসেলর হন, ১৯৩৯-এ তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ করেন, ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫-এ তিনি আত্মহত্যা করেন, ইংরেজিতে প্রচলিত অ্যালন বুলক লিখিত ওই ভাষায় হিটলারের স্ট্যান্ডার্ড জীবনী বেরোয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে, হানের ১৯৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দে, এবং অধুনা– ১৯৬১–প্রকাশিত শাইরারের ১১৭৪ পৃষ্ঠার যে বিরাট বই বাজারে নাম করেছে তাতে কোনও মৌলিকতা নেই এবং আমার মনে হয় তিনি হফমানের বইখানা হয় পড়েননি, নয় একপেশে বলে খারিজ করেছেন। বলা বাহুল্য বুলক, শাইরার এবং শতকরা ৯০ খানা বই রাজনৈতিক তথা যুদ্ধবিদ হিটলারকে নিয়ে আলোচনা করে বলে তার মধ্যে প্রেম অল্পই স্থান পায়, এবং তারও অধিকাংশ পান এফা ব্রাউন, গেলি সত্যিই এখনও কাব্যের উপেক্ষিতা!) তখন দেখে বড় আশ্চর্য বোধ হল যে তখনকার দিনে যেসব গুজব আমরা সে গাঁজা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলুম তার অনেকগুলোই এসব পুস্তকে রীতিমতো সম্মানের আসন পেয়েছে, এবং যেগুলোকে আমরা সত্য বা সত্যের নিকটতম বলে স্বীকার করে নিয়েছিলুম সেগুলোর উল্লেখ পর্যন্ত নেই!

অবশ্য এ-কথা উঠতে পারে যে, হফমানের মতে হিটলার গেলির আত্মহত্যার জন্য নিতান্ত পরোক্ষভাবে দায়ী, আদৌ যদি তাঁকে দায়ী করা হয়, তিনি গেলিকে কড়া শাসনে রাখতেন (হিটলারের সাফাই আজ গেলি যেটাকে বন্ধন বলে মনে করছে সেটা বিচক্ষণ আত্মজনের সুচিন্তিত সতর্কতা) আবার ওদিকে বলেছেন, গেলি ছিল হিস্টিরিয়াগ্রস্ত, সদাই আত্মহত্যার জন্য মুখিয়ে থাকা টাইপের একদম খাঁটি উল্টোটি। তার প্রকৃতি ছিল বেপরোয়া, জীবনের মুখোমুখি হত সে প্রতিদিন নিত্যনতুন সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসব ভাবলে তো কিছুতেই বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না যে সে আপন জীবন আপন হাতে নিতে নিজেকে বাধ্য অনুভব করল।

হফমানকৃত তাঁর সখা হিটলারের জীবনী হয়তো অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখবেন, ভাববেন, রাজনৈতিক এবং গ্যাস-চেম্বারের প্রবর্তন ও সফলীকরণ কর্তা হিটলারকে তিনি সমর্থন করতে না পেরে অবশ্য এটা সবাই স্বীকার করেছেন যে আর্ট ভিন্ন অন্য কোনও বিষয় নিয়ে তিনি অতি দৈবেসৈবে হিটলারের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং আরও সত্য যে হিটলার, বিশেষ করে গ্যোবেলুসের শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি ডাঙরতম সরকারি চাকরি বা পার্টিতে কোনও গণ্যমান্য আসন নিতে নারাজের চেয়ে নারাজ সম্পূর্ণ নারাজ ছিলেন, অতএব রাজনৈতিক হিটলারকে দোষী বা নির্দোষী প্রমাণ করার হাত থেকে তিনি (সানন্দে) অব্যাহতি পেয়েছেন তিনি মানুষ হিটলারকে অযথা অপবাদ থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এ নেমকহালালি প্রশংসনীয়, কিন্তু সে কর্ম করতে গিয়ে তিনি কতখানি সত্যবাচন করেছেন সেটা অনেকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করবে।

আমি তাকে মোটামুটি বিশ্বাস করেছি, এবং দৈনন্দিন জীবনে হিটলার যেখানে ছোট লোক সেখানে পুৎসি হানস্টেঙেলের হিটলারের বিরুদ্ধে ভার বহুস্থলে অহেতুক বিষোদ্গার সত্ত্বেও অনেক কথা মেনে নিয়েছি।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে আমার মনে হয়েছিল এখনও মনে হয়, হিটলার জানতেন এবং ভালো করেই জানতেন যে গেলি ভিয়েনার এক আর্টিস্টকে গভীরভাবে ভালোবাসত (আমার মনে হয়, হান যে বলেছেন, হিটলার সে-খবরটি জানতেন না, এটা তার ভুল এবং গেলির ভিয়েনা যাবার জন্য উৎসাহ এবং মামাকে পীড়াপীড়ি সেখানে যাবার অনুমতির জন্য)–এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে গেলি বরাবরই মনিকের রাজসিক বাসভবন, অতি সাধারণ মেয়ের সমাজে সর্বোচ্চ আসন, মুনিকের সর্বজন সম্মানিত মামার গরবে গরবিনী হওয়া, সেই গ্রেট মামার প্রেমনিবেদন তারই পদপ্রান্তে, সে মামা আবার তার কথায় উঠ-বস করেন, সর্বোত্তম থিয়েটার-অপেরায় সর্বশ্রেষ্ঠ আসনাধিকার, এক কথায় বলতে গেলে মুনিকের মতো সুখৈশ্বর্য, সর্বপ্রকারের বিলাস, চিত্তহারিণী আমোদ-প্রমোদ দিতে সক্ষম এসব ছেড়ে ভিয়েনাতে তাকে থাকতে হত সাধারণ অবশ্য অপেক্ষাকৃত বিত্তশালিনী– ছাত্রীর মতো। এ দুয়ের আসমান-জমিন ফারাক। শুধু সঙ্গীতে পারদর্শিনী হওয়ার জন্য এত বড় সুখসম্মান বিসর্জন? আমার বিশ্বাস হয় না। পুৎসি যখন কটুবাক্য ব্যবহার করে বলেন, মেয়েটা পয়লা নম্বরের ফুর্তিবাজ ফ্লার্ট, কণ্ঠসঙ্গীত উচ্চতম পদ্ধতিতে আয়ত্ত করতে হলে যে অধ্যবসায় ও ফুর্তিফার্তি বিসর্জন অবশ্য প্রয়োজনীয় সে-দুটো গেলির ছিল কোথায়? তখন আমার মনে হয় গেলির মন পড়ে থাকত ভিয়েনায় যেখানে সে অধ্যবসায়ের সঙ্গে রেওয়াজ করবে, ও সন্ধ্যায় পাবে তার আর্টিস্ট দয়িতের কাছে অনুপ্রেরণা, যদি সেখানে দৈন্যেও বাস করতে হয়, সেটা সে ভাগাভাগি করবে তারই সঙ্গে; তার তুলনায় মুনিকে মামার সঙ্গে বাস করে, মনে মনে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ থেকে উৎকৃষ্টতম বিলাসভোগ শতগুণে নিকৃষ্ট। ভিয়েনার ছাত্রজীবনের স্বাধীনতা, তরুণ-তরুণীর সঙ্গে সম্মিলিত আনন্দোল্লাস নিশ্চয়ই মুনিকের বন্দিশালা এবং প্রতি সন্ধ্যায় কাফেতে মামা এবং তার বুড়োহাবড়া ভারিক্কি-ভারিক্কি রাজনৈতিক পার্টিমেম্বারদের সঙ্গে প্রসন্নতা এমনকি উল্লাসের ভান করার চেয়ে শতগুণে শ্রেয়, কিন্তু সেইটেই তত্ত্বকথা নয়–তত্ত্বকথা ওই দয়িতের সঙ্গসুখ। সঙ্গীতই যদি বড় কথা হবে তবে অ্যানিক অজপাড়াগা? মুনিকে ঠিক সে সময়ে হয়তো কোনও মেস্ত্রো ওস্তাদের ওস্তাদ ছিলেন না, কিন্তু গেলি যে ভিয়েনাতে কোনও মেস্ত্রোর কাছে সঙ্গীতাধ্যয়ন করেছিল এ কথা তো কেউ বলেনি। না, সঙ্গীত তার শেষ বচসার এবং সর্বশেষে নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যার কারণ নয়।

হফমান বুঝতে পারেননি, কিংবা বলতে ভুলে গেছেন– সেটা পরবর্তী যুগের সহচরগণ বার বার উল্লেখ করেছেন– হিটলার ঝাণ্ডু ঝাণ্ড সুপকুতম রাজনৈতিকদের পেটের কথা টেনে বের করার কৌশলটিতে সুপটু ছিলেন। আর এ তো চিংড়ি ভাগনি! হয়তো মামা তার প্রেম নিবেদন করার পূর্বেই আবেগ-বিহ্বল তরুণী মামার সহানুভূতি এবং আনুকূল্য পাবার আশায় পূর্বাহেই সবকিছু বলে বসে আছে। কিংবা হয়তো হিটলার যখন লক্ষ করলেন, গেলি তার প্রেমের উপযুক্ত প্রতিদান দিচ্ছে না তখন সেটা চেপে দিয়ে আঁকশি চালিয়ে বের করলেন গেলির পেটের কথা– বরঞ্চ বলা উচিত হৃদয়ের ব্যথা। এবং তারই-বা কী প্রয়োজন? সেই ১৯৩১ সালেই তাঁর পার্টির অসংখ্য স্পাই ছিল ভিয়েনায়– যে নগরে তিনি নিজে যৌবনের একাংশ রাস্তায় রাস্তায় স্বহস্তে অঙ্কিত পিকচার পোস্টকার্ড ফেরি করেছেন– নইলে ১৯৩৪-এ, এ ঘটনার মাত্র আড়াই বছর পরে তিনি তাঁর পার্টির লোকের দ্বারা ভিয়েনা শহরের জনসমাগমে পরিপূর্ণ দফতরে অস্ট্রিয়ান প্রধানমন্ত্রী ডলফুসকে খুন করলেন কী প্রকারে? এবং তার চার বছর পরে একটিমাত্র গুলি না চালিয়ে ভিয়েনা দখল করলেন কী কৌশলে? তার তুলনায় একটি সাদামাটা ছাত্রী ভিয়েনাতে কীভাবে জীবন-যাপন করেছিল সেটা বের করা তো অতি সহজ। ভিয়েনাতে সে-যুগে বিস্তর প্রাইভেট ডিটেকটিভও ছিল।

আমার মনে হয় বিশ্বাস করুন আর নাই করুন–বুদ্ধিমতী গেলি তার মামার চরিত্রের একটি দিক আবিষ্কার করতে পেরেছিল তখনই, যেটি বিশ্বমানব আবিষ্কার করে স্তম্ভিত হল পুরো পনেরোটি বছর পরে, এবং তা-ও সম্ভব হত না, যদি যুদ্ধে হিটলার পরাজিত না হতেন এবং ফলে গ্যাসচেম্বার ইত্যাদি আবিষ্কৃত না হত। সে তত্ত্বটি হিটলার কী অবর্ণনীয়, নিষ্ঠুর দানব!– এই তত্ত্বটি গেলি আবিষ্কার করে এক বিভীষিকার সম্মুখীন হল। হিটলার যে কোনও মুহূর্তে, কারও সুখদুঃখের কথা মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে তার দয়িতকে নিষ্ঠুরতম পদ্ধতিতে খুন করাতে পারেন। আজ যদি কেউ বলে, এই ভয় দেখিয়েই ব্ল্যাকমেল করে হিটলার গেলিকে ১৯২৭ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত তার মুনিকের বাড়িতে— আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীন কিন্তু বস্তুত পরাধীনের চেয়েও পরাধীনভাবে আটকে রেখেছিলেন তবে সেটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য মনে হবে কেন? এবং হয়তো ওই চার বছর ধরে তাকে বাধ্য হয়ে রক্ষিতার লীলাখেলাও খেলতে হয়েছিল। হফমান বলেছেন, গেলির চরিত্রবল ছিল দৃঢ় এবং সে ছিল স্পিরিটেড গার্ল। মুনিক থেকে অস্ট্রিয়ার পথ কতখানি? আর বেৰ্ষটেশগাডেনের বাড়ি থেকে তো অস্ট্রিয়ান সীমান্ত আরও কাছে। পায়ে হেঁটে ওপারে যাওয়া যায়। বস্তুত হিটলার সেই কারণেই বেছে বেছে ওই জায়গাটিতেই বাড়ি কিনেছিলেন। এ-পারে, অর্থাৎ জর্মনিতে রাজনৈতিক বাতাবরণ বড় বেশি উষ্ণ হয়ে পড়লে, কাউকে না জানিয়ে, বনের ভেতর দিয়ে অক্লেশে ওপারে যেতে পারবেন বলে– অঞ্চলটাও অস্বাভাবিক নির্জন এবং ওই যুগে পাসপোর্টের কড়াকড়ি তো ছিলই না, এ-সব জায়গায় যারা নিত্য নিত্য ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে এপার-ওপার করত তাদের তো পাসপোর্ট আদৌ থাকত না।

এমন অবস্থায়ও স্পিরিটেড গেলি গ্রামে থাকাকালীন ওপারে চলে গিয়ে ভিয়েনা যেতে পারল না?– সেখান থেকেও ভিয়েনা তো রেলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। না, তা নয়! অমতে যাওয়ার মানেই হত, দয়িতের অবশ্যমৃত্যু। এবং পরে সে নিজেও হয়তো কিডন্যাপড় হতে পারত। তাই সে আপন কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলেছিল, হফমানের স্ত্রীকে : Well thats that! And theres nothing you or I can do about it. So lets talk about something else এ কথোপকথনের উল্লেখ আমি পূর্বেই করেছি।

হয়তো আমার নিছক কল্পনা! কিন্তু আমার মনে হয় গেলি দিনের পর দিন অভিনয় করে গেছে (যেটা হন ঠিক ধরতে পেরেছিলেন, কিন্তু পুৎসি বুঝতে না পেরে ঢলাঢলি বলেছেন) যদি শেষ পর্যন্ত মামার মন গলানো যায়, যখন দেখল কোনও ভরসাই নেই তখন করেছিল শ্মশান-চিকিৎসা পুরোপুরি ঝগড়া, যেটা একাধিক প্রতিবেশী শুনতে পেয়েছিল, এবং হয়তো-বা হয়তো-বা আত্মহত্যার ভয়ও দেখিয়েছিল, এবং হয়তো তার চোখে-মুখে তখন এমন ভাব ফুটে উঠেছিল যে চতুর–শঠ– হিটলার বুঝেছিলেন, এ ভয় দেখানোটা নিতান্ত শূন্যগর্ভ নয়, এটা আর পাঁচটা হিস্টেরিক (এবং হফমান বলেছেন, গেলি আদপেই হিস্টেরিক ছিল না) মেয়ের মতো নিতান্ত অর্থহীন প্রলাপ নয়। তাই বোধহয় মনিক শহর থেকে বেরোবার সময় সখাকে বলেছিলেন, কেন জানিনে আমার মনটা যেন অস্বস্তিতে ভরে উঠেছে, I dont know why, but I have a most uneasy feeling তাই তার পরবর্তী বিষণ্ণতা। পথিমধ্যে টেলিফোনের কথা শুনেই যেন বুঝতে পেরেছিলেন, এ টেলিফোনে থাকবে গেলি সম্বন্ধে দুঃসংবাদ।

এ অনুমান যদি সত্য হয় তবে বলতে হবে গেলি যে ভয় দেখিয়েছিল সেটা শূন্যগর্ভ, ফাঁকা আওয়াজ ছিল না। সে সেটা কাজে পরিণত করেছিল প্রথমতম সুযোগেই।

————

১. এই ভারতের অন্ধ্র অঞ্চলে হিন্দু সমাজে আপন সহোদরা ভগ্নীর মেয়েকে বিয়ে করা খুবই স্বাভাবিক ও নিত্য নিত্য হয়। বস্তুত প্রথমেই মামাকে কন্যাদানের প্রস্তাব করতে হয়– যেন ন্যায্য হক তারই। সে রাজি না হলে অন্যত্র তার বিয়ে হয়।

২. হিটলার-পরিবারের কুলজীটি দেশি-বিদেশি কোনও ঘটক-ঠাকুরেরই অমলানন্দের কারণ হবে না। প্রথমত হিটলারের (Hitler, Hiedler, Huetler, Huettler–আমাদের দেশের অল্পশিক্ষিত চাষাদের মতো হিটলারের ঠাকুরদাদারা নানাভাবে এ নাম বানান করেছেন; স্বয়ং হিটলারের পিতা– তাঁর জন্ম জারজরূপে– সেকথা পরে হবে, গোড়াতে Hiedler, এবং পরে Hitler বানান করেছেন) পিতা এবং মাতা উভয়েই দুই ভাই, অর্থাৎ হিটলার পদবি ধরেন এমন দুজনার বংশগত, এবং এই কারণে হিটলারের পিতা যখন তাঁর মাতাকে বিয়ে করেন তখন চার্চের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়েছিল। দ্বিতীয়ত ফুরার আডলফ হিটলারের পিতামহ বিবাহ করেন Maria Anna Schicklgruber-কে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে, কিন্তু তার পাঁচ বছর পূর্বে Schicklgruber একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন কুমারী অবস্থাতেই ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে ৭ জুন। এই পুত্রই ফুরার আডলফ হিটলারের পিতা। এবং যেহেতু নবজাত শিশুর মাতা বিবাহিতা নয় তাই রীতি অনুযায়ী তাকে দেওয়া হয় মাতা-মাতামহের পারিবারিক নাম Alois Schicklgruber। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, বিয়ের পরও পিতা তার পুত্রের নাম Hiedler (তিনি এভাবেই বানান করতেন)-এ পরিবর্তন করার মেহন্নটুকু আপন স্কন্ধে তুলে নেননি। অবশ্য এ কথা যেমন প্রমাণ করা যায় না, তেমনি বাতিল করাও যায় না যে Alois সত্যই ফুরারের পিতামহ Johann Georg Hiedler-এর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কি না, তবে সে অঞ্চলের সাধারণজনের বিশ্বাস ছিল Alois-এর জন্ম Johann Georg-এর ঔরসেই। Alois-এর মাতা Maria ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যেতেই Johann Hiedler অন্তর্ধান করেন। ত্রিশ বছর পর তিনি পুনরায় দেখা দিলেন এবং তিনজন সাক্ষী ও নোটারির (উকিলের) সামনে শপথ নিলেন যে, Alois Schicklgruber তারই ঔরসজাত পুত্র বটে। ওইদিন থেকে তার নাম হল Alois Hitler (বা Hiedler)। ইনিও একাধিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে তার পিতারই মতো। এদিক ওদিক বিস্তর ঘোরাঘুরির পর বিয়ে করেন শুল্ক বিভাগের এক পালিতা কন্যা Anna Glasl-Hoerer-কে। এ বিয়ে সুখের হয়নি। এবং একে তালাক দেওয়ার পূর্বেই Alois বন্ধুত্ব করেন কুমারী Franziska Matzelsberger-এর সঙ্গে। ফলে একটি পুত্রসন্তান হয়। এর নামও Alois। ইনিও জারজ; পরে আইনত পিতার নাম পান। এর পিতা তাঁর মাতা Franziska-কে বিয়ে করেন তার তালাকপ্রাপ্তা প্রথম স্ত্রী Anna Glasl-Hoerer-এর মৃত্যুর পর। বিয়ের তিন মাস পর Franziska একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেন (এর নাম Angela এবং ইনিই পরবর্তীকালে হিটলারের নতুন বাড়ি দেখাশুনা করার ভার নেন ও সঙ্গে নিয়ে আসেন কন্যা, হিটলারের প্রেয়সী Angelica, ডাকনাম Geli)। কিন্তু Angela-র জন্মের এক বছর পরে Franziska ক্ষয়রোগে মারা যান। এর চার বছর পর ফুরার আডলফ হিটলারের পিতা Alois Hitler বিয়ে করেন তার ঠাকুদ্দার ভাইয়ের নাতনি শ্রীমতী Klara Poetzl-কে, ৭ জানুয়ারি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে। এ বিয়ের চার মাস দশদিন পরে জন্মান ফুরারের সর্বজ্যেষ্ঠ সহোদর ভ্রাতা Gustav এবং বাল্যকালেই মারা যান, এবং তার পরের কন্যা Idao-ও অল্পবয়সে মারা যান। ফুরার অ্যাডলফ হিটলার তৃতীয় সন্তান (পিতার তৃতীয় বিবাহের)। তার ছোট ভাই Edmund এ পৃথিবীতে মাত্র ছ মাস ছিল। সর্বশেষ সন্তান– পঞ্চমা– Paula ফুরারের মৃত্যুর পর, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত চিরকুমারী অবস্থায় Salzburg-এ বাস করতেন। এই পাউলা একবার ভ্রাতার (হিটলার তখন ফুরার) বাড়িতে তাঁকে দেখতে আসেন কিন্তু দীর্ঘদিন (হিটলারের হিসেবে) থাকেন বলে ভ্রাতা অ্যাডল্ফ তাকে আর কখনও নিমন্ত্রণ জানাননি। সভাই (পিতার ২য় বিবাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র Alois) বার্লিনে মদ বেচতেন। তাঁর সম্বন্ধে হিটলার কখনও একটি বর্ণও উচ্চারণ করেননি। তাঁর ছোট বোন Angela বেশ কয়েক বছর হিটলারের গ্রামের বাড়ি চালানোর পরে ঝগড়া করে চলে যান এবং এক ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করেন। হিটলার এমনই চটে যান যে, বিয়েতে কোনও উপহার পর্যন্ত পাঠাননি।

৩. হিটলারের প্রখ্যাত জীবনীলেখক বুল বলেন–he (Hitler) discovered that she (Geli) had allowed Maurise to make love to her, ইংরেজিতে to make love হয়তো একাধিক অর্থ ধরে।

৪. লন্ডন পুলিশ নাকি বেশ্যাবাড়িতে হামলা চালালে মাঝে মাঝে চাবুক, লোহার গুলিওয়ালা রাইডিং বুট, ইত্যাকার যন্ত্রণাদায়ক সাজসরঞ্জাম পায়। বেশ্যাদের বক্তব্য, খদ্দের ভদ্রলোক। তিনি স্ত্রীকে এসব করতে আদেশ দিতে পারেন না– স্বাভাবিক লজ্জাবশত। তাই এ ধরনের লোক আমাদের কাছে আসেন। আমরাও সাজসরঞ্জাম তৈরি রাখি। স্ত্রীলোক ম্যাজোকিস্টও আছে, এবং যেসব রমণী স্বামী মারপিট করলে চিৎকার করে, কিন্তু যৌনানন্দ পায়, তাদের নরমতর ম্যাজোকিস্ট বলা হয়। অনেকের মতে অনেক রমণী বাড়িতে এমন সব কাজ করে থাকে বা করে না (যেমন ঘর ঝাঁট দিল না, রান্না করল না, বা স্বামীর গামছাখানা লুকিয়ে রাখল) যাতে করে স্বামী তাকে ঠ্যাঙায়।

৫. শাইরার বলেন, হিটলার ও ব্রাউনের পরিচয় হয় গেলির মৃত্যুর এক বা দুই বছর পরে। কিন্তু এ বিষয়ে হফমানের বক্তব্যই অধিকতর বিশ্বাস্য।

জেরুসলম

আইস, সুশীল পাঠক, যুদ্ধবিগ্রহ তথা রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈঠকে যে মেছোহাটার গালাগালি এবং দরকষাকষি হচ্ছে সেগুলো ভুলে গিয়ে পুণ্যভূমি জেরুসলমে তীর্থ করতে যাই।

অতি প্রাচীন নগর জেরুসলম। খ্রিস্টের দু হাজার বছর পূর্বে জেরুসলমফ মিশরীয়দের অধীনে ছিল। তখন তার নাম ছিল উরুসালিমু (শান্তিনিকেতন ত্রাণদুর্গ)। পরবর্তী রোমানযুগে রাজা হারিআন এর নাম দেন অ্যালিয়া কাপিলিনা। খ্রিস্টের দেড়শো বছর পর থেকে ইহুদিরা দলে দলে, কখনও রোমানদের দাসরূপে, কখনও-বা স্বেচ্ছায় জেরুসলমফ ত্যাগ করে।(১) ওই সময় থেকে সে নগরী আর ইহুদি ধর্মের কেন্দ্রভূমি হয়ে রইল না। সপ্তম শতাব্দীতে দ্বিতীয় খলিফা ওমরের আমলে যখন মক্কামদিনার আরবরা এ নগর দখল করে তখন শহরের ৯৫% বাসিন্দা খ্রিস্টান। এবারে প্রায় সকলেই ধীরে ধীরে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে। মক্কামদিনা ত্যাগ করে যেসব আরব এখানে আসে তাদের সংখ্যা ১%-ও হবে না। যে ৯৫% মুসলমান হয়ে যায় তারা যুগ যুগ ধরে জেরুসলমফ তথা প্যালেস্টাইনের (আরবিতে ফলতিন) আদিমতম বাসিন্দা (বস্তুত ইহুদিরা বাইরের থেকে এসে এদেশ জয় করে) এবং ইহুদি কর্তৃক যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত হয়েও আপন ধর্ম ত্যাগ করেনি, পরবর্তী যুগে খ্রিস্টান হয়ে যায় এবং সর্বশেষে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিজয়ী সেনাপতি ইংরেজ লর্ড অ্যালেন্‌বি যখন প্যালেস্টাইনে প্রবেশ করেন(২) তখন সেখানে শতকরা ৮৫ মুসলমান, ১০ খ্রিস্টান ও ৫ জন ইহুদি। সে ইহুদিরা ততদিনে ধর্ম ছাড়া সর্ব বাবদে আরব হয়ে গিয়েছে– হিব্রু ভাষা বলতে পারে না, বলে আরবি। একাধিকজন কবিতা লিখে আরবি সাহিত্যে সেরা লেখকদের মধ্যে স্থান পেয়ে গিয়েছেন।

প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাজত্ব কায়েম হয়ে ইজরেএল (আরবিতে ইসরাইল) নাম ধরার তেরো বছর পূর্বে, অর্থাৎ ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের বসন্তকালে আমি একদিন কুদস (জেরুমের আরবি নাম) শহরের নগরপ্রাচীরের বাইরে দূর যাত্রীর বাস-স্ট্যানডে দাঁড়িয়ে আছি, তোরঙ্গটি মাটিতে রেখে। বাসনা, যাব ন্যাজরিথ (নাজরেৎ, আরবিতে অর্থাৎ বর্তমান যুগে প্রচলিত নাম অন্-নসিরা –আদি যুগের খ্রিস্টানদের ওই নাম থেকে ন্যাজরিন নামে ডাকা হত। মুসলমানরা আজও ওদের সারা নামে পরিচয় দেয়) যেখানে প্রভু যিশু বাল্যকাল কাটান, মা মেরি (আরবিতে মরিয়ম) যে কুয়ো থেকে জল আনতে যেতেন সেটা নাকি তখনও আছে! আরও নাকি আছে, মা-মেরির রব জোসিফ-এর (আরবিতে ইউসুফ) ছুতোরের কারখানা। ইনি যিশুর পিতা নন। কারণ প্রভুর জন্ম হয়েছিল কুমারী-গর্ভে, পবিত্র আত্মা দ্বারা। নিউ টেস্টামেনট ও কুরান শরিফ, দুই-ই এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, মা-মেরির বর জোসিফ ব্ল্যাদা দিয়ে কাঠ পরিষ্কার করে কাঠে কাঠে জোড়া দিতেন, আর প্রভু যিশু মানুষের চরিত্র পরিষ্কার করে মানুষে মানুষে জোড়া দিতেন। যে স্যামারিটানদের প্রভু যিশুর গোষ্ঠী এবং তাঁর কট্টর ইহুদি সম্প্রদায়ের শিষ্যরা দু চক্ষে দেখতে পারে না তিনি করেছেন তাদের প্রশংসা– গুড স্যামারিটান। এই স্যামারিটানরাও ইহুদি, কিন্তু যেসব ইহুদিরা ইজরাএল সৃষ্টি করেছে এদের সঙ্গে স্যামারিটানদের দ্বন্দ্ব চলেছে প্রায় তিন হাজার বছর ধরে। জেরুসলমে প্রতিষ্ঠিত রাজা সলমনের (আরবিতে সুলেমান) মন্দির যে ইহুদির পরমেশ্বর আহভের (জেহোভা, ইলোহিম) পীঠস্থল একথা স্বীকার করেনি। আজ যেখানে নাবলুস শহর (বাইবেলের শেখেম) তারই পাশে গেরিজিম পাহাড়ের উপর ছিল তাদের আপন মন্দির।

একদা এই স্যামারিটান জাতি সংখ্যায়, খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে মূল ইজরাএলিদের চেয়ে কোনও অংশে হীন ছিল না। তাবৎ ইহুদি যখন প্যালেস্টাইন পরিত্যাগ করে তখন শত অত্যাচার সহ্য করে দেশের মাটি কামড়ে ধরে এরা পড়ে থাকে। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্বগোত্রে বিবাহের ফলে এদের সংখ্যা কমতে কমতে এখন মাত্র চারশোতে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমি যখন পুণ্যভূমিতে যাই তখন দেখি খবরের কাগজে একটা তর্কবিতর্ক চলেছে। যদ্যপি আজ খবর-প্রতিষ্ঠানগুলো বলছেন, স্যামারিটানদের সংখ্যা আনুমানিক প্রায় চারশো, আমাকে কিন্তু তখন বলা হয়েছিল প্রায় আশি। খবরের কাগজে আলোচনা হচ্ছে, এই স্যামারিটানদের প্রধান রাববি-র (পণ্ডিত পুরোহিতের) একমাত্র জোয়ান ব্যাটা– ইনিই পরে প্রধান রাববি হবেন সোমত্ত হয়েছেন, এখন তাকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু হায়, কনে কোথায়? মাসিপিসিদের অর্থাৎ অগম্যাদের বাদ দিলে তিনি যে দুটি বধূকে বিয়ে করতে পারেন তাদের একটির বয়স ষাট এবং তিনি তারস্বরে চিৎকার করে বলছেন– আমাদের আইবুড়ো জাতকুলীন বৃদ্ধারা যা বলে থাকেন– তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে! এখন সাজব কনে বউ! কী ঘ্যান্না। কী ঘ্যান্না। এবং তদুপরি দ্রষ্টব্য, এই বৃদ্ধাকে বিয়ে করলে বংশরক্ষা হবে না, এবং এস্থলে সেইটেই সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য।…দ্বিতীয় বধূটি বোবাকালা ইডিয়েট।… স্যামারিটানরা আড়াই হাজার বছর ধরে ইজরাএলিদের সঙ্গে বিয়েশাদি করেনি। এখনই-বা করে কী প্রকারে? এসব গুল-গ্যাস আমি শুনেছি প্রাচীন জেরুসলমের হেরোদ গেটের কাছের (এখানেই ভারতীয় হসৃপিস্– সরাইখানা, চট্টি যা খুশি বলুন– অবস্থিত) কাফে– আড্ডাতে। এর শতকরা ৯৯% পাঠক বাদ দিতে পারেন। মোদ্দাটুকু শুধু এই : যুবক রাববিপুত্রের জন্য বিবাহযোগ্য বধূ সে কুলে নেই।

অতএব স্থির হল, ওই জাতশত্রু ইজরাএলি ইহুদিদেরই কোনও মেয়ে বিয়ে কর। হাজার হোক, ওরা তো ইয়াহভে মানে, ধর্মগ্রন্থ পেনটাটয়েশ স্বীকার করে। খ্রিস্টান, মুসলমান তো আর বাড়িতে ভোলা যায় না।

ন্যাজরিথ যাবার পথে পড়ে স্যামারিটানদের নাবলুস; নিশ্চয়ই দেখে যেতে হবে। নিঃসন্দেহে যারা অন্তত তিন হাজার বছর ধরে ভিটের মাটি (ওহ! আর সে কী মাটি, বালি-পাথরে ভর্তি!) কামড়ে ধরে পড়ে আছে, তারা দ্রষ্টব্য বইকি।

***

সে আমলে প্যালেস্টাইনে চলত তিন রকমের বাস্। আরব বাস্, ইহুদি বাস্ আর স্টেট বাস্। কাটা ফালাইলেও ইহুদি চড়ত না আরবের বাস্ এবং ভাই ভাসা। দু দলেই চড়ত স্টেট বাস।

আত্মচিন্তায় নিমগ্ন আমার সামনে এসে হঠাৎ দাঁড়াল একখানি করকরে নতুন ট্যাকসি। আরব ড্রাইভারের পাশে দেখি গোটা পাঁচেক মেল-ব্যাগ। পিছনের সিটে জাব্বাজোব্বা পরা ইয়া মানমনোহর গলকম্বল দাড়িওলা দুই রাববি। এক রাববি পিছনের দরজা খুলে বার বার বলে যাচ্ছেন, উঠে পড়, উঠে পড়।

আমি ক্ষণে সালাম জানিয়ে, ক্ষণে জোড়-হাতে নমস্কার করে (এটা ভারতীয়দের পেটেন্ট মাল বিদেশি মাত্রই চেনে!), ক্ষণে ডান হাত বুকের বাঁ দিকের উপর রেখে ঝুঁকে ঝুঁকে ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, ট্যাকসিতে যাবার মতো কড়ি আমার গ্যাঁটে নেই। আমি যাব বাস-এ।

দুই রাববি যা বলেছিলেন– আহা কী সুন্দর অত্যুকৃষ্ট বিদগ্ধ নাগরিক আরবি ভাষাতে– তার তাৎপর্য কী উৎপাত, কী জ্বালাতন! উঠে পড়, উঠে পড়। আমরা কি কানা! দেখতে পাচ্ছিনে, তুমি ভিনদিশি? আমরা তো ট্যাসিটার সাকুল্যে পিছন দিকটা ভাড়া নিয়েছি। উঠে পড় উঠে পড়। কী মুশকিল! আড্ডা বাপু, তুমি বাস্-এ যে ভাড়া দিতে সে-ই না হয় আমাদের দেবে। (এই বেলা বলে নিই, পরে, বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও সেটা তারা নেননি।

কিন্তু ইয়া আল্লা, বসি কোথায়! গোটা তিনেক মোরগামুরগি কাক-মাক করছে, দু-তিন ঝুড়ি আলু-টমাটো-মটরশুটি কপি, দুখালুই ডিম, আর কী কী ছিল খোদায় খবর।

রাববিরা বরাব্বর বলে যাচ্ছেন, হয়ে যাবে, হয়ে যাবে।

এক রাববি কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। তাই এতসব।

আমি চোখের তারা কপালে তুলে বললুম, বলেন কী মশাই! এই তিনটে আণ্ডা, গোটাকয়েক মুরগিতেই আপনাদের দেশে কন্যাপক্ষ খুশি হয়ে যায়! তাজ্জব! তাজ্জব!! আমাদের মোশয়, সিনাই পর্বত প্রমাণ মাল নিয়ে গেলেও হালাদের মুখে হাসি ফোটে না।

আমার জেবে একটা হাতির দাঁতের ডিম্বাকার নস্যির কৌটো ছিল। নস্যাভাবে সেটাতে রাখতুম মিশরীয় সুগন্ধি। সেইটা তুলে ধরলুম তাদের সামনে।

দুই রাববি আমাকে জাবড়ে ধরে চুমো খেতে লাগলেন।

বিস্তর কথাবার্তা হল। নাবলুস, ন্যাজরিথ গল্পের তোড়ে পেরিয়ে গিয়ে তখন পৌঁছে গিয়েছি গেলিলিয়ান লেক-এ।

দুই রাববি আমার মাথার উপর হাত রেখে বিস্তর মন্ত্র পড়ে গেলেন। তাদের আশীর্বাদের এক কণাও যদি সফল হয় তবে আমি ভারতবর্ষের রাজা হব।

————

১. পুণ্যনগরী জেরুস্লম যে ইহুদিদের একদিন ত্যাগ করে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে হবে সেকথা এর প্রায় ৮০০ বছর পূর্বে ইহুদি প্রফেটরা বার বার ভবিষ্যদ্বাণী করে ইহুদিদের সাবধান করেছেন। তারা কান দেয়নি; আচার-আচরণ বদলায়নি। এই বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার নামই ডিসপারসেল, গ্রিক দিয়াসপরা।

২. ইংরেজ অ্যালেবি যখন জেরুসলমে প্রবেশ করেন তখন সে খবর একজন অস্ট্রেলিয়ান সৈন্যকে দিলে পর সে রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে বলে, তাই তো! প্রভু খ্রিস্টের জন্মকালে যেসব মেষপালককে দেবদূত সে সুসমাচার জানান, তাদের বংশধরদের একটু হুশিয়ার করে দিলে হয় না যে– ইংরেজ ভেড়ার পালে ঢুকেছে– মতলবটা ভালো নয়। শপ-লিফটার ইংরেজ শি-লিফটিঙেও যে কিছু কম যান না সে তত্ত্ব আউসি বিলক্ষণ জানত। তার হুশিয়ারি কিন্তু পরবর্তী যুগে টায় টায় ফলেনি। ইংরেজ যখন দেখল যে সে নেটিভদের সঙ্গে পেরে উঠবে না, তখন তাদের পিছনে ইহুদিদের লেলিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। আর ইহুদি যে শুধু ভেড়াগুলো মেরে দিল তাই নয়, নেটিভদের জর্ডনের হে-পারে (আমরা যেরকম বলি পদ্মার হে-পারে) খেদিয়ে দিল।  ৩. এ জায়গাটা ছিল জরডন এলাকায়। হালে ইজরাএল বাহিনী সেখানে পৌঁছে গেরিজিম মন্দিরের ভগ্নাবশেষের উপর ইজরাএলের জাতীয় পতাকা তুলতে গেলে স্যামারিটানদের সঙ্গে হাতাহাতির উপক্রম হয়। পরধর্ম বাবদে ইহুদিরা ঈষৎ অসহিষ্ণু এ তত্ত্বটি ইংরেজ জানত বলেই ইজরাএল রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় (১৯৪৮) তারা খ্রিস্ট-মুসলিম গির্জা মসজিদে ভর্তি প্রাচীন জেরুস্লম (ইহুদিদের বিশেষ কোনও স্থাপত্য এ শহরে আজ আর নেই, কারণ রাজা হাদরিয়ান শব্দার্থে এ নগরের উপর হাল চালিয়েছিলেন এবং ওই সময়ই ইহুদিকুল শেষবারের মতো জেরুস্লম পরিত্যাগ করে বলে পরবর্তী যুগে কিছু নির্মাণ করার সুযোগ পায়নি)। ইজরাএলের শত মিনতিভরা কাতর রোদনে কর্ণপাত না করে মুসলমান জর্ডনরাজকে দিয়ে দেন। হালের যুদ্ধের ফলস্বরূপ ইজরাএল যখন প্রাচীন জেরুস্লম অধিকার করে তখন এ যুগের ইংরেজ লেবার (অর্থাৎ ঐতিহ্যহীন অনভিজ্ঞ) সরকার কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। কিন্তু স্যামারিটানদের মন্দিরে ইজরাএলের ব্যভিচারের খবর ইংল্যন্ডে পৌঁছনো মাত্রই লেবার-বাবুদের কানে জল গেছে। নিরাপত্তা পরিষদে চিৎকার করে ইংরেজের ফরিনমন্ত্রী ব্রাউন একাধিকবার বলেছেন, ইহুদিকে প্রাচীন জেরুস্লম ছেড়ে দিতেই হবে। এই প্রাচীন নগরীর ভিতরে রয়েছে খ্রিস্টের বিরাট সত্যই অতি বিরাট সমাধি। সৌধ (হোলি সেপালকর), গেৎসিমেনের বাগান যেখানে প্রভু যিশুর দেহ থেকে স্বেদের পরিবর্তে রক্ত বেরোয়, মাউন্ট অলিভ এবং ভিয়া দলরসা যে পথ দিয়ে প্রভু ক্রুশ বহন করে বধ্যভূমিতে পৌঁছন। (মুসলমানদের হরমশরিফ, মসজিদ-উল-আকসা বাদ দিচ্ছি– এগুলোর জন্য ইংরেজের কোনও দরদ না থাকাই স্বাভাবিক)। ইজরাএলের সাতিশয় বিবেচক করুণ করে এগুলো সঁপে দিতে ব্রাউন হিম্মত পাচ্ছেন না। কিসের হাতে যেন কী সমর্পণ!

দুঃখ তব যন্ত্রণায়

আমাদের কৈশোরে রমা রলাঁ ছিলেন অতিশয় জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। বস্তুত এমনও একটা সময় গিয়েছে, যখন বাঙলা দেশে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় উপন্যাস বলতে রল্যার জ্যা ক্রিতই বোঝাত।

সে যুগে ঔপন্যাসিক ছাড়া অন্য কোনও রূপে র আত্মপ্রকাশ করেছেন কি না, সে সম্বন্ধে আমরা কোনও কৌতূহল প্রকাশ করিনি।

অথচ ইয়োরোপের ভাবুকজন মাত্রই রলাঁকে চেনেন আরও অন্য একটি রূপে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার বহু আগের থেকেই রলা ইয়োরোপে ক্রমবর্ধমান উকট জাতীয়তাবাদ (শভিনিজম) যে ভিন্ন ভিন্ন দেশকে অবশ্যম্ভাবী প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে সে সম্বন্ধে সচেতন হয়ে যান এবং দেশবাসী ফরাসি তথা জরমনদের (রলা ছিলেন জরমন সঙ্গীতের আবাল্য একনিষ্ঠ ভক্ত) এ বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সাবধানবাণী শোনান। বলা বাহুল্য, এহেন পরিস্থিতিতেও সর্বত্র, সর্বকালে যা হয়ে থাকে, তাই হল। উভয় দেশই তাঁকে আপন আপন শত্রু বলে ধরে নিল।

বিশ্বযুদ্ধ লাগার সময় রলাঁ ছিলেন সুইজারল্যান্ডে। তিনি রেডক্রসে যোগ দিলেন এবং দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, প্রায় সমস্ত যুদ্ধকালটা ফ্রান্সের উদগ্র শভিনিজমের বিরুদ্ধে দৈনিকে মাসিকে প্রচার-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলেন। যুদ্ধশেষের সময় ভগ্নোৎসাহ ক্লান্ত রলা খুঁজলেন শান্তির সন্ধান। ডুব দিলেন তাঁর স্বদেশের শত্রু জরমন জাতের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতসৃষ্টিকার বেটোফেনের সঙ্গীতের আরও গভীরে। বেটোফেন জরমন হয়েও জরমনদের বহু উর্ধ্বে– তাঁর সঙ্গীত মানুষকে তুলে নিয়ে যায় নভঃলোকে, যেখানে ক্ষুদ্র-নীচ শভিনিজম পৌঁছতে পারে না। একদা তিনি তারই মতো মহামানব কবি গ্যোটেকে বলেছিলেন, আপনি-আমি দেবদূত : আমাদের কাজ– মাটির মানুষকে স্বর্গলোকের দিকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া।(১)

রলাঁ যে বেটোফেনের আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেটাকে মডার্ন উন্নাসিক ইসকেপিজম, পলায়নী মনোবৃত্তি নাম দিয়ে সস্তায় কিস্তিমাত করবেন। কিন্তু ভুললে চলবে না, রল অবগাহন করতে নেমেছিলেন সুরগঙ্গায় ক্লান্ত দেহমন স্নিগ্ধ করে নিয়ে পুনরায় তার কর্তব্য-কর্মে মনোনিবেশ করার জন্য। তিনি গঙ্গা নদীর মীন হয়ে ইসকেপিজমের নদীগর্ভে বিলীন হতে চাননি।

***

আঁদ্রে জিদ-এর কপালে ছিল নিদারুণতর দুর্দৈব। তিনিও জাতি-ধর্ম-দেশের ঊর্ধ্বে বিরাজ করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে রলাঁ যেরকম আশু দুর্যোগের পূর্বাভাস সুস্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন তিনিও তেমনি পেয়েছিলেন দ্বিতীয়ের পূর্বাভাস। যুদ্ধ লাগার পর তাঁকে যখন বেতারে প্রোপাগান্ডা করতে বলা হল, তিনি অসম্মতি জানালেন। দেশকে ভালোবাসতেন রলাঁ, জিদ উভয়েই, কিন্তু যে স্থূল পদ্ধতিতে অশ্রাব্য কটু ভাষণে যুদ্ধের সময় এক জাতি অন্য জাতিকে গালাগাল দেয়, স্পর্শকাতর বিশ্ব-নাগরিক এবং সর্বোপরি বিদগ্ধ কলাকার জিদ তার সঙ্গে সুর মেলাবেন কী করে! জিদ তার জ্বরনালে (রোজনামচাতে) লিখছেন, ন! দেসিদেম, জ্য ন্য পারলরে পা আ লা রাদিয়োনা, আমার স্থির সিদ্ধান্ত, আমি বেতারে বক্তৃতা দেব না।…খবরের কাগজগুলো এমনিতেই যথেষ্ট দেশপ্রেমের ঘেউ-ঘেউয়ে ভর্তি। নিজেকে যতই ফরাসি বলে অনুভব করি ততই আমার ঘেন্না করে। এর পর জিদ বড় সুন্দর করে বলেছেন; তিনি নিজেকে যেভাবে ফরাসি মনে করে গর্ব অনুভব করেন, এই স্কুল পদ্ধতির সঙ্গে তো তার কোনও মিল নেই।

জিদের স্মরণে এল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার সময়কার কথা। তখন কিছু লোক এমনই হাস্যকর প্রচারকার্য আরম্ভ করে যে, তখনকার দিনের অন্যতম খ্যাতনামা লেখক সিআঁ জাক্‌ বলেন, চুপ করে থাকাটা কি তবে এমনই কঠিন? সে ক্ সি দিফিসিল দ্য স্য ত্যার?

তার পর জিদ বলছেন, কিন্তু হৃদয় যখন ফেটে পড়তে চায়, তখন নীরব থাকাটা যে বড়ই বেদনাময়। এটা স্বীকার করে তিনি শেষ করেছেন এই বলে, কিন্তু আমি তো চাইনে আজ এমন কিছু লিখতে, যার জন্য কাল আমাকে মাথা হেঁট করতে হয়!

এই সময় জিদ পড়ছেন জরমন কবি ও ঔপন্যাসিক আইসেনডরফের বই নিষ্কর্মা!

অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটে যেতে লাগল জিদের চোখের সম্মুখে। অবিশ্বাস্য মনে হল বিশ্বজনের কাছে যে, নেপোলিয়নের দেশ ফ্রান্স মাত্র পাঁচ-ছয় সপ্তাহের একতরফা যুদ্ধের পর– বস্তুত ফ্রান্স একবার মাত্রও পুরো জোর হামলা করতে পারেনি!–বিজয়ী জরমনির পদতলে লুষ্ঠিত হল।

জিদ বলছেন, শত্রু যখন প্রচণ্ড শক্তিশালী, তখন তার কাছে পরাজিত হওয়াতে নিশ্চয়ই কোনও লজ্জা নেই; এবং আমিও কোনও লজ্জা অনুভব করিনে। কিন্তু যখন ভাবি আমরা কী সব স্তোকবাক্যের ওপর নির্ভর করে কর্তব্যকর্ম অবহেলা করে পরাজয় ডেকে এনেছি তখন যে গভীর বেদনা অনুভব করি সেটা ভাষাতে প্রকাশ করতে পারিনে, অস্পষ্ট মূর্খ আদর্শবাদ, প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে মোহাচ্ছন্ন অপরিচয়, অপরিণামদর্শিতা, মূর্খের মতো অর্থহীন এমন সব বাগাড়ম্বরে অন্ধবিশ্বাস– যার মূল্য আছে শুধু অপোগরে কল্পরাজ্যে।

নিরঙ্কুশ পরাজয়ের পরের দিন জিদ লিখেছেন :

একমাত্র গ্যোটের সঙ্গে কথোপকথনই আমাকে দুশ্চিন্তার এই মৃত্যু-যন্ত্রণা থেকে কিঞ্চিৎ মুক্তি এনে দেয়

Seules les Conversations avec Goethe parviennent a distraire un peu ma pensee de Pangoisse.

পাঠক লক্ষ করবেন, গ্যোটের সঙ্গে কথোপকথন Conversation with Goethe (মূল জরমনে Gaspraeche mit Goethe in den letzten Jahren seines Lebens)

গ্যোটে সম্বন্ধে সর্বাপেক্ষা প্রামাণিক অত্যুত্তম জীবিত জীবনী লিখেছেন গ্যোটের সখা এবং শিষ্য একেরমান (অনেকটা শ্রীম)। কথোপকথন হয়েছে গ্যোটে এবং একেরমানে। অথচ জিদ ইচ্ছে করে এমনভাবে বাক্যটি রচনা করেছেন যে মনে হয় তিনি, জিদ-ই, যেমন স্বয়ং কথাবার্তা বলছেন জরমন মহাকবি ঋষি গ্যোটের সঙ্গে, ইঙ্গিত করছেন, তিনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন ঋষির বাণী, তার কণ্ঠস্বর। দুশ্চিন্তার বিভীষিকায় যেটুকু সান্ত্বনা তিনি আদৌ পাচ্ছেন সেটি তারই কাছে থেকে।

জিদ ঋষি নন– গ্যোটের মতো। কিন্তু তিনি তখন ফ্রান্সের গ্রা ম্যাক্স–এ্যাড় মাস্টার অর্থাৎ ফ্রান্সের পথভ্রষ্টা সাহিত্যসম্রাট। সেই ফরাসি সম্রাট সঞ্জীবনী সান্ত্বনা নিচ্ছেন যে জরমনি নির্মমভাবে ভূলুণ্ঠিত করেছে গরবিনী ফ্রান্সকে, তারই ঋষি কবির কাছ থেকে!

***

মিশরের আড্ডা সম্বন্ধে পক্ষাধিককাল পূর্বে যখন লিখি তখন কল্পনাও করতে পারিনি, এই মিশরই দু-পাঁচ দিনের ভিতর লেগে যাবে জীবনমরণ সংগ্রামে। সেই আড্ডাতে যিনি ছিলেন আমাদের কবিম্রাট তাঁর কবিতা পড়লে মনে হত তিনি যেন ইসলাম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী যুগের বেদুইন ভাট। কথায় কথায় বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন, ছুটছে ঘোড়া উড়ছে বালি আর জাত ইহুদি ইব্রাহিমের পুত্র মিশররাজ ইউসুফ ও জোলেখার সাহারার উষ্ণশ্বাস-ভরা নীলনদের দু-কূলভাঙা প্রেম।(২) আলট্রা মডারন কাইরো শহরের শিক পশ কাফের বাতাবরণে আমাদের কবিরাজ আহমদ ইবন শহরস্তানি অল-মুকদদসি যখন তার সেই ফারাও যুগের প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাত, তখন আমার মনে হত এ রস রোমানটিক, ক্লাসিক, এপিক, বৈদিক, প্রাগৈতিহাসিক সবকিছু ছাড়িয়ে গিয়ে সোজা বেআনডারটালে পৌঁছে গেছে। কবিও তাই চাইতেন।

আমাদের মুকদৃদসি কিন্তু আর্ট কী, অলঙ্কার কাকে বলে, আর অনুভূতি-প্রধান না তাতে অন্য কোনও মনোবৃত্তি চিত্তবৃত্তি প্রবেশ করতে পারে কি না সে নিয়ে কোনও আলোচনা করতে চাইত না, পারতও না। এ কিছু নতুন তত্ত্ব নয়। মা-ঠাকুরমার রূপকথা শুনে আমরা, হ্যাঁ, বয়োবৃদ্ধরা পর্যন্ত বিমোহিত হয়ে ভাবি, রূপকথা কল্পনা করার, তাকে অনাড়ম্বর ভাষায় প্রকাশ করার রহস্যটা কোনখানে। প্রশ্ন শুধিয়ে দেখি ঠাকুরমা-ও জানেন না। মুকদদসির বেলাও হুবহু তাই।

শুধু একটি কথা মাঝে মাঝে মাথা দোলাতে দোলাতে বলত, কবি হওয়ার একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে হে, কবি হওয়ার একটা বিশেষ মূল্য আছে। সে মূল্য কিন্তু অর্থ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি কোনওকিছুর মাপকাঠি দিয়েই বিচার করা যায় না। কোন এক ইরানি কবি নাকি পেয়েছিলেন লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা, দাতে পেয়েছিলেন বেয়ারিচের কাছ থেকে একটি ফুল, কিংবা কী জানি, কার ঠোঁটের কোণে স্বীকৃতির একটুখানি স্মিতহাস্য, কী জানি।

কবি মুকদদসি বড় স্পর্শকাতর। সে আরব। ইহুদিদের কাছে তারা নির্দয়ভাবে লাঞ্ছিত অপমানিত হয়েছে। তাকে চিঠি লিখেছি, সখা তুমি ইহুদিকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হাইনরিষ হাইনে পড়।

***

যে একেরমান গ্যোটের সঙ্গে কথোপকথনের বিবৃতি দিয়ে বিশ্ববিখ্যাত হন তিনি ছাত্রাবস্থায় গ্যোটিঙেন শহরে হাইনের বন্ধুত্ব লাভ করেন। এক জহুরিকে চিনতে অন্য জহুরির বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। প্রথম দর্শনেই প্রেম হয়।

ছাত্রাবস্থাতেই হাইনের সরল মধুর কবিতা জরমানির সর্বত্র খ্যাতিলাভ করে। অতিশয় সাধারণ জন-দফতরের কেরানি, ম্যাটরিকের মেয়ে, ছাপাখানার ছোকরা তাকে যেন দুবাহু মেলে আলিঙ্গন করে নেয়। আর ওদিকে বন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত আলঙ্কারিক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ফন শ্লেগেল তো তাকে প্রথমদিনই বিজয়মুকুট পরিয়ে দিয়েছিলেন।

ঘটনাটির বর্ণনা দিয়েছেন একেরমান; ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮২৪। তার পর সেটি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে।

গ্যোটিঙেন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে ঘণ্টাখানেকের পথ– লানটুভের বিয়েরগারটেন। খোলামেলাতে বিয়ারের আড়া। রোববার দিন গ্যোটিঙেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা সেখানে এসে জালা জালা বিয়ার খায়, হইহুল্লোড় করে, আর নৃত্যগীত তো লেগেই আছে।

একেরমান, হাইনে এবং কলেজের আরও কয়েকজন ইয়ার-বসি গেছেন সেখানে ফুর্তি করতে।

হাইনে আগের থেকেই মৌজে বোধহয় হামবুর্গের ব্যাঙ্কার কাকার কাছ থেকে বেশ কিছু পেয়েছেন।(৩) তিনি ছেড়ে দিয়েছেন তার আনন্দোল্লাসের লাগাম– বাক্যস্রোত ছুটেছে তুরুক সোওয়ারের মতো। বিয়ার তাদের টেবিলে নিয়ে এসেছে পাব-এর খাবসুরুত কোমলাঙ্গি তরুণী লটে (Lotte), হাইনে ফুর্তির চোটে জড়িয়ে ধরেছেন সুন্দরী লটেকে। কিন্তু একেরমান ও অন্যান্য ইয়াররা পূর্বাভিজ্ঞতা থেকে জানতেন, এই লটেটি বিয়ার-খানার আর পাঁচটা বার্গারুলের মতো ঢলাঢলির পাত্রী নয়। রাগে তার বাঁশির মতো নাকের ডগাটি হয়ে গেছে টুকটুকে রাঙা, চোখ দিয়ে বেরুচ্ছে আগুনের হলকা, আর সে এমনই ধস্তাধস্তি আর পরিত্রাহি চিৎকার ছাড়তে আরম্ভ করেছে যে, ইয়ারগোষ্ঠী কানে আঙুল দিয়ে চেপে ধরেছেন। হাইনে ওটা মশকরা হিসেবেই ভেবে নিয়েছিলেন গোড়ার দিকে, কিন্তু একটু পরেই কী যেন ভেবে অপ্রতিভ হয়ে চুপ মেরে গেলেন– যেন কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।(৪)

পরের সপ্তাহে একেরমানরা যখন হাইনেকে তুলে নিতে এলেন, তখন তিনি তাদের সঙ্গে যেতে কবুল নারাজ। শেষটায় একরকম গায়ের জোরে জাবড়ে ধরে তাকে গাড়িতে তুলতে হল।

কাফেতে আসন নিয়ে হাইনে মাথা হেঁট করে রইলেন চুপ। ঘাড় তুলে মেয়েটির দিকে তাকাবার মতো সাহস পর্যন্ত তার নেই।

কিন্তু কী আশ্চর্য! লটে স্বয়ং এসে উপস্থিত হাইনেদের টেবিলে। মধুর হাসি হেসে হাইনের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালেন। এয়ার-দোস্তরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

লটে হাইনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ওপর রাগ করবেন না, স্যার। আপনি অন্য ছাত্রদের মতো নন। আমি আপনার কবিতা পড়েছি। কী সুন্দর! কী সুন্দর!! আপনার যদি ইচ্ছে যায়, তবে এইসব ভদ্রলোকের সামনাসামনি আমাকে আলিঙ্গন করতে পারেন কিন্তু এইসব মধুর কবিতা আপনাকে রচনা করে যেতেই হবে।

বলেই লটে তার গাল বাড়িয়ে দিলেন হাইনের দিকে। আর হাইনে? কে জানত হাইনের মতো সপ্রতিভ লোকও লজ্জায় লাল হয়ে যেতে পারেন– লজ্জায় লাল হয়ে তিনি চুমো খেলেন।

একেরমান বলেছেন লক্ষ করলুম (নটবর) বন্ধু স্পিটা হিংসেয় একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে।

***

হাইনের চোখ দুটি ভিজে গিয়েছে। মৃদু কণ্ঠে বললেন, এ জীবনে এর চেয়ে সুখী আমি আর কখনও হইনি। এই আমি প্রথম হৃদয়ঙ্গম করলুম, কবি হওয়ার মূল্য আছে, কবি হওয়া সার্থক।

***

সখা মুকদদসি, কবি হওয়া সার্থক।

———–

১. দুঃখের বিষয়, মূল পাঠটি আমার কাছে নেই। উভয় মহাপুরুষের পরিচয় হয় কারলস বাড-এ (চেক নাম Karlovy Vary)। ছোট গলির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে উভয়ের দেখা হয় জনা দু-তিন রাজপুত্রের সঙ্গে। গ্যোটে সসম্মানে তাদের পথ ছেড়ে দেন। বেটোফেন পাগলা ষাড়ের মতো সোজা চলতে থাকলে রাজপুত্রেরা সবিনয় তার জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যান। গলির শেষে পৌঁছে বেটোফেন প্রতীক্ষা করেন গ্যোটের জন্য। তিনি পৌঁছলে পর রাজপুত্রদের প্রতি ইঙ্গিত করে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন, এরা কারা? আপনি-আমি দেবদূত ইত্যাদি। সমস্ত ঘটনাটিই হয়তো কিংবদন্তিমূলক। এর একাধিক পাঠ (ভারসন) আমি কারলস বাডে বাসকালীন শুনেছি। তবে রাও তার বেটোফেন-গ্যোটে সম্বন্ধে পুস্তকে ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন।

২. আমরা যে গ্রন্থকে ওলড টেস্টামেন্ট বলি সেইটেই ইহুদিদের তৌরা ইত্যাদি। সেসব গ্রন্থে বর্ণিত অনেক পয়গম্বর কুরানেও বর্ণিত হয়েছেন। ইউসুফ তাদেরই একজন। নজরুল ইসলাম হাফিজের অনুবাদ করেছেন : দুঃখ কর না, হারানো ইউসুফ কিনানে আবার আসিবে ফিরে।

৩. টাকাকড়ি বাবদে হাইনে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন অত্যন্ত বেহিসেবি। তিনি স্বয়ং এক জায়গায় লিখেছেন, কে বলে আমি টাকার মূল্য বুঝিনে? যখনই ফুরিয়ে গিয়েছে তখনই হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।

৪. কনটিনেনটের ছাত্র-পাবে এ ঘটনা নিত্য নিত্য ঘটে। কেউ বড় একটা সিরিয়াসলি নেয় না। চেঁচামেচিটা অনেক ক্ষেত্রেই ন্যাকরা বলে ধরা হয়।

ন্যাংটাকে ভগবানও ডরান

কী করে হঠাৎ একরাশ টাকা আমার হাতে এসে পৌঁছল, সেটা দফে দফে বুঝিয়ে বলা শক্ত। দরকারও নেই। মোটামুটি বলতে পারি, অনেকটা লটারি জেতার মতো।

কিন্তু বিপদ হল, টাকাটা যার মারফৎ এসেছিল, তাঁকে নিয়ে। তিনি লন্ডনের বিকটতম উন্নাসিক এক দর্জির দোকানে কাজ করেন। সে দোকান নাকি রাজ-পরিবারের বাইরের কারও জন্য অর্ডার নেয় না। সেই কর্ম-প্রতিষ্ঠানে না আছে সাইনবোর্ড, না আছে টেলিফোন-কেতাবে তাদের নাম, নম্বর। তাদের প্রাইভেট নম্বর শুধু রাজ-পরিবার জানেন। অন্য লোকে সন্ধান পাবেই-বা কী করে!

আমি বাস করতুম তারই বাড়িতে। বাড়ির জেল্লাই কিছু কম নয়। বাকিংহাম প্যালেস পেরিয়ে হাইড পার্ক গেটে তার ভবন। সে রাস্তাতেই থাকেন আর্টিস্ট এপসটাইন (না রোটেনস্টাইন, ঠিক জানিনে) ও চার্চিল সাহেব। আমি সেথায় আশ্রয় পেলুম কী করে? সেই খলিফের খলিফে গিয়েছিলেন হল্যান্ডে। সেথাকার রাজকন্যার বিয়ে হবে। বরের বিয়ের বেশভূষা তৈরি করতে। অতিশয় অনিচ্ছায়, দেশের আপন রাজার আদেশে। সেই বিদেশের রাজধানীতে পথ, হোটেলের নাম সব হারিয়ে যখন গা গার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তখন আমি তাকে কিছুটা সাহায্য করতে পেরেছিলুম। ব্যস! হয়ে গেল। তিনি সেখান থেকে পড়কে আমাকে লন্ডন নিয়ে এলেন। তদবধি তার ভবনে বাস। অবশ্য স্বীকার করব, লোকটি দ্র। আমি অন্যত্র সস্তা জায়গায় থাকলে যে কড়ি শুনতুম, তিনি সেটি সপ্তারম্ভে সহাস্যে নিতেন। পাছে আমি লজ্জিত হই, আমি মুফতে আছি।

আমি বললুম, কী ধরনের কাপড়ে স্যুটটি হবে সে বাবদে আমারও তো কিছু রুচি থাকতে পারে। দেখি, কাপড়ের নমুনা।

পাগলামিতে হাতেখড়ি হচ্ছে হেন লোককে যেভাবে ডাক্তার প্রণব রায়ের মতো লোক হ্যাঁন্ডিল করেন, সেইভাবে সদানন্দ হাস্য হেসে বললেন, বৎস, তোমাকে গুটিকয়েক প্রশ্ন শুধোই। তোমার যখন বিয়ে হয়, তখন গুরুজন তোমার ওই রুচির কথা শুধিয়েছিলেন?

সত্যের অনুরোধে আমাকে নিরুত্তর থাকতে হল।

আর এ তো সামান্য স্যুট। অবশ্য তুমি কুতর্ক করতে পার, সামান্য জিনিসেই বরঞ্চ আপন রুচিমাফিক জীবনানন্দ লাভ করা যায়। কিন্তু এ তো সামান্য জিনিস নয়, এ ব্যাপারটি অসামান্য। ভেরি ভেরি ইমপরটেন্ট। নইলে কও, এরই মেহেরবানিতে আমি বাড়ি গাড়ি হাকালুম কী প্রকারে? অতএব বুঝিয়ে কই।

গভীর দম দিয়ে মি. সিরিল হজসন-জবসন ফজ-রোবসন বললেন, উপস্থিত নববসন্ত সমারম্ভ। তুমি এসব স্যুট পরবে নিদাঘের অন্তিম নিশ্বাস থেকে হেমন্তের শেষান্ত পর্যন্ত। এইবারে শোনো বস, তত্ত্বকথা। শিশির বসন্ত নিদাঘ হেমন্ত প্রতি ঋতু অনুযায়ী বকিঙহম প্রাসাদ ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের পরিচ্ছদ ধারণ করেন। কিন্তু প্রতি বসন্তে একই বর্ণনা, প্রতি শিশিরে একই সর্ষপবর্ণ– অর্থাৎ নুন-হলদে না, একই বর্ণ না, একই বর্ণনা করা চলবে না।

প্রতি ঋতুর সমারম্ভে আমাদের একটি গুহ্যতম– টপমোস্ট সিরিট সভা বসে আসছে ঋতুর বর্ণ স্থির করার জন্য। যে বর্ণ স্থির করা হল, সেটা অত্যন্ত গোপনে রাখতে হয়। নইলে রাস্তার যেদো-মেধো সেই রঙের স্যুট পরে যত্রতত্র ঘোঁতঘোঁত করে ঘুরে বেড়াবে। তা হলে ডুক অব এডেনবরা যখন অ্যাসকটে নামবেন– না, সেখানে হাঙ্গামা কম, প্রশ্ন শুধু ওয়েসকিট নিয়ে–

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ওয়েসকিট কী?

চ্যাংড়ারা হালফিল যাকে ওয়েস্টকোট বলে।

আমি চুপ করে ভাবলুম, আমাদের দর্জিরা যখন ওয়াসকিট বলে, তখন মোটামুটি শুদ্ধ উচ্চারণই করে, এবং লাটসাহেবের লাটু উচ্চারণের মতোই প্রাচীন শুদ্ধ উচ্চারণ। বললুম, তা ওয়েসকিট নিয়ে দুর্ভাবনা কিসের?

তিনি অনেকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, তোমার ব্লাইন্ড স্পটগুলো যে খোদায় কোথায় কোথায় রেখেছেন, বলা শক্ত। এদিকে শেপিয়ার-বাইরন পড়েছ, অন্যদিকে মর্নিং স্যুটের ওয়েসকিটের মহিমা জানো না।

আমি একগাল হেসে বললুম, টায় টায় মিলে যাচ্ছে। ফ্রান্সের শ্যামপেন প্রভিনসের এক সমঝদার আমায় বলেছিল, তাজ্জব লাগে মসিয়ো, এদিকে আপনি মলিয়ের সারত্র পড়েছেন অন্যদিকে আপনি উত্তম মদ্য বর্দো বুর্গনের বুকের (Bouquet) তফাত ধরতে পারেন না! তা সে যাক গে। স্যুটের রঙের কথা কী যেন বলছিলে!

হু, আসছে সিজনে সমঝদাররা যেসব রঙের ওপর–রঙের ওপর ঠিক না, রঙের শেডের ওপর নয়াস্-এর ওপর কৃপা করবেন সেই অনুযায়ী তোমার স্যুটগুলো তৈরি করা হবে।

আমি শঙ্কিত হয়ে বললুম, গুলো মানে? কটা?

আপন ওয়েসকিটের সর্বনিম্ন বোতামটির উপর–ইটি কখনও খাজে ঢোকানো হয় না, যবে থেকে স্যুক অব উইনজার ফ্যাশানটি প্রবর্তন করেন– হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, তা, তা, গোটা বিশেক। আপাতত। পরে দেখা যাবে।

এর পর আর শঙ্কার কোনও কথা ওঠে না। আমি বললুম, যে টাকাটা ফোকটে পেয়েছিলুম, সেটা গেল। উপস্থিত লন্ডনে একটা নাতিভদ্র লাউনজ স্যুটের কেমও নিদেন– পাউন্ড ৫০/-/-, আড়ভালোরেম, আমাদের দিশি টাকায় প্রায় আটশো

বাধা দিয়ে বললেন, পাগোল! একটা সুস্থ (সোবার) স্যুটের দাম নিদেন– পাউন্ড 120/–/–

যখন পুনরায় চৈতন্যময় জগতে ফিরে এলুম তখন মি. (পরে তিনি স্যার হন) হজসন-জবসন ফজ-রোবসন আমার গলায় সাইফন থেকে সোডা-জলের সঙ্গে কড়া ব্রান্ডি মিশিয়ে তাই দিয়ে চো– ওঁ করে চাঁদমারি মারছেন– দমকলের লোক যেরকম হৌজ দিয়ে আগুন মারে।

আমার কোনও কিছু বলার মতো অবস্থা নয়। মি. হজসন (ইত্যাদি) বললেন, আকছারই এ-রকমধারা হয়। আমরা দমকল ডাকিনে। সাইফন দিয়ে কাজ চালাই। এই পদিনই ডুক্ অব কে।

আমি ক্ষীণকণ্ঠে বললুম, তা হলে আমার এই দিশি কোত-পালুন বন্ধক দিয়ে দেশের টিকিট কাটতে হবে নাকি?

সঙ্গে সঙ্গে বললেন, প্যাট কেম দি রিপ্লাই, খোলা বাজারে না, কিসসুটি পাবে না। তবে হ্যাঁ, আলবত, ব্রিটিশ মুজিয়াম পুর্না সব আরকিওলজিকাল কুররা কিনছে। অশোকের দাস্তানা, অর্জুনের পোর্টেবল অ্যাটম বম, দ্রৌপদীর প্রেসারকুকার-কম্-ফ্রিজ। কিন্তু তুমি অত ভয় পাচ্ছ কেন? আচ্ছা বল তো, পশুদিন রোদার যে মূর্তিটি বিক্কিরি হল, তার পাথরের দাম কত? বুঝতে পারলে তো প্রশ্নটা? স্রেফ পাথরের দাম? প্লেন মেটেরেলের দাম?

আমি মিনমিনিয়ে বললুম, পাথরের দাম আর কত হবে? মার্বেল বটে। টাকা তিরিশেক।

ওস্তাদ সোৎসাহে বললেন, ইয়েহ্! আর মূর্তিটি বিক্রি হল পাউন্ড 50,000/-। এইবারে একটু চিন্তা কর। তোমাকে যে ডজন দুই স্যুট বানিয়ে দেব, বাজারে তার দাম হবে, নিদেন, হাজার তিনেক পৌন্ড। কিন্তু মেটেরেলের দাম? স্রেফ উলের দাম কত হবে? রঢ়ীয়াহ সে বঢ়িয়াহ? পাউন্ড 50/-/- পাউন্ড 100/-/- অর্থাৎ ১৪০০ টাকা? আমি আরটিস্ট, আমি রোদা।

একটুখানি ভরসা পেয়ে বললুম, তা, তা, ডজন দুই, মানে কি না, অতগুলো সুটের কি সত্যই দরকার?

***

এর পর ওস্তাদ অত্যন্ত টেকনিকাল ভাষায় যেকথা বলেন সে আমি বুঝতে পারিনি, মনেও নেই। অতএব এখন যদি তার ফিরিস্তি ঠিক ঠিক না দিতে পারি, তবে পাঠক অপরাধ নেবেন না।

তিনি হুড়হুড় করে বলে যেতে লাগলেন–

মর্নিং স্যুট– স্ট্রাইপট ট্রাউজারস– অরিজিনাল ওয়েসকিট তার টপ এনডে সাদা সিলকের পাইপিং দেব কি?– টাইয়ের উপরে ডাইমনড পিন্ না পার্ল দেব? কোণভাঙা কলারের জন্য কোন কোমপানি উত্তম? স্প্যাটার ডেশেজ।

তার পর দেমি। পাতলুন যথা পূর্বং। কিন্তু কোটটা টেল নয়।

সে না হয় হল। দুপুরের লাউ স্যুটটি কী প্রকারের হবে?

সন্ধেয়? ডিনার জ্যাকেট? টেলস্?

ইতোমধ্যে যদি গলফ খেলতে লোকটা গিয়ে থাকে?

কিংবা সাঁতার কাটতে?

কিংবা খেঁকশেয়াল শিকার করতে ঘোড়ায় চড়ে, জোডপুরী?

কিংবা সে যদি অসুস্থ হয়ে তাবৎ দিন বিছানায় শুয়ে থাকে, তবে তার ড্রেসিং গাউন কী হবে?

আমার মুখে বিরক্তি দেখে বললেন, এই যে তুমি এখন লাউনজ স্যুট পরে আছ, এ তো ইংরেজের ডাল-ভাত। এর ওপর তার কী ধরনের কটা স্যুট দরকার হয় তার ফিরিস্তি দেওয়া বড়ই শক্ত। সে থাক। উপস্থিত তোমার সঙ্গে কিঞ্চিৎ ভাষা বাবদে আলোচনা হোক। আচ্ছা বল তো স্মক কাকে বলে?

জানিনে।

তা হলে বানান করছি, smoking

এরকম বিদঘুটে উচ্চারণ হতে যাবে কেন? ফরাসিরা তাই করে। অবশ্যি যারা অল্পস্বল্প দুনিয়ার খবর রাখে তারা বলে স্মকি! তা সে যাক গে, কিন্তু ফরাসিতে অর্থ হল ডিনার জ্যাকেট, টেলজ না। আবার ইংরেজিতে স্মোকিং জ্যাকিট অন্য জিনিস। অসকার ওয়াইডের বড় প্রিয় ছিল, আর ছিল ফিনসি ওয়েসকিট

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ওয়াইলডের কথা কও, শুনতে রাজি আছি। কিন্তু তোমার এই বাহান্ন রকমের স্যুটের সুবারিক দেমাক আমার আর বরদাস্ত হচ্ছে না।

সিরিল বললেন, বট্ট্যে? তুমি যখন পাঁচ রকম ঔচে (উচ্ছে) বর্ণনা দিতে দিতে বারির চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়ে বল, ইংরেজ রাসৃটিক, তেহোর কদর বোঝে না, তখন আমি বাধা দিই? তুমি যখন বারোরকম অ্যামবল (অম্বল)–

***

শ্ৰীযুক্ত নীরদ চৌধুরী যাই বলুন, যাই কন, জামাকাপড় বাবদে আমরা মুক্ত।

রাস্তা দিয়ে নাগা সন্ন্যাসী যখন যায়, তখন তো আমরা শুধোইনে, এটা হিন্দু না মুসলমান ড্রেস!!

পপলারের মগডালে

দুই মহা চাণক্যে বিশ্রম্ভালাপ হচ্ছিল। নিদাঘের মধ্যরাত্রি আসন্ন। প্রচুর সুরা পান হয়েছে। ফলে সর্বাঙ্গ দিয়ে অজস্র স্বেদ ও তজ্জনিত বাষ্প বিনির্গত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সেই স্টিম থেকে যে স্পিরিট বেরুচ্ছে সেটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সামান্যতম স্পর্শ পেলেই দপ করে জ্বলে উঠবে বলে চাণক্যদ্বয় সিগার ধরাচ্ছেন না।

ইতোমধ্যে একজন গভীরতম চিন্তায় নিমজ্জিত থাকার পর দ্বিতীয়জনকে প্রশ্ন করলেন, একটা সমস্যা নিয়ে আমি অত্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি, ভ্রাতঃ! ভেবে ভেবে কোনও কূলকিনারা পাচ্ছি নে। মার্শাল থেকে শুমপেটার হয়ে কেইনস রবিনস সবাইকে চষেছি বেকার বেকার। তা আপনার কাছে তো কিছুই অজানা নেই

হুম।

এই ডাক-বিভাগটা চলে কী প্রকারে? অত অঢেল টাকা পায় কোথায়? ভাবুন দিকিনি, বিরাট বিরাট মাইনের ডাঙর ডাঙর আপিসাররা রয়েছেন, দশাসই সব আপিস দপ্তর, অগুনতি ভ্যান, লম্বা দৌড়ের রেলগাড়ি হলেই তার আধখানা জুড়ে ডাকের জন্য খাস ব্যবস্থা– এ তো আর ফোকটে-মুফতে হয় না! হ্যাঁ, মানলুম, তারা কোটি কোটি টাকার ডাকটিকিট বেচে। কিন্তু ওটাকে তো আর ব্যবসা বলা চলে না। ১০ পয়সার ডাকটিকিট বেচে ১০ পয়সায়, ১৫ পয়সার টিকিট বেচে ১৫ পয়সায়, কুড়ির কুড়ি পয়সায়ই। এক কানাকড়িরও তো মুনাফা নেই ওতে, যা দর তাতেই বিক্রি! লাভ রইল কোথায়? তা হলে ডাক-বিভাগটা চলে কী করে?

অতি হক কথা কয়েছেন, আমিও সানন্দে স্বীকার করছি, টিকিট বিক্রি করে ডাক-বিভাগের রত্তিভর মুনাফা হয় না। যে দাম আছে, তাতেই সে বিক্রি করতে বাধ্য। কিন্তু জানেন তো, দাদা, বড় বড় মুনাফার ব্যবসা মাত্রেই লাভের পথটা থাকে লুকানো যেদিকে সরল জনের নজর যায় না, তার মনে কোনও সন্দেহই হয় না। আচ্ছা! এইবারে দেখুন সমস্যাখানার রহস্য। পনেরো গ্রাম ওজনের খামের জন্য পোস্টাপিস চায় পনেরো পয়সা টিকিট নয় কি? এইবারে আপনাকে আমি শুধধাই হক্ক কথা কন। প্রত্যেকখানি চিঠির ওজনই কি টায়-টায় পনেরো গ্রাম? হাজারখানার ভিতর একখানারও হয় কি না হয়– এ তো কানায়ও দেখতে পায়। একটার ওজন হয়তো বারো গ্রাম, কোনওটার আট, কোনওটার-বা তেরো। এইবারে বুঝলেন তো, এই যে তফাতটা– এই যে ফারাকটুকু, এর থেকেই ডাকবিভাগের নিরেট লাভ–ওই দিয়ে তার দিব্যি চলে যায়।

পাঠক ভাবছেন, আমি অর্থশাস্ত্রের জটিলতম সমস্যায় কণ্টকিত এই প্রস্তাবটি উত্থাপিত করলুম কেন? আমিও তাই ভাবছি। বস্তুত আমি মেহতা-চৌধুরী-জনসুলভ এই পঞ্চতন্ত্র কাহিনীটি যখন শ্রবণ করে কৃতকৃতার্থ হই তখন, কিংবা আমার বাতুলতম মুহূর্তেও আমি ওহেন সম্ভাবনার কণামাত্র আভাস পাইনি যে, ইটি একদিন আমার কাজে লাগবে।

লেগেছে। টায়-টায় না হলেও হরেদরে। সর্ব কাহিনী, তাবৎ উপমাই দাঁড়ায় তিন ঠ্যাঙের উপর ভর করে। চার পায়েই যদি দাঁড়ায়, তবে তো সে হুবহু একই বস্তু হয়ে গেল। উপমা রূপক, প্রতীক হতে যাবে কেন?

বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ দেখি, এক দরদী সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায় বিকট চিৎকার করে চিল্লি দিয়ে কেঁদে উঠেছেন, বিদেশি পুস্তক বিক্রেতাদের জন্য। হায় হায় হায়, এদের কী হবে? এরা কোজ্জাবে, মা!

কান্নার বহর দেখে মনে হল, এঁরা যেন ফুটপাথের পুরনো বই বিক্কিরিওলাদের চেয়েও বিকটতর বিপাকে পড়েছেন। এদের দুরবস্থা (প্রেস! হ্যাঁ, আমি আকার দিয়ে দুরবস্থাই লিখছি) দেখ সেই সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায় ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলছেন।

আম্মো দরদী। কিন্তু এই ডুকরে-ওঠা, চিল-চাঁচানো মড়া-কান্না শুনে আমার হৃদয়ে মিলক অব মেন কাইন্ডনিস না বয়ে লেগে গেল সেথায় অন্য ধুন্ধুমার। খাঁটি মড়া-কান্না আমি বিলক্ষণ চিনি। আমার বসত-বাসা শুশানের লাগোয়া।

***

মহাকবি হাইনরিষ হাইনের মরমিয়া প্রেমের গীতি-কবিতা সম্বন্ধে একাধিকবার লেখবার সুযোগ আমি পেয়েছি। ইনি সাক্ষাৎ চণ্ডীদাস। পাঠককে শুধোই, সুখের লাগিয়া এঘর বাঁধিনু, তোমার চরণে আমার পরাণে লাগিল প্রেমের ফাঁসি শুনে কি তোমার কখনও মনে হয়েছে, এ কবি …চিঠির মতো (এ মাসিকের বিরুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত কোনও ফরিয়াদ নেই– অম্মদ্দেশে শত্রু-মিত্র উভয়ভাবেই পুজো করার পদ্ধতি ঐতিহ্যসম্মত) কিংবা কংগ্রেস কমুনিস্টের মতো কটুকাটব্য কস্মিনকালেও করতে পারে?

তাই যখন বিঘ্নসন্তোষী, পরশ্রীকাতর একপাল (লুমপেন-পাক) ফেউ লাগল হাইনের পিছনে তখন তিনি কোনও উত্তর দিলেন না। সবাই ভাবল, যার মুখ দিয়ে সদাই মধু ঝরে সে আবার এসব বেতালা বদখদ বেত্তমিজি বাতের কীই-বা জবাব দেবে। ভুল, ভুল! সব্বাই করলেন ক্ষ-তে গলদ।

একদিন তার হল ধৈর্যচ্যুতি।

কী যেন একটা আমার ঠিক স্মরণে আসছে না– ভ্রমণ-কাহিনী না কী যেন কিসে মোলায়েম প্রাকৃতিক বর্ণনা দিতে দিতে তিনি বললেন, সবাই জানেন, আমি সাতিশয় সাধারণ কবি, তাই আমার খাঁইও অতিশয় সাধারণ। কবি মানুষ, দয়াময় ভগবান যদি নদীপারে আমাকে একখানা কুঁড়েঘর দেন, তা হলেই আমার দিব্যি চলে যাবে। আর ঘরের তৈরি সাদামাটা কিঞ্চিৎ রুটি- শহুরে বান, ক্রোআঁশা(১) কিসসুটি না– আর ঘরেই তৈরি মাষা পরিমাণ মাখম, ব্যস। তদুপরি দয়াময় ভগবান যদি আমাকে আরও খুশি করতে চান, তবে তিনি যেন ওই নদীপারে উঁচাসে উঁচা একসারি পপুলার লাগিয়ে দেন। সর্বশেষে, তাঁর অসীম করুণাবশে যদি দয়াময় আমাকে পরিপূর্ণ কৈবল্যানন্দ দিতে চান, তবে তিনি যেন আমার পিছনে যারা লেগেছে ওই দুশমনদের পলারের মগডালে ফাঁসি দেন। অন্তবিহীন আনন্দরসে ভরপুর হৃদয় নিয়ে, কুটিরের দাওয়ায় বসে আমি তখন উপরপানে তাকিয়ে দেখব, সাতিশয় মনঃসংযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করব, আহা কী রমণীয় দৃশ্য! দুশমনদের পাগুলো মৃদুমন্দ পবনে দুলছে– দোদুল দোলায় হিল্লোল লাগিয়ে।(২) হ্যাঁ, আলবৎ প্রভু যিশুখ্রিস্ট আদেশ দিয়েছেন(৩) শত্রুকে ক্ষমা করবে, তাকে প্রেম দেবে। নিশ্চয় করব, নিশ্চয়ই দেব– আমার সর্বসত্তা উজাড় করে, কিন্তু ওই যে বললুম, ওদের ফাঁসি হয়ে যাবার পর।

***

কিন্তু যে গল্পটা দিয়ে আরম্ভ করেছিলুম সেটা গেল কোথায়?

যারা বিদেশি বই বেচনেওলাদের তরে ঘটি ঘটি অশ্রু বর্ষণ করছেন তাঁদের একজনের ভাবখানা অনেকটা : পচ শিলিঙের বই যদি তারা তারই ন্যায্য এক্সচেঞ্জে ভারতীয় টাকায় বেচে, তবে তাদের মুনাফা রইল কোথায়? এক ডলারের দাম সাত টাকা পঞ্চাশ পয়সা (কথার কথা কইছি, আমি সঠিক ভাও জানিনে), যদি সাত টাকা পঞ্চাশেই বেচে, তবে লাভ রইল কোথায় ওই সেই ডাকটিকিট বিক্রির মতো!

তিনি তার পর আরেক ঘটি এন্ট্রা চোখের জল ফেলে বলছেন, তাদের কত খর্চা। চিঠি লিখতে হয়। (মরে যাই!), ডাকমাশুল দিতে হয় (ও বাছারে!) এবং তার পর আর কী সব ধানাইপানাই করেছেন আমার মনে নেই। কিন্তু এইবারে অসহিষ্ণু পাঠক, ক্ষণতর, মেহেরবানি করে তুমি নিচের মোক্ষম তত্ত্বটি মনোযোগ সহকারে পড়।

উপরের উল্লিখিত ওই একজনই না, যাদের হাত দিয়ে বিলিতি বইওলারা তামাক খাচ্ছেন তাদের কেউই তো বলছেন না (কিংবা আমার হয়তো চোখে পড়েনি)– অন্তত সেই সরল বিপ্রসন্তান (ইনি পণ্ডিত তথা বি– এ দুয়ের সংযোগে মানুষ বড় সরল, neif হয়) বলেননি–

বিলিতি বইওলারা কত কমিশন পায়?

আমানউল্লার মাতা রানিমার আদেশে তার বন্দি চাচা নসরউল্লাকে খুন করা হয়। সর্বত্র খবর রটল, কফি খেয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।

সংবাদদাতা বিলকুল ভুলে গেলেন মাত্র একটি সামান্যতম তথ্য পরিবেশন করতে। কফিতে ছিল সেঁকো বিষ।

এঁনারা এই সেঁকো বিষ অর্থাৎ কমিশনটির বাৎ বেবাক ভুলে যাচ্ছেন।

কত কমিশন পায়? জানিনে। তবে বঙ্গসন্তানদের ধারণা ২৫% ৩০%-এর বেশি হবে না, কারণ বাঙলা পুস্তক বিক্রেতা সচরাচর এর বেশি পায় না (হালে জনৈক প্রখ্যাত পুস্তক-বিক্রেতা গুদোম সাফ করার জন্য শতকরা ৪০/৫০ দিচ্ছেন বলে– পাঠক পরম পরিতোষ পাবেন, ওর মধ্যে আমার বইও ছিল– বাঙলা বইয়ের বাজারে ধুন্ধুমার লেগে যায়)। তাই প্রশ্ন, যেস্থলে বাঙালি প্রকাশক দু হাজার বই ছাপিয়ে শতকরা ২৫/৩০ কমিশন দেয়, সেস্থলে মার্কিন ইংরেজ এক ঝটকায় পঞ্চাশ হাজার এক লক্ষ ছাপিয়ে কত দেয়? কুইক টানঅভার নামক একটি বস্তুও আছে। শুনেছি এরা ষাট পার্সেন্ট পর্যন্ত দেয়। আমি বলতে যাচ্ছিলুম আশি। তা বলব না কেন? তোমরা যখন এই জীবনমরণ ভাইটাল তত্ত্বটি চেপে যাচ্ছ। দেখাও না কাগজপত্র। আমি অবশ্য বিশ্বাস করব না। তোমরা সব পার।

ঈশ্বর সাক্ষী, স্বরাজ লাভের পর থেকে সরকার বিস্তর বিস্তর আইন পাস করেছেন– আমি চাঁদপানা মুখ করে সব সয়েছি, রা-টি কাড়িনি। কিন্তু সরকার যখন এই কমিশন ব্যাপারের গুহ্য, সযত্নে লুক্কায়িত কমিশন তত্ত্বটি জানতেন বলে হুকুম দিলেন, বাপধনরা যখন দশ টাকার বই চার টাকায় পাচ্ছ তখন আর লাভ করতে যেও না, শিলিঙের দাম ১.০৫, এক পাচেই বেচো, কিনছ তো অষ্ট গণ্ডা পোহা দিয়ে–তখন উল্লাসে নৃত্য করে উঠলুম। আহা হাহা হা! কী আনন্দ, কী আনন্দ!

সস্তায় বই পাব বলে? মোটেই না। বই এমনিতে পাব না, অমনিতেও পাব না। ডিভ্যালুয়েশনের পূর্বেও পাইনি, এখনও পাব না। শুনবেন, কেন? বছর দুই ধরে আমি ধন্না দিচ্ছি, কয়েকখানা ফরাসি ও জর্মন বইয়ের জন্য (হিটলারের জীবনীটি সম্পূর্ণ করব বলে। যুদ্ধের কয়েকটা বছর বাদ দিলে ১৯৩৪ থেকে ১৯৬৪ অবধি আমি এ বিষয়ে বই কিনেছি– কয়েক হাজার টাকার)। সম্প্রতি কলকাতার বইয়ের বাজারে এক ঝাণ্ডু শ্রী রায় (ইনি এম এ, সুশিক্ষিত, সুপণ্ডিত) আমাকে জানালেন, আমি যদি প্রত্যেক বইয়ের অর্থাৎ একই বইয়ের পাঁচখানা করে কপি কিনি(!), তবে বিলিতি বইয়ের বুকসেলার আমাকে আমার প্রার্থিত বই আনিয়ে দিতে পারবেন। তার যুক্তি, একসঙ্গে পাঁচখানা বই না কিনলে বুকসেলার কমিশন পান না!

এ প্রস্তাবটি এমনই উন্মাদের বাতুলতা যে, কোনও পাঠকই এটা বিশ্বাস করবেন না। একই বইয়ের পাঁচখানা করে কপি নিয়ে আমি করব কী? পঞ্চবীর-পতিগর্বিতা দ্রৌপদীর পাঁচটি স্বামীই যদি একই রবর স্ট্যাম্পের পঞ্চলাঞ্ছন, পাঁচ অ্যানকোর হতেন তবে তিনিও যে খুব সন্তুষ্ট হতেন না, অনুমান করা যায়। পাঁচ কেন, দুটো হলেই চিত্তির। আমার শোনা মতে এক রমণীর বিয়ে হয়, যমজ ভাইয়ের একজনের সঙ্গে। ভাশুর ভাদ্রবধূ উভয়ই সন্ত্রস্ত। শেষটায় সাবধানী ভাশুর আরম্ভ করলেন টিকিটিতে পুজোর সময় একটি জবা ফুল বেঁধে নিতে। শয্যায় পদ্মনাভকে স্মরণ না করা পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণে চৈতনপ্রত্যন্তে হাত বুলিয়ে চেক অপ করে নিতেন, ফুলটি স্থানচ্যুত হয়নি তো! কাহিনীটি শুনে ইন্দ্রজিৎ ব্রিামীয় একখান পান ছেড়ে মন্তব্য করলেন, টিকিতে ফুল! তা হলে স্বামী নিয়ে fooling বন্ধ হল।

পাঁচখানা বই- একই বই (পাঁচখানা ভিন্ন ভিন্ন বই নয়, যে-ব্যবস্থাতে তো আমি হরবকত রাজি)– না কিনলে নাকি বাবুরা কমিশন পান না!

তবে আইস পাঠক, শূন্বন্তু বিশ্বে–

কারণ বিশ্বজোড়া ছড়িয়ে-পড়া একটি মাসিক থেকে (জুলাই, ১৯৬৮) বিজ্ঞাপনটি তুলে দিচ্ছি :

Published in England at Rupees 105.00 you have the chance of buying them (the book is in six volumes)-under our NO-RISK money-back guarantee for a mere Rs. 72.00-a saving of 30% on the published price.

অস্য বিগলিতাৰ্থ– সাদামাটা খদ্দের হিসেবেই তুমি ৩০% কমিশন পাবে; এবে শুধোই– অনাথা, অবলা বিলিতি বুকসেলাররা কত পাবেন? সে দিশি কোম্পানি বোম্বায়ে বসে, বিলেত থেকে প্রাগুক্ত বই আনিয়ে এদেশে বিক্রি করছেন, তিনি বুঝি আলা খয়রাতি হাসপাতাল খুলেছেন! তা হলে সাধু! সাধু!! সাধু!!!

বিস্ময়ে অধম নির্বাক! তবু অতি কষ্টে ক্ষীণ কণ্ঠে চি চি করে বলছি, অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য, স্বপ্ন নু মায়া নু মতিভ্রম নু– আপনাকে শ্রীরায়ের তন্বী মাফিক একই বইয়ের পঞ্চগব্য খেতে হবে না, হল না– পাঁচ ঢালা গোবর খেতে হবে না– একই বইয়ের পাঁচ কপি কিনতে হবে না।

এস্থলে আরেকটি নিবেদন– বিলিতি পুস্তক-বিক্রেতার বিরুদ্ধে আমার পুঞ্জীভূত বহুবিধ আক্রোশ আছে, গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে জমে উঠেছে ঘোরতর বিতৃষ্ণা এবং আমি তাই আদৌ নিরপেক্ষ নই, আমি প্রাইভেট এবং পাবলিক প্রসিকিউটর উভয়ই দিশি পুস্তক বিক্রেতা ২৫% কমিশন পেয়ে, রোক্কা টাকা ঢেলে বই কিনে নিয়ে যায় আপন রিকে; সে বই বিক্রি না হলে তার পুরোপুরি সমুচহ লোকসান। প্রকাশক বই ফেরত নেবে না। বিলিতি বাবুরা অর্ডার নিয়ে, কোনও কোনও স্থলে পুরো দাম বায়না পকেটস্থ করে বইয়ের জন্য বিদেশে অর্ডার দেন। সিকি কানাকড়ির রিস্ক নেই। এ যে কত বড় ঈশ্বর-প্রতিশ্রুত স্বর্গরাজ্য সে জানে বিক্রেতা।

***

এবারে একটি ব্যক্তিগত নিবেদন; একমাত্র তাদেরই উদ্দেশে যারা আমার অক্ষম লেখনীপ্রসূত মন্দ-ভালো পড়েন। তারাই বলুন, এই যে প্রায় কুড়ি বছর ধরে আমি লিখছি, কখনও দলাদলিতে ঢুকেছি? কখনও কাউকে আক্রমণ করেছি? এমনকি আমি যখন আক্রান্ত হয়েছি, তখন আত্মপক্ষ সমর্থন করেছি? হ্যাঁ, দুএকবার বাদ-প্রতিবাদে নেমেছি, যখন দেখেছি কোনও নিরীহ, বেকসুর, অখ্যাত লেখক আক্রান্ত হয়েছেন কোনও বুলি দ্বারা, যিনি তাঁর নামের পিছনে জুড়ে দিয়েছেন তার সবকটা ডিগ্রির ফিরিস্তি যাতে করে সাধারণ পাঠক, প্রাগুক্ত নিরীহ লেখক এবং সম্পাদক স্তম্ভিত, বিস্মিত এবং সর্বোপরি আতঙ্কিত হন– সেই নিরীহের পক্ষ সমর্থন করে। তখন সেই ফিরিস্তি-পুচ্ছধারী হামলা করেছেন আমার প্রতি। আমি তদ্দশ্যেই নিরুদ্দেশ, কারণ, আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনও প্রয়োজনবোধ করিনি, সেকথা পূর্বেই সবিনয় নিবেদন করেছি। ইতোমধ্যে সেই নিরীহ কিছুটা সান্ত্বনা পেল যে, এ দুনিয়ায় অন্তত আরেকটা মূর্খ আছে, যে তার মতে সায় দেয়।

কেন নামিনি? আমার কলমে বিষ নেই?

কিন্তু এবার নামতে হল। ১৯২১ সালে যখন সর্বপ্রথম জর্মন ফরাসি পাঠ্যপুস্তক কিনতে গিয়েছি, তখন বিলিতি বই বিক্রি করত শুধু বিলিতিরা, এবং তারা কান পাকড়কে নিয়েছে ঢালাও হিসেবে এক শিলিঙের জন্য এক টাকা। তখন বোধহয় শিলিঙের দাম ছিল দশ আনা। এটা নিশ্চয়ই দুর্নীতি নয়। সেই সকল বিপ্রসন্তান বলেছেন, এতদিন পর্যন্ত বই-এর ব্যবসার মধ্যে দুর্নীতি ছিল না বললেই হয়। মোক্ষম তত্ত্ব এবং তথ্য। কারণ সে যুগে, এবং এই পরশুদিনতক সরকার পুস্তকের ব্যাপারে কোনও নিরিখ, প্রাইস-শেডুল বা কেনা-বেচার সময় এক শিলিঙের জন্য কত ভারতীয় মুদ্রা নেবে তার কোনও আইন করে দেননি (controlled price)। কাজেই দুর্নীতির কোনও প্রশ্নই ওঠেনি। কিন্তু সাধারণ গেরস্ত এ নীতিটি মানবে কি? তুলনা দিয়ে শুধোই, আজ মাছের বাজারে আর কন্ট্রোল নেই; মাছওলা যদি কাদা চিংড়ির জন্য ১০ টাকা কিলো চায় তবে তো সেটা দুর্নীতি নয়–মানবে গেরস্ত? দমদমা তো মানছে না। তাদের ওপর এ বৃদ্ধের আশীর্বাদ রইল।

তখন কলকাতায়, বিলিতি বইয়ের ব্যবসাতে প্রাক্তন সুনীতিতে টইটম্বুর টাকার হরিনুট দেখে সে-বাজারে নাবলেন লেটিভরা।

কিন্তু সেই ১৯২১ থেকে ১৯৬৬-র ইতিহাস লিখতে হলে তো এক কিস্তিতে হবে না। তবে লিখব।(৪)

এ সুবাদে সদাশয় সরকারকে আবার বলি তোমার রেশনের চাল অখাদ্য, তুমি ভেজাল কালোবাজার ঠেকাতে পারছ না, বিদেশ গিয়ে দু মাসের জন্য রিসার্চ করে আমার দুখানা বই শেষ করার জন্য কুল্যে দু হাজার মার্ক চেয়েছিলুম তুমি দাওনি, বিদেশি বই কেনার জন্য তুমি ক্রমাগত এক্সচেঞ্জ কমাচ্ছ (এবং যা দিচ্ছ সে-ও ছুতোর-কামারের টেকনিকাল বই আর পাঠ্য পুস্তকের জন্য আমার কাজে লাগে না, ফলে মৃত্যুর পূর্বে আমাকে তুমি বিদেশি বইয়ের দুর্ভিক্ষ লাগিয়ে অন্নহীনবৎ মারছ– আমি রত্তিভর প্রতিবাদ করিনি, করছি না, করবও না। কিন্তু তুমি এই যে বিদেশি বইয়ের দাম কন্ট্রোল করছ, তার জন্য আমি তোমাকে দু হাত তুলে আশীর্বাদ করি। শঙ্কর তোমাকে জয়যুক্ত করুন।

ভেবো না আমি স্বার্থপর। আমি বই পাব না, এমনিতে না, অমনিতেও না। তুমি অঢেল হার্ড কারেসি ছেড়ে দিলেও না, না ছেড়ে দিলেও না। কেন, তার ইঙ্গিত বক্ষ্যমাণে দিয়েছি। বারান্তরে সবিস্তর।

হায়! কোথায় সেই কুটির আর সামনের সুদীর্ঘ পপলার গাছ। সরকার না একবার বলেছিলেন, তারা কালোবাজারিদের ল্যামপোস্ট ঝোলাবেন! পপলার গাছ অনেক ভালো। অনেক দূর থেকে দেখা যায়।

হ্যাঁ, আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল। যদ্যপি আমি বৃদ্ধ এবং শঙ্কর খেদ করেন, বৃদ্ধস্তাবৎ চিন্তামগ্ন আমি কিন্তু তরুণে আরক্ত। তাদের প্রতি এই সুবাদে একটি সদুপদেশ দিই; দুষ্টেরা তোমাদের বিদেশি ভাষা শেখার জন্য উপদেশ দেবে; সরল কনস্যুলেটগুলো তার জন্য ব্যবস্থা করবে এবং করছে। কিন্তু অমন কম্মটি কর না। বিদেশি বই না কিনতে পারলে বিদেশি ভাষা শিখে তোমার লাভ? এ যেন একগোচ্ছা চাবি নিয়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে সিন্দুক কিন্তু একটাও নেই! এ যেন রশি নিয়ে হাওয়ার কোমর বাঁধার মতো বন্ধ্যাগমন! এবং পারলে বাঙলাটাও শিখবে না। বলা তো যায় না, সে বাজারেও কোনদিন কী হয় না হয়! হয়তো একই বই পাঁচ কপি কেনবার বায়নাক্কা বাঙলা পুস্তক বিক্রেতাও করবেন এবং অথবা পাঁচ টাকার বইয়ের জন্য সাত টাকা চাইবেন। আগের থেকে সাবধান হওয়া বিচক্ষণের কর্ম। কেন, নিরক্ষরের দিন কাটে না এদেশে? টিপসই দিয়ে চালাবে।

আমি ভালো করেই জানি, এ প্রবন্ধ ইংরেজিতে লিখলে ধুন্ধুমার লেগে যেত। কারণ, তা হলে হয়তো বিদেশি পুস্তকবিক্রেতাদের চাই, বোম্বাইবাসী শ্রীল শ্রীযুক্ত সদানন্দ বিটকল এটি পড়তেন (শুনেছি, বোম্বাইওয়ালারা নাকি এ বাবদে কলকাতাকে কল্কে দেয় না বড় আনন্দ হল)। যারা বাঙলা জানেন, তাঁরা যদি হুহুঙ্কার সচিৎকার যুদ্ধং দেহি রব ছেড়ে আসরে নামেন তবে আমি প্রস্তুত।

শুধু দয়া করে পরের হাত দিয়ে তামাক খাবেন না।(৫)

সুপণ্ডিত বিপ্রসন্তানকে ডোবাবেন না। অবশ্য তার যদি ব্যবসাতে শেয়ার থাকে তো আলাদা কথা। আমার বিশ্বাস তার নেই।

আর সরকার যদি শেষটায় কন্ট্রোল তুলে নেন মাছের বেলা যা হয়েছে তা হলে আম্মো শেয়ারের সন্ধানে বেরুব। টাকা নিয়ে কথা, মশাই। তার আবার সুনীতি দুর্নীতি কী?

ঝুলবই না হয় একদিন পপলারের মগডালে। ক্রুশবিদ্ধ ক্রাইস্টের দু দিকে আরও কে যেন দুজন ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিল।

———–

১. ক্রোআঁশা =ক্রেসেন্ট অর্ধচন্দ্রের ন্যায় দুধেমাখমে তৈরি ফিনসি রুটি। তুর্করা ভিয়েনা যুদ্ধে পরাজিত হলে পর, ভিয়েনাবাসী তুর্কদের পতাকা-লাঞ্ছন অর্ধচন্দ্র আকারে রুটি বানিয়ে তাঁদের জয় সেলেব্রেট করে। আজ যদি ইস্টবেঙ্গল একটি কেকের উপর মার্শপেনের বাগান বানিয়ে সেটা খায়– অনেকটা সেইরকম! আমি কিন্তু মোহনবাগানি।

২. যাঁরা আর্ট হিস্ট্রির চর্চা করেন, তাদের স্মরণে আসবে গোঁয়ার ছবি, যেখানে গাছে ঝোলানো শত্রুকে পর্যবেক্ষণ করছেন এক অফিসার টেবিলে কনুই রেখে হাতে আরামসে মাথা রেখে। বস্তুত এ ছবি বেরোবার (১৮১০-১৩) কয়েক বছর পরই হাইনে তার প্রবন্ধ লেখেন।

৩. হাইনে ইহুদি। ইহুদিরা খ্রিস্টকে স্বীকার করে না।

৪. এস্থলে নিবেদন, বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা তথা দুর্বলতাবশত আমাকে মাঝে মাঝে পত্রিকায় পঞ্চতন্ত্র বন্ধ করতে হয়। সাতিশয় শ্লাঘা সহকারে স্বীকার করছি তখন কোনও কোনও পাঠক সম্পাদকও আমার কাছে কৈফিয়ত চেয়ে কখনও মিঠে কখনও কড়া চিঠি লেখেন। (যেসব বিচক্ষণ জন আমার লেখা অপছন্দ করেন, তাদের সান্ত্বনার্থে বলি, I am a fool; এবং প্রবাদ আছে One fool raiseth a hundred)। কাজেই পরের কিস্তির গ্যারান্টি দিতে পারি না বলে আমি সন্তপ্ত।

৫. যেসব ভারতীয় বিদেশি বইয়ের ব্যবসা করেন, তাঁদের সম্বন্ধে একটি আপ্তবাক্য প্রযোজ্য। শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে এসেছেন এক সদ্য বিলেত-ফো– ইভনিং জ্যাকেট, বয়েলড শার্ট পরে। অতি কষ্টে পিড়িতে বসতে বসতে বললেন, মুশকিল, বাঙালাটা ভুলিয়া গেইছি। রবিঠাকুর নাকি শুনে বললেন, সত্যি মুশকিল হে ভড়, ইংরেজিটাও শিখলে না; বাঙলাটাও ভুলে গেলে!

পাসপরট

গল্পটি পুব বাঙলার বিশেষ একটি জেলা সম্বন্ধে। মনে করুন তার নাম লোহারা।

পুব বাঙলার সাধারণজন মাত্রেরই দৃঢ়তম বিশ্বাস লোহাভরা জেলার লোকমাত্রই অতিশয় ধুরন্ধর। এদের কেউ একা বা দল বেঁধে ঢাকা স্টেশনে নামলে বিদগ্ধ, হাজির-জবাব কুট্টি পর্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে এদের রীতিমতো সমঝে চলে। সর্বশেষে বলা হয়, ওই জেলাতে কখনও দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সেখানে স্বয়ং শয়তান সে জেলার যে প্রধান প্রতিভূ সে পর্যন্ত মাছি ধরে ধরে খায়–কারও গোলায় হাত দিতে হিম্মত পায় না।

তামাম পুব বাঙলার চাণক্য-মাকিয়াভেললি যে এদের সম্মুখীন হলে হুশিয়ারির খাতিরে তদ্দণ্ডেই তাঁদের কানাকড়িটি পর্যন্ত স্টেট ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে আসেন সে-তত্ত্বটি লোহাভরাবাসী বিলক্ষণ অবগত আছে বলে তারা সহজে আপন বাসভূমির খবর দেয় না; লোহাভরার পার্শ্ববর্তী কোনও এক জেলার বাসিন্দা বলে পরিচয় দেয়।

***

পারটিশনের ফলে কলকাতা এবং ঢাকাতেও নানা নয়া নয়া সমস্যা দেখা দিল।

ঢাকা সেকরেটারিয়েটে খবর এল আমেরিকা থেকে ভারতের বিস্তর জানোয়ার-দরদী মহাজনরা বাধা দিচ্ছেন, বাদর যেন মারকিন মুলুকে চালান না দেওয়া হয়, মারকিনরা নাকি ডাক্তারি এক্সপেরিমেন্টের অছিলায় এদের ওপর পাশবিক অত্যাচার (ডিভিসেকশন) করে। মারকিন ডাক্তাররা তাই ঢাকাকে অনুরোধ করেছেন, তারা যদি ন্যায্যাধিক মূল্যেও মর্কট সরবরাহ করেন। পশ্চিম ও পুব বাঙলার মর্কটে মর্কটে নাকি রত্তিভর ফারাক নেই এবং এরা কোনও প্রকারের মাইগ্রেশন সারটিফিকেট নিয়ে দেশত্যাগী হয়েছে বলে জানা যায়নি।

সংশ্লিষ্ট সেকরেটারি মহোদয় তিনি আমাকে সংক্ষেপে ইতিহাসটি কীর্তন করেন– তাঁর দফতরের ঝানু-ঝাণ্ড এসিসটেনট তস্য এসিসটেনটদের এত্তেলা দিয়ে তাদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, এটা ফরেন ইচেনজের সাতিশয় গুরুতর ব্যাপার!

দফতর-ভূশুণ্ডিরা একবাক্যে উত্তর দিলেন : বদর ধরার কৈশল অতিশয় প্যাচাল। এর স্পেশালিস্ট ছিলেন হিন্দুরা। তাঁরা ইন্ডিয়া চলে গেছেন।

অনেক তর্কাতর্কির পর স্থির হল জেলায় জেলায় খবরের কাগজে যেন নিম্নোক্ত বিজ্ঞাপনটি ফলাও করে ছাপানো হয়–

বাঁদর!   বাঁদর!!   বাঁদর!!!

এতদ্বারা সর্বসাধারণকে জানানো যাইতেছে যে, মারকিন-মুলুকের অনুরোধে এই দেশ হইতে জীবন্ত বাঁদর আমেরিকায় রফতানি করা হইবে। তজ্জন্য উপযুক্ত মূল্য দেওয়া হইবে।
স্বাক্ষর সেকরেটারি
সবুজপুরা, ঢাকা-১১।

আমি সচিব মহোদয়কে শুধালাম, উত্তম ব্যবস্থা। তার পর?

বললেন, যেই না বিজ্ঞাপনটি লোহাভরা জেলায় বেরিয়েছে অমনি দেখা গেল, তাবৎ জেলার লোক লুঙ্গি ফেলে ফেলে গুয়া গাছের ডগায় চড়ে বসে আছে। সবাই মারকিন মুলুকে যাবে। মুশকিল! জানেন তো, লোহাভরার লোকের যা কাত্তিকের মতো চেহারা, তাতে কোনটা বাঁদর কোনটা মানুষ ঠিক ঠাহর করা—

***

ইতিহাস-দার্শনিক শ্রীযুক্ত টইনবি বলেছেন, দেশকালপাত্রের যোগাযোগের ফলে নিত্য নিত্য প্যাটার তৈরি হচ্ছে বটে, কিন্তু সেগুলো আকছারই প্রাচীন প্যাটারনের পুনরাবৃত্তি মাত্র। তফাত ডিটেলে।

অতএব, যখন সবিশেষ অবগত আছি, উভয় বাঙলার দেশকালপাত্রে ফারাক যৎসামান্য তবে পূর্বোল্লিখিত পূর্ববঙ্গীয় প্যাটারনের পুনরাবৃত্তি পশ্চিমবঙ্গে প্রতিভাসিত হবে না কেন? আমরা কিসে কম?

অবশ্য স্বীকার করছি ডিটেলে উনিশ-বিশ হওয়া বিচিত্র নয়।

এবং তাই হয়েছে।

কারণে, কিংবা অকারণে, অথবা বলতে পারেন, কিসমতের মারে এদেশে পাশপর যোগাড় করাটা ক্রমশ কঠিন হতে কঠিনতর হতে লাগল, স্বরাজ পাওয়ার অল্প কিছুকালের মধ্যেই। শেষটায় হাল এমন অবস্থা দাঁড়াল যে তখন কেউ আর নিতান্ত বিপদে না পড়লে ওই সাপের পায়ের সন্ধানে বেরুত না। অবশ্য লক্ষপতি, কালোবাজারি, বিদেশে যার আচার-করা ফরেন কারসি আছে তাদের কথা আলাদা। এসব কাহিনী দফে দফে বয়ান করার প্রয়োজন নেই। খবরের কাগজে অনেক খবর বেরোয় সাদা কালিতে ছাপা। সেগুলো পড়ার জন্য একটি তৃতীয় নয়নের প্রয়োজন–ইংরেজিতে যাকে বলে টু রিড বিটুইন দ্য লাইনজ। যাদের সেটা আছে। আমার নেই তারা আপনাকে-আমাকে অনায়াসে দু কলমফ শেখাতে পারেন। সেকথা থাক।

ইতোমধ্যে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল।

লোকটার নিশ্চয়ই কোমরের জোর, কড়ির ওজন ও বুকের পাটা আছে, নইলে সরকারের সঙ্গে লড়তে যাবে কেন? কটা আদালতে হারার পর লোকটি সুপরিম কোরটে পৌঁছল জানিনে। সেখানে প্রধান বিচারপতি (তৎকালীন) শ্ৰীযুক্ত সুববা রাও যা রায় দিলেন তার বিগলিতাৰ্থ, কোনও ভারতীয় যদি আপন দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে চায় তবে তাকে ঠেকাবার এখৃতেয়ার ভারত সরকারের নেই। সেটা হবে সংবিধান-বিরুদ্ধ।

ব্যস্। আর যাবে কোথায়।

আমাগো দ্যাশে কয়, একেতো ছিল নাচিয়ে বুড়ি তার উপর পেল মৃদঙ্গের তাল।

পুব বাঙলার প্যাটারনে এস্থলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গাছের মগডালে না চড়ে মেয়েমদ্দে আণ্ডাবাচ্চায় ধাওয়া করল পাসপরট ফরমের জন্য। বাঁদরের জন্য ও-বস্তুর প্রয়োজন নেই তাকে খাঁচায় পুরে প্লেনে ঢুকিয়ে দিলেই হল। মানুষের বেলা জাহাজের কাপতান, প্লেনের টিকিট বেচনেওয়ালা, ভূপৃষ্ঠে বর্ডারের উভয়পক্ষের পুলিশ শুধোত, অভিজ্ঞান-পত্রটি কোথায়?

ইতোমধ্যে নাকি আরও দুজন জজ সাহেবের রায় বেরুল : আইনত নাকি পাসপরটের কোনও প্রয়োজনই নেই। এটা আমি বুঝতে পারিনি, কাজেই এটি নিয়ে তড়িঘড়ি আলোচনা করা আমার শোভা পায় না।(১) পয়লা তো ঝামেলাটা বুঝে নিই।

উপস্থিত একটি কথা বলে রাখি।

আইন অবশ্যই সর্বজনমান্য। কিন্তু কার্যত কী হয়?

আইনত (ডেজুরে) পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই তার নাগরিককে অবাধ চলাফেরা করার ক্ষমতা দেয়, কিন্তু কার্যত (ডে ফাঁকটো) কোনও দেশ দেয় বলে জানি নে।

এই তো হালের কথা। মার্কিন দেশে যে জোর গণতন্ত্রের রাজত্ব সেকথা আমরা সবাই জানি। অন্তত সেই নিয়ে তাদের বড়-ফাটাইয়ের অন্ত নেই। দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম সর্বত্রই তাঁরা যে গণতন্ত্র তথা ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিচ্ছেন একথা তারা বিশ্ববাসীকে অহরহ শোনাচ্ছেন। সত্যি হতে পারে, মিথ্যা হতে পারে, কিংবা হয়তো মারকিনগণ নিজেদের এটা বোঝাবার চেষ্টা করছেন। এবারে সেই হালের কথাতেই আসি।

দার্শনিক বারট্রানড রাসল কিছুদিন হল স্থির করলেন, একটা বেসরকারি আদালত বসিয়ে সেখানে ভিয়েতনামে মারকিন পাপাচারের বিচার করা হবে। ভোলা আদালতে যেরকম যে কোনও মানুষ, হয় আসামি নয় ফরিয়াদি পক্ষে দাঁড়াতে পারে বা আদালতের দোস্ত (আমিকুস কুরিএ) হিসেবে নিরপেক্ষভাবে কথা বলার হক ধরে রাসেলের বেসরকারি বেআইনি (বা অ-আইনিও বলতে পারেন) আদালতেও সেই ব্যবস্থা থাকবে।

এ আদালতে হাওয়া কোন দিকে বইবে সেটা ঠাহর করার জন্য হ্যামলেট নাটকের ভূতের প্রয়োজন হয়নি। তৎসত্ত্বেও মার্কিন জুজুর ভয়ে সব রাষ্ট্রই মুখে কথা চাপলেন। অর্থাৎ সে আদালতের জন্য আসন দিতে (ভেনু) রাজি হন না– তোমার আসন পাতবো কোথায় হে অতিথি–অবশ্য ভিন্নার্থে।

শেষটায় সরল সুইডেন লাজুক কনেটির মতো কবুল পড়ল এবং আখেরে পস্তাল, কিন্তু সেকথা থাক।

সেই উয়োর ক্রাইমস ট্রিবুনালে সাক্ষ্য দিলেন ৭ মে তারিখে এক ভদ্রলোক– এঁর নাম রালফু শ্যোমান। মারকিন নাগরিক, এবং রাসলের খাস নায়েব (পারসনাল সেকরেটারি)। ভিয়েতনামে মারকিনদের পাশবিক অত্যাচারের দফে দফে বয়ান দিয়ে যার সঙ্গে এ রচনার কোনও সম্পর্ক নেই– তিনি বলেন, তিনি স্বয়ং হানয় গিয়েছিলেন এবং অনুমান করেন, যেহেতু তিনি ওই জায়গায় মারকিন সরকারের বিনানুমতিতে গিয়েছিলেন তাই সে সরকার এক্ষণে তার পাসপরট রদ করবে (অর্থাৎ বাতিল বা বাজেয়াপ্ত করে নেবে)।

যদি করে তবে সেটা আইনসঙ্গত কি না, সেটা বিচার করার মতো আইনজ্ঞান আমার কেন, বহু ধুরন্ধরেরও নেই।

(১) এই দেখুন না, কেন্দ্রীয় সরকার পাসপট বাবদে যে আইন এতদিন মেনে চলতেন তারও একটা রেজো দেতত্র (raison detre) নিদেন একটা ভিত ছিল (২) তিনজন মহামান্য জজ সেটা অস্বীকার করলেন (৩) অন্য দুজন মহামান্য জজ ওই তিনজনের সঙ্গে একমত হলেন না। ওদিকে পাসপ দরখাস্তের বন্যায় হিল্পি দিল্লি যায়-যায়। সেটা ঠেকাবার জন্য সরকারকে বাধ্য হয়ে জারি করতে হয়েছে, (৪) অরডনস্ সাময়িক আইন। এ আইনের আয়ুষ্কাল মেরেকেটে ছ মাস। ইতোমধ্যে সরকার এই অরডানটি মেজে-ঘসে (৫) বিলরূপে পরিবর্তন করে পেশ করবেন পারলিমেনটের সন্মুখে।

তখন লাগবে ধুন্ধুমার, ইংরেজিতে যাকে বলে দ্য ফ্যাট উইল বি ইন দ্য ফায়ার। উপরের প্যারায় আমি পাঁচ রকমের দৃষ্টিবিন্দু পরিবেশন করেছিলুম– এবারে পারলিমেনটে জুটবে এসে আরও পাঁচশো!

আমার ঘাড়ে কী ৫০৬টি মাথা যে আমি রা-টি কাড়ব।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়।

পারলিমেনটে বিস্তর বেদরদ ভোলাইয়ের পর ইস্ত্রি হয়ে বেরুবেন বিলটি তখন আইনরূপে।

আমরা শঙ্খ বাজাব, হুলুধ্বনি দেব।

কিন্তু হায়, এ পোড়ার সংসারে শান্তি কোথায়? এই নয়া তুলতুলে তুলোয় ভরা তাকিয়া-পারা আইনটার ওপর ভর করে যে দুদণ্ড জিরিয়ে নেবেন তারই-বা মোকাফুরসত কোথায়?

আবার এক পাষণ্ড হয়তো হয়তো কেন, নিশ্চয়ই সে আইনকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিমকোর্টে দাঁড়াবে।

এবং এবারও যদি মহামান্য বিচারপতি…?

তা হলে শুরুসে, ফিসে, সেই ঔড্র পদ্ধতিতে :

ক-রে কমললোচন শ্রীহরি,

খ-রে খগ-আসনে মুরারি।

গ-রে…!

————

১. কাগজে রিপোর্ট বেরিয়েছে : Giving their reasons the minority said that there was no compulsion of law that a passport must be obtained before leaving India. আমারই মতো জনৈক সম্পাদক ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি এবং ওই নিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছেন।

পূর্ণপ্রেম

ভিয়েনাতে সর্বপ্রচেষ্টায় পরিপূর্ণ নিষ্ফলতা অর্জন করে হিটলার দেশত্যাগ করে চলে গেলেন জর্মনির বাভারিয়া প্রদেশের প্রধান নগর মুনিকে। সেখানেও তিনি বেকার, এমন সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেলে তিনি স্বেচ্ছায় জর্মন সৈন্যবাহিনীতে জওয়ান রূপে প্রবেশ করলেন। যুদ্ধশেষে মনিকে ফিরে এসে জওয়ানদের কী যেন এক কালচারাল বা ওইজাতীয় অস্পষ্ট কী এক ট্রেনিং দেবার জন্য নিযুক্ত হলেন। এই সময়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, সরস্বতী তাঁর রসনায় বিরাজ করেন তাকে একদিন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বক্তারূপে জনসমাজের অভিনন্দন গ্রহণ করাবার জন্য। এই সময় মুনিক শহর রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাবাত্যায় বিক্ষুব্ধ। অসংখ্য রাজনৈতিক দল এবং রাস্তায় রাস্তায় গণবিক্ষোভের কোলাহল। হিটলার এরই একটার সদস্য হলেন। সে দলের সভ্যসংখ্যা দশ হয় কি না হয়। ১৯১৯ থেকেই তিনি এই দল (National Sozialictiche Deutsche Arbeitspartei এরই প্রথম শব্দের Na এবং দ্বিতীয় শব্দের Zi নিয়ে বিপক্ষ না নিরপেক্ষ দলের অজানা কে একজন Nazi–নাৎসি নামকরণ করে) গড়ে তুলতে আরম্ভ করলেন, অচিরে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করলেন, এবং বাভারিয়া প্রদেশের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক কমুনিস্টবৈরী রূপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দুসরা জঙ্গিলাট, পয়লা নম্বর হিন্ডেনবুর্গের (ইনি পরবর্তী যুগে জর্মনির প্রেসিডেন্ট হন) সহকর্মী জেনারেল এরিষ লুডেনডর্ফের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিন-চার বছর যেতে না যেতে পার্টির সভ্যসংখ্যা আশাতীতরূপে বৃদ্ধি পাওয়ায় হিটলারের এতখানি শক্তিসঞ্চয় হল যে তিনি সবলে বাভারিয়া প্রদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপ্রমুখদের অপসারণ করে প্রদেশের রাজ্যভার গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন–এই বিশ্বাস তার দৃঢ় হল। এই উদ্দেশ্যে লুডেনডর্ফকে পুরোভাগে নিয়ে এই ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি সদলবলে প্রধান রাজকার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হলেন। রক্ষীরা গুলি ছোঁড়াতে সমস্ত দল পালাল, স্বয়ং হিটলার কিঞ্চিৎ আহত হলেন (কিন্তু বন্দুকের গুলিতে নয়), কিছুদিন পর, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে পাঁচ বছর জেল হল। কিন্তু ইতোমধ্যে এবং বিশেষ করে কারাবাসের সময় তিনি মুনিক তথা বাভারিয়া প্রদেশের সর্বত্র এমনই জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন, (এবং তথাকার সরকার ইতোমধ্যে কম্যুনিস্টদের শশীকলার ন্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্তি দেখে, রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে কণ্টক দ্বারা কন্টক উৎপাটনার্থে) হিটলারকে অল্প কিছুদিন যেতে না যেতেই, অর্থাৎ ১৯২৩ সালেরই ডিসেম্বর মাসে এবং শুভেচ্ছার প্রতীক রূপে বড়দিনের অল্প কয়েকদিন পূর্বে কারামুক্ত করে দিলেন।

হিটলার নবোদ্যমে ইতোমধ্যে নেতার অভাবে দ্বিখণ্ডিত পার্টিকে দিনে দিনে শক্তিশালী করে তুলতে লাগলেন।

রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে হিটলার সম্বন্ধে কোনও কিছু বললে সেটা যথেষ্ট বোধগম্য হয় না বলে সংক্ষেপে কয়েকটি বছরের বর্ণনা দেওয়া হল।

এখন প্রশ্ন, ইতোমধ্যে হিটলার আর কাউকে প্রেম নিবেদন করেছিলেন কি না। ভিয়েনায় এসে হিটলার কিছুদিন তাঁর বন্ধুর মারফতে উৎকণ্ঠিত চিত্তে তাঁর প্রিয়ার (লেখক ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন স্তেফানি) খবর নিতেন। তার পর সেই বন্ধু, গুস্তাফও ভিয়েনায় এসে একই কামরায় বাসা বাঁধলেন। স্তেফানি হিটলারের তুলনায় বহু উচ্চবংশের কন্যা। পাত্র হিসেবে হিটলারের চেয়ে অযোগ্যতর পাত্র তখন বোধহয় লিনৎস শহর খুঁজলেও দ্বিতীয়টি পাওয়া যেত না। ম্যাট্রিক ক্লাসে ওঠার পূর্বেই সে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে, জাতে প্রায় মজুর শ্রেণির, অর্থসম্বল প্রায় ধনুগুণ ভক্ষণের অবস্থা। হিটলার ভিয়েনা থাকাকালীন স্তেফানির বিয়ে হল সুযোগ্য বরের সঙ্গে। হিটলার সে খবর কখন পেয়েছিলেন– আদৌ পেয়েছিলেন কি না, কারণ বন্ধু গুস্তাফ তাঁর সঙ্গে তখন ভিয়েনাতে এবং ওদের দু-জনার পরিবারের কেউই স্তেফানিকে চিনতেন না– এ সম্বন্ধে সর্ব ঐতিহাসিকই নীরব।

কারণ তখন হিটলার বিরাট ভিয়েনা শহরের ঘূর্ণাবর্তে প্রায় বিলীন হবার উপক্রম।

কিন্তু এস্থলে তার স্থাপত্য শিক্ষালয়ে প্রবেশ করতে অক্ষম হওয়া, তাঁর নিদারুণ দৈন্য, পাবলিক লাইব্রেরি থেকে অবিচারে নানা জাতের বই এনে সেগুলো গোগ্রাসে ভক্ষণ–এর কোনওটাই আমাদের বিষয়বস্তু নয়। আমরা জানতে চাই, ওয়াইন-উইমিন-সং মদ্য-মৈথুন-সঙ্গীত– এই তিন বস্তুতে যে রাজসিক প্রিয়দর্শন ভিয়েনা নগর প্যারিসের সঙ্গে পাল্লা দিত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তো বহু পূর্বে সে প্যারিসকে ছাড়িয়ে গিয়েই ছিল, সেই ভিয়েনাতে নারী সম্প্রদায়ের সঙ্গে হিটলারের কোনও সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল কি না।

গুস্তাফ দৃঢ়কণ্ঠে বলছেন, যতদিন হিটলার তার সঙ্গে বাস করেছেন ততদিন ওদিকে তার কণামাত্র উৎসাহও তিনি কখনও দেখেননি। বস্তুত দীনবেশে সজ্জিত হলেও কঠোর কৃসাধনরত সন্ন্যাসীর চোখেমুখে যে দীপ্তি পথিকজনেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ভিয়েনার দ্র, দেমি মদেন, গণিকাদের চোখেও সেটা ধরা পড়ত হিটলারকে দেখে। এবং তরুণ হিটলারের দিকে কটাক্ষনয়নে তাকিয়ে বিশেষ ইঙ্গিতও দিত। সাদামাটা, কিঞ্চিৎ ঈর্ষান্বিত গুস্তাফ সেদিকে হিটলারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, তিনি তার বাহু ধরে অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলতেন, চল, চল, গুল, বাড়ি চল।

পূর্বেই বলেছি তার পর তিনি উধাও হলেন।

সেই ১৯০৮ থেকে ১৯১৯-২০ পর্যন্ত যে যা-কিছু লেখেন তার পনেরো আনা কাল্পনিক। অবশ্য ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যখন জওয়ানরূপে যুদ্ধক্ষেত্রে, তার সম্বন্ধে সে সময়কার খবর সরকারি কাগজপত্রে রয়েছে, কিন্তু সেগুলো আমাদের কাছে অবান্তর।

বস্তুত এ-কথা প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, ১৯০৮ থেকে ১৯২৫-২৬ পর্যন্ত কোনও রমণী তার ওপর কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।(১) পরিচয় হয়েছিল তাঁর বহু রমণীর সঙ্গে– একে ভিয়েনায় তার যৌবনের বেশ কিছুকাল কেটেছে, যে-ভিয়েনার রমণী জাতিকে খাতির করতে তার সঙ্গে প্রেমে পড়ার জন্য সর্বক্ষণ সচেতন, কিংবা অচৈতন্যি দুটোই বলতে পারেন, এক কথায় ভিয়েনা গ্যালান্ট নগর– তদুপরি ১৯২২ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত তিনি মুনিকের রাজনৈতিক আকাশে অন্যতম জ্যোতিষ্মন গ্রহ, কম্যুনিস্টদের মোকাবেলা করতে পারেন একমাত্র তিনি, রাস্তাঘাটে নাৎসি আর কমুনিস্ট দলে আবার প্রতিদিন মারামারি হয় এবং উভয় পক্ষে কয়েকটা গুপ্ত এবং প্রকাশ্যে খুনও হয়ে গিয়েছে– এ সবার নেতা তো বীর্যবান না হয়ে যায় না। তদুপরি মহিলাদের প্রতি কী প্রকারের ব্যবহার করতে হয়, তাদের প্রতি ব্যবহার্য সর্ব আদব-কায়দা-এটিকেট-গ্যালানট্রি তিনি জানেন– ভিয়েনাতে অবশ্যই তার বেশিরভাগ তিনি দেখে শিখেছিলেন, কিন্তু হিটলারের মতো অসাধারণ জিনিয়াসের পক্ষে সেইটে যথেষ্টর চেয়েও ঢের বেশি। এবং সর্বশেষ কথা, তাঁর যে একটা ম্যাগনেটিক চার্ম চৌষিক আকর্ষণ শক্তি ছিল সেটা তো জর্মন ভাষায় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ বহু বিদেশি রমণীও বলেছেন।

আমি পূর্বেই নিবেদন করেছি, হিটলার-জীবনে প্রেম হাফ প্লাস ওয়ান প্লাস হাফ।

স্তেফানির প্রতি তার প্রেম প্রথম হাফটা, শেষ হাফটা এফা ব্রাউন, যাকে তিনি শেষ মুহূর্তে বিয়ে করেন এবং সেই সূত্রে পৃথিবীর বহু লোক এ প্রেমের খবর পায়। কিন্তু আমরা এস্থলে যে দৃষ্টিবিন্দু– অর্থাৎ প্রেমের পরিপ্রেক্ষিতে হিটলারকে দেখছি, সেভাবে কেউ দেখেননি, লেখেননি। হয়তো সেই হাফটি এস্থলে আগে বর্ণনা করে মাঝখানে ফুল ওয়ানটিতে গেলে ভালো হত, পাঠক পুরো পার্সপেকটিভ পেতেন, কিন্তু শেষটায় অনেক চিন্তা করে দেখলুম বিশেষ কারণ না থাকলে এ ধারার কালানুক্রমিক অগ্রসর হওয়াই প্রশস্ত (সিনেমার ফ্লাশব্যাক কিংবা ফ্লাশ ফরওয়ার্ড টেকনিক অবশ্য আজকাল বড়ই জনপ্রিয়)। দ্বিতীয়, এফার সঙ্গে হিটলারের সর্বশেষ প্রেম ১৯৩৯-৪৫-এর যুদ্ধাদি দ্বারা এতই বিক্ষুব্ধ যে বহু অবান্তর নর-নারীকে সেখানে টেনে এনে প্রবন্ধের কলেবর বাড়াতে হয়। তৃতীয়ত, অনেকেই সে প্রেম সম্বন্ধে অল্পবিস্তর পড়েছেন বলে স্বল্প পরিসর প্রবন্ধে মূল ঘটনাগুলো শুধু আবার তারা শুনতে পাবেন মাত্র– অর্থাৎ, সে-প্রেম বর্ণাতে হলে পূর্ণ পুস্তকের প্রয়োজন।

এস্থলে নিবেদন করা কর্তব্য মনে করি, রমণীর প্রতি পুরুষের একনিষ্ঠ প্রেম এদেশের এবং ওদেশের বহু কাব্যকাহিনীতে আছে কিন্তু বাস্তবে যদ্যপি যে কোনও কারণেই হোক, (কুলীন প্রথার কথা তথা শ্রীকৃষ্ণ বা দশরথের কথা এস্থলে স্মরণে আনছিনে) আমরা আজ এদেশে একদারনিষ্ঠতাকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখি, ইয়োরোপে বহুকাল যাবৎ একই রমণীকে আজীবন পুজো করার বিশেষ মূল্য দেয়নি। অতএব পাঠক যেন স্তেফানির কথা স্মরণে এনে হিটলারের সর্মহৎ, সর্বগ্রাহী প্রেমকে তার যথোপযুক্ত সম্মান দিতে কুণ্ঠিত না হয়।

ঠিক কোন সালে যে প্রেমের সূত্রপাত হয় সে কথা তার অন্তরঙ্গতম ব্যক্তিও জানেন না– যদিও আমার সুদৃঢ় অচল বিশ্বাস, বয়সে পরিণত হওয়ার পর তিনি কারুর সঙ্গেই অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব স্থাপন করে নি, ফোটোগ্রাফার হফম্যান ছিলেন তাঁর একমাত্র নিত্যালাপী বিদৃষক– তবে নিশ্চয়ই ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে।

ইতোমধ্যে হিটলারের একটি বিশিষ্ট স্বভাবের উল্লেখ না করলে সে বলার যথার্থ তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করা অসম্ভব।

পূর্বেই নিবেদন করেছি মোটামুটি ১৯২৭, পাকাভাবে বলতে গেলে তার দু-তিন বছর আগে থেকেই হিটলার মুনিকাঞ্চলে এমনই প্রখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি যেখানে যেতেন সেখানেই তাঁর চতুর্দিকে ভিড় জমে যেত! দিনের পর দিন বিশাল জনতার সামনে তিনি ওজস্বিনী বক্তৃতা দ্বারা দেশের দুঃখ-দৈন্যের নিদারুণ বর্ণনা দিচ্ছেন, বিশেষ করে শিশু-পুত্রকন্যার জন্য আহার-বসন সংগ্রহার্থে মা-জননীদের কঠোর সংগ্রাম (মেয়েরা দু হাত দিয়ে মুখ চেপে কাঁদলেও তার সম্মিলিত ধ্বনি হিটলারকে কখনও কখনও পুরো দু-তিন মিনিট বক্তৃতা বন্ধ করতে বাধ্য করত), এবং সমসাময়িক রাষ্ট্রনায়কের ক্লৈব্য তথা পাপাচার (করাপশন) নিয়ে তাঁর সুতীক্ষ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এবং সর্বোপরি তার আত্মবিশ্বাস, তাঁর আশাবাদ যে তিনিই মেসায়া (কল্কি, যিনি পুনরায় পৃথিবীতে ধর্মস্থাপনা করবেন) তিনিই ভের্সাঈ ডিকটাট (ডিকটা = ডিটেশন থেকে, অর্থাৎ ক্রীতদাসদের প্রতি যে কোনও অন্যায় পশুবলপ্রযুক্ত অলঙ্ঘ্য আদেশ, যে আদেশ পালন না করলে আদিষ্ট ব্যক্তিকে সবংশে নির্বংশ করা হবে এবং জর্মন রাষ্ট্রকে সমূলে উৎপাটিত করা হবে) ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে জর্মনিকে পুনরায় সার্বভৌম এবং ধীরে ধীরে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নেশানরূপে পরিণত করবেন।(২)

ব্যক্তিগত জীবনেও হিটলার আর কাউকে আমল দিতেন না। প্রায় প্রতিদিনই তিনি তার প্রিয় তিনটে ক্যাফের একটাতে কয়েকজন বন্ধুসহ বসতেন। কিন্তু আমরা যাকে বলি আড়া মারা, কিংবা গালগল্প করা– সে কর্মে ভিয়েনা বাঙালির চেয়েও এক কাঠি সরেস এবং যে ভিয়েনায় হিটলার প্রথম যৌবন কাটান– সেটি হত না। হিটলার ভিয়েনাতে অনেক কিছু শিখেছিলেন, শুধু এই সমাজনন্দন আচরণটি রপ্ত করতে পারেননি। সর্বক্ষণ তিনিই কথা বলতেন, একমাত্র তিনিই।

এসব মণ্ডলীতে মহিলাদের নিরঙ্কুশ প্রবেশ-নিষেধ না হলেও তাদের মাত্র দু-একজন আহ্বান পেতেন অতিশয় কালেভদ্রে। হিটলার ভিয়েনার কায়দায় তাঁদের হস্তচুম্বন করতেন (যদিও জর্মনিতে তখন সেটা বিলকুল আউট অব ডেট), তাঁদের সুখ-সুবিধার প্রতি কড়া নজর রাখতেন, সামান্য হা, হুঁ কিংবা অতি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করতে দিতেন, কিন্তু একটা দিকে তিনি কঠোর কঠিন দৃষ্টি রাখতেন, কোনও রমণী যেন ভ্যাচর ভ্যাচর করতে আরম্ভ না করে– তা তিনি যত বুদ্ধিমতীই হোন, মাদাম পম্পাডুর, ইজাবেলা ডানকান, মাদাম দ্য স্তাল যেই হোন না কেন।

———-

১. এমনকি পরবর্তীকালে এফা ব্রাউনও না।

এস্থলে আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ করি। ১৯৪১-এর গ্রীষ্মকালে হিটলারের সেনাদল যখন বীরবিক্রমে জয়ের পর জয় লাভ করে মস্কো পানে এগিয়ে চলেছে তখন তিনি প্রতিদিন লাঞ্চ-ডিনারের পর ঘন্টার পর ঘণ্টা গল্প করতেন। ১৯৪২-৪৩-এর শীতে স্তালিনগ্রাদের পরাজয়ের পর জেনারেলদের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি শুধু তার মহিলা সেক্রেটারি-স্টেনোদের সঙ্গে খেতেন। (এফার হেডকোয়ার্টার্সে আসার অনুমতি ছিল না। হিটলার সময় পেলে বেৰ্ষটেশগাডেনের বাড়ি বের্গহপে তাঁর সঙ্গে মিলিত হতেন) কিন্তু ওই ১৯৪১-৪২ এক বা দেড় বছর তিনি যে-সব গালগল্প করেছেন সেটি লিখে রাখা হয়েছিল স্টেনোদের দ্বারা। প্রকাশিত হয়েছে হিটলারস্ টেবল-টক শিরোনামায়। প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার কেতাব। এ পুস্তকের বহু স্থলে পাওয়া যায় রমণীজাতি সম্বন্ধে তার অভিমত। কিন্তু ভিয়েনা বাসকালীন কিংবা ১৯২৫-২৬ পর্যন্ত তিনি যে কোনও রমণীকে কাছের থেকে চিনতে পেরেছেন, এর কোনও ইঙ্গিত নেই। অবশ্য এ-দ্বারা কোনও কিছু নিঃসন্দেহে প্রমাণ করা যায় না।

২. হিটলারের বক্তৃতা দেবার ভঙ্গি ও বিষয়বস্তু নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ লেখা যায়– লেখক তার বহু বক্তৃতা শুনেছে। এ বাবদে একটি অত্যুত্তম– সর্বোৎকৃষ্ট বললেও অত্যুক্তি হয় না— পরিচ্ছেদ লিখেছেন জর্নালিস্ট মার্কিন মাউরার তাঁর জর্মনি পুটস দি ক্লক ব্যাক পুস্তিকায়।

প্রেম

কী কায়দায় আলাপ হয়েছিল সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়।

ছোকরা আইন পড়ে।

একদিন বলল চ, একটা ইনট্রেসটিং মোকদ্দমা হচ্ছে। এদেশের নিয়ম, আইন পরীক্ষা দেবার পূর্বে ছ বার না দশবার আমার সঠিক মনে নেই– আদালতে হাজিরা দিতে হয়, বোধহয় সরকারি উকিলের অ্যাসিসট্যান্টরূপে দু-চারবার কাগজপত্রও দুরস্ত করে দিতে হয়।

সুইস আদালত আদৌ ভীতি উৎপাদক নয়। কেমন যেন ঘরোয়া ঘরোয়া ভাব।

অথচ মোকদ্দমাটা বেশ গুরুতর বিষয় নিয়ে।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একটি যুবতী। সুন্দরী বলা চলে না, সাদামাটা, তবে দেখতে ভালোই। এবং তার চেয়ে বড় কথা, মেয়েটি বেশ স্বাস্থ্যবতী। মুখের রঙটি যেন শিশিরে ভেজা। জানা গেল, মেয়েটি সুইস ইতালিয়ান।

দোস্ত ফিসফিস করে বলল, জানিস তো, জাতে সুইস হলেও এই ইতালিয়ানরা একটু আস্টেডি অর্থাৎ উড়ুক্কু ভাব ধরে।

প্রেমট্রেমের ব্যাপার আদালত সংক্ষেপেই সারে। তবে এস্থলে বিবরণীটি নিশ্চয়ই কোনও রোমান্টিক ছোকরা পুলিশ লিখেছিল। প্রেমটা হয়েছিল গভীরই। প্রতি ছুটির দিনে উইক-এন্ড, এমনকি কাজকর্মের ফাঁকেফিকিরে সিনেমা-কাবারে-সুইমিং পুল। বেশ স্ফূর্তিতে কেটেছে দিনগুলো– কোনও সন্দেহ নেই। এবং কোনও সন্দেহ নেই মেয়েটাই মজেছিল মরমে মরমে।

সরকারি উকিল গলাখাকরি দিয়ে বললেন, এবং খর্চাটা মেয়েটির কষ্টে জমানো টাকা থেকে।

আমার কান ছিল বিবরণীর দিকে, চোখ মেয়েটির পানে। এতক্ষণ তার মুখে কোনও ভাবের পরিবর্তন হয়নি। এবারে তার ঠোঁটের কোণে যেন ঈষৎ অসহিষ্ণুতার ভাব দেখা গেল।… উকিল পড়ে যেতে লাগলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে আসামি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। প্রকাশ, ছেলেটা প্রতিজ্ঞা করেছিল, আসামিকে বিয়ে করবে। আসামির পিতামাতা ধর্মভীরু, সে-ও প্রতি রোববারে গির্জেয় যেত। আসামি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে জানামাত্রই ছেলেটা পালায়।

এবারে বিবরণী প্রথম পুরুষে– মেয়েটির বাচনিক।

আমার এই বিপদে আমাকে সাহায্য করবার মতো সে শহরে কেউ ছিল না; জমানো কড়িও ফুরিয়ে গিয়েছে। তখন স্থির করলুম, গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবা-মাকে সব খুলে বলব। তারা আঘাত পাবেন জানতুম, কিন্তু এছাড়া আমি অন্য পথ খুঁজে পেলুম না।

বাড়ি ফিরে যে অবস্থা দেখলুম তাতে বাবা-মাকে কিছু খুলে বলার সাহস আমার আর রইল না। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমার দু বছরের ছোট বোনটি– সে-ও শহরে গিয়েছিল কাজ নিয়ে, সে-ও ফিরে এসেছে পেটে বাচ্চা নিয়ে। তাকে কে দাগা দিয়েছে শুধধাইনি। আমি কী কষ্টের ভিতর দিয়ে গিয়েছি সে শুধু আমিই জানি। সে বাবা-মাকে সব খুলে বলেছে। আমাকে বলল, তাঁরা বড় আঘাত পেয়েছেন, কিন্তু তাকে গ্রহণ করেছেন, বাচ্চাটাকেও মানুষ করবেন।

আমি তখন করি কী? দু-দুটো মেয়ে কুপথে গেল– অথচ তারা কত যত্নেই আমাদের মানুষ করেছিলেন। আমি তাদের কী করে বলি, আমিও কুপথে গিয়েছি। আর দু-দুটো বাচ্চা তারা পুষবেনই-বা কী করে?

আমি স্থির করলুম, আমার বাচ্চাটাকে আমি বিসর্জন দেব। হাজার হোক, আমার ছোট বোন। তার হক বেশি। আমি তাকে ভালোবাসি। আমি তাকে সাহায্য করতে চাই। সে বেচারি একেবারে ভেঙে পড়েছে। আমিও যদি মুখে কলঙ্কের ছোপ মাখি তবে তার হয়ে পাঁচজনের সঙ্গে লড়াই দেব কী করে?

আমি মেয়েটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলুম। সে যেন একেবারে পাষাণ হয়ে গিয়েছে।

এবারে সরকারি উকিল বললেন, নদীপারে নির্জনে আসামি বাচ্চা প্রসব করে তাকে জলে ফেলে দেয়। তার পর একটু থেমে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, কিন্তু সেখানে আর কেউ ছিল না বলে প্রমাণ করা অসম্ভব না হলেও সুকঠিন, বাচ্চাটা মৃতাবস্থায় জন্মেছিল কি না।

সমস্ত আদালতঘর নিস্তব্ধ, নীরব।

এইবারে প্রথম জজ মুখ খুললেন। সামনের দিকে শূন্য দৃষ্টি ফেলে শুধোলেন, বাচ্চাটা জন্মের সময় জীবিত না মৃত ছিল?

মেয়েটি একবার মুখ তুলে তাকিয়ে ফের মাথা নিচু করল। বলল, আমি সত্যই শপথ করে বলতে পারব না। আমি আমার আমি তখন সবকিছু বুঝতে পারিনি।

আশ্চর্য, জজ তো নয়-ই সরকারি উকিল পর্যন্ত কোনওরকম জেরা বা চাপাচাপি করলেন না, প্রকৃত সত্য উঘাটন করার জন্য। কারণ এটা তো আইনত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বাচ্চা জ্যান্ত জন্মে থাকলে এটা খুন হয়তো মারডার নয় ম্যানটার– আর মৃতাবস্থায় জন্মে থাকলে বা জন্মের পরেই যদি মরে গিয়ে থাকে তবে বাচ্চা প্রসবের কথা পুলিশকে জানায়নি বলে অপরাধটা কঠিন নয়–হাইডিং অব এভিডেন্স, সত্য তথ্য নির্ধারণের প্রমাণ গোপন করেছে শুধু।

মোকদ্দমা এখানেই শেষ বলা যেতে পারে। কিন্তু জজ তবু একটা প্রশ্ন শুধোলেন, আড্ডা, তুমি সেই ছেলেটার সন্ধান নিলে না কেন? তাকে বিয়ে করাতে বাধ্য করালে না কেন?

কুণ্ডলি পাকানো গোখরো সাপ যেরকম হঠাৎ ফণা তুলে দাঁড়ায় মেয়েটা ঠিক সেইরকম বলে উঠল, কী! সেই কাপুরুষ– যে আমাকে অসহায় করে ছুটে পালাল! তাকে বিয়ে করে আমার বাচ্চাকে দেব সেই কাপুরুষের, সেই পশুর নাম! তার পর দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। গোঙরানোর শব্দ কানে এল।

আমি তার মুখের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারিনি।

প্রেম যে কী দ্বেষ, কী ঘৃণায় পরিণত হতে পারে তার বিকৃত মুখে দেখলুম– পূর্বেও দেখিনি, পরেও দেখিনি।

আমি বসেছিলাম একেবারে দরজার পাশে। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলুম।

দু দিন পরে দোস্তের সাথে ফের দেখা।

বলল, ছোঃ, তুই বড্ড কাঁচা। পালালি?

কী সাজা হল?

চার মাস। কিন্তু জেলে যেতে হবে না। গাঁয়ের পাদ্রি সাহেবের কাছে প্রতি সপ্তাহে একবার করে হাজিরা দিতে হবে– গুড় কনডাকটের রিপোরট দেবার জন্য। আদালত বললেন, সমস্ত পরিবার যে বদনামের পাবলিসিটি পেল, সে-ই যথেষ্ট সাজা– আর যার ফাঁসি হওয়া উচিত সে তো আদালতে নেই।

প্রেম যে কী দ্বেষ, কী ঘৃণার—

প্রোটকল

শ্রীল শ্রীযুক্ত জলসা সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু,

মহাত্মন,

স্বভাবতই সর্বপ্রথম প্রশ্ন উঠবে, উপরিস্থ পদ্ধতিতে আপনাকে সম্বোধন করবার হক আমার আছে কি না? অর্থাৎ এটিকেটে বাধে কি না? আরও সরল আন্তর্জাতিক পরিভাষা ব্যবহার করতে হলে বলব, আমার এ আচরণ প্রোটকল-সম্মত কি না।

ভয় নেই। আমি শব্দতত্ত্ব নিয়ে অযথা মাথা ফাটাফাটি করব না। সামান্যতম যেটুকু নিতান্তই না হলে চলে না তারই দিকে আপনার তথা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। ভোজনারম্ভে তিক্তবস্তুর ন্যায় যৎসামান্য।

কোনও কোনও শব্দের পরিধি পরিব্যাপ্তি দিন দিন বেড়ে যায় কোনওটার আবার কমে। এই ধরুন না, কনটাক্ট শব্দটি। একদা বোঝাত নিতান্ত স্থূলভাবে শারীরিক সংস্পর্শে আসা।

সে আমলে যদি কেউ লিখত উপমন্ত্রী সুশীলাবালা দাসী গত রাত্রে শ্রীযুক্ত নটবর নায়ককে কনটাক্ট করেছেন তবে সেটা প্রায় অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়ে যেত। আজ স্বচ্ছন্দে বলি, প্রাচীন নব্যন্যায় অধুনা প্রতীচীর এপিস্টমলজির কন্টাক্‌টে আসাতে উভয়ই উপকৃত হয়েছেন। অবশ্য তার অর্থ কী, আল্লায় মালুম।

প্রোটকল শব্দটির বেলাও তাই হয়েছে। একদা গ্রিক ভাষাতে বোঝাত– যেমন ধরুন, আপনার একখানা টাইম-টেবিল আছে। হঠাৎ ইশটিশানে পেয়ে গেলেন, হ্যান্ড-বিল-পারা একখানা নোটিশ। তাতে ট্রেনের সময় পরিবর্তনের নবীন ফিরিস্তি রয়েছে। আপনি সেটি আপনার টাইম-টেবিলের যথাস্থলে গঁদ দিয়ে সেঁটে দিলেন। তখন এ কাগজের টুকরোটি পেয়ে গেলেন পৈতে। হয়ে গেলেন প্রোটকল। গেরেমভারি নাম। এ পাড়ার মেধো হয়ে গেলেন ভিন্‌পাড়ার মধুসূদন।

সরকারি না-হক ট্যাকশো যেরকম বাড়তে বাড়তে পর্বতপ্রমাণ হয়ে যায় এ শব্দটিও আড়াই হাজার বছর ধরে বাড়তে বাড়তে তার তনুটিকে অদ্যকার বন্ধু করে তুলেছে। বেশ এক যুগ পূর্বে এটিকেটের মহানগরী প্যারিসে পররাষ্ট্র বিভাগ বা ফরেন আপিসে একটি ভিন্ন বিভাগ খোলা হয়েছে; তার নাম প্রোটকল বিভাগ। একটা পুরো পাক্কা আস্ত ডিপারটমেন্ট।

রাজ্যচালনার কোন গুরুভার এঁদের স্কন্ধে সমর্পিত হয়েছে?

বহুবিধ। এমনকি আমার মতো লোক না পারলেও আপনি এদের সাহায্য তলব করতে রেন। অবশ্য কলকাতাতে এরকম পুরো-পাক্কা-প্রোটকল বিভাগ আছে কি না, আমি সঠিক নিনে। ধরুন আছে। আরও ধরুন, আপনি, সম্পাদক মশাই, কোনও পারটিতে নর্থ পোলের কনসাল জেনারেলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। কথায় কথায় বেরিয়ে গেল তিনি ভারতীয় ফলমে বড়ই ইনটেরসটেড। পরিচয় নিবিড়তর হল। ইতোমধ্যে তিনি আপনাকে একটি খাসা উনারও খাইয়ে দিয়েছেন। সেটি রিটার্ন করতে হয়। কনসাল বিপত্নীক। একটি অবিবাহিত মেয়ের বয়স একুশ অর্থাৎ সোসাইটি করার বয়স হয়েছে। অন্য মেয়েটি পল্টনের কেপটেনকে বিয়ে করেছেন। তিনি একা এসেছেন কলকাতায়, বাপের কর্মস্থলে। ওদিকে আপনি সাউথ পোলের কনসুলেট জেনারেল শার্জে দাফেরকেও ওই দিনই নিমন্ত্রণ করেছেন। তাঁর ভামিনী ও এক কন্যাও সঙ্গে আসছেন। কন্যাটির স্বামী ছিলেন। তিনি স্বামীর কাছ থেকে সেপারেশন নিয়ে পিতার সঙ্গে বাস করেন।… ডিনারে আরও ইনি উনি তিনি আসবেন।

এবারে আমরা আসছি ইংরেজিতে যাকে বলে– থিক্‌ অব্ দ্য বেটুল-এর। অর্থাৎ মূল সমস্যায়। আপনি বিলক্ষণ অবগত আছেন প্রিসিডেনস বস্তুটি সাংঘাতিক। আপনার ড্রয়িংরুমে ককটেলাদি পান করার শেষের দিকে যখন বাটলার এসে আপনার স্ত্রীর সামনে বাও করবে তখন তিনি মুচকি হাসবেন প্রধান অতিথির দিকে। সেই মসিয়ো ল্য কনস্যুল জেনারেল যেন পবনে ভর করে আপনার স্ত্রীকে এসে দান করবেন তার দক্ষিণ বাহু। তারই উপর নির্ভর করে দু-জনাতে এগোবেন খানা-কামরার দিকে। এর পর যাবেন আপনি। কিন্তু দক্ষিণ বাহু দান করবেন কাকে? সাউথ পোলের শার্জে দাফেরের স্ত্রীকে, না নর্থ পোলের অবিবাহিতা কন্যাকে, না কেপটেনের স্ত্রীকে, না কর্নেলের তালাকপ্রাপ্ত মহিলাকে?…এবং তার পর আসবেন কোন জোড়া, তার পর, ইত্যাদি।

তাই আপনি সুবুদ্ধিমানের মতো পূর্বাহেই ফোন করেছেন, শ্যা দ্য প্রোটকলকে– অর্থাৎ প্রোটকলের বড় কর্তাকে। অতি অমায়িক লোক। তদুপরি আপনি সম্মানিত কাগজের তারই মতো শ্যা, বড় কর্তা। কে কতখানি সম্মান পাবেন, তাদের দফতর ফিষ্টি দিলে আপনার প্রিসিডেনস কী– অর্থাৎ কার আগে কার পরে আপনি খানা-কামরায় ঢুকবেন তার প্রোটকলে আপনার নাম উঁচুর দিকে। অতএব একগাল হেসে বললেন,–সে কী মসিয়ো– (ভুললে চলবে না, আন্তর্জাতিক প্রোটকলের ভাষা এখনও ফরাসিস্!) আপনি অতখানি আঁবায়াসে (এমবারাট) হচ্ছেন কেন? এ যে একেবারে ডিমের খোসায় কালবোশেখী। আপনি তো আর অফিশিয়াট ডিপ্লোমেটিক ডিনার দিচ্ছেন না। কী বললেন? না, না, না পারলো, আমি আপনার ব্যান-কুয়েটটাকে মোটেই হেনস্তা করছিনে। তবু বলছি, ওটা তো।

ওই আনন্দেই থাকুন, সম্পাদক মশাই, ওঁকে বিশ্বাস করেছেন কী মরেছেন।

যতই ঘরোয়া বাড়ির ব্যাপার ফেমিলি ওয়ে বলে নেমন্তন্ন করুন না কেন, এবারে খাঁটি দিশি তুলনা দিচ্ছি সেখানে যদি মাছের মুড়োটা আপনার দিদির শ্বশুরকে না দিয়ে দেওয়া হয় আপনার ভাগ্নের শ্যালাকে, তদুপরি উনি কুলীনস্য কুলীন, আর কালো ছোকরা মৌলিকস্য মৌলিক, তা হলে ব্যাপারটা কীরকম দাঁড়াবে? আমি বলছি না, শ্বশুরমশাই বাড়ি ফিরে অ্যাট হিজ আরলিস্ট কনভিনিয়ে আপনার দিদির পিঠে ছি, ছি, তিনি আবার বৌমা–দু ঘা না না, তা বলছিনে।

প্রোটকলের শ্যাফ সবিশেষ অবগত আছেন যে আপনি তার স্তোকবাক্য সিরিয়স নেননি। তিনিই বলবেন।

সে তো হল। কিন্তু ওই যে বললেন সাউথ পোলের ডিভোর্স কন্যা–স্বামী ছিলে কর্নেল–তিনি এখন কী নামে পরিচয় দেন? ঠিক ডিভোর্স তো হয়নি–হয়েছে সেপারেশন।

সেটা কি ইমপরটেন্ট?

ভেরি, ভেরি। মহিলাটি যদি স্বামীর নাম ত্যাগ করে পুনরায় তার মেডেন (কুমারী) নাম, অর্থাৎ তার পিতার নাম গ্রহণ করে থাকেন তবে তিনি পাবেন সেই পরিবারের র‍্যাঙ্ক, নইলে পাবেন কর্নেলের বিবাহিতা স্ত্রীর র‍্যাঙ্ক। তার পর দেখতে হবে

ততক্ষণে আপনার মাথাটি তাজ্জিম মাজ্জিম করছে। ভাবছেন, এবারে আর ডিমের খোসাতে টর্নাডো নয়, আপনার কানের টিপেনামে চলেছে মহাবেগে যুগ রুশমার্কিন নির্মিত স্পুটনিক।

আম্মো ভাবছি আজ যদি ডাচেস অব উইনজর তৃতীয় বারের মতো যদি, মানে, ইয়ে হয়ে যান তবে তার নাম কী হবে? শুনেছি, হালে নাকি তিনি লন্ডনে জলচল হয়ে গেছেন। ডুককে বিয়ের পূর্বে মিসেস সিমসন অবস্থাতে তিনি রাজবাড়িতে দাওয়াত খেয়েছেন যদ্যপি রাজমাতা মেরি সে দাওয়াত বর্জন করেন। তাঁর সে বামনাই নাকি প্রোটকল-নিন্দিত অপকর্ম হয়েছিল। ঈশ্বরেচ্ছায় তিনি দেহরক্ষা করেছেন। এখন প্রশ্ন, ডাচেস যদি আরেকটা ডিভোর্স নেন তবে তিনি লন্ডনে সাধনোচিত ধাম পাবেন কি না, অর্থাৎ বকিংহম ধামে নিমন্ত্রিত হবেন কি না?

হাসছেন? হাসবার জিনিস মোটেই নয়। চাকরি যেতে পারে। রুটি মারা যেতে পারে।

নিন্ হিটলারের যে কোনও প্রামাণিক জীবনী। পড়ুন ঘটনাটা। হিটলার গেছেন ইতালি– স্টেট ভিজিটে। সঙ্গে গেছেন ফরেন আপিসের শ্যাফ দ্য প্রোটকল। শ্যাটি সাতিশয় খানদানি ঘরের ছেলে। পোষা বেড়ালটাকে আগে দুধ দিতে হয়, না কুকুরটাকে হাড়ি– সে প্রোটকল তিনি সাত বছর বয়সেই পারিবারিক কাসূলে যুক্তিতর্কসহ সপ্রমাণ করে দিয়েছিলেন।

ইতালির রাজা সর্বান্তঃকরণে ঘেন্না করতেন হিটলারকে অবশ্য অনুভূতিটি ছিল উভয়পক্ষীয়, সাতিশয় বরাবরেষু! রাজা পাতলেন ফাঁদ, হিটলারকে অপদস্থ করার জন্য। শেষ মুহূর্তে কী একটা হয়ে গেল রদবদল। যার ফলে হিটলার উপস্থিত হলেন কী এক পরবে সিভিল ড্রেস পরে, যেখানে আর সবাই মুনিফর্মে! কিংবা উল্টোটা।

বিশ্বসংসার জানে হিটলার ছিলেন অত্যন্ত বদ-মেজাজি লোক যদিও একথাও সত্য যে মিষ্টি ব্যবহার করতে চাইলে তিনি পারমিট-প্রার্থী মেবারবাসীকে তিন লেনথে হারাতে পারতেন– দুষ্টলোকে বলে, তিনি তখন মেঝেতে শুয়ে পড়ে কারপেট চিবুতে আরম্ভ করতেন– তাকে নাকি বলা হত The Carpet-Eater!

প্রোটকল শ্যাফ বরখাস্ত হয়ে প্রথমতম ট্রেনে নাক বরাবর আপন গায়ে। হিটলার তার মুখদর্শন পর্যন্ত করেননি।

অবশ্য এর সরল দিক নিয়েও একাধিক কাহিনী আছে। বাল্যকালে হিটলার যে অস্ট্রিয়ার নগণ্য প্রজা ছিলেন সেই বিরাট অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির মহিমান্বিত সম্রাট ছিলেন কাইজার ফ্রানস যোজেফ। তাঁর ভাব-ভালোবাসা ছিল সুন্দরী অভিনেত্রী শ্রীমতী শ্রাটের সঙ্গে। তিনি প্রায়ই কাইজারকে বলতেন, আপনি স্টেজের উপর গিরাডির রসিকতা শুনে হাসতে হাসতে কাত হয়ে পড়েন। স্টেজে আবার রসিকতা করার সুযোগ পান গিরার্ডি কতটুকু? পাবৃ-এ, বার-এ, চায়ের মজলিশে তিনি যা একটার পর একটা ছেড়ে যান তার তুলনায় কেউ কখনও করতে পেরেছেন বলে কোনও কিংবদন্তী পর্যন্ত এই বিরাট ভিয়েনা শহরে নেই। তাই গিরার্ডিকে কফি পানে নিমন্ত্রণ করা হল। কাইজার তো এলেন বিরাট প্রত্যাশা নিয়ে। এদিকে কী আশ্চর্য! গিরাডি-র কোটের বোতাম ওপরবাগে উঠতে উঠতে যেন তার ঠোঁটদুটোকেও বোমিত করে দিয়েছে। নিজের থেকে কথা কন না আদৌ, প্রশ্ন শুধলে মহা সম্ভ্রমে যেটুকু বলেন সেটি তার গোঁফের ছাঁকনিতেই আটকা পড়ে যায়।

কফি পান খতম হতে চলেছে। শেষটায় থাকতে না পেরে হতাশ কাইজার ক্ষুণ্ণকণ্ঠে বললেন, মাই ভেরি ডিয়ার গিরার্ডি! আপনার মজলিশ-জমানো কথার ফুলঝুরি সম্বন্ধে আমি কত মুখে কতই না বেহদ্দ তারিফ শুনেছি– আর এ কী?

রুমাল দিয়ে মাথার ঘাম মুছতে মুছতে এক্কেবারে গ্রাম্য ভাষায় গিরার্ডি বললেন, হুজুর জাঁহাপনা! অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির কাইজারের লগে অ্যাগুবার আপনে কফি খাইতে বইয়া দ্যাহেন না!

বেচারি গিরার্ডি প্রোটকলকে কনস্লট করে কফি খেতে এসেছিলেন!

তার শেষ বাক্যটি ঠিক প্রোটকলসম্মত কি না সে নিয়েও আমার মনে ধোকা আছে।

একদম হালের ঘটনায় চলে আসি।

এই গত ৯/১০ জুন তারিখে আরব রাষ্ট্রগুলো এবং ইজরাএল সকলেই যখন অস্ত্রসম্বরণ (সিস ফায়ার) করতে রাজি হয়ে গেছেন তখন রাশা ইউনাইটেড নেশনের সিকুরিটি কৌনসিলের বিশেষ জরুরি সভা ডাকার জন্য প্রস্তাব পাঠাল; তার অভিযোগ, ইজরাএল সিস ফায়ার করেনি ক্রমাগত সিরিয়ার ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সিটিং বসল সকাল নটা-দশটায়। এদেশে তখন রাত বারোটা। মিটিঙে বসানো মাইকের মারফত তার প্রত্যেকটি বাক্য ভইস অব আমেরিকার নিউজ রুমে আসছে। সেইটে ফের বেতারিত হয়ে রিলের পর রিলের মারফত ভারতে পৌঁছচ্ছে। অধমের অন্দ্রিা ব্যাধি আছে।

এই সিকুরিটি কৌনসিলের কর্মপদ্ধতি অতিশয় ছিমছাম। যে যার বক্তব্য বলে যান সাধারণত অতিশয় শান্ত-কণ্ঠে। কেউ কাউকে বাধা দিয়ে আপন কথা বলতে চায় না– অতি দৈবেসৈবে কেউ যদি কখনও করে তবে বার বার মাফ চেয়ে, ও বাধাপ্রাপ্ত বক্তাও সঙ্গে সঙ্গে থেমে যান। চেল্লাচেল্লি হৈ-হুঁল্লোড়ের কথাই ওঠে না।

প্রেসিডেন্ট গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমি এখন সোভিয়েত রাশিয়ার মহামান্য (ডিসটিংগুইসট শব্দটি প্রতিবার প্রতি মেম্বারের উল্লেখ করবার সময় ব্যবহার করাটা প্রোটকলানুযায়ী নিরঙ্কুশ বাধ্যতামূলক) ডেলিগেটকে ঘরের ফ্লর ছেড়ে দিচ্ছি। অর্থাৎ তখন ঘরের ফ্লর মেঝেটাতে দাঁড়িয়ে কথা বলার হক সোভিয়েত ডেলিগেটের। অবশ্য তিনি ফ্লর গ্রহণ না-ও করতে পারেন।

মহামান্য রাশান ডেলিগেট দাঁড়িয়ে বললেন, স্পাসিব– কিংবা ব্লাগোদারিয়ু ভাসও বলে থাকতে পারেন। অর্থ একই; থ্যাঙ্কু। অর্থাৎ তিনি ফ্লর গ্রহণ করলেন।

তার পর এখন যে বিবৃতি নিবেদন করছি সেটা স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে। সন্দেহপিচেশ পাঠক আমার অত্যল্পই। তাঁরাও ওই সময়কার খবরের কাগজ পড়ে চে-অপ্ করে নিতে পারবেন, তাদের হাত দিয়ে আমি দা-কাটা তামাক অর্থাৎ সাতিশয় স্কুল ভুল– খেয়েছি কি না। কিন্তু আমি অতি সংক্ষেপে সারছি।

রুশ : থ্যাঙ্কস, মি. প্রেসিডেন্ট! আমি বলতে চাই, এই সম্মানিত কৌনসিল আরব এবং ইজরাএল উভয়কে আদেশ দিয়েছেন সিস-ফায়ার মেনে নিতে। সিরিয়ার মহামান্য ডেলিগেট বলেছেন, সিস-ফায়ার মেনে নেওয়া সত্ত্বেও ইজরাএল সিরিয়ায় অনুপ্রবেশ করে, ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া গাড়িসহ ক্রমাগত রাজধানী দিমিশকের (ডিমেকাস্, দামা, ডামাস্কুস) দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বোমারু বিমান অনবরত রাজধানীর উপর বোমাবর্ষণ করছে। আমি প্রস্তাব করি, কৌনসিল সর্বসম্মতিক্রমে ইজরায়েলের এ আচরণের নিন্দা করুক। ধন্যবাদ, মি. প্রেসিডেন্ট।

(বক্তৃতা শেষ করে কোনও কোনও সদস্য ভবিষ্যতে তার বক্তৃতার কী ভাষ্য হবে না হবে সে বাবদে তার অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার দাবি জানান। পক্ষান্তরে বক্তব্য স্পষ্ট হ্যাঁ, না বা নিতান্ত দ্ব্যর্থহীন হলে সে অধিকার যে রাখছেন না, সেকথাও বলে দেন। এটার প্রয়োজন এই কারণে যে কৌনসিলের বাহান্ন রঙের নানান চিড়িয়া নানান বুলি কপচান। অনুবাদ নিয়ে পরে তাই নানা হক-না-হক তর্ক ওঠে)।

প্রেসিডেন্ট বললেন, আমি এখন ইজরাএলের মহামান্য ডেলিগেটকে ফ্লর ছেড়ে দিচ্ছি!

ইজরাএল ডেলিগেট : আমার মহামান্য সরকার যখন সিস-ফায়ারে স্বীকৃতি দেন তখন তিনি স্পষ্ট বলেন, আমরা সিস-ফায়ার মানব, কিন্তু শর্ত (অন কন্ডিশন) যে আরবরাও তাই মানবে! অতএব সিস-ফায়ারটা মুচুয়াল করতে হবে। ইতোমধ্যে আমার মহামান্য সরকার তাঁর সেনাবাহিনীকে সিস-ফায়ারের হুকুম দিয়েছেন।

এ উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে হয়তো-বা রুশ ডেলিগেট নিন্দাসূচক প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে পারেন। সে সম্ভাবনা দেখে প্রেসিডেন্ট ফের রুশকে ফ্লর দিলেন।

রুশ : (অতি সামান্য অসহিষ্ণু কণ্ঠে) মি. প্রেসিডেন্ট! এ তো বড় তাজ্জব কি বাত! এই মচুয়াল সিস-ফায়ার রহস্যটা কী? মহামান্য ইজরাএল ডেলিগেট কি বলতে চান, প্রথমে, পয়লা, সিরিয়া সিস-ফায়ার করবে, তবে ইজরাএল অস্ত্রসংবরণ করবেন? তদুপরি, মি. প্রেসিডেন্ট, চুয়াল শব্দটাই আমাদের অনুশাসনে নেই। এবং আসল তত্ত্ব, ইজরাএলই আক্রমণ করেছে প্রথম। সিস-ফায়ার করতে হবে তাকেই প্রথম। আচমকা ওই মুচুয়াল শব্দ আমদানি করে ইজরাএল কথার মারপ্যাঁচ (কজিস্টরি) আরম্ভ করে মূল সত্য এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন? (তার পর অতি সামান্য ব্যঙ্গের সুরে– লেখক) এর পর বুঝি সফিরি আরম্ভ হবে! (কথার প্যাঁচে সত্য গোপন ও মিথ্যা ভাষণের ভদ্র নাম সফিরি–রুশ সদস্য ফেদেরেকো কব্জিস্টুরি ও সফিস্টুরি দুটো শব্দই ব্যবহার করেছিলেন যৎসামান্য ব্যঙ্গের সুরে কারণ ইজরাএল সদস্য যে সত্যি সত্যিই পাঁকাল মাছের গা মোচড়ানো আরম্ভ করে দিয়েছেন সেটা ততক্ষণ শক্ৰমিত্র সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে– লেখক)। মি. প্রেসিডেন্ট! আমি আদৌ অবিশ্বাস করছিনে যে, ইজরাএল সরকার তার সেনাবাহিনীকে সিস-ফায়ারের হুকুম দিয়েছেন, কিন্তু মহামান্য ইজরাএল সদস্য বলুন, তারা সেটা মেনে নিয়েছে কি না, তিনি বলুন, তারা সিরিয়ায় ক্রমাগত আরও অনুপ্রবেশ করছে কি না? থ্যাঙ্কু মি. প্রেসিডেন্ট।

প্রেসিডেন্ট : আমি মহামান্য এজরাএলের ডেলিগেটকে ফ্লর দিচ্ছি।

এর পর কিছুক্ষণ চুপচাপ। তার পর শোনা গেল ফের প্রেসিডেন্টের কণ্ঠস্বর : আমি মহামান্য বুলগেরিয়ার ডেলিগেটকে ফ্লর দিচ্ছি। স্পষ্ট বোঝা গেল মহামান্য ইজরাএল ফ্লর গ্রহণ করলেন না। পোটকলানুযায়ী প্রেসিডেন্ট তাঁকে হুকুম দিতে পারেন না।

বুলগেরিয়া (ঈষৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বস্তুত একমাত্র ইনিই কিঞ্চিৎ উত্তেজনা দেখান যদিও সর্বদ্রতা বজায় রেখে। ইজরাএল কথা বলেছে স্বভাবতই বিজয়ীর গর্বিত কণ্ঠে, সিরিয়া করুণ ফরিয়াদভরা সুরে আর ইজরাএলের জয়ে খুশিতে ডগমগ মার্কিন তথা তার ফেউ ইংরেজ করেছে হে-হে-হে-হে) : মি. প্রেসিডেন্ট! ইজরাএল উত্তর দিচ্ছেন না কেন? আমি শুধু জানতে চাই, ইজরাইলি বাহিনী এখন কোথায়? সিরিয়াতে? হ্যা কি না তিনি স্পষ্ট বলুন। তিনি যদি কথা বলেন তবে আমাদের যা বলার বলব, তিনি যদি না বলেন তবে আমরা ভেবে নিয়ে জেনে যাব। (ডিলেমাটি সুন্দর If Israel speaks, we shall speak; if Israel does not speak we shall know,- 977)

প্রেসিডেন্ট পুনরায় ইজরাএলকে ফ্লর দিলেন। খানিকক্ষণ চুপচাপ।

প্রেসিডেন্টের গলা : আমি মালির মহামান্য ডেলিগেটকে ক্ষুর দিচ্ছি।

এর থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, ইজরাএল ফ্লর গ্রহণ করেননি, করতে চান না। এর পর বোধহয় কর্মসূচিতে মালি রাষ্ট্রের নাম ছিল।

মালি : মি. প্রেসিডেন্ট! আমরা সবাই এখানকার সদস্য। এক সদস্য যদি অন্য সদস্যের কাছে কিছু জানতে চান তবে আপনি তাকে সেটা শুধোচ্ছেন না কোন বিধি অনুসারে? থ্যাঙ্কু! (বা ওই ধরনের)

প্রেসিডেন্ট; আমি সম্মানিত মালি সদস্যের কাছে জানতে চাই, আমি যে সম্মানিত ইজরাএলি সদস্যকে সম্মানিত রুশের প্রশ্ন জিগ্যেস করব তা কোন বিধি অনুযায়ী? মালি কোনও উত্তর দিতে চান কি না ঠাহর হল না। কারণ ইতোমধ্যে রুশ সদস্য ফ্লর চাইলেন। প্রেসিডেন্ট সসম্মানে তাই দিলেন।

রুশ : মি. প্রেসিডেন্ট! সভার কাজ সুষ্ঠুরূপে চালাবার জন্য আমরা ওয়ার্কিং এরেঞ্জমেন্ট মেনে নিয়ে থাকি। সেই অনুযায়ী যে কোনও সদস্য যে কোনও খবর যে কোনও সদস্যের কাছে চাইতে পারেন। এই তো আমরা সভার সদস্য সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্তকে অনুরোধ করলুম, সিরিয়া থেকে তাজা খবর আনিয়ে দিতে। তিনি দিলেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।

তৎসত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট সম্মানিত ইজরাএলি সদস্যকে প্রশ্নটি শুধোলেন না। তিনি কিন্তু একাধিকবার তাঁকে সসম্মানে ফ্লুর ছেড়ে দিলেন। ইজরাএল ফ্লর গ্রহণ করলেন না।

তবেই বুঝুন, সম্পাদক মশাই, প্রোটকলের ঠেলা কী চিজ!

কিন্তু চিন্তা করলে দেখতে পাবেন মি. প্রেসিডেন্ট থুড়ি সম্পাদক মশাই (ক্ষণতরে ভাবছিলুম, আমি বুঝি সেকুরিটি কৌনসিলে পৌঁছে গিয়েছি!) এটা কিছু নতুন তত্ত্ব নয়। আমি প্রাচীনপন্থী পদি পিসির অপজিট পুংলিঙ্গ। যা নাই ভারতে! খুলে বলি।

সেকুরিটি কৌনসিলের কার্যকলাপ যখন আমি সরাসরি বেতারে শুনছি তখন ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছিল এইরকমই একটি ধুন্ধুমার যেন আমি সশরীর কোথাও দেখেছি। হ্যাঁ, হা– ওই ধুন্ধুমার কথাটাই সব মনে করিয়ে দিল। যে মধুকৈটভনিধন শ্রীবিষ্ণুকে আর্যদ্রাণ সায়ংপ্রাতঃ স্মরণ করেন সেই বিষ্ণু তথা অন্যান্য দেবাদিকে প্রচণ্ড নিপীড়ন আরম্ভ করে মধুকৈটভের পুত্র ধুন্ধুমার এবং অবশেষে নৃপতি কুবলাশ্ব কর্তৃক নিহত হয়। মহাভারতের • আপ্তবাক্যমধ্যে সেটি লিপিবদ্ধ আছে।

ধুন্ধুমার স্মরণ করিয়ে দিল সেই সভা, যেখানে দ্রৌপদী লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। আমি জাতিস্মর। আমি সে সভায় উপস্থিত ছিলুম তখনকার দিনের পি-টি-আই চিফ রিপোর্টার মূলগায়েন সঞ্জয়ের দোহাররূপে।

পৃথিবীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে দুইটি নিরপরাধ ব্যক্তি যেভাবে আত্মসমর্থন করেছেন তার তুলনা আজো ইহসংসারে অলভ্য। ঐতিহাসিক যুগে সোক্রাতেস, তার বহু পূর্বে দ্রৌপদী।

কিন্তু অবিস্মরণীয় তত্ত্ববাক্য : সোকরাতেস জাত দার্শনিক, পড় তার্কিক। তিনি যে আত্মপক্ষ সমর্থনকালে শাণিত শাণিত তর্কবাণে অ্যাথিন্স নগরীর নভোমণ্ডল দিবাভাগে তমসাচ্ছন্ন করে দেবেন তাতে আর বিচিত্র কী? সেকুরিটি কৌনসিল প্রসঙ্গে পূর্বেই নিবেদন করেছি, রুশ প্রতিনিধি ফেদেরেনকো ইজরাএলকে সফিস্ট আখ্যা দিতে চেয়েছিলেন। সোকরাতেস এইসব সফিস্টুদেরই নগরীর মুক্ত হট্টে বাক্যেতর্কে নিত্য নিত্য অম্লত পান করাতেন। তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন অত্যাশ্চর্য অবিস্মরণীয় হলেও সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য নয়।

কিন্তু একবস্ত্রা যাজ্ঞসেনী আত্মসমর্থন হেতু দুর্যোধনের সভামধ্যে যে যুক্তিজাল বিস্তার করে কতিপয় সূচ্যগ্র তীক্ষ্ণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন তার সম্মুখে তদানীন্তন ভারতের গুণীজ্ঞানী শূরবীর সমন্বিত সর্ববৃহৎ সভা নিরঙ্কুশ নিরুত্তর। অসূর্যম্পশ্যা কৃষ্ণা যে আইনকানুন প্রোটকল সম্বন্ধে কতখানি অনভিজ্ঞা ছিলেন তা তাঁর সভা মধ্যে রোদনের সময়ই ধরা পড়ছে : হায়, আমি স্বয়ংবরকালে রঙ্গমধ্যে ক্রমাগত ভূপালগণের নেত্রপথে একবার নিপাতিত হইয়াছিলাম, ইতোপূর্বে যাহারা আর আমাকে দেখেন নাই, এক্ষণে আমি তাহাদেরই সম্মুখে সভামধ্যে উপস্থিত হইয়াছি, যাহাকে পূর্বে গৃহমধ্যে বায়ু ও আদিত্য পর্যন্ত দেখিতে পান নাই… (আমরা বলি) তিনি যে সোরাতেসের মতো সেকালের কোনও প্রটো-আকাডেমির সদস্য ছিলেন না অথবা ডক্টরেট অব জুরিসপ্রুডেন্স পাস করেননি সে বাবদে আমরা স্থিরনিশ্চয়, দৃঢ়প্রত্যয়। তাই পাঞ্চালীর ডিফেন্স আমাদের কাছে ঘূতলবণতৈলতণ্ডুলবস্ত্রইন্ধনসমস্যাহীন কলিকাতা মহানগরীর মতো সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

এ যেন সেকুরিটি কৌনসিলের ঠিক উল্টো পিঠ। হেথায় তাবৎ সভা কা কা রবে চিৎকার করছে কিন্তু ডিসটিংগুইশ ইজরাএল প্রতিনিধি নিপ, নীরব। অথচ তার জিভে ফোস্কা পড়েনি, তার টনসিলে বাত হয়নি। সভায় ৯৫ নয়াপয়সা মেম্বর কোনও প্রোটকল খুঁজে পাচ্ছেন না যেটা গজাঙ্কুশের মতো প্রয়োগ করে ইজরাএলের দাঁতকপাটি খুলতে পারেন।

আর হেথায় দ্রুপদতনয়া বারবার একটিমাত্র প্রশ্ন জিগ্যেস করছেন, ধর্মরাজ দূতক্রীড়ায় অগ্রে আমাকে কি নিজেকে বিসর্জন করেছেন? (ইজরাএলকেও মাত্র একটি প্রশ্ন জিগ্যেস করা হয়েছিল ইজরাএলি বাহিনী এখন কোথায়?) যুক্তিটি অতি সুস্পষ্ট। ধর্মরাজ যদি নিজেকে স্টেক করে আগেভাগেই খুইয়ে ফেলে দুর্যোধনের দাস হয়ে গিয়ে থাকেন তবে যেহেতু দাসের কোনও সম্পত্তিতে অধিকার থাকতে পারে না অতএব দাস যুধিষ্ঠির কৃষ্ণাকে স্টে করতে পারেন না (দাস হবার পূর্বেও তিনি মাত্র ২০% মালিক কিন্তু এ লপইনট বোধহয় তখন ওঠেনি।(১)

তা সে যা-ই হোক, ওই একটিমাত্র প্রশ্নের উত্তরই তিনি পাচ্ছেন না। এবং হা অদৃষ্ট! কোনও প্রোটকলও খুঁজে পাচ্ছেন না যার চাপে তিনি সভাসদদের মুখ খোলাতে পারেন। বরঞ্চ ভীষ্ম যে প্রোটকল উত্থাপিত করলেন তার মোদ্দা : ডিসটিংগুইশট দ্রুপদতনয়া তাদের প্রশ্ন শুধিয়েছেন (ইংরেজিতে এস্থলে বলে বার্কিং আপ দি রং ট্রি)। তার উচিত তার স্বামী ধর্মরাজকে এ প্রশ্ন জিগ্যেস করা। তিনিই বলতে পারেন, কৃষ্ণা জিতা বা অজিতা!

কিন্তু বিদুর যে জিনিসের আশ্রয় নিলেন, সেটাকে প্রিসিডেনস, নজির বা হদিস বলা যেতে পারে, ঠিক প্রোটকল নয়। তাঁর মতে মহর্ষি কশ্যপ দৈত্যকুলের প্রহ্লাদকে অনুশাসন দেন হে প্রহ্লাদ, যে ব্যক্তি জানিয়া শুনিয়াও প্রশ্নের প্রত্যুত্তর না দেয় এবং যে সাক্ষী মিথ্যা সাক্ষ্য দান করে তাহারা সহস্ৰ সংখ্যক বারুণ-পাশ দ্বারা বন্ধন পায়।(২) অর্থাৎ silence সর্বাবস্থায় golden নয় (অবশ্য এস্থলে gold is silent, কারণ সভাসদদের আর সকলেই দুর্যোধনের gold 60161 silent!)

কিন্তু এ নজির ধোপে টিকল না। মহাভারতকার বলছেন, বিদুরের বাক্য কর্ণগোচর করিয়া সভাস্থ পার্থিবরা কিছুই প্রত্যুত্তর করিলেন না!!!

কিন্তু এ সব চুলচেরা বাগ্‌বিতণ্ডার মূলে কে?

দ্রৌপদী যে প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন সেটা তো কেউ সেকেন্ড করবে। নইলে সেটা উলট্রা ভিরেস, নাকচ।

নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে সেকেন্ড করে বসল দুর্যোধনের ছোট ভাই চ্যাংড়া অর্বাচীন বিকর্ণ! তিনি স্পষ্ট গলায় বললেন, যাজ্ঞসেনী যাহা কহিয়াছেন কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, ইহারা আসিয়া এ বিষয়ে কিছু বলুন। তার পর তিনি যখন দেখলেন সভাসদবর্গের কোনও ব্যক্তিই সাধু অসাধু কিছুই কহিলেন না তখন হস্তে হস্ত নিষ্পেষণ করিয়া নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে করিতে কহিতে লাগিলেন, অর্থাৎ অনেক যুক্তিতর্ক দেখিয়ে রায় দিলেন, এই সকল বিচার করিয়া দেখিলে দ্রৌপদীকে জয়লব্ধ বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না।

সর্বনাশ! আজকের দিনের ভাষায় বলতে গেলে এ যেন নিতান্ত চ্যাংড়া ঘানা বা মালি রাষ্ট্র সেকুরিটি কৌনসিলে বলে বসল, এই সকল বিচার করিয়া দেখিলে (অর্থাৎ যেহেতু ইজরাএলই প্রথম আক্রমণ করেছে) সাইনাইকে ইজরালের (প্রাচীন দিনের ভাষায় দুর্যোধনের) জয়লব্ধ বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না।

ধুন্ধুমার লেগে গেল সভায়, মহাভারতের ভাষায় সঙ্কলরবে (একসুরে) তুমুল নিনাদ উঠল সভাস্থলে। এখানে আমার বলা উচিত যে, বিদুরাদি কেউ কিছু বলার পূর্বেই বিকর্ণ আপন রায় দিয়ে বসে আছেন। তাঁর ভয় হয়েছিল, প্রবীণরা নীরবতা দিয়ে দ্রুপদনন্দিনীর প্রশ্নটি পিষে ফেলবেন– নীরবতা যে শুধুমাত্র হিরন্ময় তাই নয়, সরব প্রশ্নকে নিধন করার মারণাস্ত্রও বটে।

অনেকেই বিকর্ণের পক্ষে সায় দিচ্ছেন দেখে কর্ণ ফ্লর গ্রহণ করলেন। বললেন, হে বিকর্ণ, এই সভায় বহুবিধ বিকৃতি দৃষ্ট হইতেছে বটে।

আমরাও বলি, সেই কথাই কও। বিকৃতি মানে প্রোটকল-সম্মত নয়!

কর্ণ বললেন, তুমিই কেবল বালস্বভাবসুলভ অসহিষ্ণুতায় অধৈর্য হইয়া স্থবিরোচিত বাক্য প্রয়োগ করিতেছ। তুমি দুর্যোধনের কনিষ্ঠ, পর্ব বিষয়ে যথাবৎ অভিজ্ঞ হও নাই।

এইবারে কর্ণ মারলেন পেরেকটার ঠিক মাথার উপর মোক্ষম ঘা। এই পর্ব বস্তুটি কী? কারণ মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রের যে নির্ঘণ্ট আছে তার প্রথমটার মতে বিকর্ণের নম্বর আট, দ্বিতীয়টার মতে উনিশ।

আর পর্ব অর্থই হচ্ছে নির্দিষ্ট–আমাদের পরব মাত্রই হয় নির্দিষ্ট দিন ক্ষ্যাণে। তাই পর্বই হচ্ছে প্রোটকল। যা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, যার থেকে নড়চড় নেই। বিকর্ণ সেই প্রোটকল ভঙ্গ করেছেন। কিন্তু তার ও দ্রৌপদীর কার্যোদ্ধার অংশত হয়ে গেছে। ওদিকে আবার কর্ণ স্বয়ং করে বসেছেন প্রোটকলে গলদ!

কারণ সভারম্ভেই মি. প্রেসিডেন্ট দুর্যোধন প্রোটকল ধার্য করে দিয়েছেন– কর্ণ যাকে পর্ব বলেছেন যে, কৌরবগণ দ্রৌপদীর সমক্ষে তাহার প্রশ্নের উত্তর করুন। অর্থাৎ তিনি ফ্লর দিয়েছেন কুরু সদস্যদের। অপিচ কর্ণ আইনত (ডে জুরে) রথচালক শ্রেণির লোক– আজকের ভাষায় শোফার সর্দারজি ক্লাস (যদ্যপি প্রকৃতপক্ষে (ডে ফাটো) তিনি কুন্তীনন্দন প্রথম পাণ্ডব; কিন্তু সদস্যগণ সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বলে এ বিবেচনা এস্থলে উঠতে পারেনি, কস্মিনকালে ওঠেওনি]। তিনি ফ্লর গ্রহণ করতে পারেন না। তবে বিকর্ণ যে প্রোটকল ভঙ্গ করেছেন সেটা হয়তো তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন– কারণ পইন্ট অব্‌ অরডার সভাসীন যে কোনও সদস্য যে কোনও সময়ে তুলতে পারেন। কিন্তু তার পর কর্ণ যখন বললেন, দ্রৌপদী ও পাণ্ডবগণের যাহা কিছু আছে সে সমুদয়ই শকুনি ধর্মতঃ জয় করিয়াছেন তখন তিনি বিলকুল আউট অব্ প্রোটকল। কারণ প্রেসিডেন্ট রুলিং দিয়েছেন, উত্তর দেবেন কৌরবরা।

অতএব দ্রোণ যে ফ্লর গ্রহণ করেননি সেটাও অতিশয় করে। কারণ তিনি ও অন্যান্য কৌরবেররা অবগত আছেন ব্যাপারটা বহুলাংশে কুরু-পাণ্ডবের ঘরোয়া ব্যাপার। যে শকুনি সর্বস্ব জয়লাভ করেছেন তিনিও তার হক্কের দাবি করে ফ্লর চাননি।

বস্তুত সভাপতিরূপে ডিটিংগুইশ প্রেসিডেন্ট মি. দুর্যোধনের আচরণ অক্ষরে অক্ষরে প্রোটকলসম্মত। তিনি কুরুকুলকে ক্ষুর দিয়েছেন কিন্তু কি ভীষ্ম কি বিদুর কাউকে কিছু বলার জন্য কোনও চাপ দিচ্ছেন না।

অবশেষে তুমুল বাগ-বিতণ্ডার পর প্রেসিডেন্ট দুর্যোধন যখন স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে কুরুকুলের কেউই আপন সুচিন্তিত অভিমত দিচ্ছেন না, যাজ্ঞসেনী যে জিতা সে রায় দূরে থাক (কর্ণের রায়ের মূল্য নেই, এবং দুঃশাসন তখন প্রতিহারী বা বেলিফ বা সভার মারশাল; এবং তিনিও সুদ্ধমাত্র দ্রৌপদীকে অপমানার্থে দাসী দাসী বলে সম্বোধন করছেন, যুক্তিতর্ক দ্বারা শকুনির লিগেলরাইট প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেননি) তখন তিনি যে রুলিং দিলেন সেটাও অতিশয় ন্যায্য। তিনি জানতেন যে যদিও তিনি আইনত প্রেসিডেন্ট, তবুও এ তত্ত্ব অনস্বীকার্য যে কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম কুরুকুলের সর্বোচ্চ আসন ধরেন। তিনি যখন স্পষ্ট বলেছেন, স্বয়ং ধর্মরাজ এর মীমাংসা করুন তখন এ সিদ্ধান্ত এক হিসেবে তাবৎ কুরুবংশের সিদ্ধান্ত। এবং যেহেতু দুর্যোধন সভারম্ভেই বলেছেন কুরুকুল উত্তর দেবেন তখন যুক্তিযুক্তভাবেই শেষ উত্তর দিলেন, কুরুকুলের সিদ্ধান্ত; ধর্মরাজ উত্তর দেবেন। কিন্তু ধর্মরাজ যখন ফ্লর গ্রহণ করলেন না, তখন তিনি দ্রৌপদীকে বললেন, (ধর্মরাজ যখন ফ্লর নিচ্ছেন না তখন প্রোটকলানুযায়ী তাঁর কনিষ্ঠেরা ফ্লর পাবেন– হুবহু যেরকম অপর পক্ষে বিকর্ণ পেয়েছিলেন) হে যাজ্ঞসেনী, ভিম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবের মতই আমার মত।

এবং এঁরাও ফ্লর গ্রহণ করলেন না। অর্থাৎ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন না।

এখানেই সভা শেষ।

সম্পাদক মহাশয়, যতই চিন্তা করি, পুনরায় মহাভারত অধ্যয়ন করি, পুনরায় চিন্তা করি, তখন দেখি, সেই অতি প্রাচীনকালে আমরা কতখানি ন্যায়ধর্ম ও প্রোটকল মেনে সভা চালাতুম! যদি দুঃশাসনের অনার্য চরণের কথা তোলেন তবে বলব সেটা অবশ্যই নিন্দনীয়, দুর্যোধন কর্তৃক দ্রৌপদীকে উরুমধ্য প্রদর্শন অনুচিত কিন্তু সেগুলো ইনট্রিগেল পার্ট অব দি প্রসিডিংস অব দ্য মিটিং নয়, সভার কর্মসূচির অন্তর্গত অবর্জনীয় অংশ নয়। দুঃশাসন ও দুর্যোধন শুধু অতিশয় রূঢ় পদ্ধতিতে দেখাতে চেয়েছিলেন, তাঁদের মতে দ্রৌপদী জিতা। সভার কার্যকলাপে প্রোটকল আদৌ লাঞ্ছিত হননি।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, সম্পাদক মহাশয়, সে যুগে ফিলিমি ছিল না, তার মাসিক ছিল না, তস্য সম্পাদক ছিলেন না। কাজেই তাঁকে কীভাবে সম্বোধন করতে হয় সে-বাবদে কোনও প্রোটকল খুঁজে পেলুম না। তবু খুঁজছি, কারণ দুধ না পেলেও পিটুলি পাব নিশ্চয়ই!!

————

১. ইসলামে দাস যেমন আইনগত পূর্ণ নাগরিক নয় (সেখানেও সে কোনও কিছু স্টেক করতে পারে না) ঠিক তেমনি সে কোনও আইনভঙ্গ করলে (চুরি, ডাকাতি) তার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা হয় না। খেসারত দিতে হয় মুনিবকে।

২. জ্বর-জ্বালাদি রোগকেও পাশ বলে ধারণা করা হত বলে অথর্ববেদে ঋষি পাশমুক্তির জন্য বরুণদেবকে আহ্বান জানাতেন।

বিদ্রোহী

ইংরেজ কবি পারসি বিশ শেলির মধ্য-শব্দটি আমরা উচ্চারণ করতুম বিশী, কারণ অন্তে রয়েছে e অক্ষরটি এবং তাই আমরা বাল্যবয়সে শ্ৰীযুক্ত প্রমথনাথ বিশির সঙ্গে ইংরেজ কবি শেলির সাদৃশ্য দেখতে পেতুম। তিনি মোলায়েম প্রেমের কবিতা লিখতেন, কিন্তু ওদিকে তিনি আবার ছিলেন মাহমুদ বাদশার মতো প্রতিমা-বিনাশধর্মী– এ সংসারে যত প্রকারের false idols, false ideals, অন্ধবিশ্বাস, ভক্তিভরে কুমড়ো গড়াগড়ি, যা কিছু বুদ্ধিবৃত্তির ওপর নির্ভর করে না তার বিরুদ্ধে ছিল বিশীদার জিহাদ। তাই তিনি কবিতাগুলোকে পরাতেন প্রাচীন আসামের ছদ্মবেশ। নজরুল ইসলাম তখন সবে ধূমকেতুর মতো আত্মপ্রকাশ করেছেন। বিদ্রোহী কাজীকবি পরশুরাম হলে (ক্ষত্রিয়, ফিরিঙ্গি বিনাশার্থে তাঁর অবতরণ) প্রমথনাথ তাঁরই অনবচ্ছিন্ন পূর্ববর্তী বামনাবতার। তাই তিনি অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সেই হয়ে যান বারনারডশর প্রতি আসক্ত। এখানে আরও একটি সাদৃশ্য পাঠক পাবেন। বারনারডশ ছিলেন প্রতিমাবিনাশী। তার আদর্শ চরিত্র, সেই ব্ল্যাক গার্ল ওলড টেস্টামেনটের দেবতাগুলোকে তার ডাণ্ডা দিয়ে ক্রমাগত ভেঙে যাচ্ছে আর খুঁজে বেড়াচ্ছে শাশ্বত ভগবানকে।

প্রমথনাথ তাঁর ডাণ্ডা– নবকেরি নিয়ে আক্রমণ করতেন– প্রধানত বাঙালির জড়ত্বকে। শান্তিনিকেতন আশ্রমও রেহাই পেত না।

এটা এল কোথা থেকে!

আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের চতুর্দিকে যেসব অন্ধ-স্তাবকসম্প্রদায় রবীন্দ্রনাথকে প্রায় কর্তাভজাদের গুরুর আসনে বসাতে চাইতেন তার বিরুদ্ধে ছিল কিশোর প্রমথ-র ঘোরতর উম্মা। এদেরও ছাড়িয়ে যেতেন বাইরের থেকে প্রধানত কলকাতা থেকে আসতেন যেসব স্তাবক সম্প্রদায়। এঁদের কেউ কেউ বিলিতি ডিগ্রিধারী, জামাকাপড় চোস্তদুরুস্ত– কাঁধে ক্যামেরা ঝোলানো।

এদেরই মুখ দিয়ে ডি এল রায় বলিয়েছিলেন, কবিগুরুর উদ্দেশে :

মর্ত্যভূমে অবতীর্ণ কুইলের কলমফ হস্তে
কে তুমি হে মহাপ্রভু নমস্তে নমস্তে!

কিন্তু এর পরপরই রায় করলেন ভুল; রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে বললেন ঝুট কথা :

আমি একটা উচ্চ কবি, এমনিধারা উচ্চ,
শেলি ভিক্টোর য়ুগো মাইকেল আমার কাছে তুচ্ছ!

এরকম ধারণা রবীন্দ্রনাথ তো পোষণই করতেন না– বলা দূরে থাক। তিনি ছিলেন শেলির ভক্ত। বস্তুত তিনি বার বার আমাদের পড়িয়েছেন শেলির কবিতা। আমার বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথই বিশীদাকে শেলির প্রতি অনুরক্ত হবার পথ দেখিয়ে দেন।

বস্তুত রবীন্দ্রনাথ এই অন্ধ-স্তাবকদের নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। এবং তার ধৈর্যচ্যুতি যখন ঘটল তখন দুর্ভাগ্যক্রমে একাধিক সত্য গুণগ্রাহীকেও তাঁর কাছ থেকে অযথা কটুবাক্য শুনতে হল। ইরানি কবি তাই বলেছেন :

দাবানল যবে দগ্ধদাহনে বনস্পতিরে ধরে
শুষ্কপত্রে, আর্দ্রপত্রে তফাৎ কিছু না করে।

পাঠকের স্মরণে আসতে পারে রবীন্দ্রনাথের অপ্রিয় সত্যভাষণ– যখন তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষে কলকাতা থেকে বহুলোক শান্তিনিকেতনে এসে তাঁকে অভিনন্দন জানান। আমার যতদূর জানা, বালক প্রমথনাথ সে সভায় উপস্থিত ছিলেন।

কিন্তু এহ বাহ্য। অন্ধ-স্তাবকদের চিনতে আমাদের বেশি সময় লাগেনি। কারণ এদের কেউ কেউ বিশেষত বিলেতফের্তারা, শ-র ভাষায় উয়েল শেল্ড অ্যান্ড উয়েল সোপড়, আসতেন আমাদের মতো ডর্মিটারিবাসী নিরীহদের ওপর ফপরদালালি করতে। তখন অনেক ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে যেত, শব্দসমন্বয় দ্বারা যে আলিম্পন সৃষ্ট হয়ে লিরিক উচ্ছ্বসিত হয় সে রসে তাঁরা বঞ্চিত, রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুর এবং কথা কীরকম অদ্ভুত অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্টের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে অভূতপূর্ব সমন্বয়জনিত রসসৃষ্টি করেছে সে বিষয়ে পরিপূর্ণ জড়ভরত। এদের কেউ কেউ ছিলেন আবার পয়লা-নম্বরি ব্লাফমাস্টার। তিনি যে অন্ধস্তাবক নন সেইটে বোঝাবার জন্য একজন আমাকে বলেন, পুব হাওয়াতে দেয় দোলা, মরি মরি– এই মরি মরি টা কেমন যেন বস্তাপচা বলে মনে হয় না। আমি বিস্ময়ে নির্বাক। অতি মহৎ কবিই যে হ্যাঁকনিড ক্লিশের নতুন ব্যবহার করে নবীন রস সৃষ্টি করেন, এ তত্ত্বটা এই ফিরিঙ্গি-মার্কা এ্যাডুয়েট জানে না? আমার তো মনে হত, এস্থলে মরি মরি ভিন্ন অন্য কিছুই মানাত না।

কিন্তু বিশীদা ছিলেন কালাপাহাড়। আশ্রমের সে সময়কার ভাষায় এদের হুট করে দিতে তাকে অতিমাত্রায় বেগ পেতে হত না। তাঁকে দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হত আশ্রমের ভিতরকার অন্ধ-স্তাবকদের নিয়ে। বিশেষ করে বিচার-সভায় অর্থাৎ আশ্রম পরিচালনার ব্যাপার নিয়ে।

শান্তিনিকেতনের বয়স তখন কত? একুশ-বাইশের মতো। এত অল্প সময়ের মধ্যে কোনও ট্র্যাডিশন, ঐতিহ্য, আচার নির্মিত হতে পারে না। বিশেষত শুরু রবীন্দ্রনাথই করে যাচ্ছেন নানা প্রকারের এক্সপেরিমেন্ট। একবার ভেবে দেখলেই হয়, আশ্রম প্রবর্তনের সময় ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণে একই পঙক্তিতে ভোজন করত না, কিছুদিন পরে একজন কায়স্থ শিক্ষক আসছেন শুনে কর্তৃপক্ষ সন্ত্রস্ত, ব্রাহ্মণ শিষ্য এই ব্রাহ্মণ শুরুর পদধূলি প্রতি প্রাতে নেবে কি না! তারই পনেরো বছর পর আমি যখন পৌঁছলুম তখন সেসব সমস্যা অন্তর্ধান করেছে। ইতোমধ্যে মৌলানা শওকত আলী সাধারণ ভোজনালয়ে ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ ব্রাত্য সক্কলের সঙ্গে এই পঙক্তিতে ভোজন করে গেছেন।

তবু হিন্দু মন সর্বক্ষণ খুঁত খুঁত করে আচারের সন্ধানে। সে চায়, সর্ব সমস্যার সামনে সে যেন নজির দেখাতে পারে, এটা পূর্বে এরকম পদ্ধতিতে হয়েছে, অতএব এবারেও সেইরকম হওয়া উচিত– এটা এরকম হয়নি, অতএব এবারে হবে না; তাতে করে নবাগত ছাত্রের অসুবিধা হোক আর না-ই হোক। মুসলমান যে এ বাবদে দুর্দান্ত প্রগতিশীল তা নয়, সে-ও ইনোভেশনকে ডরায় এবং তাকে বলে বিদাৎ, কিন্তু ইসলাম মাত্র ১৩০০ বছর পুরনো বলে অতখানি লোকাচার দেশাচারের দোহাই দেয় না।

প্রমথনাথ বিশী ছিলেন এই ট্র্যাডিশন নামক প্রতিষ্ঠানটির দুশমন। বিচার সভা তথা অন্যান্য স্থলে তিনি প্রিসিডেনসের দোহাই শুনতে চাইতেন না। তাঁর বক্তব্য এবং সেটা সবসময়ই উত্তেজিত কণ্ঠে পঞ্চমে, তদুপরি তার কণ্ঠস্বরটি ঠিক আব্দুল করীম খানের মতো নয়– শুনে আমার মনে হত, তাঁর নীতি; নতুন সমস্যা যখন এসেছে তখন তার নতুন সমাধান খুঁজতে হবে এবং যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করে পূর্বে হয়নি, তাই এখন হবে না, এটা কোনও কাজের কথা নয়। অবশ্য তিনি যে সবসময় রেশনালিটি এবাভ অল সচেতনভাবে ভলতেরের মতো নীতিরূপে গ্রহণ করতেন তা না-ও হতে পারে।… এমনকি শুরু রবীন্দ্রনাথের মতের বিরোধিতাও তিনি করেছেন। এই নিয়ে বোধহয় গুরু-শিষ্যে মনোমালিন্যও হয়েছে। তবে নিশ্চয়ই চিরস্থায়ী তো নয়ই, দীর্ঘস্থায়ীও নয়।

প্রমথনাথ জাত সাহিত্যিক। শান্তিনিকেতনে যখন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কলেজ স্থাপিত হল– সাধারণ জন একেই বিশ্বভারতী বলে, যেন গোড়ার স্কুলটি বিশ্বভারতীর সোপান নয়– তখন রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রণ জানালেন বিশ্বাচার্যদের। তারা এসে পূর্ণোদ্যমে আরম্ভ করলেন, প্রধানত প্রাচ্যবিদ্যাচর্চা (এবং সর্বপ্রধানত ইন্ডলজি)– চীনা, তিব্বতি ভাষাও বাদ গেল না, এবং লাতিন, ফরাসি, জর্মন ইত্যাদি ইউরোপীয় ভাষাচর্চা। সবাই সেই দয়ে মজলেন। বাঘা বাঘা পণ্ডিত যেমন বিধু শাস্ত্রী, ক্ষিতি শাস্ত্রী, সাহিত্যিক অমিয় চক্র, এস্তেক ক্ষিতিমোহনের সহধর্মিণী ঠানদি– কেউ ফরাসি, কেউ জর্মন, কেউ চীনা, কেউ-বা তিব্বতি শিখছেন মাথায় গামছা বেঁধে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নোটবই হাতে নিয়ে লেভি-র ক্লাসে শিখছেন একাক্ষরপারমিতার ঠিকুজি আর অহিবুধনিয় সংহিতার কুলজি।

শুধু শ্রীপ্রমথ নিশ্চল নির্বিকার। তিনি বেঙ্গলি লিতেরাতোর পার একসেলাস (litterateur par excellence) বঙ্গসাহিত্যের একনিষ্ঠ সাধক। তার কোন প্রয়োজন, রজত কাঞ্চন? এমনকি সংস্কৃত ব্যাকরণ ঘটতেও তিনি নারাজ। হরিবাবু স্কুলে যেটুকু শিখিয়ে দিয়েছেন তারই প্রসাদাৎ তিনি কালিদাস শূদ্রক পড়ে নেবেনখন। শুনেছি, লক্ষৌয়ের খানদানি ঘরের ছেলেকে উর্দু ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা বলতে দেওয়া হয় না– পাছে বিজাতীয় ভাষা বলতে গিয়ে উর্দুর তরে বিধিনির্মিত তার মুখের ডৌল অন্য ধ্বনির খাতিরে এডজাসটেড হয়ে বিকৃত হয়ে যায়!

বিশ্বভারতীর উত্তর-বিভাগকে (কলেজকে) এহেন নিরঙ্কুশ বয়কট করার পিছনে বিশীদার হৃৎ-করে সেই বিদ্রোহ ভাব ছিল কি না হলফ করে বলতে পারব না।

কিন্তু বিএ এমএ তো পাস করতে হয়; নইলে গ্রাসাচ্ছাদন হবে কী প্রকারে?

অতিশয় অনিচ্ছায় তিনি কলকাতার কলেজে ঢুকলেন। তাঁর কলেজ-জীবন সম্বন্ধে আমি বিন্দুবিসর্গ পর্যন্ত জানিনে। এই মর্মান্তিক অধ্যায় তিনি বোধহয় তার জীবন-পুঁথি থেকে ছিঁড়ে ফেলেছেন। তবে আমি নিঃসন্দেহ, প্রসি-প্রতিষ্ঠান-প্রসাদাৎ তিনি তাঁর কলেজ-জীবনের ন-সিকে কাটিয়েছেন চায়ের দোকানে, মেসের রকে এবং ইহলোক পরলোকের সর্ববিশ্ববিদ্যালয়কে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ্য অভিসম্পাত অনবরত দিতে দিতে। এবং আমি তার চেয়েও নিঃসন্দেহ, এমএস পাস করার পর তিনি বঙ্গভাষাসাহিত্য ও তজ্জড়িত তত্ত্ব ও তথ্য ব্যতিরেকে বিশ্ববিদ্যালয়র্জিত সাতিশয় বিতৃষ্ণা ও চরম জুগুপ্সাসহ অর্জিত জ্ঞানগম্যি শেষনাগের মতো, প্রাগুক্ত অহিবুধনিয় সংহিতায় অহির বাৎসরিক কবর্জনন্যায় অক্লেশে পরম পরিতোষ সহকারে ত্যাগ করেছেন চিরকালের তরে। লোকে যখন শুধোয়, কালচার কী– উত্তরে গুণীজন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়লব্ধ জ্ঞানগম্যি বিস্মৃত হওয়ার পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে সেই কালচার। কিন্তু, প্রমথনাথের কালচার অত্যন্ত কনসানট্রেটেড নির্যাসেরও নির্যাস। মাত্র একবার, তা-ও অযত্নে ডেসটিল করা গৌড়ি (rum) বা মধ্বী (mead, meth) খেয়েই মানুষ হয় গড়াগড়ি দেয় নয় ল্যাম্পপোস্ট ধরে চুমো খায়– যেন লঙ লসট ব্রাদার। রাজা জহানগির খেতেন ডবল ডেসটি এরেক। প্রমথনাথের ব্রুয়ারিতে পাক বড় কড়া–শতগুণে কড়া।

কিন্তু সেই বিদ্রোহীর কী হয়?

শ-র কৃষ্ণাও একদিন হৃদয়ঙ্গম করল, এলোপাতাড়ি লাঠির বাড়ি ধুপুস-ধাপুস মারাতে কোনও তত্ত্ব নেই। নিছক বর্বরস্য শক্তিক্ষয়। প্রমথ তাই প্রমথেশের মতো ধ্যানতাণ্ডবে সম্মেলন করেছেন।

কিন্তু বিদ্রোহী থাকবেই।

কেন?

প্রমথের প্রিয় কবি শেলি। তাঁর প্রিয় এবং শ্রেষ্ঠ নায়ক প্রমিথিয়স অনবাউন্ড। তিনি দেবাদিদেব দ্যোঃ পিতর, জুপিটারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বর্গলোক হতে অগ্নি নিয়ে এসে মানবসন্তানকে উপহার দেন– যার জন্য তাবৎ সভ্যতাসংস্কৃতির সৃষ্টি। প্রমথগণ ধূর্জটির অনুচর বা ইয়েস-মেন বটেন কিন্তু প্রমথগণ অগ্নিবাহ রূপেও পরিচিত– এঁরা মরীচির পুত্র ও সপ্ত পিতৃগণের প্রমথ। তা প্রমথ অগ্নির পুত্র। অপরঞ্চ গ্রিক পুরাণে আছে প্রমিথিয়ুস নলের (reed–এবং স্যাকরারা এখনও নল ব্যবহার করে, তথা অগ্ন্যস্ত্র অর্থে নালাস্ত্র, নালিকও ব্যবহৃত হয়) মাধ্যমে পৃথিবীতে অগ্নি আনয়ন করেন। এবং আমাদের কাহিনীতে আছে, নলরাজ ইন্ধন প্রজ্বালনে সুচতুর ছিলেন।(১) এবং এই নলের বিরুদ্ধে দেবতারা যেরকম লেগেছিলেন (প্রমিথিয়ুসের বিরুদ্ধে জুপিটার) অন্য কারও বিরুদ্ধে না; আমার পুরাণাদির জ্ঞান অতিশয় সীমাবদ্ধ, তাই শপথ দিতে পারছি না, অন্য কোনও মানবীর স্বয়ংবরে স্বয়ং দেবতারা সপত্নরূপে অবতরণ করেছিলেন কি না–দময়ন্তীর বেলা যেরকম করেছিলেন। এবং নলের অন্য নাম প্রমন্থ।(২)

প্রাচীন গ্রিকেরা প্রমিথিউস শব্দের অর্থ করতেন : পূর্বে (প্র)+ মতি, চিন্তাকারী (methe), কিন্তু অধ্যাপককুল প্রমিথিয়ুস নিয়েছেন সংস্কৃত প্রমন্থ= অরণি বা সমিধ অর্থে; যে দণ্ড মন্থন, ঘর্ষণ করে অগ্নি জ্বালানো হয়। দ্বিতীয়টিই শুদ্ধ। কারণ– metheus থেকে মথ, মন্থ। নইলে th=থ-এর অর্থ হয় না।

প্রমিথিয়ুস, নল– প্রমথ কখনও বিদ্রোহ করেন, কখনও বশ্যতা স্বীকার করেন। আমাদের প্রমথ শেষ পর্যন্ত কী করেন তার জন্য অত্যধিক অসহিষ্ণু না হয়ে বলি–

শতং জীব, সহস্ৰহং জীব।

———-

১. তিনি (নল) এক মুষ্টি তৃণ গ্রহণপূর্বক সূর্যদেবকে ধ্যান করিবামাত্র ওই তৃণে সহসা হুতাশন প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। দময়ন্তী সকাশে সৈরিন্ধ্রী কেশিনীর প্রতিবেদন। বনপর্ব।

২. এ তত্ত্বটি আমার গুরু আমাকে বলেন, কিন্তু আমি এটি কোথাও পাইনি। কেউ জানাতে পারলে বাধিত হব।

বিষবৃক্ষ

নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমাকে কিছু ব্যক্তিগত কথা বলতে হচ্ছে। আমি খবরের কাগজের সম্মানিত রিপটার নই। তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টা, যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক (ইপাসনাল) ভাবে আপন বয়ান পাঠকের সম্মুখে পেশ করা। তৎসত্ত্বেও তারা মাঝে মাঝে কটুবাক্য শুনতে পান। পাঠকসাধারণ ভুলে যান, রিপটারও মাটির মানুষ, তারও ধর্মবুদ্ধি আছে, সে-ও অন্যায়-অবিচারের সামনে কখনও কখনও আত্মসংযম না করতে পেরে উত্তেজিত ভাষা ব্যবহার করে। ফলে কখনও-বা কটুবাক্য শুনতে হয়, কখনও-বা হাততালিও পেয়ে যায়। প্রকৃত রিপটার অবশ্য কোনওটারই তোয়াক্কা করে না। সে আত্মপ্রসাদ অনুভব করে যদি দেখে যে, সে নির্ভয়ে সত্য প্রকাশ করতে পেরেছে।

রিপরটার হওয়ার মতো শক্তি আমার নেই। তদুপরি দৈনন্দিন যেসব ঘটনা রিপরুটেড হচ্ছে, তার যদি কোনও ঐতিহাসিক মূল্য না থাকে, সে যদি আমাকে মানবসমাজের পতন উত্থান সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ চিন্তার খোরাক না যোগায় তবে সে জিনিসের প্রতি আপনার-আমার মতো সাধারণজনের চিত্ত আকর্ষিত হয় না।

যেমন ধরুন আরব-ইজরাএল দ্বন্দ্ব। কথার কথা কইছি, কাল যদি মার্কিন, ইংরেজ, ফরাসি, রুশ সবাই একজোট হয়ে একটা সমাধান করে দেন যার চেষ্টা এখন প্রতিদিনই হচ্ছে– তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, উভয় পক্ষই যখন শান্ত হয়ে গেছেন তখন আমরাও নিশ্চিন্ত মনে আর পাঁচটা খবরের দিকে নজর বুলাই। আর রিপরটারদের তো কথাই নেই। দুই প্রতিবেশী শান্তিতে আছে– এটা খবর নয়। দুই প্রতিবেশীতে খুনোখুনি হচ্ছে সেটা খবর। সংবাদ-সরবরাহ-ভুবনের আপ্তবাক্য- কুকুর মানুষকে কামড়ালে সেটা খবর নয়, মানুষ কুকুরকে কামড়ালে সেটা খবর।

অথচ আমি বিলক্ষণ জানি, আরব-ইজরাএল সমস্যার প্রকৃত সমাধান যে কী, তার সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি। নাসির বলছেন, আমি ইজরাএলকে সমূলে উৎপাটন করব। ওদিকে ইজরাএল যেটুকু জমির উপর এখন রাজ করছেন তা নিয়ে যে তিনি একদম সন্তুষ্ট নন, সেকথাও তিনি গোপন রাখেন না। অ্যানটনি ইডন-এর গোঁয়ার অভিযানের ফলে যখন ইজরাএল সৈন্য সবলে মিশরের সাইনাই (সিনাই, আরবিতে(১) সিনিন, সিনা) অধিকার করে তখন আনন্দে উল্লাসে কম্পিত, ভাবাবেগ দমনে অশক্ত ইজরাএল-প্রধান বেন গুরিয়ন যাজকসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেন তার অর্থ, আমরা আমাদের ন্যায্য ভূমি অধিকার করেছি, এ ভূমি আমরা আর কখনও পরিত্যাগ করব না। তাঁকে পরিত্যাগ করতে হয়েছিল (এবং আজ সেখানে পুনরায় দুই দল সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু তার বাক্যের প্রথমার্ধ, অর্থাৎ সাইনাই ইজরাএলের প্রাপ্য, এটা ইজরাএল-দৃষ্টিবিন্দু থেকে সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। রাজা সলমনের (আরবিতে সুলেমান) আমলে ইহুদি রাজত্ব কতখানি বিস্তৃত ছিল সেটা পাঠক বাইবেলের পিছনে যে প্রাচীন যুগের ম্যাপ দেওয়া থাকে সেইটে দেখলেই কিছুটা বুঝতে পারবেন। আজ তার বৃহৎ অংশ লেবানন, সিরিয়া, জর্ডন, মিশরের দখলে। কিন্তু হায়, বিশ্বের আদালত ইজরাএলের আড়াই হাজার বছরের তামাদি এ দাবি মানবে না। প্রায় দু হাজার বছর ধরে ইহুদিরা তাদের পুণ্যভূমি প্যালেস্টাইন ত্যাগ করে দলে দলে সেই সুদূর রুশ দেশ থেকে আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু একথাও সত্য, ইহুদিদের যাজক-সম্প্রদায় কখনওই আপন পুণ্যভূমিতে ফিরে যাবার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি। কারণ, স্বয়ং ইহুদির সদাজাগ্রত প্রভু য়াহবে ধর্মগ্রন্থ তোরাতে প্রতিজ্ঞা করেছেন, আমি তোমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব, সেই দুগ্ধ-মধুর দেশে। এ স্বপ্ন বাস্তবে দানা বাঁধতে আরম্ভ করে প্রধানত ঊনবিংশ শতাব্দীতে এরই নাম জায়োনিজম এবং এর প্রধান কেন্দ্র ছিল জরমনিতে। মহাকবি হাইনে কিছুদিন বারলিনে এ আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন কিন্তু পরে সেটা ত্যাগ করেন; বস্তৃত জায়োনিজমের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই একদল শক্তিশালী ইহুদি এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তাঁদের বক্তব্য ছিল : প্যালেস্টাইনে স্বাধীন ইহুদি রাজ্য নির্মাণের প্রস্তাব দূরে থাক, সেখানে ইহুদিদের জন্য কোনও ধরনেরই খাস ন্যাশনাল হোম করা হবে ভুল। কারণ সে দেশ ছেড়েছি আমরা দু হাজার বছর পূর্বে, এখন (১৯/২০ শতাব্দীতে) সেখানে শতকরা দশজন ইহুদিও বাস করে না, বাদবাকি শতকরা ৭০/৮০ মুসলমান, ১৫/২০ খ্রিস্টান (হিসাবটা খুবই মোটামুটি, কারণ সে যুগে এ অঞ্চলের তুর্কি শাসনকর্তারা আদমশুমারিতে বিশ্বাস করতেন না। এখানে শত শত বছর ধরে বাস করছে (এবং এঁরা না বললেও আমরা জানি, এই মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের অনেকেই গোড়াতে ইহুদি ছিল, পরে ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান-খ্রিস্টান হয়। প্রভু যিশু স্বয়ং ইহুদি ছিলেন এবং তিনি যাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দেন তার ৯৯% ছিলেন জাত-ইহুদি। পরবর্তী যুগে এঁদের অনেকেই হয়ে যান মুসলমান)। এঁদের অধিকাংশই চাষা, জেলে। এদের ভিটেমাটি কেড়ে না নিয়ে নবাগত ইহুদিদের বসাবে কোথায়?… তার চেয়ে বহুতর গুণে কাম্য আমরা, ইহুদিরা, যেন যেসব দেশে বাস করি সেইসব দেশের পূর্ণ নাগরিক হয়ে যাই। আমার যতদূর মনে পড়ছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন লয়েড জরজ ইহুদির জন্য ন্যাশনাল হোমের খসড়া বানাচ্ছেন তখন ভারত-খ্যাত ইহুদি (?) মনটাগু এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং বার বার বলেন, এতে করে আখেরে ইহুদিকুলের অমঙ্গল হবে।

কিন্তু যুক্তিতর্ক এক জিনিস আর অনাগত যুগের সুখস্বপ্ন দেখা অন্য বিলাস। রাজকুমারী মীরাকে রাজসভার গুণীজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই অত্যুত্তমরূপে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, বৃন্দাবনের পেভমেন্ট(!) সোনা দিয়ে গড়া নয়, যদ্যপি বর্ষারম্ভে মেঘাগমনে তথাকার আকাশ মেদুর হয় অতি অবশ্য, ঘন তমালমরাজি জনপদভূমিকে শ্যামল করে রাখে নিঃসন্দেহেই, কিন্তু সেস্থলে বিষধর সর্পও ঠিক ওই সময়েই গোপগোপীদের প্রাণহরণ করে, তদুপরি– তদুপরি নিশ্চয়ই সভাসদরা বিস্তর অকাট্য যুক্তিতর্ক দ্বারা সপ্রমাণ করেছিলেন যে, ওই সাতিশয় অগণ্ডগ্রাম রাজকন্যার বাসভূমি হওয়ার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত, তথাপি তিনি স্বপ্ন দেখছেন,

চাকর রহসু বাগ লাগাসু
নিতি উঠি দরশন্ পাসুঁ
বৃন্দাবনকে কুঞ্জগলিমে
তেরি লীলা গাসুঁ!

পিস্তলের বুলেট দিয়ে যেরকম ভূত মারা যায় না, যুক্তিতর্কের খাণ্ডার দিয়েও সুখস্বপ্ন খণ্ডবিখণ্ড করা যায় না।

স্বপ্ন দিয়ে তৈরি আর স্মৃতি দিয়ে গড়া মেলা ঝামেলার ভিতর রিপটার অনুপ্রবেশ করে খামখা হয়রান হতে চান না তাই বলেছিলুম, আমি রিপটার নই, হবার মতো এলেম ও হক্কও আমার নেই।

কিন্তু সেই ১৯২৯ থেকে আমি গণ্ডায় গণ্ডায় ইহুদিদের সংস্পর্শে এসেছি। বোম্বাই অঞ্চলে শনিবারের তিলি নামে পরিচিত এদেশে অতি প্রাচীনকালে আগত ইহুদিদের সঙ্গে আমি বাস করেছি (ব্যক্তিগতভাবে আমি এঁদেরই ইহজগতের সর্বোত্তম ইহুদি বলে মনে করি), দিগ্বিজয়ী ইহুদি পণ্ডিতের কাছে হিব্রু শেখার নিষ্ফল প্রচেষ্টা আমি দিয়েছি (দোষ রাব্বির নয়, আমার) ইহুদির (তথা খ্রিস্টান ও মুসলমানেরও) পুণ্যভূমিতে আমি বাস করেছি, জরডনের পাক পানিতে ওজু করেছি, গ্যালিলীয় হ্রদের অতিশয় সুস্বাদু মৎস্য আমি দিনের পর দিন দু বেলা পরম তৃপ্তি সহকারে ভক্ষণ করেছি, বস্তুত প্যালেস্টাইনের উত্তরতম সীমান্ত থেকে যেখানে সিরিয়া আজ সৈন্য সমাবেশ করেছে দক্ষিণতম সীমান্ত গিজা অবধি, তথা পূর্বতম সীমান্ত (ট্র্যান্স) জরডন থেকে পশ্চিমতম সীমান্তের খাস ইহুদি নগরী তেলআবিব (বসগিরি) পর্যন্ত অবাধে যাতায়াত করেছি।

***

পরম পরিতাপের বিষয় উপরের ছত্রের কালি শুকোতে না শুকোতে মর্মান্তিক দুঃসংবাদ এসেছে যে, আরবে-ইহুদিতে কোনওপ্রকারের সমঝতা সম্ভবপর হল না বলে সশস্ত্র যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।

এ দুঃসংবাদের পর বিমূঢ় মূহ্যমান হয়ে আমার এ অক্ষম লেখনী আর এগোতে চায় না।

যদি ইজরাএল হারে তবে তার তিনদিকের আরব বেদুইন ও বাস্তুহারা আরব (প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার) যারা জরডন অঞ্চলে কেউ কুড়ি বছর ধরে, কেউ-বা এগারো বছর ধরে তাঁবুতে তাঁবুতে দুঃখদৈন্যের জীবন কাটাতে কাটাতে এই মহালগ্নের অপেক্ষা করছিল তারা পঙ্গপালের মতো সমস্ত ইজরাএলে ছেয়ে পড়ে বালবৃদ্ধনারী কাউকে নিষ্কৃতি দেবে না। হিটলারকে ছাড়িয়ে যাবে।

আর সম্মিলিত আরব জাতিপুঞ্জ যদি হেরে যায় তবে তাদের সে অবমাননা ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও তাদের সে অবমাননা, তাদের আত্মসম্মানবোধের পরিপূর্ণ পদদলিত বিনাশ তাদের করে তুলবে নিষ্ঠুরের চেয়েও নিষ্ঠুর, সর্বনেশে ভবিষ্যতের প্রতিশোধকারী জিঘাংসু জীবন্ত প্রেতাত্মার মতো।

মধ্যযুগের সেই নির্মম ক্রুসেডের মতো এর প্রস্তুতি চলবে পুনরায় শত বছর ধরে, পরিণাম হবে শত শত বর্ষব্যাপী।

প্রথম লেখনেই আরম্ভ করেছিলুম এই বলে যে, এ তো শুধু অবতরণিকা। মনে মনে দুরাশা করেছিলুম, এই বিষবৃক্ষের চারাটাকে বিশ্বমানবের শুভবুদ্ধি হয়তো-বা উৎপাটিত করে দেবে; এখন দেখছি, এই শিশু বিষবৃক্ষ মহীরুহ হয়ে উঠবে একদিন শত শত বছর ধরে এ বিষবৃক্ষ পাবে উভয়পক্ষের ক্রোধোন্মত্ত প্রতিশোধ কামনার অপবিত্র শূকররক্তের উর্বরতাদায়ক খাদ্যনিষ্কর্য।

এ বিষবৃক্ষকে তখন আর সমূলে উৎপাটিত করা যাবে না।

যদি যায়, কিংবা বিধির আদেশে কোনও দৈবাগত ঝঞ্ঝায় সে ভূপাতিত হয় তবে সে মৃত্যুবরণ করার পূর্বে সঙ্গে নিয়ে যাবে অসংখ্য নরনারী বালবৃদ্ধকে নিষ্পিষ্ট করে তাদের প্রাণবায়ু ॥

আরব-ইজরাএল যুদ্ধারম্ভ দিবস।

————

১. ইহুদি আরব উভয়ের কাছেই এ গিরি পূতপবিত্র। কুরানশরীফে আল্লাতালা এর নাম নিয়ে শপথ গ্রহণ করেছেন। ৯৫ সুরা, ২য় ছত্র।

ভঙ্গ বনাম কুলীন

যে ভাষার প্রশংসায় এক শ্রেণির মহাজন অধুনা পঞ্চমুখ সেই ভাষায় একটি প্রবাদ আছে : হে গভীর-সংকট-সঙ্কুল-অরণ্যের-পথভ্রান্ত-পথিক, অরণ্য ভেদ করে জনপদে না পৌঁছবার পূর্বে হর্ষধ্বনি করো না। অধম আপ্তবাক্যটি বিস্মরণ করে হর্ষোল্লাস করে বসেছি, এমন সময় দেখি, আমি গভীরতম অরণ্যে। সেই শ্রেণির সজ্জনগণ এখন আরও প্রাণপণ লড়াই দিচ্ছেন, ইংরেজি যেন সর্বাবস্থায় কলেজাদিতে শিক্ষার মাধ্যমরূপে বিরাজমান থাকে। বোধহয়, অধুনা শিক্ষামন্ত্রী যে প্রাদেশিক ভারতীয় ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করে ফেলবেন বলে মনস্থির করে বসেছেন, এ সংবাদ এঁদের বিচলিত করেছে।

এই শ্রেণির একাংশ কোনও তর্কাতর্কি না করে তারস্বরে ইংরেজি ভাষাসাহিত্য ও তার প্রসাদগুণ কীর্তন করেন। সে কীর্তনের ঢঙটি বড়ই মজাদার। সর্বপ্রথম তারা বলেন, যারা বাংলা বা অন্য কোনও ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে চান তারা অজ্ঞ; তাঁরা ভাষাতত্ত্বের মূল নীতিই জানেন না। যেহেতু এদের প্রবন্ধাদি ও ইংরেজি কাগজে ছাপা চিঠিতে এঁদের নাম থাকে তাই প্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগে, এঁরা বুঝি সুনীতি চাটুয্যের গুরুসম্প্রদায়। কারণ এনারা যখন বলেন, আমরা লিনুগুইসটিকস জানি না, তখন আমরা ধরে নিই, আমরা জানি আর না-ই জানি, তেনারা অতি অবশ্যই জানেন। এবং লিনগুইটিক্স তো আর মাত্র একটি বা দুটি ভাষা শিখেই আয়ত্ত করা যায় না–অতএব এঁরা নিশ্চয়ই এন্তের, বিশেষ করে ইয়োরোপীয় ভাষা, বিলক্ষণ রপ্ত করার পর আমাদের অজ্ঞ বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছেন। কিন্তু কই, এঁদের নাম তো ভাষাবিদ পণ্ডিতদের নাম করার সময় কেউ বলে না। এঁরা তা হলে নিশ্চয়ই ইংরেজ কবির আদেশানুযায়ীতে

অসংখ্য রতনরাজি বিমল উজল
খনির তিমির গর্ভে রয়েছে গভীরে।
বিজনে ফুটিয়া কত কুসুমের দল।
বিফলে সৌরভ ঢালে মরুর সমীরে ॥

বিফলে নয় বিফলে নয়– আমরা সন্ধান পেয়ে গিয়েছি। এবং চুপি চুপি বলছি, তারা যে-প্রকারের ঢক্কানিনাদ করছেন তার থেকে সন্দ হয়, তাঁরাও নিঃসন্দেহ ছিলেন, আবিষ্কৃত হবেনই।

আইস সুশীল পাঠক, এবারে আমরা সেইসব জেদের জলুস দেখে হতবাক হই (ইংরেজিতে অবশ্য জে বক্রোক্তিতে ব্যবহার হয়; যেমন কেউ যখন বলে, এই প্রেশাস জেমটি তুমি পেলে কোথায়? তখন তার অর্থ এই আকাট পণ্টকটিকে তুমি আবিষ্কার করলে কোত্থেকে? আমি কিন্তু, দোহাই ধর্মের, সেভাবে বলছিনে), এদের সৌরভ শুঁকে কৃতকৃতার্থ হই।

কেউ কেউ বলেন, বহু শতাব্দীর ভিতর দিয়ে ইংরেজি ভাষার বৃদ্ধি (গ্রোথ) অধ্যয়ন করলে রোমাঞ্চ হয় (এ থ্রিলিং স্টাডি)! অবশ্যই হয়! আমরা শুধোব, কোন ভাষার ক্রমবৃদ্ধির ইতিহাস পড়লে রোমাঞ্চ হয় না? তবে ইংরেজির বেলা একটু বেশি হয়। কেন বেশি হয়? এই সম্প্রদায় বলেন, ইংরেজি তার শব্দসম্পদ আহরণ করেছে অন্যান্য বহু ভাষা থেকে যেমন লাতিন, গ্রিক, ফরাসি, হিব্রু, আরবি, হাঙ্গেরিয়ান, চীনা– এস্তেক হিন্দি-বাংলা থেকে তবেই নাকি সম্ভব হয়েছে, এদের মতানুসারে– শেক্সপিয়ার, মিলটন, ওয়ারওয়ার, টেনিসন ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিস্তর ভাষা থেকে এন্তের শব্দ নিয়েছে বলে ইংরেজিতে অত-শত উত্তম কবি– এ সিদ্ধান্তটি পরে আলোচনা করা যাবে।

এই যে থ্রিলিং স্টাডি সেটা সম্ভব হয়েছে ইংরেজি অন্যান্য থেকে বিস্তর শব্দ নিয়েছে বলে। সাধু প্রস্তাব!… এস্থলে আমরা তা হলে এ তথ্যের আরেকটু পিছনে যাই– যথা, ইংরেজি অত বিদেশি শব্দ নিল কোথায়, কেন, কী প্রকারে? আমি কথা দিচ্ছি। এটা আরও থ্রিলিং হবে।

১. কোনও দেশ পরাধীন হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তার ভাষাও পরাধীন হয়ে যায়। নরমান বিজয়ের পর ইংরেজি যে প্রায় তিনশো বছর অবহেলিত অপাঙক্তেয় ছিল সেকথা পূর্বেই বলেছি। এস্থলে বিজয়ী জাত যদি শিক্ষা-দীক্ষা-সভ্যতায় বিজিত জাতের চেয়ে সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ হয় তবে বিজিত ভাষা ক্রমে ক্রমে বিদেশি ভাষার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে যায়। তাই আজও ইংরেজ সবচেয়ে বেশি ঋণী ফরাসির কাছে। এমনকি, যেসব গ্রিক-লাতিন শব্দ নিয়েছে তার চোদ্দ আনা ফরাসির মারফত।

হুবহু এই ঘটেছিল ইরানে, সে দেশে আরব বিজয়ের ফলে। তাদের শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যম হুবহু তিনশো বছর ছিল আরবি। সে ভাষার প্রভাব ফারসির ওপর এতই প্রচণ্ড যে, আজ আরবি শব্দ বর্জন করলে ফারসি এক কদমও (কদম শব্দটাও আরবি) চলতে পারবে না। হুবহু তেমনি উর্দুর ওপর (বা প্রাকৃত হরিয়ানার ওপরও বলতে পারেন) ফারসির প্রভাব পড়েছিল ও ফারসির মারফত আরবির।

পক্ষান্তরে ফ্রান্স বা জরমনির ওপর কোনও বিদেশি বেশিকাল রাজত্ব করেনি বলে ফরাসি জরমনে বিদেশি শব্দ–ইংরেজি যেরকম বে-এক্তেয়ার হয়ে গিয়েছে তার তুলনায় মুষ্টিমেয়।

২. এর পর যদি সেই বিজিত জাত– এস্থলে ইংরেজ– বিধির লেখনে আপন দেশ ছেড়ে বাণিজ্য করতে বেরোয়, সেই বাণিজ্য রক্ষা করতে গিয়ে রাজ্য জয় করতে আরম্ভ করে, এবং সর্বশেষে রাজত্ব করার ছলে ডাকাতি করে চরকা পুড়োয়, আফিঙ গেলাবার জন্য সঙিন চালায়, শত্রু ঠেকাবার জন্য কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে, ড্রাই-আরথ পলিসি এক্তেয়ার করে, নির বাগ-আবদ্ধ সহায় নর-নারীকে যারা পাশবিক হুহুঙ্কারবলে গুলি করে মারে, তারা দেশে ফিরে স্বয়ং সম্রাটের আশীর্বাদাভিনন্দনসহ সুপপ্লেট সাইজের মেডেল পায়– তবে, তখনই, সেই বাণিজ্য সেই রাজত্ব সেই ডাকাতি– এক কথায় সেই রক্তশোষণ, সেই এপ্লয়টেশনের চৌকশ সুবিধার জন্য সেইসব মহাপ্রভুরা বহু ভাষা শেখেন এবং তারই ফলে তাদের আপন ভাষাতে বেনোজলের মতো হুড়হড় করে বিদেশি শব্দ ঢোকে।

এস্থলে বিশেষভাবে লক্ষ করার জিনিস, যে বিজিত জাত ইতোপূর্বে বিজয়ী জাতের কাছ থেকে অকাতরে শব্দ নিয়ে নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে, তারাই পরবর্তীকালে অন্য জাতকে শোষণ করার সময় আরও অকাতরে শব্দ নিতে পারে। এদের তুলনায় ফরাসি-জরমন অনভিজ্ঞ বালখিল্য। তদুপরি এরা চেয়েছিল প্রধানত রাজত্ব করতে; বাণিজ্য করতে নয়। এরা নেশন অব শপকিপারজ বা শপ-লিটারজ নয়। বণিকের মানদণ্ড যখন পোহালে শর্বরী দেখা দেয় রাজদণ্ডরূপে তখন সে রাজদণ্ডের সর্বাঙ্গে বেনে-দোকানের কালিঝুলের চিত্র-বিচিত্র ছোপ আর সপসপে ভেজাল তেলের দুর্গন্ধ।

শুনেছি, কোনও কোনও আন্তর্জাতিক গণিকা বাইশটি ভাষায় অনর্গল কথা কইতে পারে। তাদের সেই ভাষাজ্ঞান নমস্য কিন্তু পদ্ধতিটা গ্রহণ না করাই ভালো। ইংরেজের শব্দভাণ্ডার হয়তো-বা নমস্য– আমি এস্থলে তর্ক করব না, কিন্তু তার পদ্ধতিটা ঘৃণ্য। পাঠক এটা দয়া করে ভুলবেন না। যদ্যপি এস্থলে এটা ঈষৎ অবান্তর তবু মনে রাখবেন, প্রথম গোলাম হতে হবে, পরে ডাকাত হবে, তবেই শব্দভাণ্ডারে সঞ্চিত হয়। এবারে চরে খান গে– যার যা খুশি করুন। এবং স্বীকার করুন, এ স্টাডি থ্রিলিংতর নয় কি না?

কিন্তু দোহাই ধর্মের, পাঠক ভাববেন না, গোলামির কড়ি তথা লুটের মাল দিয়ে ভরতি ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে আমি অনিচ্ছুক। ডাকাতির মোহরও মোহর, পুণ্যশীলের মোহরও মোহর। ফোকটে পেয়ে গেলে ব্যবহার করব না কেন? মধুভাণ্ডের রস তো আগাপাশতলা চোরাই মাল– সেটা জেনেও তো কবিগুরু সিলেটের কমলালেবুর জন্য ছোঁক ছোঁক করতেন। এটা তো তবু নির্দোষ উদাহরণ। শাহ-জাহানের হারেম ছিল ফেটে-যাওয়ার-মতো ভরতি। তথাপি তিনি মাঝে-মধ্যে বাজার থেকে রমণী আনতেন। অনুযোগ করাতে বলতেন, হালওয়া মিষ্টি, তা সে যে কোনও দোকান থেকেই আসুক। হালওয়া নিক অস্ত– আজ হর দুকান্ বাদ– না কী যেন বলে ফারসিতে।

কিন্তু প্রশ্ন, মিশ্রিত ভাষা হলেই বুঝি তিনি অতুলনীয় সর্বশ্রেষ্ঠ একচ্ছত্রাধিপতি? ফরাসি ভাষা লাতিনসতা, এবং সে কিছু গ্রিক শব্দ নিয়েছে। ইটিকে প্রায় অবিমিশ্র ভাষা বলা চলে। তবে কেন মিশ্রিত ভাষার পদগৌরবদমদমত্ত সায়েব-লোগ হন্যে হবে অবিমিশ্রা ফরাসি ভাষার পিছনে পড়িমরি করে? আসলে ভঙ্গজ চৌষট্টি-আঁসলা সর্বত্রই কুলীনের জন্য ছোঁক ছোঁক করে।

মিশ্র বলেই নাকি ইংরেজি শেক্সপিয়ার, মিলটন পেয়ে ধন্য হয়েছে।

তা হলে হায় কালিদাস! তোমার কী গতি হবে, বাছা? তোমার শকুন্তলা, রঘুবংশ, মেঘদূতের পেটে বোমা মারলেও যে তাদের জবান থেকে বিদেশি লবজো বেরুবে না!

হায় হোমর, ইস্‌কিলস, আরিসতোফানেস, ইউরিপিদিস!

(কিন্তু আশ্চর্য, ইংরেজ তো এখনও প্রতি বছর এঁদের কাব্য লক্ষ লক্ষ ছাপায়–নয়া নয়া অনুবাদ করে!)।

প্রাচীন যুগের আধা-মিশ্র আরবি ভাষায় কবিকুল, ওল্ড টেস্টামেটের স, দায়ুদ সলমনের সঙ অব সজ তোমরা তো বানের জলে ভেসে গেলে। দাঁতের স্মরণে দীর্ঘনিশ্বাস দীর্ঘতর হল। সান্তনা, চীনা-জাপানের কবিদের সঙ্গে পরিচয় নেই। তাঁরা অন্-ওয়েট, অ-অনড়, অসাঙ হয়ে রইলেন।

পাপমুখে কী করে বলি, এক পাল্লায় মিশ্রিত ভাষার কবি, অন্য পাল্লায় অবিমিশ্র ভাষার কবিকুল তুললে কোনটা ওজনে ভারী হবে সে নিয়ে আমার মনে সন্দ আছে। অবশ্য প্রতিপক্ষ বলতে পারেন, ইংরেজি কাব্যে যে ভেরাইটি আছে অন্য কাব্যে নেই। উত্তরে বলি, ফরাসি গদ্যে যে ভেরাইটি আছে, ইংরেজি গদ্যে তা নেই। এবং অনেকে বলতে পারেন, বত্রিশ-ভাজাই দুনিয়ার সর্বোত্তম খাদ্য না-ও হতে পারে। সিংহের এক বাচ্চাই ব্যস!

বিবিসি সম্প্রতি এবারের মতো পুনরাবৃত্তি করলেন, ইংরেজিই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে চালু ভাষা। অবশ্যই। কিন্তু কোন পদ্ধতিতে সেটি চালু হল– যার বয়ান এইমাত্র দেওয়া হল– সেটি বলতে ভুলে গেলেন। হয়তো-বা সে স্থলে সেটি অবান্তর ছিল। তার পর সগর্বে বললেন, হালের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন– থুড়ি, সেমিনারে দশটি প্রবন্ধ পড়া হয়; তার ন-টি ছিল ইংরেজিতে।

আমি বলি, অধুনা ডাক্তারদের একটি সেমিনারে দশটি প্রবন্ধ পড়া হয়। তার ন-টি ছিল ক্যানসার সম্বন্ধে, তবে নিশ্চয়ই ক্যানসারের গর্ব অনুভব করা উচিত।

পদ্ধতিটা কী সম্পূর্ণ অবান্তর?

ইংরেজ তার মিশ্রিত ভাষার প্রশংসা করে। তাই শুনে শুনে এদেশের অনেকেই ইংরেজের গলার সঙ্গে বেসুরো গলা মেলান। কিন্তু তর্কস্থলে একবার যদি ধরে নিই, ইংরেজের ভাষা যদি ফরাসির মতো অপেক্ষাকৃত ঢের ঢের অবিমিশ্র হত, তা হলে কে কী করত? নিশ্চয়ই উচ্চতর কণ্ঠে বলত, ভো ভো ত্রিভুবন! শূন্বন্তু বিশ্বে… ইত্যাদি ইত্যাদি… এই যে আমাদের ভাষা সে কী নির্মল কী নির্ভেজাল! সে কোনও ভাষার কাছে ঋণী নয়, সে স্বয়ংপ্রকাশ। ওহো হো হো, সে কী পূত, পবিত্র– পর্বতনিঝরিণীর ন্যায় অপাপবিদ্ধ। আইস, ইহাতে অবগাহন করিবা!

এতে আশ্চর্য হবার কী আছে? সে তার আপন রক্ত অমিত্র রাখতে চায়, ইস্তক তার ঘোড়া, তার কুকুরটাকে পর্যন্ত দো-আঁশলা হতে দেয় না। এদেশের হুদো হুদো পকেট-ছুঁচোর কেত্তনওলা মি লাটুরা আপন আপন রক্তের বিশুদ্ধতা (অবশ্য কিঞ্চিৎ নরমান বেআইনি ভেজাল আছে বইকি!) ভাঙিয়ে মারকিন মুলুকে পয়সাউলি শাদি করছেন। প্রত্যয় যাবেন না, এই হালে বিবিসি-তেই এক ইংরেজ চারচিলের বিদেশি মাতার প্রতি ইঙ্গিত করে (যদ্যপি মাতা অধিকাংশ মারকিনের মতো গোড়াতে ইংরেজই বটেন) বলেন, হি উয়োজ নেভার কুআইট ওয়ান অব আস। শুনেছি চারছিল পার্লামেন্টে তাঁর জীবনে মাত্র একবার হুট হয়েছিলেন, তাঁর বক্তৃতা চিৎকারে অসমাপ্ত থেকে যায় তিনি যখন ডুক অব্‌ উইজারের মারকিন রমণী বিবাহ-প্রস্তাব সমর্থন করতে চান।

সব বাবদে ইংরেজ অবিমিশ্র থাকতে চায়– শুধু ভাষার বাবদে ব্যত্যয়!

আসলে ভাষাটা বর্ণসংকর হয়ে গিয়েছে যে! এখন এরই প্রশংসায় আসমান ফাটাও!

আমরাও হুক্কাহুয়া করি। দু-একটা নরসমেন, গোটা-দুই ফরাসিও করেছে। কেউ কিছু বললে, ওদের দোহাই দেব।

হিটলার পঞ্চাশ লক্ষ ইহুদি পোড়াল নরডিক রক্ত অমিশ্র রাখার জন্য।

ইংরেজি ভাষা নির্মিত হল কত পরাধীন জাতের রক্তশোষণের পিঠ পিঠ।

.

কিন্তু ইহসংসারের সর্বাপেক্ষা মিশ্রিত, বর্ণসংকর ভাষা কোনটি- ইংরেজি যার একশো যোজনের পাল্লায় আসতে পারে না? বেদেদের, জিপসিদের ভাষা। নর্থ-পোল থেকে সাউথ-পোল, পৃথিবীর নগণ্যতম ভাষার অবদানও এ ভাষাতে আছে। বস্তুত, মূলত ইটি কোন দেশের ভাষা, আর্য সেমিতি না মঙ্গোলীয় জাতের, সেই তর্কেরই সমাধান হয়নি।

বিবেচনা করি, এ ভাষাতে আরও ডাঙর ডাঙর শেক্সপিয়ার-মিলটন গণ্ডায় গণ্ডায় অসংখ্য রতন, ডেজারট-ফ্লাউয়ারের ন্যায়–ঘাপটি মেরে আপসে আপসে আবৃজা করছেন।

একাধিক গুণী বলেন, বেদেদের ভাষা মূলে ভারতীয়। বৎস! আর কী চাই! কেল্লা ফতেহ। আইস ভ্রাতঃ! সবে মিলি বেদেদের ভাষা শিখি।

ভূতের মুখে রাম নাম

যে কোনও ভদ্রসন্তান স্তম্ভিত হবে। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ঝাড়া দশটি মিনিট গা-গা রব ছাড়বে। অপেক্ষাকৃত রোগাপটকা ভিরমি যাবে। খবরটা এমনই অবিশ্বাস্য।

মানুষের তৈরি বেঙ্গল ফ্যামিনের সময় এক অজানা কবি রচেন–

দেখো না আজব হ্যায়,
এ যেন ভূতের পায়
স্বস্তিবাচন
করা নিবেদন।
এ যেন প্রেতের গায়
উদা উদা আতর মাখানো ভুরভুরে খুশবায়।
এ যেন দুখিনী মায়
Amery-র কাছে শিশুটির তরে
ভিক্ষার চাল চায়।

খবরটা এর চেয়েও বিস্কুটে।

ফ্রানসের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ফ্লোবেরের(১) বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস মাদাম ভারি ফ্রাসে এখন থেকে ছাপা যাবে, বেচা যাবে বটে কিন্তু বিজ্ঞাপন দেওয়া তথা বইয়ের দোকানে পেটি রেখে খদ্দের আকৃষ্ট করা বেআইনি!

কেন?

বইখানা অ্যামরাল, ইমরাল (immoral) অর্থাৎ দুর্নীতিপূর্ণ, এক কথায় অশ্লীল। বইখানা লিখতে ফ্রোবেরের লেগেছিল পূর্ণ চারটি বছর কিঞ্চিৎ অধিক–১৮৫২ থেকে ১৮৫৬। প্লটটি নিয়ে চিন্তা করেছিলেন তার পূর্বে তিনটি বছর। এই ছোট বইখানা লিখতে ফ্লোবেরের এতখানি সময় লাগল কেন? তার প্রথম কারণ, তিনি ছিলেন মাত্রাধিক পিটপিটে পারফেনিস্ট। বাস্তব জগতের পরিবেশ যেমন তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন, (অন্য উপন্যাসে একটি রোমান ভোজের নিখুঁত বর্ণনা দেবার জন্য তিনি নাকি প্রাচীন ক্ল্যাসিক্স ঘটেন– কেউ বলে ছ মাস, কেউ বলে দু বছর)(২) ঠিক তেমনি তার স্বপ্নলোক কাগজকলমে মৃণয় করার সময় তিনি চাইতেন সেটা যেন বাস্তবের চেয়েও বাস্তব হয়, এবং সর্বশেষে প্রত্যেকটি বাক্য, প্রত্যেকটি সেনটেনস যতক্ষণ না তার নিখুঁত ভারসাম্য পায়, তার প্রত্যেকটি শব্দ অন্য শব্দগুলোর সঙ্গে মিলে গিয়ে যতক্ষণ না উন্নয়নাতীত হয়, নিটোল সুডৌল না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি পরের সেটেসে যেতেন না, কিংবা বলব, যেতে পারতেন না, যেন আগের সেটেনস্ তাকে জোর করে আঁকড়ে ধরে বলছে, আমাকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছিয়ে দিয়ে তবে তুমি এগোও।

এমন দিন বহুবার গেছে, যেদিন ফ্লোবের মাত্র একটি ছত্রের বেশি লিখতে পারেননি! এটা কিংবদন্তি নয়। নইলে চারশো পাতার বই লিখতে চারটি বছর লাগবার কথা নয়। এবং স্মরণ রাখা উচিত, ফ্লোবের যখন কোনও বই লিখতে আরম্ভ করতেন, তখন সেইটে নিয়েই অষ্টপ্রহর মেতে থাকতেন। পেটের ধান্দা তার ছিল না, তার দেখভাল করার জন্য লোকের অভাব ছিল না, তিনি চিরকুমার, প্রতিদিন নিয়মিতভাবে লেখার টেবিলে বসতেন, বাড়ি ছেড়ে পারতপক্ষে রাস্তায় পর্যন্ত নামতেন না, অথচ চল্লিশ বছর সাধনার ফলস্বরূপ তিনি লিখেছেন মাত্র খান-আষ্টেক বই।

মোটামুটি ভালো বই হলেই আমরা সেটাকে বলি রসোত্তীর্ণ, খেয়াল না করেই বলি পিস অব আর্ট, কিন্তু সত্য সত্য যদি কোনও একখানি বইকে শব্দার্থে পিস অব আর্ট বলতে হয় তবে সে বই মাদাম ভারি। এর সর্বোৎকৃষ্ট পরিচিতি লিখেছেন ফ্লোবেরের পুত্রপ্রতিম প্রিয়শিষ্য মোপাসাঁ। তাঁর ভুবনবিখ্যাত নেকলেস গল্পে পাঠক ফ্লোবেরের প্রভাব দেখতে পাবেন। বস্তৃত বভারি বেরুবার পর সে-যুগের ফরাসি কৃতী লেখকদের বড় কেউই এর প্রভাব থেকে নিষ্কৃতি পাননি। একমাত্র এরকম বইকেই পিস অব আর্ট বলা চলে। সিপাহি বিদ্রোহের বছরে এই কাব্য প্রকাশিত হয়– আজও নবীন লেখক নবীন পাঠক এ পুস্তকের শরণ নেন।

মোপাসাঁ তার গুরু সম্বন্ধে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন। আজও যারা ফ্লোবের নিয়ে আলোচনা করেন তারা এ দুটি প্রবন্ধের বরাত না দিয়ে পারেন না।(৩) এছাড়াও তিনি কাগজে-কলমে ফ্লোবেরের মৃত্যুর পর তার হয়ে একাধিক লড়াই দিয়েছেন। এসব উত্তমরূপে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য আইস, পাঠক, প্যারিস যাই।

কিন্তু প্যারিসের বর্ণনা দেবার মতো কোথায় আমার বীর্যবল, কীই-বা অধিকার! তাই আমার যেটুকু দরকার সেটুকু নিবেদন করি।

সেই ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে প্যারিস যত না কাজ করেছে তার চেয়ে বেশি চেঁচিয়ে দুনিয়া ফাটিয়েছে, লিবেরতে (liberty), লিবেরতে, তুজুর (চিরন্তন) লা লিবেরতে। সে চিল্কারে মোহাচ্ছন্ন হয়েছেন গ্যেটে থেকে শুরু করে মিশর-ইন্ডিয়া পেরিয়ে চীন দেশের সুন ইয়াট সেন পর্যন্ত। ক্রমে ক্রমে তার বিকৃত রূপ দেখা দিল তার সামাজিক জীবনে তার আমোদ-আহ্লাদে। পুরীর নুলিয়ারা যে বড়ম্বর পরিপূর্ণ বস্তাভরণ পরিধান করে সমুদ্রে নামে, কিংবা আমাদের জেলেরা মাছ ধরার সময়, সেই পরে মেয়েরা প্যারিসে নৃত্যাদি আরম্ভ করলেন। এবং শুধু যে আপন-ভোলা নটরাজের জটার বাঁধন খুলে যায় তাই নয়, দিব্য সচেতন অবস্থায়– যাক গে, পূর্বেই বলেছি, যতখানি জ্ঞাতাস্বাদো বিপুলজঘনাং হলে পর প্যারিস বর্ণনের শাস্রাধিকার জন্মে, আমার ততখানি নেই।

এই বাতাবরণের মাঝখানে ফ্লোবের এতই সংযত সমাহিত যে, আজকের দিনের মডার্নরা তাঁকে রীতিমতো চেঁচিয়ে গালাগাল দেবেন, কাপ্রুs তোমার sহs নেই (কাপুরুষ! তোমার সাহস নেই– পাঠক সামবাজারের সসীবাবুর মত স-গুলো উচ্চারণ করবেন!)।

বইখানা পত্রিকায় কিস্তিতে কিস্তিতে বেরিয়ে পুস্তকাকারে ছাপা হবে এমন সময় ঘটল বিপর্যয়।

আল্লায় মালুম কোন শুকদেব ঠাকুরের সুপরামর্শে তখনও তো দ্য গল জন্মাননি– ফরাসি সরকার লাগিয়ে দিলেন ফ্লোবেরের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা। ফরাসি সরকারের শিক্ষা বিভাগ- মিনিস্ট্রি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন, ওই সময় থেকেই বোধহয় প্যারিসের যদো মেধা ওর নাম দেয়, মিনিস্ট্রি অব পাবলিক ডিস্ট্রাকশন।

ফ্লোবেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকি বভারি পুস্তকের মাধ্যমে দেশের দশের নীতিধর্মের সর্বনাশ করছেন! সোজা বাংলায় তাঁর বইখানা অশ্লীল, কদর্য!!

অশ্লীল শব্দটা একথা শুনে হেসে উঠল না তো?

সেই যে-রকম ঢাকাতে সোয়ারি কম ভাড়া হাঁকলে রসিক কুট্টি কোচমান ফিসফিস করে বলে, আস্তে কন, কত্তা, ঘোড়ায় হাসব!

এবং কার মুখে এই অভিযোগ?

প্যারিসের মুখে! তাজ্জব, তাজ্জব! গজব, গজব!!

প্যারিসিনির পরনে তখন কী? A la নুলিয়া নয় তো?

তাই বলছিলুম,

এ যেন প্রেতের গায়
শানেল আর উ (h) বিগ মাখানো
ভুরভুরে খুশবায়।

কিংবা রাষ্ট্রভাষায় :

আরে তেরা লড়কেকা
আজব তরে কা খেল
চুচ্ছুন্দর কা সিরপর
চামেলি কা তেল!

(তোর ছেলেটার আজব কীর্তি! ছুঁচোর গায়ে মাখিয়েছে চামেলির তেল। কীরকম চামেলি? বাদল শেষে করুণ হেসে, যেন চামেলি কলিয়া!)।

পাঠক ভাবছেন, আমি রগড় দেখে, the uter absurdity of it ভূতের মুখে রামনাম শুনে বে-এক্তেয়ার হয়ে উচ্ছ্বসিত গঞ্জিকা বিলাস করছি?

আদৌ না। আর করলেও আমি আছি সত্যঙ্গে, ইন গুড কামপনি!

মোপাসাঁ মোকদ্দমার সাতাশ বছর পরে মসকরা করে বলেন, সরকারি পক্ষের উকিল যেভাবে ফ্লোবেরকে আক্রমণ করে বজ্রনির্ঘোষ বক্তিমে ঝাড়েন, একমাত্র সেই কারণেই তাঁর নাম মার্কামারা (marque) হয়ে থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন, উকিল মসিয়োটি মোকদ্দমা আরম্ভের প্রাক্কালে তার নাম Pinard-টি– বদলালেন না কেন।(৪)

পিনার একরকম মদ। মোপাসাঁর বক্তব্য : বক্তিমে ঝাড়বি ঝাড়। হামলা করবি, কর। কিন্তু দোহাই ধর্মের, সাদা চোখে কর। পিনার–হুঃ ড়ি এলেন শ্লীলতা বাঁচাতে। এ যে দুঃশাসন এল নুলিয়াকে জোব্ব পরাতে।

এর পরও মোপাসাঁ আরেকখানা সরসে মাল ছেড়েছেন। কিন্তু হায়, সেটা তুলে দিলে লালবাজার চোখ লাল করেই ক্লান্ত হবে না!! দে উইল বি আফটার মাই রেড় ব্লাড!!!

———–

১. উচ্চারণ ফ্লো, তার পর ব্যার। ফ্লোব্যার লিখতে সাধারণ বাঙালি ফ্লোববার পড়ে বসতে পারে; সেটা হবে ভুল। ওইটে বাঁচাবার জন্য পূর্বসূরিগণ লিখতেন ফ্রোবেয়ার বা ফ্লোবের।

২. এদেশের উপন্যাসে প্রায়ই পড়ি, বিলিতি বড়সাহেব বা বিলেতফের্তা ন-সিকে এটিকেট-দুরস্ত সাহেব জুতো মস্ মস্ করে চলে গেলেন। জুতোজোড়া মস্ মস্ করলে এদেশের ট্যাশসায়েবও সেটা ভেজাছালার উপর রাতভর পেতে রাখে। সামান্যতম মস্ করলেও বন্ধুজন মস্করা করে বলে, দাম দাওনি বুঝি! বেচারি যে চিৎকার করে করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

৩. প্রবন্ধ দুটি বেরোয় মোপাসার চিঠি-চাপাটির (করেদাস) সঙ্গে সঙ্গে পুস্তকাকারে। এ পুস্তকে পাঠক পাবেন মোপাসাঁর অন্যান্য রচনা-সংগ্রহ। গল্পলেখক মোপাসাঁর খ্যাতি ব্যাল ল্যারিসৃৎ (রম্যরচনা তথা প্রবন্ধ-লেখক) মোপাসাকে এমনই ম্লান করে দিয়েছে যে, ফ্রান্‌সের বাইরে কেউ মোপাসার এসব লেখার সন্ধান বড় একটা করে না। এ পুস্তকে পাঠক পাবেন, বালজাক, জোলা, তুর্গেনিফ (একাধিক), সুইনবার্ন এবং অন্যান্য সম্বন্ধে প্রামাণিক প্রবন্ধ। এবং সবচেয়ে কৌতূহল উদ্দীপক পাঠক এতে পাবেন, মোপাস কোন আকস্মিক যোগাযোগের ফলে কথাসাহিত্যে প্রবেশ করেন। জোলার গ্রামের বাড়িতে একদিন গল্প বলার আর্ট, এবং সে আর্টের রাজা তুর্গেনিফ ও মেরিমে (চারু বাঁড়ুয্যে এর বই কলব আগুনের ফুলকি নাম দিয়ে প্রায় ৪৫ বছর হল অনুবাদ করেন) সম্বন্ধে কথা উঠলে জোলা প্রস্তাব করেন, সে মজলিশের সবাইকে একটি একটি করে গল্প বলতে হবে। গল্প বলেন জোলা, হোসমাস সেআর, এনিক এবং সবচেয়ে বড় কথা মোপাস স্বয়ং। সেই তাঁর প্রথম গল্প। সেটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় অন্যান্য গল্প-লেখকদের রচনাবলি সংগ্রহের সঙ্গে। যেহেতু জোলার বাড়ি ঘেঁদাতে গল্পগুলো বলা হয়, চয়নিকার নাম হয় মোর সোয়ারে। সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি মোপাস ফ্রাসে বিখ্যাত হয়ে যান। ফ্লোবের তখনও বেঁচে। আন্তরিক অভিনন্দন ও অকুণ্ঠ প্রশংসা জানালেন তরুণ লেখককে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, জোলার চাপে না পড়লে কী হত! কারণ এর পূর্বে মোপাসা নিজেই জানতেন না, কথাসাহিত্যে তিনি কী অভূতপূর্ব সৃজনীশক্তি নিয়ে জনুগ্রহণ করেছিলেন। মোপাসার চিঠি-চাপাটি ও প্রবন্ধাবলির পরিচয় আমি অন্যত্র অতি সংক্ষেপে দিয়েছি। এ বাবদে দুটি সংকলন আছে এবং যেহেতু এ দুটির ইংরেজি অনুবাদ আমার চোখে পড়েনি, তাই পুনরুল্লেখ প্রয়োজন বোধ করি :

1. Rene Dumesnil, chroniques, Etudes, Correspondance de Guy de Maupassant, publiees pour la premiere fois avec de nombreux documents inedits, Gruend, Paris 1938.

2. Artine Artinian & Edouard Maynial, Correspondance inedite de Guy de Maupassant Wapler, Paris, 1951.

৪. ফ্লোবেরের মৃত্যুর পর জর্জ সাড় (George Sand)-কে লিখিত তার পত্রাবলির ভূমিকারূপে মোপাসাঁ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন, উদ্ধৃতিটি সেই প্রবন্ধ থেকে। সাড়, সড, সঁদ– এ তিনটেই শাস্ত্রসম্মত। কিন্তু দিল্লিবাসীর সদম্ভ প্রদত্ত ফতোয়া যে ইটি স্যান্ড়– কোথাও নেই। সাদামাটা a হরফটির উচ্চারণ একমাত্র ইংরেজি ছাড়া কোনও ভাষাতেই অ্যা হয় না। অবশ্য ai, au, ae বা a-র উপর দুটি ফুটকি থাকলে (উমলাউট) ভিন্ন কথা।

রোদন-প্রাচীর– ক্লাগে-মাত্তার

প্রাচীরটা যে প্রাচীন সেটা দেখামাত্রই বোঝা যায়। কত প্রাচীন, সেটা অবশ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ঐতিহাসিক গবেষণা না করে বলতে যাওয়াটা অবিবেচকের কর্ম হবে। তবে এ নগরে যারা বাস করে তারা ছেলেবেলা থেকেই চতুর্দিকের এতসব প্রাচীন দিনের ভগ্নাবশেষ দেখে আসছে যে তাদের চোখ যেন বসে গেছে; আপন অজান্তেই অবচেতন মন জরাজীর্ণ পাষাণস্তূপের একটার সঙ্গে আরেকটা তুলনা করে করে যেন প্রাচীনত্ব নির্ণয়ের কতগুলো সাদামাটা কাঁচা-পাকা সূত্র নির্ণয় করে ফেলে। এমনকি যে বিদেশি প্রাচীন ভগ্নস্তূপ অতি অল্পই দেখেছে– যেমন ধরুন মামুলি মারকিন– সে পর্যন্ত এখানে কিছুদিন থাকার পর এটা-ওটার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে বেশকিছুটা ওয়াকিফহাল হয়ে যায় অবশ্য যদি গাইয়া মারকিনের মতো চোখে ফেটা কানে তুলো মেরে টুরিজম কর্ম না করে।

মোটা, দড়, ভারিক্তি প্রাচীর। প্রায় বিশ গজ উঁচু, অন্তত পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন গজ লম্বা। রোদে জলে পাথরের চাই তার মসৃণতা হারিয়ে খোওয়া-খাওয়া হয়ে গিয়েছে কিন্তু পাথরে পাথরে যে জোড়া লাগানো আছে সেটা আজও যেন প্রথমদিনের মতো মোক্ষম। রঙ প্রায় কালো।

কিন্তু আশ্চর্য, এ প্রাচীর যে এখানে কী করতে আছে সেটা কিছুতেই অনুমান করতে পারলুম না। অন্য প্রাচীরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সে কোনও চত্বর বা বাড়ির বেষ্টনী নির্মাণ করেনি। শহরের মাঝখানে না হয়ে যদি ফাঁকা মাঠে এটা দেখতুম তবে হয়তো বলতুম, এটা চাঁদমারির (টারগেট শ্যুটিঙের) দেয়াল। এখানে এটার স্থাপত্যে যাকে বলে আরকিটেকচরল ফংশন কী?

একটি প্রৌঢ়া মহিলা– সর্বাঙ্গ লম্বা ভারী কালো জোব্বায় ঢাকা, মাথায় কপাল পর্যন্ত অবগুণ্ঠন, শুধু মুখের লালচে হলুদ রঙের আভা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে এক হাত উপরে তুলে দেয়ালে রেখেছেন, দেয়ালে হেলান দিয়ে, মাথাটিও দেয়ালের উপর কাত করে রেখে যেন কোনও গতিকে দাঁড়িয়ে আছেন। খানিকটে এগিয়ে যেতে দেখি, তার দু চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে, আর ঠোঁট দুটি অল্প অল্প কাঁপছে যেন, কেমন মনে হল, মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। কোনও প্রিয়জনের স্মরণে? কিন্তু কই, কাছে-পিঠে কোথাও তো কোনও গোরস্তান নেই। আমি আর এগোলুম না। রোদ চড়তে আরম্ভ করেছে। বাঁ-দিকে মোড় নিয়ে হেরড গেটের কাছে ভারতীয় ধর্মশালার দিকে রওনা হলুম।

একটা ছোট বাজারের ভিতর দিয়ে যেতে হয়।

প্রায়ান্ধকার রাস্তা হাত ছয় চওড়া। দু-দিকে দোকানের সারি আর রাস্তার উপরটাও ঢাকা বলে মনে হয় গোধূলির অন্ধকার যেন নেমে আসছে। তবু ফলের দোকানে কী রঙের বাহার! সবচেয়ে চোখে পড়ে আমাদের কমলানেবুর তিনগুণ সাইজের জাফা অরেজ। মধুর মতো মিষ্টি রসে টইটম্বুর। দুপুরে একটা খেলে সে বেলা আর যেন অন্নে রুচি হয় না। দুটো খেলে গা বিড়োয়।

একটা কিউরিওর দোকান। টুকিটাকি অলঙ্কার, তাবিজ, তসবি, রেকাবি, গেলাস, তীর, ধনু, আরও কত কী! কোনওটা নাকি পাঁচশো, কোনওটা নাকি পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। আমি অবশ্য জানতুম, এগুলোর ৯৯% কাইরোর কারখানায় তৈরি হয়। কোনও কোনওটাতে এস্তেক সরকারি ক্ষুদে সিলমারা আছে; সরকারি মিউজিয়াম গ্যারানটি দিচ্ছেন, এটা প্রাচীন দিনের কোনও পিরামিডে বা গোর খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে। বলে আর কী হবে, মাল যেমন জাল, সিলও তেমনি।

সামনে দাঁড়িয়ে সেই জরমন টুরিস্ট ছোকরা। পরশুদিন আমি এদেশে এসেছি– ছোকরা বেশ কয়েক সপ্তাহ হল। আলাপ হয়েছে কাল সকালে, খ্রিস্টের সমাধিসৌধে অর্থাৎ হোলি সেপাল্কর-এ। অবাক হয়ে বললুম, এ কী ভায়া, এসব যে বিলকুল ডাড়– জাল মাল।

একগাল হেসে বলল, আমার নোটও জাল।

একসঙ্গে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

খানিকক্ষণ পরে আমি সেই দেয়ালের ধারের মহিলাটির কথা পাড়লুম।

বললে, সে তো ক্লাগে-মাত্তার।

জর্মন ভাষায় ক্লাগে অর্থ লেমেনটেশন অর্থাৎ বিলাপ : মাত্তার অর্থ প্রাচীর। বিলাপ করার প্রাচীর। আমি বললুম, খুলে বল।

পরম তাচ্ছিল্যভরে ঘোঁত করে উঠল, ইহুদিদের কী যেন একটা কী, আমার ও নিয়ে কোনও শিরঃপীড়া নেই। ওই যে, কে এক হিটলার, সে শিখেছে ইহুদিদের কাছ থেকে একটা মারাত্মক তত্ত্ব ইহুদিরাই এ পৃথিবীতে সর্বপ্রথম বলে তারা বিশ্বেশ্বর য়াহভের নির্বাচিত সর্বোকৃষ্ট জাতি–অন্যেরা বলত, অমর ঈশ্বরের নির্বাচিত প্রিয় জাতি আমরা। ওনারা বিশ্বেশ্বরের! হিটলার ওদেরই কাছ থেকে এই অদ্ভুত, প্রলয়ঙ্করী, জাতে জাতে রক্তাক্ত সংগ্রামসৃষ্টিকারী বীজমন্ত্র শিখে নিয়ে বলল, বটে! এত বড় মিথ্যে কথা! সার সত্য কিন্তু, হে বিশ্বজন, জেনে নাও :– আমরা, আর্যরা, এবং তাদের ভিতরও নীল চোখ, সোনালি চুলওলা নরড়িকরা ত্রিলোকের সর্বোকৃষ্ট জাত। এবং এইখানেই হিটলার থামল না; বলল, এবং ইহুদিরা এ জগতে কাফরি নিগরোর মতো উন্‌টর মেনশ (মানব পর্যায়ের নিম্নস্তরের সৃষ্টি)-ও নয়। তারা ভারমিন, নরকের কিট! যথেষ্ট হয়েছে, আমি ওসব কোঁদলে নেই।

নিরপেক্ষ ইতিহাস বলেন, হেরড দ্য গ্রেট খ্রিস্টজন্মের মাত্র কয়েক বছর পূর্বে জেরুসলমে যে বিরাট বিচিত্র য়াহভের মন্দির নির্মাণ আরম্ভ করেন সেটা আকারে-প্রকারে সর্বভাবে হাজার বছর পূর্বেকার সুলেমানের টেম্পলের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ছিল।(১) রোমানরা এ মন্দির ৭০ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে।

পরিপূর্ণ সম্পূর্ণ বিনষ্ট করেনি। বিরাট মন্দির-চতুরের চতুর্দিকে যে প্রাচীর একে পরিবেষ্টন করে ছিল তার একটি ক্ষুদ্র অংশ কী কারণে জানি না, আজ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে– এরই বর্ণনা দিয়ে এ লেখা আরম্ভ করেছি।

কবে এ প্রথা, অনুষ্ঠান বা আচারটা আরম্ভ হয় সেটা বলা কঠিন। অন্তত মোলশো বছর তো হবে।

প্রতি শুক্রবারের বিকেলে দেড়/ দুই হাজার বছর ধরে ইহুদিরা এই দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে বিলাপ রোদন করছেন। অনেকক্ষণ ধরে যে দীর্ঘ মন্ত্রোচ্চারণ করেন সেটিতে বার বার যে ধুয়া আসে (আমার যতদূর স্মরণে আসছে তারই ওপর নির্ভর করে বলছি, কারণ বহু চেষ্টা করেও এই সুন্দর কিনোৎ = ইংরেজি এলিজি মন্ত্রটি জোগাড় করতে পারিনি। তার নির্যাস আমাদের সর্বগৌরব-মহিমার যে মন্দির ধ্বংস হয়েছে আমরা তারই স্মরণে এই বিজনে রোদন করি।

যতদূর মনে পড়ছে রাববি– পুরোহিত যে গৌরব-মহিমার কিছুটা বর্ণনা দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আর সবাই উপরের ধুয়াটি বলে। ফের রাববি আরও খানিকটা বর্ণনা দেন, ফের উপাসকমণ্ডলী ওই ধুয়ার পুনরাবৃত্তি করে। বিলাপের সঙ্গে সঙ্গে সকলের চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রুধারা বয়।

প্রতি শুক্রবারের বিকালে ইহুদিরা এই প্রাচীরের দিকে মুখ করে এই কিনোৎ বিলাপ করেন। অন্যান্য দিনও যে কোনও সময় দু-একজনকে কাঁদতে দেখা যায়। আমি যে মহিলাটিকে দেখিছিলুম ইনি তাদেরই একজন। আর ইহুদি পঞ্জিকা অনুসারে তাদের আব মাসের ৯ তারিখ মন্দির ধ্বংসের সাম্বাৎসরিক কিনোৎ।

প্রাচীন জেরুসলমের যে অংশে এই প্রাচীরটি পড়েছে সেটি মন্দির ধ্বংসের বহু পূর্ব থেকে গত জুন মাস পর্যন্ত ছিল, হয় রোমান, না হয় খ্রিস্টান নয়, আরবদের অধীনে। গত জুন মাসে আরব-ইজরাএল যুদ্ধের সময় আরব শাসনকর্তা ও প্রজাকুল নগর ত্যাগ করে জরডন নদীর পূর্ব পারে চলে যায়।

বিজয়ী ইহুদি প্রধান সেনাপতি দায়ান ও পুরোহিত বংশজাত (লেভি) প্রধানমন্ত্রী এশকল দুই/আড়াই হাজার বছরের পরাধীনতার পর বিলাপ প্রাচীর-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে হাজার হাজার ইহুদি। অতিশয় পরিতাপের বিষয়, যে মহোৎসব সমাধিত হল তার খবর এসেছে মাত্র কয়েক ছত্রে।

আমার মনে প্রশ্ন জাগে : এশক-দায়ান এরা কি সেই প্রাচীন দিনের কিনোৎ-বিলাপ করেছিলেন? করার কী প্রয়োজন? সুলেমান হেরডের মন্দির যেখানে ছিল সেখানে নতুন মন্দির গড়ে তুলে সর্ব গৌরব-মহিমা ফিরিয়ে আনলেই হয় তা হলে অবশ্য শত শত শতাব্দীর প্রাচীন কিনোৎ পরবটি মারা যায়। আজ যদি ভারতে সর্পকুল লোপ পায় তবে কি মনসাপূজা বন্ধ হয়ে যাবে?

কিন্তু যে জায়গায় প্রাচীন মন্দির ছিল সেখানে তেরশো বছর ধরে যে মসজিদ।

হজরত মুহম্মদের পরলোকগমনের পর আরবদের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের সময় ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাইজেনটাইন খ্রিস্টানদের হারিয়ে স্বয়ং ওমর জেরুসৃলমে প্রবেশ করেই প্রশ্ন করলেন, নবী সুলেমানের মন্দির ছিল কোথায়? সেখানে তখন শহরের তাবৎ ময়লা-আবর্জনা ভর্তি ভগ্নস্তূপ। খলিফা স্বয়ং স্বহস্তে ময়লা আর পাথর সাফ করতে লাগলেন। দেখাদেখি তার সেনাপতিরা ও সৈন্যদল সে কাজে যোগ দিল। অত্যল্প সময়েই কর্ম সমাধান হলে পর ওমর সেখানে একটি মসজিদ গড়ার হুকুম দিলেন। কারণ মুসলমান শাস্ত্রানুযায়ী মক্কার কাবার পরই এ স্থানটি দ্বিতীয় পুণ্যভূমি। এরই নাম হরমশরিফ এবং এরই কাছে যেখানে মসজিদ উল আকসা(২) সেটিও অতিশয় পুণ্যভূমি কারণ হজরত মুহম্মদকে তাঁর জীবিতাবস্থায় বেহেশতে আল্লার কাছে যখন নিশাভাগে নিয়ে যাওয়া হয় (সশরীর না শুধু আত্মা এ নিয়ে মতভেদ আছে) তখন তাঁকে আরবদেশ থেকে প্রথম এই মসজিদ উল-আকসা ভূমিতে নিয়ে আসা হয়েছিল।

৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে ওমর যে সাদামাটা মসজিদ নির্মাণ করেন তার পরিবর্তে খলিফা আব্দুল মালিক আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্টাব্দে যে মসজিদ সেখানে নির্মাণ করলেন সেটি সত্যই অতুলনীয়। বিশ্ববিখ্যাত স্থপতিদের মতে পৃথিবীর আটটি স্থাপত্যকলার নিদর্শন উল্লেখ করতে হলে এটিকে বাদ দেওয়া যায় না। তবে এটি ঠিক মসজিদ নয়, এটাকে পুণ্যসৌধ বলা চলে– আরবিতে এর নাম কুব্বত্ উস্-সরা (ডোম্ অব্ দ্য রক্)।

এ দুটি না ভেঙে সুলেমানের টেম্পল গড়া যায় না।

ইতোমধ্যে খবর এসেছে ইহুদিরা জেরুসলমে প্রবেশ করেই মসজিদ উল্-আকসার উপর ইহুদি পতাকা তুলে পূর্ণ এক দিবস সেটা সেখানে রাখে। অনেকেই এই ঝাণ্ডা ওড়ানোটাকে ইহুদির আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন স্বত্বাধিকার দাবি করার পূর্বাভাস মনে করে শঙ্কিত হয়েছেন। খ্রিস্টান উইলসন শঙ্কিত হননি, এবং খ্রিস্টান জনসন তো ইহুদির পিছনে রয়েছেনই। যা শত্রু পরে পরে। লেড়েতে-শাইলকে লড়াই।

কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে ইহুদিরা চালে করল একটা ভুল। দায়ান-এশক সম্প্রদায়ের জাতবৈরী আরেক ইহুদি সম্প্রদায়ের নাম স্যামারিটান। তাদেরও আড়াই হাজার বছরের পুরনো একটা ভাঙা মন্দির পড়ে আছে একটা টিলার উপর। ১৯৪৮ সালে প্যালেসটাইন বিভাগের সময় স্যামারিটানরা কিছুতেই দায়ান-হিস্যায় পড়তে চায়নি। তারা জরডনের আরব হিস্যাঁতে যেতে চেয়েছিল এবং যায়। জুন মাসে আরব সেখান থেকে পালালে পর এ মন্দিরেও দায়ানরা দাবির ঝাণ্ডা ওড়াতে গেলে হাতাহাতির উপক্রম হয়- যদ্যপি সেস্থলে মাত্র তিন-চারশো স্যামারিটান বাস করে (তাবত দুনিয়ায় এ সম্প্রদায়ের সাকুল্য সংখ্যাই মাত্র তিন থেকে পাঁচশো!) তবু তারা সাহস করে এ গুণ্ডামি রোকতে যায়।

তখন খ্রিস্টজগৎ– মাইনাস জনসন– শঙ্কিত হল।

জেরুসলমে যে রয়েছে প্রভু যিশুর সমাধিমন্দির এবং গণ্ডায় গণ্ডায় গির্জে। ক্যাথলিক, গ্রিক অর্থডক্স, আরমেনিয়ান, কপট, হাবশি, সিরিয়ান, লুথেরিয়ান আরও কত জাত-বেজাতের (মুসলমানদের তো মাত্র দুটো– হরম শরিফ আর আত্সা)। আজ ঝাণ্ডা ওড়ায়নি বটে কিন্তু মুসলমানের দুটো দখল করার পর ইহুদির হিম্মত বেড়ে যাওয়াতে যদি সে খ্রিস্টানগুলোও

পোপ শঙ্কিত হন সর্বপ্রথম। তার পর উইলসন। তিনি হুঙ্কারিলেন, বেরিয়ে যাও, প্রাচীন জেরুস্লম থেকে। দায়ান উত্তরিলেন, ইয়ারকি পায়া হৈ? যাব না।

স্নাবৃড় উইলসন চুপ-ed!!

———–

১. নির্মাণ আরম্ভ খ্রি. পৃ. ২০; নির্মাণ শেষ খ্রিস্টাব্দ (খ্রিস্টের পর) ৬২। কী ট্র্যাজেডি! যে মন্দির গড়তে লাগল প্রায় ৮২ বছর, সেটা ভাঙতে (প্রধানত লুট করতে কারণ ইহুদি মন্দিরে তাদের কোষাকুষি হয় বিরাট আকারের ও নিরেট সোনায় তৈরি) ৮২ ঘণ্টাও লাগেনি! প্রফেট নোআ-র (আরবি-বাঙলায় নুহ) আর বা নৌকা তুলনীয়।

২. বছর চল্লিশেক পূর্বে হায়দরাবাদের নিজাম প্রায় পাঁচ লক্ষ (পাকা অঙ্কটি কেউ আমাকে বলতে পারেনি) মুদ্রা ব্যয় করে মসজিদটির আমূল সংস্কার করেন।

লক্ষ মার্কের বরমান

সম্প্রতি জর্মন সরকার ঘোষণা করেছেন যে, কেউ যদি এমন খবর দিতে পারে যার সাহায্যে মার্টিন বরমান নামক লোকটাকে গ্রেফতার করা যায় তবে তাকে এক লক্ষ জর্মন মার্ক পুরস্কার দেওয়া হবে।

তাই নিয়ে একখানি মাসিক পত্রিকা ফলাও করে উক্ত হত্যার বরমান সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। পত্রিকাখানি চোদ্দটি ভাষায় প্রকাশিত হয় এবং শতাধিক দেশে পড়া হয় বলে পত্রিকার কর্তৃপক্ষ দম্ভ করে থাকেন। প্রবন্ধ-লেখক তাই বলেছেন, হয়তো-বা আপনিই বরমানকে ধরার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন, কারণ হিটলারের মৃত্যুর পর বরমান কোথায় যে উধাও হয়ে গিয়েছে কেউ জানে না। সর্বশেষে প্রবন্ধ-লেখক বরমানের একটি বর্ণনা দিয়েছেন যাতে করে আপনি তাকে অল্পায়াসে বা অনায়াসে চিনে নিতে পারেন।

আমরা বরমান সম্বন্ধে যেটুকু জানি, তাতে মনে গভীর সন্দেহ হয়, লেখক বরমানের যে বর্ণনা দিয়েছেন সে অনুযায়ী চললে তাকে আদৌ চিনতে পারবেন কি না, বরঞ্চ হয়তো তাঁকে পালাবার সুযোগই দেওয়া হবে বেশি।

ইতোমধ্যে আরেকটি কথা বলে রাখি, উক্ত পত্রিকার ভারতীয় সংস্করণ বলেছেন, এক লক্ষ জর্মন মার্ক যে আপনি পাবেন তার ভারতীয় মূল্য এক লক্ষ টাকা। আমরা যতটুকু জানি, তার মূল্য অন্তত এক লক্ষ দশ হাজার টাকা সাদা বাজারেই। এই হল প্রবন্ধটির বিসমিল্লাতে গলদ। এর পর অন্যসব গলদে আসছি। তার পূর্বে বরমানটির পরিচয় কিঞ্চিৎ দিই।

হিটলারের জীবনে শেষের দু বছর বরমান ছিলেন তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি। তার পূর্বেই তিনি নাৎসি পার্টির সেক্রেটারি হয়ে গিয়েছিলেন। নাৎসি পার্টিই যে জর্মনি চালাত সে-কথা। সবাই জানেন– অন্য কোনও পার্টির অস্তিত্ব পর্যন্ত বেআইনি বলে গণ্য হত এবং হিটলার ছিলেন তার সর্বময় কর্তা। এবং তার পরেই বরমান।

আইনত হিটলার হঠাৎ মারা গেলে কিংবা কোনও কারণে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেললে তাঁর জায়গায় বসার কথা ছিল গ্যোরিঙের। ওদিকে নাৎসি পার্টির সশস্ত্র বাহিনীর (এস.এস.) বড়কর্তা ছিলেন হিমলার। তিনি আবার ছিলেন দেশের সামরিক বেসামরিক সর্ব রিজার্ভ ফোর্সের অধিপতি এবং সর্ব কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ছিল সম্পূর্ণ তাঁরই জিম্মায়। শেষের দিকে গ্যোরিঙ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন এবং দেশের আপামর জনসাধারণ জানত, হিটলারের হঠাৎ কিছু একটা হয়ে গেলে হিমলারই দেশের ফুরার–লিডার–বা নেতা হবেন। আইষমান যা কিছু করেছেন সেসব হিমলারের হুকুমেই।

তা ছাড়া ছিলেন গ্যোবেলস। যদিও তিনি প্রপাগান্ডা মিনিস্টার কিন্তু তিনি হিটলারের বিশেষ প্রিয় আমির ছিলেন। শেষদিন পর্যন্ত তিনি ও হিমলার যদি হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন তবে বরমানও সেটা ঠেকাতে পারতেন না। বিশেষ করে গ্যোবেলকে। বরমান সেটি জানতেন, এবং হিমলারকে যদিও তিনি শেষপর্যন্ত কোণঠাসা করে এনেছিলেন তবু গ্যোবেলসকে ঠেকাতে পারবেন না জেনে তাঁর সঙ্গে একটি চুক্তি (ওয়ার্কিং এরেঞ্জমেন্ট– মডুস ভিভেন্ডি) করে নিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, হিটলারের জীবনের শেষের বছরখানেক বরমান ছিলেন সর্বেসর্বা। হিটলারের তাবৎ হুকুম তারই মারফতে বেরুত। তাঁর ইচ্ছেমতো তিনিও হিটলারকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নিতেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী খ্রিস্টধর্মের এমনই কট্টর শত্রু ছিলেন যে, তারা খ্রিস্টানদের মাবার জন্যে যেসব ব্যবস্থা করতে চাইতেন তার দু-একটি হিটলারের মতো ধর্মদ্রোহীর মনেও বিরক্তির সঞ্চার করেছিল।(১)

এ বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই, গ্যোরিঙের পতনের জন্য বরমানই দায়ী। এমনকি হিটলারের বিনানুমতিতে তিনি হুকুম পাঠান যেন গ্যোরিঙকে গুলি করে মারা হয়। কিন্তু নাৎসি রাজ্য পতনের দিন আসন্ন দেখে যে কাপ্তানের ওপর সে আদেশ দেওয়া হয়েছিল তিনি সেটা অমান্য করেন।

হিটলারের মাত্র একটি খাস দোস্ত ছিলেন। চক্রান্ত করে বরমান তাঁকেও প্রায় ছ মাস ধরে হিটলারের কাছ থেকে দূরে রাখেন। হিটলারকে বলেন, তিনি সংক্রামক টাইফুঁসে ভুগছেন। হিটলারের মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে তিনি কোনও গতিকে হিটলারের সাক্ষাৎটা পান– শেষবারের মতো। চক্রান্ত ধরা পড়ে। হিটলার কিন্তু বরমানকে কিছুই বললেন না। বরঞ্চ দোস্ত হফমানকে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন দয়া করে এ প্রসঙ্গ উত্থাপন না করেন।(২)

এই যে এত শক্তিশালী বরমানকে লোকে খুঁজে পাচ্ছে না? আইষমান তাঁর অনেক নিচের নিচে কর্মচারী ছিলেন। তাঁকেও ইহুদিরা ধরতে পেরেছে। এঁকে পারছে না কেন?

যে বিখ্যাত মাসিকপত্রের উল্লেখ করে এ প্রবন্ধ আরম্ভ করেছি সেখানে এ প্রশ্নটির উল্লেখ নেই। যদিও হিটলার-বরমান নিয়ে যারাই আলোচনা করেন তাঁদের সবাই এর উত্তর জানেন।

তার একমাত্র কারণ বরমান পাবলিসিটি বা খ্যাতি চাইতেন না। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল শক্তি, ক্ষমতা মানুষের জীবনমরণের ওপর অধিকার আয়ত্ত করা।

হেস, গ্যোরিঙ, গ্যোবেলস, হিমলার, রিবেনট্রপ এমনকি হিটলারের আমির ওমরাহ চুনোপুঁটিরাও কাগজে কাগজে যখন আপন আপন ফোটোগ্রাফ ছাপাচ্ছেন, যত্রতত্র ভাষণ দিচ্ছেন, বেতারে তরো-বেতরো বক্তৃতা ঝাড়ছেন, মোকা-বেমোকায় কেতাব ছাপাচ্ছেন, পরব-পার্টি ডে-তে চোখ ঝলসানো ইউনিফর্ম পরছেন, তখন মান হিটলারের ছায়ায় দাঁড়িয়ে– তা-ও বাড়ির বাইরে জনসমাজে না– কলকাঠি নাড়ছেন, দিনের পর দিন আপন শক্তি বাড়িয়ে যাচ্ছেন। বড় বড় জেনারেল সিভিলিয়ানরা যখন ডাঙর ডাঙর মেডেলের জন্য হিটলারের সামনে হুটোপুটি করছেন তখন বরমান তার স্ত্রীকে লিখেছেন এ কী পাগলামি।(৩)

তাই জর্মন-অজর্মন সাধারণজন তাকে চিনত না। তখনকার দিনে এবং আজও তার ফোটোগ্রাফ দুষ্প্রাপ্য ছিল এবং আছে।

হিটলার যখন তাঁর খ্যাতির মধ্যগগনে অর্থাৎ স্তালিনগ্রাদের পরাজয় তখনও তাঁকে স্বীকার করে নিতে হয়নি সে সময়ে খানাপিনার পর হিটলার ইয়ারবক্সিদের সঙ্গে গালগল্প করতেন। অবশ্য হিটলারই কথা বলতেন বেশি। বরমান তখন ব্যবস্থা করেন যে দুজন শর্টহ্যান্ড এককোণে বসে সেগুলো যেন লিখে নেন। পরে বরমান সেগুলো কেটেছেটে ধোপ-দুরুস্ত করে দিতেন। এগুলো হিটলারের মৃত্যুর পর তার টেবল-ট (table talk) রূপে প্রকাশিত হয়েছে। প্রাগুক্ত বিশ্ববিখ্যাত মাসিকের প্রবন্ধ-লেখক বলেছেন, বরমান যে এ ব্যবস্থা করেছিলেন তার উদ্দেশ্য ছিল so that he could know and fulfil Hitlers every whim. এ উদ্দেশ্যও হয়তো তার ছিল কিন্তু এই টেবল-ট পড়লেই বোঝা যায় সেটা অত্যন্ত গৌণ। আসলে বরমান মনে করতেন হিটলার যা করেন যা বলেন তার চিরন্তন ঐতিহাসিক মূল্য আছে এবং পরবর্তী যুগের নাৎসি তথা বিশ্ববাসীর জন্য অমূল্য নিধি। নিধি হোক আর না-ই হোক– এ-কথা সত্য যারা হিটলারকে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে চিনতে চান তাদের পক্ষে হিটলারের স্বরচিত মাইন কাপ পুস্তকের পরেই এর স্থান। এসব ১৯৪১-৪২-এর কথা।

১৯৪৫ সালে হিটলার যখন আসন্ন পরাজয়ের সম্মুখীন তখন বরমান হিটলারকে দিয়ে আবার কথা বলিয়ে নেন। একথা সত্য, আত্মহত্যার কুড়ি-বাইশ ঘণ্টা পূর্ব পর্যন্ত হিটলার জয়াশা সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারেননি। তবু এই শেষ talk-গুলোতে হিটলার যেন আপন মনে চিন্তা করছেন, কেন তাঁর পরাজয় হল? এবং শুধু তাই নয়, পরাজয় যদি নিতান্তই হয়ে যায় তবে ভবিষ্যতে ইয়োরোপ-আমেরিকার কী অবস্থা হবে, তখন জর্মন রাজনীতি কোন পন্থা অনুসরণ করবে সে সম্বন্ধেও হিটলার ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন। আশ্চর্য, তার অনেকগুলিই আজ ফলে যাচ্ছে। চীন যে চিরকাল জড় হয় পড়ে থাকবে এটা তিনি স্বীকার করেননি। বরঞ্চ বলেছেন, চীনের কোটি কোটি লোক ওই দেশে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে না। তবে তার বিশ্বাস ছিল, চীন আমেরিকার পানে ধাওয়া করবে (তার পূর্বে রুশ-মার্কিনে যুদ্ধ হয়ে আমেরিকা ছারখার হয়ে যাবে); চীন যে ভারতপানে ধাওয়া করবে সে ভবিষ্যদ্বাণী তিনি করেননি।

বলতে গেলে টে-টও বরমানেরই অবদান।

কিন্তু এহ বাহ্য।

প্রাগুক্ত প্রবন্ধ-লেখক বলেছেন, বরমান মদ এবং কফি খেতেন না, পাতলা চা খেতেন এবং কৃচিৎ কখনও মাংস (drinking neither alcohol nor coffee, just week tea, and eating sparingly of meat)!

অর্থাৎ কাল যদি আপনি কলকাতায় (প্রবন্ধ-লেখক বলেছেন he could be in Canada or Mexico even in India), কিংবা কেউ যদি আর্জেন্টাইনে দেখে একটা লোক এক ঢাউস গেলাসভর্তি বিয়ারের সঙ্গে বিরাট একটি কাটলেট খাচ্ছে তবে তার বরমান হবার সম্ভাবনা নেই।

বস্তুত বরমান মাংস খেতেন প্রচুর। মদের তো কথাই নেই।

তবে প্রবন্ধ-লেখকের এ ভুল ধারণা এল কোথা থেকে?

সকলেই জানেন হিটলার মাছ মাংস মদ খেতেন না। তিনি যখন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে খেতে বসতেন তখন তার সামনে থাকত নিরামিষ, এবং অন্যদের জন্য মাছ মাংস মদ। অবশ্য কেউ যদি হিটলারের মতো নিরামিষ খেতে চাইত তবে তাকে সানন্দে তাই দেওয়া হত।

হিটলার-সখা হফমান–যার পুস্তকের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি–বলছেন, গ্যোরিঙও এসব খানাতে প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন না। তিনি বলতেন, আহারাদির ব্যাপারে প্রভুর সঙ্গে আমার রুচির অমিল। এবং এসব নিরামিষ অন্য কেউ কখনও খেতে চায়নি। এক বরমান ছাড়া। প্রভুকে খুশি করার জন্য সেই কর্তাভজাটা তার সঙ্গে ওই কচুঘেঁচু খেত। এবং তার পর আপন কামরায় গিয়ে সেটা কাছেই ছিল পরমানন্দে শুয়োরের চপ (বিরাট মাংসের টুকরো– এর সঙ্গে আমাদের আলুর চপের কোনও মিল নেই) বা বাছুর মাংসের কাটলেট গব গব করে গিলত। (৪)

প্রাগুক্ত প্রবন্ধ-লেখক তাঁদেরই ওপর নির্ভর করেছেন যারা বরমানকে শুধু বাইরের থেকে দেখেছেন। তাই কবি বলেছেন, বাহ্যদৃশ্যে ভোলো না রে মন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, হন্ আর বরমানে ছিল আদায়-কাঁচকলায়। তাই তিনি দুশমনি করে এসব নিন্দে রটিয়েছেন। কিন্তু ভুললে চলবে না, যখন হফমানের বইখানি প্রকাশিত হয় তখন বরমানের প্রাইভেট সেক্রেটারি, স্টেনো, চাকর, প্রাপ্তবয়স্ক একাধিক ছেলেমেয়ে স্বাধীনভাবে জর্মনিতে চরে বেড়াচ্ছেন। তাদের কেউই কোনও আপত্তি জানাননি।

এবারে মদের ব্যাপারে। হিটলারের খাস চাকর (ভ্যালে) লিঙে দশ বছর রুশদেশে কারাবাস করে, ১৯৫৫ সালে খালাস পেয়ে দেশে ফিরে হিটলার সম্বন্ধে অনেক কথা লিখেছেন। হিটলার নাকি প্রায়ই তাকে বলতেন, দেখ লিঙে, রাত্রে আপন ঘরে তুমি যত খুশি মদ খেয়ে যেমন খুশি মাতলামো কর, আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু সমাজে সাবধানে খেয়ো। বরমানও তাই সাবধানে মদ খেতেন।

আমার এই প্রবন্ধের তিন নম্বর ফুটনোটে যে চার নম্বরের লেখকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তিনি বলট।

পূর্বেই বলেছি হিটলার আত্মহত্যা করার ছাব্বিশ ঘন্টা পূর্বে তিনি হিটলার আর সাঙ্গোপাঙ্গদের ভূগর্ভ-নিবাস (বুঙ্কার) ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচান। এই ভূগর্ভ-নিবাস বহু কামরায় বিভক্ত ছিল। তারই একটাতে থাকতেন তিনি আর তার সহকর্মী শরিংহফেন। হিটলারের আত্মহত্যার দু-তিন রাত্র পূর্বে ভোরের দিকে তার সহকর্মী তাঁকে জাগিয়ে বলেন, কান পেতে শোন, কী সব হচ্ছে। পাশের কামরায় তিন ইয়ার বরমান, জেনারেল বুর্গড আর জেনারেল ক্রেী মদ্যপানের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছেন। রাশানরা তখন বার্লিনে ঢুকে গিয়েছে এবং কয়েকদিনের ভেতর যে তাদের জীবনমরণ সমস্যা দেখা দেবে সেটা জানতে পেরে বিশেষ করে বুর্গডফের আত্মগ্লানি দেখা দিয়েছে এবং তার জন্য তিনি প্রধানত নাৎসি পার্টি ও তার কর্তা বরমানকে দায়ী করছিলেন। বরমান আত্মপক্ষ সমর্থন করতে করতে বলছেন, এস, দোস্ত, আরেক পাত্তর হয়ে যাক–বুর্গ অধিকাংশ সময়ই মত্তাবস্থায় থাকতেন।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বলটু তার পর ঘুমিয়ে পড়েন।

দুপুরের দিকে বল্টু তার সহকর্মীর সঙ্গে গেলেন মিলিটারি কনফারেন্স রুমে–বুঙ্কারের ক্ষুদ্র-পরিসর কামরাগুলোর মধ্যে এইটেই ছিল সবচেয়ে প্রশস্ত। সেখানে গিয়ে দেখেন, হিটলার, এফা এবং গ্যোবেলস্ বসে আছেন, আর সামনের তিনখানা সোফাতে হিটলারের তিন ওমরাহ-বরমান, বুর্গড, ক্রেস্– লম্বা হয়ে, পা ফাঁক করে সর্বাঙ্গে কম্বল জড়িয়ে, সোফার ফাঁকা জায়গাগুলো কুশন (তাকিয়া-বালিশ) দিয়ে ভর্তি করে ঘরঘর করে প্রচুর নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছেন।

পূর্ব রাত্রির এবং সেই সকালের অত্যধিক সুমিষ্ট দ্রাক্ষারস পানের ধকল কাটিয়ে তখনও তারা জেগে উঠতে পারেননি। মদ্যপানশেষে তিন ইয়ার একসঙ্গে শোবার জন্য বড় ঘরটাই বেছে নিয়েছিলেন। বলট বলছেন, গ্যোবেলস্ তার দিকে এগুতে গিয়ে এদের নিদ্রাভঙ্গ না করার জন্যে প্রায় সার্কাস খেলোয়াড়ের মতো তাঁদের পা বাঁচিয়ে এক রকম ডিঙিয়ে এলেন। তাই দেখে এফা একটু মৃদু হাস্য করলেন। (পৃ. ৮১, ৮২)

এর পরও যদি প্রাগুক্ত প্রবন্ধ-লেখক বলেন বরমান মদ খেতেন না তা হলে আমরা সত্যিই নিরুপায়।

অবশ্য একথা ঠিক যে বরমান যতক্ষণ-না হিটলার ঘুমিয়ে পড়েন ততক্ষণ সচরাচর মদ খেতেন না। পাছে হিটলার ডেকে পাঠান। এমনকি স্বয়ং বরমানই তার স্ত্রীকে লিখছেন ফেব্রুয়ারি মাসে– (হিটলার আত্মহত্যা করেন ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫, অপরাহ্র সাড়ে তিনটেয়; হিটলারের ভ্যালে খাস চাকর- লিঙের মতে ৩-৫০) ভাগ্যিস কাল রাত্রে এফার জন্মদিন পরবে আমি মদ্যপান করিনি, কারণ রাত সাড়ে তিনটেয় হিটলার আমাকে ডেকে পাঠালেন; আমি তাই সাদা চোখেই তার সঙ্গে কথাবার্তা কইতে পারলুম।

প্রাগুক্ত প্রবন্ধ-লেখক বলেছেন, বরমান হালকা চা খেতেন!

সে-ও সর্বজন সমক্ষে, হিটলারকে খুশি করার জন্য যেমন তিনি কচুঘেঁচু খেতেন তেমনি। কারণ, আর সবাই যখন মদ্যপান করতেন তখন হিটলার ঘন্টার পর ঘন্টা হালকা চা খেতেন, চীনারা, রুশোরা, কাবুলিরা যেরকম করে থাকে।

বরমান যে মদ্যপান করেন সেকথা হিটলারের অজানা ছিল না। বস্তুত বুঙ্কারের অনেকেই শেষের দিকে পরাজয় আসন্ন জেনে সুরাতে দুশ্চিন্তা ভোলবার চেষ্টা করছিলেন। সখা হফমান যখন হিটলারকে এপ্রিলের মাঝামাঝি শেষবারের মতো দেখতে আসেন তখন তাঁর জন্য শ্যাম্পেন অর্ডার দিয়ে হিটলার এই মন্তব্য করেন।

এ প্রবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য আমার এ নয় যে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন করে বরমানকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করা। তদুপরি বরমানের এই বঙ্গদেশে আগমন অসম্ভব। ধরা পড়লে ভারত সরকার তাঁকে পয়লা প্লেনেই জর্মনি পাঠিয়ে দিতে কোনও আপত্তি করবেন না। তিনি থাকবেন ওইসব দেশেই যেসব দেশ আসামি বদলের চুক্তি জর্মনির সঙ্গে করেনি– অর্থাৎ নাৎসিদের প্রতি এখনও যাদের কিছুটা দরদ আছে। অবশ্য বরমান তার প্রাপ্য শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পান সেটাও আমার উদ্দেশ্য নয়।

আমার উদ্দেশ্য, এইসব চৌদ্দ আর বাইশ ভাষায় প্রকাশিত মার্কিন কাগজগুলোকে যেন বঙ্গসন্তান চোখ-কান বন্ধ করে বিশ্বাস না করেন। বিশেষ করে যখন তারা স্বাস্থ্য সম্বন্ধে নানা প্রকারের উপদেশ দেয়।

———–

১. অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস বলতে হবে, নাস সাম্রাজ্য পতনের প্রায় এক বছর লুকিয়ে থাকার পর বরমানের স্ত্রী এক ক্যাথলিক পাদ্রির সাহায্য নেন, এবং মৃত্যুর পূর্বে আপন ডজনখানেক ছেলেমেয়েকে তাঁরই হাতে সঁপে দেন। এবং নির্মমতম পরিহাস– তাঁর বড় ছেলে ক্যাথলিক পাদ্রি হয়েছে।

২. এই দোস্ত হফমানকেই হিটলার পাঠিয়েছিলেন মস্কোতে, রিবেট্রপের সঙ্গে, নাৎসি-কম্যুনিস্ট চুক্তি সই করার সময় স্তালিন কী রকম লোক সে তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ করার জন্য। হিটলারের মৃত্যুর পর ইনি হিটলার উয়োজ মাই ফ্রেন্ড নামক একটি পুস্তক লেখেন। ইনিই হিটলারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন তাঁর ফোটোগ্রাফ ল্যাবরেটরির আসিসটেন্ট শ্রীমতী এফা ব্রাউনের সঙ্গে। আত্মহত্যা করার চল্লিশ ঘণ্টা পূর্বে হিটলার এফাঁকে বিয়ে করেন– পনেরো বছরের বন্ধুত্বের পর। এফাও একইসঙ্গে আত্মহত্যা করেন। উভয়কে একই চিতায় পোড়ানোর পর একই কবরে গোর দেওয়া হয়। রাশানরা স্কেলিটেনগুলো খুঁড়ে বের করে।

৩. বরমান এতই গোপনে থাকতেন যে তাঁর সম্বন্ধে কেউই সবিস্তর কিছু লিখতে পারেননি। রনবের্গ মোকদ্দমায় সবাই তার বিরুদ্ধে গায়ের ঝাল ঝেড়েছেন বটে কিন্তু তথ্য বিশেষ কিছু দিতে পারেননি। এছাড়া আছে (১) বরমান লেটার্স– স্ত্রীকে লেখা বরমানের পত্রগুচ্ছ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর এগুলো প্রকাশিত হয়েছে। (২) ট্রেভার-রোপার লিখিত লাস্ট ডে অব হিটলার। (৩) প্রাগুক্ত হফমান লিখিত হিটলার উয়োজ মাই ফ্রেন্ড। (৪) গেরহার্ট বলটু কৃত ডি লেৎসতেন টাগে ড্যার রাইসকানৎসলাই (অর্থাৎ জর্মন প্রধানাবাসের শেষ কটি দিন)। এই বলটু হিটলার ভবন (মাটির গভীরের অ্যার রেড শেলটার– বুঙ্কার) ত্যাগ করেন হিটলারের মৃত্যুর মাত্র ছাব্বিশ ঘন্টা পূর্বে।

8. Goering too was a rare guest. Hitlers culinary confections he declared was not to his taste. But the lick-spittling Borman dutifuly consumed raw carrots and leaves in his masters company,–and then he would retire to the privacy of his own room and devour with relish his pork chop or a fine Wiener Schnitzel (calf cutlet); Hoffmann, p 202.

৫. অধিকাংশ লোকের বিশ্বাস, হিটলারের মৃত্যুর দু দিন পরে যখন বুঙ্কার রাশান সৈন্য দ্বারা অধিকৃত হয় তখন বুর্গড এবং ক্রেবস্ আত্মহত্যা করেন। বরমান পালান। গোড়ায় তাঁর সঙ্গে পলায়মান যারা পরে বন্দি হন তাঁরা বলেন, বরমান রাশান দ্বারা নিহত হন। পরে নানা সন্দেহের অবকাশ দেখা দিল। তাই আজ জর্মন সরকার এক লক্ষ মার্ক পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তাঁর পলায়ন সম্বন্ধে সবিস্তার বর্ণনা, তিনি বেঁচে আছেন কি না সে সম্বন্ধে সবচেয়ে ভালো আলোচনা পাঠক পাবেন, ট্রেভার-রোপার লিখিত পুস্তকে, পৃ ২২১।

 ল্যাটে

রদাঁগৎ কাকে বলে জানো?

একরকমের ফরাসি কোট। প্রায় ফ্ৰককোটের কাছাকাছি। এর বেশি কিছু জানি নে, কখনও দেখিনি।

শব্দটা– রাদার, সমাসটা– কোত্থেকে এসেছে?

আমার ইংরেজ বন্ধু সিরিল বেশভূষা বাবদে পয়লা নম্বরি, কিন্তু শব্দ, ভাষা এসব বাবদে তাঁর অণুমাত্র ইনট্রেসটু নেই। তাই একটু উৎসাহ দেখিয়ে বললুম, কোত্থেকে?

চেনবার জোটি নেই। ইংরেজি রাইডিং কোটের এই হল ফরাসি উচ্চারণ। শুধু তাই নয়, এতে আরও মজা। সেই রাগৎ যখন ফের বিলেতে এল তখন তার ইংরেজি উচ্চারণ হয়ে গেল রেডিংগট এবং ফ্রান্সে নবজন্মপ্রাপ্ত এ পোশাক এদেশে আবার এক নবজন্ম লাভ করে হয়ে গেল মেয়েদের পোশাক– পুরুষ আর এটি এদেশে পরে না, অন্তত এ নামে পরিচিত পোশাকটি পরে না। কিন্তু রাগৎ এখনও ফ্রান্সের ভারিক্কি পোশাক। তোমারও তো বয়স হতে চলল, আর যাচ্ছও ফ্রান্সে–

আমি বললুম, থাক, আমার সাদামাটা লাউনজ স্যুটেই চলবে।

***

ফ্রান্সের একটি জায়গা দেখার আমার অনেককালের বাসনা।

বহু বছর পূর্বে আমরা একবার মার্সেলস বন্দরে নামি। সঙ্গে ছিলেন দেশনেতা স্বর্গত আনন্দমোহন বসুর পুত্র ড, অজিত বসু ও তাঁর স্ত্রী শ্রদ্ধেয়া মায়া দেবী।

বড়ই দুঃখের বিষয় এই গুণী, জ্ঞানী কর্মবীর অজিত বসু সম্বন্ধে কেউ কিছু লেখেননি। আসলে ইনি চিকিৎসক ছিলেন কিন্তু তার জ্ঞানসাম্রাজ্য যে কী বিরাট বিস্তীর্ণ ছিল সেটা আমি আমার অতি সীমিত জ্ঞানের শিকল দিয়ে জরিপ করে উঠতে পারিনি।

তার কথা আরেকদিন হবে।

তখনকার মতো আমাদের উদ্দেশ্য ছিল জিনিভা যাওয়া। কিন্তু খবর নিয়ে জানলুম, সন্ধ্যার আগে তার জন্য কোনও থ্রু ট্রেন নেই।

গোটা মধ্য এবং পশ্চিম ইয়োরোপ তিনি চিনতেন খুব ভালো করে। এবং বিখ্যাত শহর হলেই তিনি ইয়োরোপের ইতিহাসে সে শহর কী গুরুত্ব ধরে ধাপে ধাপে বলে যেতে পারতেন, কারণ তার মতো পুস্তক কীট আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি।

বললেন, তার আর কী হয়েছে! চলুন, ততক্ষণে অ্যাকস্ হয়ে আসি। মাইল আঠারো পথ।

আমি বললুম, সে কী? অ্যাকস-লে-ব্যাঁ তো অনেক দূরে।

তিনি হেসে বললেন, আমার জানা মতে তিনটে অ্যা আছে। উপস্থিত যেটাতে যেতে চাইছি সেটা আগা খানের প্যারা জায়গা অ্যাক্স-লে-ব্যাঁ নয়– এটার পুরোনাম অ্যাকস–আঁ-প্রভাঁস!

আমি বললুম, প্রভাঁস? তা হলে এ জায়গাতেই তো আমার প্রিয় লেখক আলস দোদে তার লেটারজ ফ্রম মাই মিল লিখেছিলেন, এখানকারই তো কবি মিস্ত্রাল যিনি নোবেল প্রাইজ পান–

ড. বোস বললেন, পূর্ব বাঙলার যে লোকসাহিত্য আছে সেটা প্রভাঁসের আপন ফরাসি উপভাষায় রচিত সাহিত্যের চেয়ে কিছু কম মূল্যবান নয়। অথচ দেখুন, মিস্ত্রাল যে-রকম একটা উপভাষা– একটা ডায়লেকটে, অবশ্য আজ এটাকে ডায়লেকট বলছি–কাব্য রচনা করে বিশ্ববিখ্যাত হলেন, নোবেল প্রাইজ পেলেন, ঠিক তেমনি পুব বাঙলায় কেউ সেই ভাষা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, গর্ব অনুভব করে, মিসূত্রালেরই মতো পরিশ্রম স্বীকার করে, সেটিকে আপন সাধনার ধন বলে মেনে নিয়ে নতুন সৃষ্টি নির্মাণ করে না কেন? জানেন, আমি বাঙাল?

ইতোমধ্যে যান এসে গেছে।

এদেশের বর্ণনা আমি কী দেব? অ্যাও নাকি দু হাজার বছরের পুরনো শহর। কই, মেয়েগুলোকে দেখে তো অত পুরনো বলে মনে হল না! তা হলে বলতে হয়, শহরটা দু হাজার বছরের নতুন।

পার্কের একটি বেঞ্চিতে বসে ভাবছিলুম, এই তো কাছেই তারাসক শহর যাকে বিখ্যাত করে দিয়েছেন দোদে তার তারতারা দ্য তারাসকঁ লিখে।(১) তারই পাশে ছোট্ট জায়গাটি– মাইয়ান (জানি নে, প্রভাঁসলে তার উচ্চারণ কী) যেখানে কবি মিস্ত্রাল তার সমস্ত জীবন কাটালেন। তারই মাইল সাতেক দূরে বাস করতেন দোদে– ভিয়েই গ্রামের কাছে। কবি মিত্রালের বর্ণনা লিখে একাধিক ফরাসি লেখক নিজেদের ধন্য মেনেছেন। কিন্তু অপূর্ব দোদের বর্ণনাটি –এক রোববারের ভোরে ঘুম থেকেই উঠে দেখেন, বৃষ্টি আর বৃষ্টি, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। গোটা পৃথিবীটা গুমড়ো মুখ করে আছে। সমস্ত দিনটা কাটাতে হবে একঘেয়েমিতে। হঠাৎ বলে উঠলেন, কেন, তিন লিগ আর কতখানি রাস্তা? সেখানে থাকেন কবির কবি মিস্ত্রাল। গেলেই হয়।

কিন্তু দোদে যেভাবে (তাঁর লেয়-এ Letters de mon Moulin-এর ইংরেজি অনুবাদ কতবার কত লোক যে করেছেন তার হিসাব নেই, পাঠক অনায়াসে পুরনো বইয়ের দোকানে মূল অনুবাদ জোগাড় করতে পারবেন)(২) সেই জলঝড় ভেঙে পয়দল মিস্ত্রালের গায়ে গিয়ে পৌঁছলেন তার বর্ণনা আমি দেব কী করে? দোরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে পেলেন কবি উঁচু গলায় কবিতা রচনা করে যাচ্ছেন– কী করা যায়? নিরুপায় ঢুকতেই হবে–

মিস্ত্রাল যেন লাফ দিয়ে