বললুম, বসো।
কেমন যেন সঙ্কোচের সঙ্গে খাটের বাজুতে বসল।
এই মেয়েই না একদিন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমার পদসেবা করতে চেয়েছিল।
তবে কি পীরের মানা– গুরুর বারণ–পরপুরুষস্পর্শ বিষবৎ বর্জনীয়?
নিকুচি, নিকুচি। পীরের গুষ্টি আর গুরুর দঙ্গল!
অভিমানের বদলেতে নেব তোমার মালা এসব মরমিয়া মাল আমার তরে নয়। আমার হল রাগ। এই নিষ্পাপ শিশুটিকে কে শেখাল এইসব কাল্পনিক পাপ? কে সে পীর? তাকে একবার দেখে নিতে হবে। কিন্তু পীরের নিকুচি যতই করি না কেন, আমার ঠাকুরদা থেকে ঊধ্বতম ক পুরুষ যে পীর ছিলেন সে তত্ত্ব অদ্যাপিও বিলক্ষণ অবগত আছে তর পরগণার কিছু কিছু চাষাভূষো, মোল্লামুনশি। এরা বংশানুক্রমে আমাদের পরিবারের শিষ্য। কিন্তু আমার পিতা এবং আমার অগ্রজেরা পীর হতে রাজি হলেন না বলে এদের অধিকাংশই অন্য পীরের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু গুরুভক্তি শুধু শুরুতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সে-ভক্তি শুরুর বংশধরগণকেও নিষ্কৃতি দেয় না; তাই এদের কয়েকটি পরিবার অন্য পীর বরণ না করে দু তিন পুরুষ ধরে অবিশ্বাস্য ধৈর্য ধরে বসে আছে, আমার দাদাদের বা আমার বেটা-নাতি যদি সদয় হয়ে কোনও একদিন এদের বেটা-নাতিদের শার্গিদ (সাকরেদ) রূপে গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে যে-পীর বাঙলাদেশে এসে আমাদের বংশ স্থাপনা করেন তাঁর দর্গাতে এইসব প্রতীক্ষমাণ সাকরেদরা শিরনি চড়াচ্ছে, ফুল সাজাচ্ছে, মানত মানছে।
মাত্র এই দুপুরুষ– আমার পিতা আর আমরা তিন ভাই পীর হতে রাজি হইনি। তাই বলে চোদ্দপুরুষ যে সব ধ্যানধারণা করেছে, সাকরেদদের দীক্ষা দিয়েছে, ধর্মপথে চালিয়েছে সেটা কি দু পুরুষেই আমার রক্ত থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? হাঁসকে দু পুরুষ খাঁচায় বন্ধ রাখার পর তৃতীয় পুরুষের বাচ্চাদের জলে ছেড়ে দিলে কি তারা সাঁতার না কাটতে পেরে পাথর-বাটির মতো জলে ডুবে মরবে!
এই তো মাত্র দু তিন বৎসর পূর্বে শান্তিনিকেতনের কর্তৃপক্ষ আমার ওপর হামলা করে অনুরোধ– আদেশও বলতে পারেন– করলেন, পৌষমেলা ও সমাবর্তন উৎসবের প্রাক্কালে যে সাম্বৎসরিক উপাসনা করা হয় তাতে আচার্যের আসন গ্রহণ করতে। আমি সাতিশয় সবিনয় সবিস্তর অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলুম। ওঁদের বলিনি কিন্তু আমি মনে মনে জানি এসব কর্ম করে পুরুত-মোল্লারা পেটের অন্ন জোটায়– অবশ্য এ স্থলে এরা আমাকে একটি কানাকড়িও দেবেন না, সে-কথা আমি বিলক্ষণ অবগত ছিলুম। আবার এ তথ্যও তো জানি যে, বিপদে-আপদে কাছেপিঠে নিতান্তই কোনও মোল্লা-মুশি ছিল না বলে আমার পিতৃপুরুষ এসব ক্রিয়াকর্ম কালেকস্মিনে অত্যন্ত অনিচ্ছায় সমাধান করেছেন। পূর্বেই বলেছি, তবুও আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম। তখন কর্তৃপক্ষ তাদের আখেরি মোক্ষম বজ্রবাণ ছেড়ে বললেন, আমারই ওপর ভরসা করে তাঁরা অন্য কোনও ব্যবস্থা করেননি; এই শেষ মুহূর্তে অন্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আমার সন্দেহপিচেশ মন অনুমান করল, অন্য কোনও ডাঙর চাঁইকে হয়তো কর্তারা কাবু করে রেখেছিলেন এবং তিনি শেষ মুহূর্তে তার অক্ষমতা জানিয়ে খবর পাঠিয়ে কত্তাদের সমূহ বিপদে ফেলেছেন। বিপদে পড়লে শয়তানও মাছি ধরে ধরে খায়। তাই এসেছেন অধমের কাছে। অবশ্য এনারা শয়তান নন, আমো মাছি নই। আমি শুধু রিলেটিভিটি সিপ্লিফাইড গ্রু প্রভাব বোঝাবার জন্য এই প্রবাদটি উদ্ধৃত করলুম।
তখন অবশ্য আমি তিন কবুল পড়ে মুসলমান যে রকম বিয়ে করে সে রকম ধারা আমার সম্মতি দিলুম।
এটা আমার পীরত্ব প্রমাণ করার জন্য শহর-ইয়ারকে বলবই বলব। সে কোন দম্ভভরে চিত্তপ্রসাদ অনুভব করছে যে তার পীরই ইহলোক-পরলোকের একমাত্র পীর! আমি সপ্রমাণ করে ছাড়ব, বেলাভূমিতে তার পীরই একমাত্র নুড়ি নন, আরও বিস্তরে বিস্তর আছে, এবং আমি তো রীতিমতো একটা বোল্ডার– অ্যাব্বড়া পাথরের চাই।
অবশ্য সে-ও ধুরন্ধরী। সে যদি শুধায়, শান্তিনিকেতনে আচার্যের কর্ম আমি কীভাবে সমাধান করলুম তখন আমি কিচ্ছুটি না বলে সাক্ষী মানব কলকাতার একখানি অতি প্রখ্যাত দৈনিকের সম্পাদক মহাশয়কে। তিনি সে-উপাসনায় উপস্থিত ছিলেন।
গতানুগতিক সাধারণ অবস্থায় আমি আত্মচিন্তার জন্য এতখানি ফুরসত পেতুম না। ইতোমধ্যে শহর-ইয়ারের সফেন বুদবুদিত চিত্ত কথায় কথায় বকবকানিতে ফেটে পড়ত। কিংবা তিনখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে ফেলত– তার অভ্যাস অনুযায়ী প্রত্যেকটি অসমাপ্ত রেখে।
এমনকি, এদানির সে কী পড়ছে, আমার সেই প্রথম প্রশ্নের উত্তরও এ তাবৎ সে দেয়নি।
আমি বললুম, জানো, শহর-ইয়ার, আমার চতুর্দশ পুরুষ কিংবা ততোধিক ছিলেন পীর– সুফি?
এতক্ষণ অবধি শহর-ইয়ার ছিল আপন মনের গভীর গহনে আত্মচিন্তায় নিমগ্ন। পীর, সুফি এ দুটি শব্দ তার কানে যেতেই সে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠল। তার নিষ্প্রভ, কুয়াশা-মাখা চোখ দুটি সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন দিনের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল।
কিন্তু মুখ দিয়ে কথা ফুটল যেন হোঁচট খেতে খেতে।
শুধলো, সে– সে সে কী? আপনি আপনি আপনি তো আমাকে কখনও বলেননি। কী বললেন? –সুফি?
আমি তন্মুহূর্তেই বুঝে গেলুম, শহর-ইয়ারের পীর তাকে সুফিমার্গে দীক্ষিত করেছেন। কিংবা চেষ্টা করেছেন।
আমি কিন্তু অত সহজে ধরা দেব না। তুমি কি আমার কানু যে, বাঁশি শুনেই উদোম হয়ে ছুটব!