অসকার ওয়াইডল বলেছেন, আমাদের প্রত্যেকেরই বেশকিছু বেকার বাজে জিনিস আছে যেগুলো আমরা স্বচ্ছন্দে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি, কিন্তু ভয়, পাছে কেউ কুড়িয়ে নেয়! আফগান দেশে মাইলের পর মাইল শুধু পাথর আর পাথর, কিংবা সিন্ধুদেশে বালি আর বালি, কিন্তু হলে কী হবে, আমি– মার্কিন যদি দখল না করি তবে বলশি ব্যাটা যে নেবে না, তারই-বা কী পেত্যয়? ইন্ডিয়াই-বা কোন তক্কে আছে কে জানে? এই হল বিশ্বভুবনের শঙ্কা, বিভীষিকা!
অতএব এটা নিতান্তই কল্পনা-বিলাস যে, দাউদ খান আর ভুট্টোর ব্যারিস্টারে রোদের পর রোদ লড়ে যাবেন আর দুনিয়ার কুল্লে নেশন রাস্তার ছোঁড়াদের মতো শুধু হাততালি দিয়েই মজাটা লুটে নেবেন। কথাটা খুবই খাঁটি কিন্তু এই কল্পনা-বিলাসেও সুদুমাত্র যে আকাশ-কুসুম চয়ন করা হয়, তা নয়। বিজ্ঞানীরা বিস্তর এক্সপেরিমেন্টে প্রথম ভ্যাকুয়ামে সফল হলে পরে স্বাভাবিক বাতাবরণের প্রভাবদুষ্ট অবস্থায় অর্থাৎ রুশ-মার্কিন-ইন্ডিয়া-ইরানের আপন আপন স্বার্থসিদ্ধির মতলবের মাঝখানে সেই একসপেরিমেন্টের পুনরাবৃত্তি করে প্রত্যক্ষ ফল লাভ করেন।
.
যদিস্যাৎ
ভ্যাকুয়ামের লড়াইয়ে ব্যারিস্টারের বিশেষ ভয় পাবার কিছু নেই।
ধরে নিলুম, দাউদ খান প্রধানত রুশ বা/এবং যে-কোনও জাতের কাছ থেকেই হোক, অস্ত্রশস্ত্র যা কিছু জমায়েত অবস্থায় পেয়েছেন তথা জহির শাহ চল্লিশ বছর ধরে যা-সব কিনেছিলেন তাই নিয়ে নামলেন লড়াইয়ে। মোল্লাদের হুকুমে সেপাই পেতেও অসুবিধে হবে না। আর সরাসরি হুকুমটাও গৌণ– শোর বাজার বারণ না করলেই হল। আসল যে যুক্তি শাহি ফৌজকে অনুপ্রাণিত উদ্বুদ্ধ করবে, তার দিল জানে জোশ পয়দা করবে সেটা অতি অবশ্যই লুট করার সম্ভাবনা কতখানি? আফগান সরকার সেপাইদের যে কী মাইনে দেন সে আমার জানা আছে। পূর্বেই ধরে নিয়েছি অন্য কোনও রাষ্ট্র সদর দাউদকে কোনও অর্থসাহায্য উপস্থিত করবে না। আর করলেও যা হবে সেটা আমরা বিলক্ষণ অনুমান করতে পারি। ইনফ্লেশন। আঁতকে উঠলে নাকি সোনার বাংলার পাঠক সিদুরে মেঘ দেখতে পেলে নাকি? কিন্তু পাঠান এই সুপ্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি চেনে না।
.
ইনফ্লেশন
ঈষৎ অবান্তর হলেও, পাঠক, তুমি উপকৃত হবে। বিশেষ উপস্থিত আমরা যখন কাবুল পেশাওয়ার নিয়ে আলোচনা করছি। আমার জানা মতে যে মহাপুরুষ এ ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম ইনফ্লেশন নামক গজবটা অনুমান করতে পেরেছিলেন তিনি বাবুর বাদশা। হিন্দুস্থান জয় করার পর বাবুর বাদশাহর আমিররা কাবুলে ফিরে গিয়ে লুটতরাজে বিস্তর যে সব ধন-দৌলত জমা করেছিলেন সেগুলো দু হাতে ওড়াবার জন্য বাবুরের কাছ থেকে বিদায়ের অনুমতি চাইলেন। তিনি বিস্তর যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, হিন্দুস্থানের মতো ঐশ্বর্যশালী বিরাট রাজত্ব ত্যাগ করে কাবুল-কান্দাহারের মতো নির্ধন দেশে ফিরে যাওয়াটার মতো আহামুকি তাঁর কল্পনাতীত। আমিররা পণ ছাড়েন না। শেষটায় তিনি যা বললেন (আমি স্মৃতি থেকে বলছি, পাঠক বাবুরনামাতে পাবেন) তার বিগলিতাৰ্থ : ধরুন, এখন কাবুল-বাজারে দৈনিক ওঠে এক হাজার আণ্ডা। আপনার বিস্তর টাকা-কড়ি নিয়ে সেখানে উপস্থিত হওয়ামাত্রই তো সেখানে তিন হাজার আণ্ডা হাজির হবে না। কাবুল এবং তার আশেপাশের শক্তি তো আর রাতারাতি বেড়ে যেতে পারে না। আপনারা একে অন্যের সঙ্গে লড়ালড়ি করার ফলে আণ্ডার দাম তখন যাবে চড়ে। যে আণ্ডা আগে এক পয়সা দিয়ে কিনতেন সেটা কিনবেন এক টাকা দিয়ে, যে গালিচা কিনতেন একশো টাকা দিয়ে সেটা কিনবেন এক হাজার টাকা দিয়ে। লাভটা তা হলে কী হল? আগে যে-রকম আমোদ-আহ্লাদ করতেন এখনও করবেন ততখানিই। মাঝখানে শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি মোহর-দিনার ঢালাই হবে সার।
অবশ্য আমিররা এই সূক্ষ্ম অর্থনৈতিক তত্ত্বটির কানাকড়িও বুঝতে পারেননি। তারা যে শেষ পর্যন্ত বাবুর বাদশাহকে বর্জন করে কাবুল চলে যাননি তার অন্য কারণ ছিল। কিন্তু আমিরদের দোষ দিলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। দুষ্টলোকে বলে বাংলাদেশে এখন ইনফ্লেশন। কেনবার জিনিস নেই, ওদিকে নোটের ছয়লাপ, ইনফ্লেশন হবে না তো কী, আসমান থেকে মন্না সলতা ঝরবে? আমি নিজে জানিনে। মার্কিন মুল্লুকে তো কোনও দ্রব্যের অভাব নেই। তবে ডলার মার্কেটের ধাক্কায় বিশ্বজোড়া ধুন্দুমার লেগে গেছে কেন? একাধিক গুণী বলছেন, নিক্সন কর্ণধার হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে ইনফ্লেশন, অবশ্য আমাদের তুলনায় ধূলি পরিমাণ এবং অর্থশাস্ত্রের প্রাচীন অর্বাচীন ডাঙর ব্যাঙ্কার প্রফেসার বাণিজ্যের কর্ণধার সব্বাই বলেছেন, এ ইনফ্লেশনের কারণ এবং দাওয়াই যে মুনি বাৎলাতে পারবেন তিনি অর্থশাস্ত্রের ইতিহাসে অজরামর হয়ে বিরাজ করবেন।
.
দুশমন বাইরে না ভিতরে
মোদ্দা কথায় ফিরে আসি।
কবে সেই ১৯৫৩ থেকে দাউদ খান দাবি জানাচ্ছেন, ফ্রনটিয়ার এলাকাকে স্বায়ত্তশাসন দাও, আর (হিটলারি কায়দায়) আমাকে দাও খাইবারপাস পেরিয়ে করাচি অবধি একটা করিডর। আমাদের একটা বন্দর না হলে চলবে কেন? পাঞ্জাবিরা বুদ্ধ। তারা তখন চাইল না কেন, খাইবার গিরিপথের পশ্চিম মুখ থেকে কাবুল অবধি একটা করিডর? কাবুলের গাছপাকা আঙুর, আপেল, নাসপাতি, জরদ-আলু, আলু বালু, শফৎ-আলু, গেলাস, চিলগুজা, বাদাম, আখরোট আপন হাতে পেড়ে পেড়ে না খেলে তাদের গায়গত্তি লাগবে কী করে? স্বাস্থ্য বরবাদ হয়ে যাবে না? ইয়ার্কি পেয়েছ?