রাজনীতিতে অবিশ্বাস নয়, অবিশ্বাসে রাজনীতি।
.
আমান বনাম নাদির
আমান উল্লা অবিশ্বাস দিয়ে কর্মারম্ভ করে থাকলেও আখেরে নীতিভ্রষ্ট হয়ে রাজ্য খোয়ালেন।
নাদির শাহকে নির্বাসনে পাঠালেন। কিন্তু সসম্মানে অর্থাৎ ফ্রান্সের রাজদূতরূপে। দারাপুত্রকে জামিনস্বরূপ কাবুলে আটকে রেখেছিলেন কি না, সেটা গুরুত্বব্যঞ্জক। আমি কাবুলে রাজগোষ্ঠীর অনেক বালক-কিশোরকে চিনতুম। বেশ কজন আমার ছাত্র ছিল। কিন্তু জহির খানের কথা একবারও শুনিনি। হয়তো-বা কয়েক বৎসর পর নাদির যখন রাজদূত-কর্মে ইস্তফা দিয়ে প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলেন তখন স্বভাবজাত কোমল-হৃদয় আমান উল্লা নাদিরের দারাপুত্রকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, কিংবা হয়তো গোড়ার থেকেই আটক রাখেননি।
একটা কথা এখানে ভালো করে মনে গেঁথে নিতে হয়। নাদির ফ্রান্সে পৌঁছেই প্রথম বিশযুদ্ধজয়ী মার্শাল পেতা এবং সঁা সির-এর ফরাসি অফিসারদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেন এবং আমি লোকমুখে শুনেছি, নাদির-পেতাতে দিনের পর দিন বিরাট বিরাট মিলিটারি ম্যাপ খুলে যুদ্ধবিদ্যা অধ্যয়নে নিমগ্ন হতেন। একদিন আমান উল্লা তখৎ হারাবেন আর তিনি স্বদেশ জয় করার জন্য লড়াই লড়বেন, এহেন আকাশ-কুসুম তিনি তখন চয়ন করেছিলেন কি না, সে তথ্য নির্ধারণ করবে কে? প্রবাদবাক্য আছে, ভাগ্যলক্ষ্মী কোনও না কোনও সময়ে হাতে একটা সুযোগ নিয়ে প্রতি মানুষের দোরে এসে আগল ধরে নাড়া দেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেন, তাঁর কৃপাধন্য জন সে সুযোগের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রাখেনি। নাদির অতি অবশ্যই ব্যত্যয়!… একদিন ফ্রান্সে খবর পৌঁছল আমান উল্লা তখৃৎ হারিয়ে দেশত্যাগী হয়েছেন। নাদির তদ্দশ্যেই স্বদেশমুখী হলেন। কিন্তু তিনি অর্থ-হীন, অস্ত্রহীন। কী করে তিনি শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করলেন সে ইতিহাস দীর্ঘ। ভারতে তখন আমান উল্লাহর প্রতি মাত্রাধিক সহানুভূতি। নাদির কিন্তু আমান উল্লাহর পক্ষে না বিপক্ষে সে সম্বন্ধে কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না। তিনি বললেন, প্রথম কর্তব্য, ডাকু বাচ্চা-ই-সকাওকে খেদানো; তখন দেখা যাবে। তার পর আফগান জনসাধারণ তাকে সিংহাসন গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালে তিনি স্বীকৃত হলেন। অবশ্য একথা সত্য, তখন তখুতের জন্য অন্য কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। বসুন্ধরা বীরভোগ্যা; যদিও এস্থলে অবান্তর, তবু বহুজনহিতায় বলে রাখা ভালো, উপস্থিত তিনি তদ্বিরভোগ্যা।
প্রেসিডেন্ট দাউদ খান কীভাবে নির্বাচিত হয়েছেন সেটা সম্পূর্ণ অবান্তর। কিন্তু তাজ্জব মানতে হয়, অবিশ্বাস-শাস্ত্রে অবিশ্বাসী হলেও জহির শার নিরেট অতি-বিশ্বাসের আহাম্মকি দেখে। তিনি কি আদৌ জানতেন না, দাউদ খান কতখানি শক্তিশালী? সেটা তো পরিষ্কার বোঝা গেল একটিমাত্র সাদামাটা তথ্য থেকে : ইহ সংসারে আর কোন্ কু দে তার নায়ক চব্বিশ ঘন্টার ভিতর কিংবা অম্লাধিককালের মধ্যে প্রথম স্বীকৃতি লাভ করার পর ঢাউশ ধামা নিয়ে বসতে পেরেছেন স্বীকৃতি লাভের কামতরুতলে। পটাপট পড়তে লাগল দুনিয়ার গোটা গোটা মোটা মোটা সরেস সব মেওয়া কাবুলি মেওয়াকে সঙ্গ দেবার তরে, একটা হপ্তা ঘুরতে না ঘুরতে! এস্তেক অভিমানভরে, গোসসা করে কমনওয়েলথ বিবিকে তিনতালাক দেনেওয়ালা হি-ম্যান, হজরত আলীর তরবারি নামধারী অপিচ বাংলাদেশকে মেনে-নিতে-নিতান্তই-লজ্জাবতী নখুরা রানি সদূর-ই-আলা আগা-ই-আগা মুহম্মদ জুলফিকার আলী ভুট্টো।
সু-উচ্চ স্বীকৃতিতরু শাখা থেকে তাঁর বাং-মাছ-পারা মোচড় খাওয়া পতনভঙ্গির রঙ্গটা দেখতে আমার বড়ই সাধ যায়।
.
অবিশ্বাসস্য পুত্ৰা
মিস্টার ভুট্টোর অত্যধিক ভয় পাবার এখনও কোনও কারণ নেই। রুশ, মার্কিন, চীন, ইরান সবাই যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকে এবং মল্লভূমিতে সুন্দুমাত্র সদর দাউদ পাকিস্তানের সদর ভুট্টোর মোকাবিলা করেন তবে ভুট্টোর বিশেষ কোনও দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আমি কোনও স্ট্যাটিসটিকসের ওপর নির্ভর করে এই ভাগ্যফল গণনা করিনি। ধরে নিলুম, দুই মল্লবীর লড়াই লাগার পর তাদের আপন আপন দেশে যা অস্ত্রশস্ত্র সৈন্যদল আছে তাই নিয়ে লড়ে যাবেন। কোনও পক্ষই বিদেশি কোনও রাষ্ট্রের কাছ থেকে একটি কানাকড়ি কিংবা ডাড বুলেটও পাবেন না। জানি, আজকের দিনে এ রকম একটা ভ্যাকুয়ামে দুই পক্ষ বেশিদিন লড়তে পারবেন না। মার্কিন, রুশ, চীন– তিন রাষ্ট্রই যে বিশ্বের একচ্ছত্রাধিপত্য চান এ রকম একটা সিদ্ধান্ত কেউই কসম খেয়ে করতে পারবেন না, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ তত্ত্বটা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, এই তিনজনের প্রত্যেকেই প্রতিদিন ঘামের ফোঁটায় একে অন্যের কুমির দেখেন। মাঝরাতে হঠাৎ রাশা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে বসে ককিয়ে ওঠে, এইযু-যা! মার্কিন ব্যাটারা বুঝি কাজে গিলে ফেলল! হু, কাল আবার রিপোর্ট পেয়েছি, মার্কিন মুরগিটা এক ঝটকায় আরও এক ডজন এটম বোম পেড়েছে। একুনে তা হলে কত হল? আমার ভাঁড়ারে কটা? মার্কিন ওই একই দুঃস্বপ্ন দেখে, বলশি ব্যাটারা যে বড্ড বেশি গুঁড়ি গুঁড়ি জাপানের সঙ্গে দোস্তি করার তরে এগোচ্ছে। আর মাটির তলায় কিংবা ওই বহুদূর আর্কটিকের সমুদ্রগর্ভে যদি এটম বোম ফাটায় তবে হেথায় কি সেটা যন্ত্রপাতিতে ধরা পড়বে? হুঁ, সত্যি বটে বাবাজি ব্রেজনেভ এসেছিলেন বোষ্টমের নামাবলি পরে, বাজালেন শ্রীখোল, কিন্তু, দাদা কিসিংজার, ভুলে যেয়ো না মাইরি, শ্ৰীযুত মলটফও বৈষ্ণবতর চন্দনের এ্যাব্বড়া তিলক কপালে একে ঘোরতর-শাক্ত শ্রীহিটলারের সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করতে এসেছিলেন শ্রীবৃন্দাবন– বার্লিন কুঞ্জে। ফলং? সর্বশেষ ফল হিটলারের গোটা মুলুকসুদু গেলেন তেঁশে। চীন কী স্বপ্ন দেখে তার ছোট্ট একটি নমুনা বলে গেছেন সাধনোচিতধামপ্রাপ্ত জওয়াহির লাল। চীন নেতা নাকি তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলেন, লড়াইয়ের নামে শিউরে উঠবে তোমরা, এরা-ওরা, আর-সব্বাই- সে তো বাংলা কথা! কিন্তু আমি ডরাব কোন্ দুঃখে! দু পাঁচ কোটি মরে গিয়ে তোমরা সবাই যখন চিৎপটাং, তখনও আমার আরও ক কোটি রেস্ত থাকবে, হিসাব করে দেখেছ? দুনিয়াটা দখল করতে তখন আমাদের গাদা-বন্দুকটারও দরকার হবে না। জাপানও যে কোনও স্বপ্নই দেখছে না, কে বলবে? কুল্লে দুনিয়ার ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার বেপরোয়া ডোন্টো-কেয়ার করে ওই যে হোথা ফ্রান্স পরশুদিন এটম বোম ফাটাল, সেটা কি খয়রাতি হাসপাতাল খোলার হুলুধ্বনি? … অবিশ্বাস অবিশ্বাস, সর্ব বিশ্বে অবিশ্বাস! শৃন্বন্তু বিশ্বে অবিশ্বাস্য পুত্রা।