আমার লেখা ভালো না মন্দ তার সাফাই আমি গাইব কি? মোদ্দা কথা– আমার রচনা পাঠ্যপুস্তকে তুলে সেটা জোর করে জোরসে যাদের গেলানো হয়েছে তাদের বর্তমান আবাস ঢাকার ভিন্ন ভিন্ন হল-এ। সাধে কি আমি ওসব পাড়া এড়িয়ে চলি।
.
সূর্যসেন হল, বাপস! নব পরিচয়
তাই আমি নতুন করে আমার পরিচয় দিতে চাই। প্রায় বিশ বৎসর ধরে আমার লেখা এ দেশে পাওয়া যেত কালে কস্মিনে। ওপার বাংলা আমায় কিছুটা চিনেছে ওই দুই দশক ধরে। পূর্বদেশের বিজ্ঞপ্তি যে আমি সনাতন আফগানিস্তান আজকের দৃশ্যপটে ফেলে ধারাবাহিকভাবে লিখব, এ খবরটা যদি পাক-চক্রে সেখানে পৌঁছায় তবে ঘটিরা যে কী অট্টহাস্য ছাড়বে সে আপনারা হাইকোর্ট দর্শনে না গিয়ে স্রেফ বুড়িগঙ্গার পারে বসেই ঘটিগঙ্গার জলমর্মরের সঙ্গে শুনতে পাবেন। ওরা এবং এ-পারে, বহু দূরের বগুড়াবাসীরা মাত্র গুহ্য তত্ত্বটি অবগত আছেন; পার্টিশনের পরেই একটি বিশেষ দ্রব্য হেথাকার নওগাঁ থেকে চালান বন্ধ হয়ে যায়। ভদ্রলোকের ছেলে সরাসরি নওগাঁ যাই কী প্রকারে? তাই সেটাকে বগুড়াবাসের কামুফ্লাজে ঢেকে সেখানে কয়েক মাস কাটাই। কিন্তু কপাল মন্দ। চিফ-সেক্রেটারি আজিজ আহমদ- আহা, কী আজিজ প্যারা দোস্তই না পেয়েছিল মহাপুণ্যবান মরহুম পূর্ব পাকিস্তান– তিনি আমাকে হাতের কাছে না পেয়ে লাগলেন আমার ইষ্টিকুটুমের পিছনে। কীই-বা করি তখন আমি আর? গুটি গুটি ফের কলকাতা। মেহেরবান আজিমুশোন আজিজ আহমদ খান জান-প্রাণ ভরে তসল্লির ঠাণ্ডি সস ফেললেন! পাকের চেয়ে পাক মশরিকি পাকিস্তানকে বরবাদ পয়মাল করার তরে যে বদ বখৎ হিন্দুস্থানি এসেছিল হেথায়, সে-ইবলিস গেছে। জিন্দাবাদ সাহেবজাদ আজিজ যদিও তিনিই পুব পাক বাবদে যে পাজ-সে-পাক সব-সে পহলি পালিসির (পলিসির খাঁটি আজিজি পাঞ্জাবি উচ্চারণ) পালিশ লাগিয়েছিলেন, তারই ফলে ডজন দুই বছর যেতে না যেতেই উপরকার দুই পাকের ভাই বেরাদরি ভণ্ডামির পলকা পলেস্তরা উবে গিয়ে বেরিয়ে এল– গিল্টি, গিল্টি, নির্ভেজাল গিল্টি; আজিজের দুই চোখ, দিলজানের দুশমন রবিঠাকুরের কণ্ঠে তখন পাগলা মেহের আলীর চিৎকার তফাত যাও, তফাত যাও। সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।
ব এ গর্দিশে চরখ-ই-নীলুফরি
ন আজিজ বজ-আমদ ন্ নাদরি ॥
সুনীল নীলাম্বুজের ন্যায় গভীর নীলাকাশ একটি বারের মতো পরিবর্তিত হইয়াছে কি, না– নাদির এমনকি তাহার নাদরি হুকুম পর্যন্ত লোক পাইল– অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদ। আমি শুধু প্রথম নাদিরের স্থলে আজিজ লোকটাকে দিয়ে নাম পরিবর্তন করেছি; স্বাধিকারপ্রমত্ত আজিজ চোটাওয়ালা নাদিরের মতো ফরমান ঝাড়তেন বলে নাদরীর পরিবর্তন করার প্রয়োজন বোধ করিনি।
মেহেরবান সম্পাদক, কারণ অকৃপণ অভাজন-অনুরক্ত পাঠক, আজ যদি প্রাণ খুলে দুটি মনের কথা কই তবে অপরাধ নিয়োনি। সিকি শতাব্দী ধরে ট্যাঁ-ফুঁ-টি করার উপায় ছিল না। ওপার বাংলাতেও না। এপারে যে আমার শতাধিক প্রিয়ের চেয়ে প্রিয়তর জন রয়েছে।
আচ্ছা, সে নয় আরেকদিন হবে।
.
গঞ্জিকা মিশ্রণ
নওগাঁয়ের সেইসঙ্গে বিশেষ বস্তুটি গুল যোগ করে যে অনির্বচনীয় রস তৈরি হয় আমি তারই রাজা– গুলগির। আলগিরের ওজনে টায় টায়। এর পুরো ইতিহাস বারান্তরে।… নিতান্তই কপালের গেরো, গ্রহের গর্দিশে আমি দু পাঁচজন গুণীর সংস্রবে একাধিকবার আসি। তাদেরই ঝড়তি-পড়তি মাল নিজের নামে চালিয়ে বাজারে কিঞ্চিৎ পসার হয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃত অবিমিশ্র সত্যঃ–গুরুগম্ভীর তত্ত্ব বা তথ্য ভেজাল না দিয়ে পরিবেশন করাটা আমার ধাতে সয় না, স্যাকরা যেমন আপন মায়ের জন্যে গয়না গড়ার সময়ও সোনাতে খাদ মেশাবেই মেশাবে। আমি উভয় বাংলার ক্লাউন ভাড়। নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, সার্কাসের ক্লাউন হরেক বাজিকর, প্রত্যেক ওস্তাদের কিছু না-কিছু নকল করতে পারে। আমো পারি।
অতএব প্রকৃত চাণক্য, আজকের দিনের রাজনৈতিক ভাষ্যকার আলাক্টের কুক-এর অনুকরণে আমি অতি যৎসামান্য কিছু বলতে গেলেও তার সঙ্গে গাঁজাগুল মিশে যায়। আমি মূল বক্তব্যে নিজেকে কিছুতেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারিনে। কবিতৃরস রক্তে থাকলে বলতুম, নাক বরাবর মোকামের দিকে হনহন করে না এগিয়ে মোকাবেমোকায় আকছারই পথের দু পাশে নেমে ফুল কুড়োই, প্রজাপতি-স্পন্দন ভ্রমর গুঞ্জনে বার বার মুগ্ধ হয়ে হঠাৎ দেখি, তপ্তদিনের শেষে মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গিয়েছে এবং মজিলে মা দূর আস্থ। পথের পাশেই ঘুমিয়ে পড়ি। পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, এ যাবৎ বাঘ-সিঙ্গির পেটের ভিতর যাইনি। সেই কুড়োনো ফুলের দু চারটে পাঠকের সামনে অবরে-সবরে পেশ না করতে পারলে আমার মেজাজ খাট্টা হয়ে যায়।
কামশাস্ত্রে দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত লিখলেন, তন্বী সকাশে মৃদ্যাচারী অর্থাৎ তন্বী-শ্যামা পবিম্বাধরোষ্ঠী তথা সর্বনারীজনকে মৃদু-আচারে জয় করবে। জর্মন দার্শনিক বলেছেন, নারী সকাশে গমনকালে বেত্ৰদণ্ডটি নিয়ে যেতে ভুলো না ফেরগিস ডি পাইশে নি; প্রাগুক্ত কাম-পণ্ডিতের একদম বিরুদ্ধ বাণী, বিরুদ্ধ উপদেশ। আমার কোনও মন্তব্য নেই। আমি হাড়-আসে জড়ভরত। তাই বেকার বখেড়া না বাড়িয়ে স্ত্রী-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।
রাজনীতিবিদ পণ্ডিত দুটি শব্দেই মোক্ষমতম তত্ত্ব রাজনীতিতে অবিশ্বাস প্রকাশ করলেন। অর্থাৎ রাজনীতির আগাপাশতলা অবিশ্বাসে গড়া।