শোর বাজার-যাজক-সম্প্রদায় আমানউল্লাহর বিরোধী ছিলেন বলে ধর্মবিদ্বেষী সোভিয়েত আমান উল্লাহকে যতখানি পারে সাহায্য করে সেটা অবশ্য যৎসামান্য। কিন্তু তখন সোভিয়েত রাষ্ট্র মাত্র এগারো বৎসরের বালক। ক্যুনিস্ট-বৈরীরা বলে সোভিয়েত ইতোমধ্যে ধর্মবাবদে যথেষ্ট সহিষ্ণু হয়ে গিয়েছে, এমনকি প্রয়োজন হলে যাজক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আঁতাত করতেও এখন তার বিশেষ কোনও বাধা নেই। ইতালির শান্ত সংযত কম্যুনিস্ট নেতা নাকি এ পথ সুগম করে দেন।
এ সব জল্পনা-কল্পনা যদি সত্য হয় তবে একটা অভিজ্ঞতা-জাত তত্ত্ব এস্থলে স্মরণে রাখা ভালো। কাবুল রাজদূতাবাসের একাধিক ইংরেজ কূটনীতিক আমাকে বলেন, আফগান ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিদেশি কোনও রাষ্ট্রের মোটা রকমের মদত নিয়ে যিনিই এযাবৎ আফগান রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়েছেন, তিনিই আজ হোক কাল হোক, জনপ্রিয়তা হারান এবং তাকে হটাবার জন্য নতুন ষড়যন্ত্র নতুন বিপ্লববাদীর অভাব হয় না। একটা প্যাটাইম শেষ হতে না হতেই অন্য দুর্দৈবের কথা কল্পনা করতেও আমার মন বিকল হয়ে যায়। আমরা গরিব, আফগানিস্তান আমাদের চেয়েও নিঃস্ব। সেখানে অযথা শক্তিক্ষয় রক্তপাত সার্বিক দৈন্য বৃদ্ধি করার জন্য গ্রহ-কুগ্রহের যোগাযোগ।
ভারত একদা আফগানিস্তানের প্রতিবেশী ছিল, এখন নয়। সে স্বীকৃতি দিয়েছে একটিমাত্র বিষয় বিবেচনা করার পর। যে কোনও কারণেই হোক, তার বিশ্বাস হয়েছে সদর দাউদের গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টা সফল হবে। তদুপরি হয়তো-বা কেউ কেউ বলবে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যে বিলম্ব করেছিলে সেটার পুনরাবৃত্তি কর না। ব্যক্তিগতভাবে আমি অতি অবশ্য বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানকে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে একাসনে বসাই না, যদ্যপি আমি চিরকালই আফগানের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। নীতির দিক দিয়ে, মানবতার দৃষ্টিবিন্দু থেকে বাংলাদেশের দাবি বহু বহু উচ্চে।
মি. ভুট্টো পড়েছেন ফাটা বাঁশের মধ্যিখানে। ওদিকে মুর্শিদ নিনও অসুস্থতা ও ওয়াটার-গেট দুই গেরোর চাপে পড়ে সদর ভুট্টোর ভেট নামঞ্জুর করেছেন, এদিকে পাকদ্বেষী শিয়াবৈরী সদর দাউদ বড় বেশি মাত্রায় ভেট করতে চাইছেন যে।
.
রাজনীতি অবিশ্বাসে
ভারতের এক প্রাচীন রাজা তার দেশের সর্বোত্তম চিকিৎসক, কামশাস্ত্রবিদ এবং রাজনীতিকে ডেকে বললেন, তোমরা সবাই যে যার শাস্ত্রে পর্বতপ্রমাণ কেতাব-পুঁথির যেসব কাঞ্চনজঙ্ নির্মাণ করেছ সেগুলোতে আরোহণ করার প্রবৃত্তি এবং শক্তি আমার নেই। তোমরা তিনজন মিলে মাত্র একটা শ্লোকে আপন আপন বিদ্যে পুরে দাও। ওই দিয়েই আমার কাজ চলে যাবে।এস্থলে অক্ষম লেখকের সঙ্কোচে নিবেদন, আসলে রাজা চার শাস্ত্রের চার সুপণ্ডিতকে। ডেকেছিলেন, আমি চতুর্থ পণ্ডিতের বিষয়বস্তু তথা শ্লোকের চতুর্থাংশ বেমালুম ভুলে গিয়েছি। অতএব আশুতোষ ও অল্পতোষ পাঠককে বক্ষ্যমাণ ত্রিলেগেডরেস দেখেই সন্তুষ্ট হতে হবে।
বৈদ্যরাজ তার বরাদ্দ শ্লোকাংশে লিখলেন : জীর্ণে ভোজনং! অর্থাৎ ইতিপূর্বে যা খেয়েছ। সেটা হজম– জীর্ণ-হলে পর তবে ভোজনং অর্থাৎ তখন খাবে। এই বিসমিল্লাতেই ডাক্তার এবং কবিরাজে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। ডাক্তারের আদেশে, রুটিনমাফিক, পানকচুয়ালি, প্রতিদিন একই সময়ে ভোজনং! পক্ষান্তরে কবিরাজ বলেছেন, পূর্বাহের পূর্বান্ন হজম হলে পর আপনার থেকেই ক্ষুধা পাবে, তখন খাবে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এটা ডাক্তারি প্রেসক্রিপশনের উল্টো বিধান। যেদিন শারীরিক পরিশ্রমের বাড়াবাড়ি সেদিন ক্ষিদে পায় তড়িঘড়ি। যেদিন কারফুর কানমলায় উঠান-সমুদ্র পেরোনো প্রাণের দায়, সেদিন ক্ষিদে পায় কি না পায়! অতএব পানকচুয়ালি ভোজন হয় কী প্রকারে? তদুপরি অদ্যদিনের সুপার ডাক্তার রোগ ধরতে না পারলেই বলেন, নার্ভাস একদা যেমন বলতেন এলার্জি। তা তারা যা বলুন, যা কন- পাড়ার বারিক মালিক অবধি সব্বাই জানে, হৃদয়মন বিকল থাকলে ক্ষিদে পেট ছেড়ে মাথায় চড়েন।
মমেকসদয় পাঠক ঈষৎ অতিষ্ঠ হয়ে বলবেন, কোথায় কাবুলের হানাহানি আর কোথায় তুমি করছ ডাক্তার-বদ্যি নিয়ে টানাটানি!
.
কনফেশন বা কৈফেয়ৎ
পয়লা কদম ফেলার নাম মকদ্দমা, এর হুবহু সংস্কৃত প্রতিশব্দ অবতরণিকা। মকদ্দমা বলতে আরবিতে মামলা দায়েরের পয়লা পর্ব প্রিমা ফাঁসি কেস- বোঝায়। বাংলায় সাকুল্যে মোকদ্দমাটা বোঝায় এবং তারও বেশি আগাপাশতলা মোকদ্দমা এবং তার সাথি আর পাঁচটা বিড়ম্বনা বোঝাতে হলে বলি, মামলা-মোকদ্দমা। ইতিহাসের দর্শন শাস্ত্রের আবিষ্কর্তা ইবন খলদুন তাঁর বিশ্ব-ইতিহাসের অবতরণিকা মুকদ্দমার জন্য বিশ্ববিখ্যাত।
আসলে যা বলার কথা সেটি মোকদ্দমাতেই বলে নিতে হয়। আমারও শাদির পয়লা রাতেই বেড়াল মারা উচিত ছিল, অর্থাৎ বক্ষ্যমাণ ধারাবাহিকের পয়লা কিস্তিতেই। কিন্তু সে সময় ভাই-বেরাদর পাড়ার পাঁচো ইয়ার ছোঁক ছোঁক করছেন সদ্য সদ্য তাজা কাবুলি মেওয়া চাখবার তরে। আমার ফরিয়াদ শুনবে কে?
বাংলাদেশের পাঠক আমাকে চেনেন অল্পই। এর ভিতরে অনেকেই আবার আমার ওপর রাগত ভাব পোষণ করেন। মরহুম পূর্ব পাকিস্তানের সেকেন্ডারি বোর্ড আমার সর্বনাশকল্পে মল্লিখিত প্রথম পুস্তক থেকে তাদের স্কুলপাঠ্য গ্রন্থে বেপরোয়া ঝালে-ঝোলে-অম্বলে অর্থাৎ ক্লাস সিক্স্ থেকে ম্যাট্রিক অবধি দু পাঁচ পাতা তুলে দিতেন। আর কে না জানে, এনুয়েলের আজরাইল না আসা পর্যন্ত রবি-কবির ভাষায়, অপাঠ্য সব পাঠ্য কেতাব সামনে আছে খোলা- কোন মূর্খ পাঠ্যপুস্তককে পাঠের উপযোগী বলে মনে করে? বললে পেত্যয় যাবেন, কাবুলিওয়ালার মতো সরেস গল্প ক্লাসে পড়াতে গিয়ে আমি হিমসিম খেয়েছি? বরঞ্চ বাচ্চাটাকে জোর করে কুইনিন গেলানো যায়, কিন্তু জোর করে রসগোল্লা গেলাতে গেলে সে যা লড়াই দেয় তার সামনে যোদ্ধাও ভাবে মিঞা ওসমানীর জায়গায় একে জঙ্গিলাট বানালে ন মাস আগেই স্বরাজ আসত।