অতএব, উল্লেখ নিতান্তই বাহুল্য যে, সদর দাউদকে বন্ধুর সন্ধানে– ব তলাশে দোস্ত– বেরুতে হবে। ভ্রাতৃযুদ্ধের সময় বান্ধবের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। ওদিকে সম্ভাব্য বান্ধবরাও রাষ্ট্রনেতাকে বাজিয়ে দেখতে চান, তিনি শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকবেন কি না। পূর্বেই বলেছি, কাবুলের কর্ণধার হলেই যে তিনি তাবৎ আফগানিস্তানের প্রভু হতে পারবেন, এমন কোনও কথা নেই। অতএব, আফগানিস্তানের সঙ্গে যেসব রাষ্ট্রের স্বার্থ সাক্ষাৎ বা পরোক্ষভাবে বিজড়িত তারা সদর দাউদের নতুন রাষ্ট্রকে পত্রপাঠ ঝটপট স্বীকৃতি দেবার পূর্বে কান্দাহার, গজনি, জালালাবাদ তাঁর বশ্যতা মেনে নিয়েছে কি না, না মেনে থাকলে সেগুলোকে শায়েস্তা করবার মতো তার সৈন্যবল, অস্ত্রবল, অর্থবল পর্যাপ্ত কি না তারই সন্ধান নেবে। ওদিকে, বলতে গেলে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, কাবুল এইসব এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন। যেসব রাষ্ট্র আফগানিস্তানের প্রতিবেশী, যেমন রুশ, ইরান, পাকিস্তান– এরাও এসব এলাকার কোনও পাকা খবর পাচ্ছেন না।
তৎসত্ত্বেও বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ রুশের মতো রাষ্ট্র, যার ওরিয়েন্টাল ধর্ম শত শত বৎসর ধরে বিশ্বময় সুপরিচিত, এস্তেক দশক দুত্তিন পূর্বে হিটলার-চেম্বারলেন উভয়কে প্রায় উন্মদাশ্রমে পাঠাবার মতো বাতাবরণের সৃষ্টি করে তুলেছিল আর এদানির কেষ্ট বিষ্ট, রাজনীতির স্কুলে নিতান্তই তিফল-ই-মক্তববৎ চ্যাংড়া, যাদের কোনওকিছুতেই তর সয় না, রাতারাতি চৌষট্টি-তলার এমার নির্মাণ যাদের কাছে ডাল-ভাত– থুড়ি, হট-ডগ-হাম বুর্গার সেই নিকসন-কিসিংজারকে পকেটে পুরেছে যারা, তারা কি না অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে, প্রতিবেশী কুল্লে মুল্লককে সুপারসনিক স্পিডে তালিম দিয়ে তেরাত্তির যেতে না যেতে দুশমনি মার্কিনি কায়দায়, বহু বৎসরের হারিয়ে যাওয়া ফিরে পাওয়া ভাইটির মতো সদর দাউদকে নিয়ে পাঠানি বেরাদরি কায়দায় একই বন থেকে গোশত-রুটি খেতে আরম্ভ করে দিল? আমি মূর্খ, বার বার আহাম্মুখ বনে বনে ওই তামাশায় দস্তুরমতো চ্যাম্পিয়ন, আন্মো বেবাক অবাক। ক্ষণতরে ভাবলুম, পূর্বদেশে বিজ্ঞাপিত ধারাবাহিকের ধারাটা বেলাবেলিই পাথর দিয়ে বন্ধ করে দিই। পরে দেখলুম কিলটা হজম করে নেওয়াই প্রশস্ততর।
রুশের এই সৃষ্টিছাড়া আচরণের কারণটা কী?
অবশ্যই প্রথম কারণ, সতের বৎসরের পুরনো ইংরেজ সপত্ন বঁধুয়ার আঙিনাতে আজ আর নেই। সে থাকলে এই বরমাল্য দানের বদলাই নেবার তরে এনে দিত মোতির মালা। রুশকে আনতে হত লাল-ই-বদখশান– চুন। ইংরেজ আনত… গয়রহ ইত্যাদি।
অর্থাৎ দাউদ যাত্রারম্ভের পূর্বে হয়তো-বা রুশের আশীর্বাদ নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। হয়তো-বা রাজা জহিরের নিরপেক্ষ নীতি রুশ পছন্দ করত না। দাউদ হয়তো ভিন্ন ওয়াদা দিয়েছেন। জহিরের নীতি একদিন হয়তো মার্কিনকে ইংরেজের ভ্যাকুয়ামে টেনে আনত। কান্দাহার-জালালাবাদকে ঘায়েল করার জন্য রুশ আজ সদর দাউদকে যা দেবে, মার্কিন তার বদলে দাউদ বৈরীদের দিত মোতির মালা, রুশকে ছুটতে হত বদখশান… উপরে দেওয়া আড়াআড়ির বাজার দর দ্রষ্টব্য। অতএব মার্কিন নাগর রসবতীর সন্ধানে আসার পূর্বেই দাও স্বীকৃতি।
কয়েক বছর আগেও রুশ ঝটিতি দাউদকে এরকম স্বীকৃতি দিত না, কারণ কিংবদন্তি অনুযায়ী যে হিন্দুকুশ পর্বত উত্তীর্ণ হবার সময় সে পর্বত বিস্তর হিন্দুর (আর্যের) প্রাণহরণ করে (কুশৎ, তাই হিন্দুকুশ), সেটাকে অতিক্রম করে মাত্র কয়েক বৎসর পূর্বেও ট্যাঙ্ক-কামান কাবুলে আনাটা ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব। বেশ কয়েক বছর হল বাদশাহ জহিরের অনুরোধে রাশানরা অপথে-বিপথে কয়েকটা টানেল খুঁড়ে, লেভেল রাস্তা বানিয়ে, কে জানে ক হাজার ফুট চড়াই-উত্রাই তো এড়িয়েছে বটেই, তদুপরি না জানি ক-শো মাইল রাস্তাও কমিয়ে দিয়েছে।
.
তৃতীয় পক্ষ পাকিস্তান
তদুপরি সরাসরি দুশমন না হলেও পাকিস্তানের সঙ্গে রুশের ঠিক বনছে না। কারণটা অতীব সরল। পাকিস্তান নিক্সনের চতুর্দিকে সাত পাকের বদলে সত্তর পাক খাচ্ছেন। পাকিস্তানই অগ্রণী হয়ে মার্কিনের সঙ্গে তার দুশমন চীনের ভাবসাব করিয়ে দিয়েছে। এখন তার দাদ নিতে হবে। এবং এর সঙ্গে জড়িত আছে আরেকটি ফৌজি চাল। শেষ পর্যন্ত যদি চীনের সঙ্গে লেগে যায় তবে আফগানিস্তানের ঘাঁটি থেকেও চীনকে কিছুটা বিব্রত করা যাবে।
কিন্তু একটা ব্যাপার আমার মনে ধন্ধ সৃষ্টি করেছে। পাঠকের স্মরণে আসতে পারে, আমান উল্লাকে বিতাড়িত করার পিছনে ছিলেন, যাকে প্রায় আফগানিস্তানের পোপ বলা যেতে পারে, সেই শোর বাজারের হজরৎ। ডাকু বাচ্চা-ই-সাঁকোও কাবুলের দিকে এগিয়ে আসার পূর্বেই তাঁর আদেশে শাহি ফৌজের সেপাইরা বাগ-ই-বালা ত্যাগ করে যে যার বাড়ি চলে যায়। আমি পূর্বেই প্রশ্ন শুধিয়েছিলুম, আর্ক এবং বাগ-ই-বালা দাউদ খান দখল করলেন কী করে? যতদূর জানা গেছে, বলবার মতো কোনওই প্রতিরোধ সেখানকার সৈন্যরা দেয়নি হয়তো-বা ক্যু-র পূর্বেই এরা আপন আপন গাঁয়ে শোর বাজারের বর্তমান-গদিনশিনের আদেশে চলে গিয়েছিল। এবং এটাও লক্ষ করেছি, সদর দাউদ সরকারি পদ্ধতিতে সাড়ম্বরে তাঁর প্রথম ভাষণেই বলেছেন, তাঁর নবীন রাষ্ট্র যদিও রিপাবলিক তবু সেটা ইসলামের ঐতিহ্যানুযায়ী গঠিত হবে। বলা বাহুল্য, সেটা সুন্নি মজহব অনুযায়ী। তদুপরি দাউদ খান যখন দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়ার মতো অনেক কিছু অনেক দিন থেকেই তাঁর রয়েছে, তখন শোর বাজার সঙ্গে সঙ্গে স্মরণে আনেন, স্বয়ং মরহুম জিন্নাহ থেকে আরম্ভ করে কোন কোন পাকনায়ক শিয়া। এমনকি শিয়া না হয়েও জফরউল্লাহ এঁদের আরেক ধাপ নিচে তিনি কাদিয়ানি। গোঁড়া আফগান সদাসর্বদা কাদিয়ানি মাত্রকেই ইসলাম-ত্যাগী মুলাহিদ বলে গণ্য করে এবং তারা ওয়াজিব উল-কৎল– যাদের কতল করা ওয়াজিব। কাবুলবাসী জাত হিন্দু বা শিখের কাছ থেকে হয়তো-বা জিজিয়া ভোলা যায়, কিন্তু তাদের ওপর অত্যাচার করার বিধান নেই। স্বয়ং আমান উল্লাহর আমলে শহর-কাজির হুকুমে একজন তথাকথিত কাদিয়ানিকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারা হয়। দাউদেরও শিয়াদের প্রতি নিজস্ব উকট জাতক্রোধ আছে। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ইরানের শিয়া শাহের প্ররোচনায় জহির তাঁকে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে বরখাস্ত করে সরদারদের হিসেবে না নিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাদামাটা ড, ইউসুফকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দেন।*[* ১. ড. ইউসুফ বুদ্ধিজীবী ও রবিভক্ত। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরের বৎসরই শান্তিনিকেতনে এসে কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান।]