স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এ রকম একটা জিগির চিত্তহারিণী হবেই। পেশাওয়ারে খাস পাঠানদের বাড়ি-গাড়ি অত্যল্পই। পাঞ্জাবিরা সেখানে বিস্তর ধনদৌলত সঞ্চয় করেছে পার্টিশনের সময় বেধড়ক লুট করে। এবারে পাঞ্জাবি মৌমাছিদের খেদিয়ে দিয়ে বাড়ি আনতে হবে ইয়াব্বড়া বড়া মধুভাণ্ড! আজ সদর দাউদ খাইবারপাস থেকে শুরু করে জালালাবাদ, সিমলা, খাক-ই-জব্বার তক সব দেশপ্রেমী পাঠানদের যে ইঙ্গিত দিচ্ছেন সেটা কিঞ্চিৎ বঙ্কিম হলেও সুস্পষ্ট। অর্থাৎ কাবুলে বাদশা-বদল হলে ওইসব অঞ্চলের যে পাঠানরা একজোট হয়ে ধাওয়া করে জালালাবাদ লুটতে– দাউদ তাদের বলছেন, হে দেশপ্রেমী পাঠান, তুমি আপন দেশ লুটতে যাবে কেন? তোমাকে তো বলেছি, পাকিস্তানের সঙ্গে আমার যে বোঝাপড়া এতদিন তোমাদের ওই নিষ্কর্মা জহিরের জন্য মুলতবি ছিল, এখন সে শুভ-লগ্ন উপস্থিত। তোমাদের কম্পাসের কাটাটা ঘুরিয়ে দাও। ভালো-মন্দের কথা হচ্ছে না; এটা সহজ পলিটিক্স। বেতারে শুনতে পেলুম, দাউদ প্রেসিডেন্ট হয়েই বিদেশি রাজদূতদের ডেকে পাঠান- নিদেন প্রেসিডেন্টের তখতে না বসা পর্যন্ত ওঁদের ডাকা যায় না এবং তাঁদের শান্তি শান্তি, সালাম ইয়া সালাম, সর্ববিশ্বে শান্তি এই বাণী উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে এইবারে আমার বোঝাপড়া শুরু হবে। বেতারের রিপোর্টার মন্তব্য করেছেন, প্রেসিডেন্টের বলার ধরনটা আদৌ সুলেহ্-সন্ধি সূচক ছিল না। (আমি নিজে ধরনটার গুরুত্ব অত বেশি দিইনে; কে না জানে, মানুষ রান্নার সময় যে গরমে ভাত ফোঁটায়, অতখানি গরমাগরম গেছে না)।
এই মামুলি লেখনের গোড়াতে যে দোনলা বন্দুকের উল্লেখ করেছিলুম, এই তার দোসরা নল।
কিন্তু পাকিস্তান যে ইসলামি রাষ্ট্র? আমরা পাকিস্তান-আফগানিস্তান কোনও রাষ্ট্রেরই অমঙ্গল কামনা করি না। কিন্তু দাউদ কী উত্তর দেবেন সেটা কিঞ্চিৎ অনুমান করতে পারি। জালালাবাদ অঞ্চলের পাঠানদের চাপে পড়ে যদিচ সেটাই একমাত্র চাপ ছিল না– একদা আমান উল্লাহর তখৎ যায়। এখন এরা যদি অবশ্য সেটা অনুমান মাত্র– জেনারেল দাউদকে সমর্থন না করে তবে তাঁর তো গত্যন্তর নেই। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তাঁকে তখন কট্টরস্য কট্টর সুন্নি পাঠানদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলতে হবে, পাকিস্তানের সদর (শব্দার্থে বক্ষস্থল), ডিক্টেটর কে, যার হুকুমে তামাম পাকিস্তান ওঠ-বস করে? স্বৈরতন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। সে তো শিয়া।
নজিরস্বরূপ আরেকটা তথ্য সদর দাউদ বলবার হক্ক ধরেন। তিনি বলতে পারেন, ১৯৫৮ সালে যখন আমি প্রধানমন্ত্রী তখন পাকিস্তানের যে সদর ইসকন্দর মির্জা আমাদের সঙ্গে সুলেহ করতে চেয়েছিল, সে কথাবার্তা বলেছিল তার সঙ্গে? বাদশাহ জহিরের সঙ্গে। আমি কথাই বলিনি। কেন? সে-ও ছিল শিয়া। তারও একটুখানি পরে কেঃ ইয়াহিয়া। সে-ও শিয়া।
মুশকিল!!
***
ক্যু দে তা মূলত ফরাসি। ক্যু = আঘাত, গুঁতো; দ্য-ইংরেজি অব; এতা = রাষ্ট্র ইংরেজি স্টেট ওই একই শব্দ। অকস্মাৎ, বলপ্রয়োগ করে, সচরাচর দেশের সংবিধান বা ঐতিহ্য উপেক্ষা করে যদি এক রাজার বদলে আরেক রাজা তখতে বসে যান, কিংবা রাজাকে হটিয়ে গণতন্ত্র, অথবা গণতন্ত্রকে হটিয়ে স্বৈরতন্ত্র (ডিক্টেটরি) পত্তন করেন তবে সেই বলপ্রয়োগ (কু) দ্বারা রাষ্ট্রের (এ) রূপ বা ভাগ্য পরিবর্তনের নাম কু দে তা। দেশবিভাগের পর সর্বপ্রথম একটা কু দেতার পূর্বাভাস দেন আধ-সেদ্ধ ডিক্টেটর ইসকন্দর মির্জা, আসল সুসিদ্ধ ক্য করলেন আইয়ুব। তার পরের মাল সব ঝুট। ভুট্টো যদি মিলিটারি জুন্তাকে নির্মূল করে যা-ইচ্ছা-তাই বা যাচ্ছেতাই করতে পারেন তবে সেটা হবে তাঁর ব্যক্তিগত ক্যু।
ক্যু দ্য পালে রাজপ্রাসাদের (পালে, পেলেস, প্রাসাদ) ভিতরকার আকস্মিক পরিবর্তন। কু দ্য পালে প্রতিষ্ঠানটি অতিশয় প্রাচীন, কিন্তু বাক্যটি প্রচলিত হয়েছে হালফিল। একদা যে কোনও ব্যক্তি রাজাকে গুম-খুন করে দুম করে সিংহাসনে বসে যেতে পারলেই দেশের লোক গড়িমসি না করে তাঁকে রাজা বলে মেনে নিত। এখন অত সহজে হয় না। রাজা ফারুককে হটানোটার আরম্ভ হয় কু দ্য পালে দিয়ে, কিন্তু নজিব-নাসিরের পিছনে দেশের (এতা-র) লোক ছিল বলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে কু দে তা-তে পরিবর্তিত হয়।
অতএব কু দে তা বিরাটতর রাষ্ট্রবিপ্লব ক্যু দ্য পালের চেয়ে।
জেনারেল দাউদ যে কর্মটি সমাধান করলেন সেটা স্পষ্টত কু দ্য পালে দিয়ে আরম্ভ; এখন যদি সেটা কু দে তাতে পরিবর্তিত না হয় তবে বেশ কিছুকাল ধরে চলবে অরাজকতা, অর্থাৎ রাষ্ট্র-শক্তিধারীহীন রাষ্ট্রবিপ্লব না সিভিল ওয়ার। ইহ-সংসারে যত প্রকারের যুদ্ধ হয়, কোনও দেশের কিস্মত ভাণ্ডারে যত রকমের গজব আছে, তার নিকৃষ্টতম নিষ্ঠুরতম উদাহরণ ভ্রাতৃ-যুদ্ধ।
চাণক্য বলেছেন, যে ব্যক্তি উৎসবে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে (যখন পুলিশ কাউকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করায়) এবং সর্বশেষে বন্ধুকে শ্মশানে বয়ে নিয়ে যায়, সে-ই প্রকৃত বান্ধব।
উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে।
রাজদ্বারে শুশানে চ যঃ তিষ্ঠতি স বান্ধব ॥
দোস্ত কুজা আস্ত?
মিত্র কুত্র অস্তি? দোস্ত কোথায় আছে?