তাই ইংরেজ গলফ খেলার সময়ই হোক আর রিলেটিভিটি কপচাবার ওক্তেই হোক, সবকিছু মা-লক্ষ্মীর আঁচলে বেঁধে দেয়।
পাঠানের বর্ণচোরা সংস্করণের নাম ইংরেজ। পাঠানও তার ন্যাশনাল প্যাসটাইম–দু-দুশ বছর পর পর কাবুলের তখৎ থেকে পুরনো বাদশাহকে সরিয়ে নয়া বাদশাহ সানোর জাতীয় চিত্তবিনোদনের সময় মার্কস-নির্দিষ্ট নীতি, ইংরেজ কর্তৃক হাতে-কলমে তার ফলপ্রাপ্তি, কোনওটাই ভোলে না।
বিআ ব-কাবুল, বরওম ব-কাবুল,
বিআ ব-কাবুল বরওয়িম ব-কাবুল।
আয় তুই কাবুল, আমি চললাম কাবুল,
আয় তুই কাবুল আমরা চলি কাবুল ॥
দীন দীন রবে হুহুঙ্কার চিৎকার পাঠানের কাছে বিলকুল ফজুল। কাবুল লুট করাতে কী আনন্দ কী আনন্দ!
ন্যাশনাল প্যাস্টাইমের সঙ্গে অর্থপ্রাপ্তির সমন্বয়।
.
দোনলা-বন্দুক
প্রেসিডেন্ট দাউদ খানের সর্বপ্রধান শিরঃপীড়া হবে এই পাঠান ডাকুর পাল। ওদের সামলাতে হলে দরকার ফৌজ। দাউদ খান তার ভাষণারম্ভে সম্বোধন জানিয়েছেন পেট্রিয়টদের, দেশপ্রেমিকদের ফারসিতে দোস্তান-ই-মূলক বা সমাসবদ্ধ ইয়ার-উল-মুলক কিংবা আরব্য রজনীর শহর-ইয়ার-এর ওজনে মুলক-ইয়ার অথবা সাদামাটা হম্ ওয়াতুন স্বদেশবাসী যা-ই বলে থাকুন না কেন, পাঠান-হৃদয়ে আফগানিস্তান নামক রাষ্ট্রের প্রতি কোনও প্রকারের খাস, দিল-তোড় মহব্বতের কোনও নিশান আমি দেখিনি। যে অঞ্চলে সে বাস করে অর্থাৎ কওমি এলাকার প্রতি তার টান থাকা অসম্ভব নয়– পাখিটাও তার নীড়ের শাখাঁটির মঙ্গল কামনা করে কিন্তু দেশপ্রেম! অতএব দেশপ্রেমী দাউদ দেশের দোহাই দিয়েছেন দোনলা বন্দুকের মতো। কাবুল ও কাবুলাঞ্চলের সরকারি ফৌজ যেন তার কাছ থেকে বড্ড বেশি টাকা-কড়ি না চায়। কাবুলের ভিতরকার আর্ক-দুর্গের তোষাখানায় কী পরিমাণ অর্থ তিনি পেয়েছেন সেটা তাঁর প্রথম ভাষণেই ফাঁস করে দেবেন এমনতরো দুরাশা তার নব-নিযুক্ত প্রধানমন্ত্রীও করবেন না। এবং এটাও অসম্ভব নয় যে, জহির শাহ ভিনদেশ যাবার মুখে বাগ-ই-বালার (আমাদের তেজগাঁও) কেন্দ্রীয় শাহী সৈন্যদের কমান্ডান্ট আপন দামাদ জেনারেল শাহ ওয়ালি খানের হেফাজতে গ্যারিসনের মধ্যেই রেখে গিয়েছিলেন। বলা শক্ত মানুষ আপন দামাদ, না ভগ্নীপতি, কাকে বেশি বিশ্বাস করো খবর এসেছে, জেনারেল ওয়ালিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। সেটা নিশ্চয়ই গ্যারিসন জয় করার পূর্বে দাউদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। হঠাৎ করে দাউদ ওটাকে জয় করার মতো ফৌজ আর হাতিয়ার পাবেন কোথায়? এবং আর্ক-দুৰ্গই-বা তিনি কাবু করলেন কী করে? সেখানে তো তাঁর বাস করার কথা নয়।
.
দাউদের পূর্বকথা
আফগান রাজনীতিতে বলা উচিত ছিল কাবুলের রাজনৈতিক দলাদলির প্রধান নেতা রাজ-গোষ্ঠীর সরদারগণ। দাউদ এদেরই একজন। জহির রাজা হন ১৯৩৩-এ। দাউদ তার প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে। অনুমান করা অসঙ্গত নয়, তিনি কুড়ি বত্সর ধরে তার শক্তি সঞ্চয় করে চলছিলেন অর্থাৎ সরদারদের মধ্যে যে কজনকে পারেন আপন দলে টানছিলেন। এটা যে প্রকাশ্যে তখৎ-নশিন বাদশাহর বিরুদ্ধে করা হয় তা নয়। গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান মেনে নিয়ে প্রত্যেক পলিটিশিয়ান যে রকম আপন দলের সংখ্যা বৃদ্ধি করে হুবহু সেই রকম কাউকে দলের উচ্চাদর্শ দেখিয়ে, কাউকে মন্ত্রিত্বের ওয়াদা দিয়ে, কাউকে-বা উঁই ডাই কন্ট্রাক্টের লোভ দেখিয়ে ইত্যাদি। কোনও সরদার যদি সত্যই পালের মধ্যে বড় বেশি জোরদার হয়ে যান, তবে বাদশাহ যে ঈষৎ শঙ্কিত হন সেটাও জানা কথা। তখন তাঁকে নিতান্ত নিজস্ব আপন দলে টানার জন্য বাদশাহ তার বোন বা মেয়েকে সেই সরদারের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত হন। পাঠকের স্মরণে আসতে পারে, আমির হবীবউল্লাহ যখন দেখলেন, মোল্লাদের চিত্তজয় করে তাঁর অনুজ নসরউল্লাহ এত বেশি তেজিয়ান হয়ে গিয়েছেন যে তিনি রীতিমতো শঙ্কিত হলেন– তাঁর মৃত্যুর পর আপন পুত্র যুবরাজ ইনায়েউল্লাহ হয়তো রাজা হতে পারবেন না, রাজা হয়ে যাবেন নসরউল্লাহ। তাই তিনি যুবরাজকে বিয়ে দিতে চাইলেন নসর-কন্যার সঙ্গে। নসর হয়তো-বা আপন দামাদকে খুন করতে ইতস্তত করবেন– ওই ছিল তাঁর গোপন আশা।… এ স্থলে, যদিও টায় টায় খাটে না, তবু হয়তো-বা দাউদকে আপন দলে টানবার জন্য জহির বোনকে আদমের আপেলের মতো তার সম্মুখে ধরলেন। বস্তুত আফগান রাজগোষ্ঠীর হতভাগিনী কুমারীকুল সে দেশের রাজনৈতিক দাবা খেলায় বড়ের মতোই এগিয়ে গিয়ে ছকের মাঝখানে প্রাণ দেন, রাজার দুর্গ অভেদ্যতর করবার জন্য (কাসলিং)। কেউ কেউ আমৃত্যু কুমারীই থেকে যান– ক্রীড়ারম্ভে যে ছকে জন্মগত অধিকার বা কিস্মতবশত তাঁকে দাঁড় করানো হয়েছিল কিস্তিমাৎ পর্যন্ত সেখানেই অর্থহীন নিষ্কর্মার মতো অবশ অচল হয়ে থাকেন। ষাট বছরের বুড়ো সরদারের সঙ্গে চৌদ্দ বছরের কচি মেয়ের বিয়ে হওয়াটাও আদৌ বিচিত্র নয়। কিন্তু উপস্থিত থাক সে দীর্ঘ দয়াধর্মহীন কাহিনী। শুধু বাদশাহর নয়, কুল্লে সরদার-বালাদের ওই একই হাল।
.
পট বদল
১৯৪৭-এ হঠাৎ ইংরেজের পরিবর্তে দেখা দিল পাকিস্তান। আমানউল্লাহ ইংরেজ এবং রুশ দুই সপত্নের (সপত্নীর পুংলিঙ্গ বিশুদ্ধ সংস্কৃতে সপত্ন মডার্ন কবিদের ভাষায় পুং-সতীন) মাঝখানে ছিলেন মোটামুটি ভালোই। আখেরের নতিজা– সে কাহিনী প্রাচীন ও দীর্ঘ।…বাদশাহ জহির হঠাৎ দেখেন তাগড়া ইংরেজ সপত্নের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দুর্বল পাকিস্তান সে-ও আবার কাবুলের সঙ্গে ফ্লার্ট করা দূরে থাক, ইন্ডিয়া নিয়ে সে ব্যতিব্যস্ত। খুদ বাদশাহর কী মতিগতি ছিল জানিনে, কিন্তু সরদার দাউদ হয়ে দাঁড়ালেন পয়লা নম্বরের চ্যাম্পিয়ান, পাঠানদের তাড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে কামড় মেরে এক খাবলা গোশত, ফোকটে মেরে দিতে। তাঁর দল হল আরও ভারী। বিআব-পেশাওয়ার চলি, চলো পেশাওয়ার/চে খুব উমদা সে-ভাণ্ডার।