এর মোদ্দাটা আমাদের সোনার বাংলার একটি প্রবাদে অনায়াস-লভ্য। একে তো ছিল নাচিয়ে বুড়ি, তার ওপর পেল মৃদঙ্গের তাল। পাঠান-আফগানরা নাচবার তরে হরহামেশা তৈরি, কিন্তু ওই যে মৃদঙ্গটা ওতে দু চারটে চাটিম চাটিম বোল তুললে তবে তো মৌজটা জমে এবং সে মৃদঙ্গ বাজাতেন আকছারই ইংরেজ মহাপ্রভুরা পেশোয়ারে বসে। ১৯১৭-এর পূর্বে কখনও-বা রাশার জার– আমু দরিয়ার ওপারে বসে। এনারা নাচবার তরে কড়ি ভি দিতেন, নাচের সময় শাবাশি দিতেন, নাচ শেষে আপন আপন পছন্দসই আমিরকে তখতে বসাতেন। শেষবারের মতো ডুগডুগি বাজিয়েছিল ইংরেজ ১৯২৮/২৯-এ। নাদির শাহকে মারার পিছনে কেউ ছিল কি না, সঠিক বলতে পারব না।
.
পটভূমি
আমান উল্লাহ যখন দেশের তরে লড়াই দেন, তখন তাঁর জঙ্গিলাট ছিলেন নাদির খান। স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন পরেই, যে কোনও কারণেই হোক, তার মনে নাদিরের মতলব সম্বন্ধে সন্দেহের উদয় হল, লোকটা আফগান ফৌজের এতই প্যারা যে, কখন যে একটা মিলিটারি কু লাগিয়ে নিজেই রাজা হয়ে বসবে না, তার কি প্রত্যয়! আমান উল্লাহ নিজেই তো রাজা হলেন সত্তাই, যুবরাজ এনায়েত উল্লাকে তার হক্কের তখুৎ থেকে বঞ্চিত করে– যদিও সমস্ত ষড়যন্ত্র বলুন, প্যান্টটাইম বলুন ব্যাপারটার পরিপাটি ব্যবস্থা করেছিলেন তার আম্মাজান, আমান উল্লাহর পেটে কতখানি এলেম ছিল সে তারিফ তার পরম প্যারা দোস্ততক করতে গেলে বিষম খেত। কিন্তু তার চেয়ে একটা মোক্ষমতর তত্ত্ব আছে, সিংহাসন নিয়ে কাড়াকাড়ি বাবদে। আর্যদের ভিতর বহু প্রাচীনকাল থেকেই একটা ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে- পিতা গত হলে বড় ছেলে পরিবারের কর্তা হবে। কোনও কোনও আর্য গোষ্ঠীতে তো সে আইন এমনি কট্টর যে, বড় ছেলে ভিন্ন অন্য ভাইরা পিতার সম্পত্তির কানাকড়িটাও পায় না, গ্রাসাচ্ছাদনও না। সর্বব্যবস্থার মতো এ ব্যবস্থাটারও সদ-গুণ বদ-গুণ দুই-ই আছে। কিন্তু আফগানদের ভিতর সে আইন খুব একটা চালু হয়নি। আমান উল্লাহ নাদিরকে বিদেশে চালান দিয়েছিলেন।
.
লাঠি যার দেশ তার
কাবুলের সিংহাসনে বসার হক্ক শেষটায় বংশানুক্রমে গিয়ে দাঁড়ায় মূলত কান্দাহারের আব্দুর রহমান, হবীব উল্লা, আমান উল্লাহর গোষ্ঠীতে। তার অর্থ ওই গোষ্ঠীর যার লাঠি তার মোষ। আমান উল্লাহ, নাদির, জহির আর আজকের জেনারেল মুহম্মদ দাউদ খান সক্কলেরই যে কেউ গায়ের জোরে একবার কাবুলের তখতে বসে যেতে পারলে, ক্রমে ক্রমে জালালাবাদ, গজনি, কান্দাহার শায়েস্তা করে তাঁবেতে আনতে পারলে তাবৎ আফগানিস্তান তাঁকে আলা-হজরত বাদশাহ বলে মেনে নেয়। কাতাখান-বদখশান মজার-ই-শরীফের বিশেষ কোনও মাহাত্ম্য নেই।
উপস্থিত দেখতে পাচ্ছি, জেনারেল দাউদ মাত্র কাবুলের প্রধান। সদরও বলতে পারেন। বেতার বলছে, কাবুলের বাইরে এখনও তার রাজ্যবিস্তার আরম্ভ হয়নি। তবে কাবুল উপত্যকার বাইরে উত্তর দিকে, অন্তত মাইল দশ-পনেরো দূরের একটা জায়গা (চল্লিশ বছর হয়ে গেল, নামটা ঠিক মনে নেই, খুব সম্ভব জাবাল উস্-সরাজ) থেকে আসে বিজলি। সেটা নিশ্চয়ই জেনারেল দাউদের বেতে। নইলে সিমলে পাহাড় থেকে কাবুল বেতারে দাউদের জয়ধ্বনি আকাশবাণীর মনিটর শুনল কী করে?
ওদিকে যদিও কাবুল বিমানবন্দর এক্কেবারে শহরের গা ঘেঁষে তবু বিলেত ছেড়ে কাবুলে যে প্লেন আসছিল সেটা সোজা দিল্লি চলে গেল কেন? লাহোর কিংবা করাচিতেই নামল না কেন? হয়তো প্লেনে রাজপরিবারের দু-চারজন কিংবা/এবং জহিরপন্থি কিছু লোক ছিলেন যাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে কাবুল যাওয়াটা মোটেই নিরাপদ নয়। পাকিস্তানে নামাটাও খুব সুবুদ্ধিমানের কাজ হত না। ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের কোনও দুশমনি নেই। ভারতই ভালো। কাবুল অ্যার-পোর্টে নামাটা টেকনিক্যালি সম্ভবপর হলেও।
বহুকাল হল কাবুল বেতার শুনিনি। একদা সন্ধে সাতটা-আটটা থেকেই বিদেশের জন্য তাদের প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যেত, পশতু এবং ফারসিতে। রাত এগারোটার ঝোঁকে ইংরেজিতে, এবং পিঠ পিঠ ফরাসিতে। দেখি, রাত ঘনালে পাই কি না। তবে ক্য দেতা, বা কু দ্য পালে হয়ে যাওয়ার পর নানা কারণে সচরাচর জোরদার ট্রান্সমিটার ব্যবহার করা হয় না বা যায় না।
.
অর্থই পরমার্থ
কার্ল মার্কস বলেছেন, অর্থনৈতিক কারণ ভিন্ন ইহ-সংসারে কোনও বিরাট পরিবর্তন হয় না। ইংরেজ এই নীতি অবলম্বন করে তার ন্যাশনাল প্যাসটাইম জাতীয় চিত্তবিনোদন প্রতিষ্ঠান ফুটবল-ক্রিকেটকে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে সমাসন স্থলবিশেষে উচ্চাসন দিয়ে যে অত্যদ্ভুত সমন্বয় সাধন করল তারই অর্ধশিক্ষিত-অধর্মবীর সন্তানগণ স্থাপন করল বিশ্বজোড়া রাশি রাশি উপনিবেশ। কন্টিনেন্টের তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়ামোদ তার চতুঃসীমানায় প্রবেশ করতে দিত না। অতএব উপনিবেশ স্থাপন ও তথায় রাজত্ব করার জন্য শিক্ষিত লোক পাঠালে তারা মরত পটাপট করে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, সে সে ফিভার ইত্যাদির নানাবিধ রোগে; পক্ষান্তরে আখড়া থেকে ধরে ধরে ডানপিটে গাঁট্টাগোট্টাদের পাঠালে তারা পট পট পটল তুলত না বটে, কিন্তু পটলক্ষেতের হিসেব-নিকেশ থেকে আরম্ভ করে উপনিবেশের বাজেট, অডিট, আইন-কানুন, এককথায় দেশ শোষণ করার জন্য যে সিভিল সার্ভিস গড়ে তুলতে হয় তার জন্য নিরঙ্কুশ অনুপযুক্ত। কেউ কেউ তো নামটা পর্যন্ত সই করতে পারত না।