এর সঙ্গে শ্রীযুক্তা উমা চট্টোপাধ্যায় যোগ দিয়েছিলেন, কোনও কোনও স্বনামধন্য লেখক আজও ইট পাটকেলের মতো অযথা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করেন।
অনায়াসে বোঝা যাচ্ছে উভয় বাঙলার সমস্যা এক নয়। যদিও চিরন্তন সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে উভয় বাঙলার সমস্যা প্রায় একই, বিশ্বসাহিত্যেও প্রায় তাই-ই। উভয় বাংলার সার্থক সাহিত্য সৃষ্টিতে পার্থক্য থাকবে অত্যল্প এবং সেগুলো রসের বিচারে গৌণ। পুব বাঙলার অধিকাংশ লেখক মুসলমান তাঁদের সৃষ্টিতে মুসলিম সমাজ চিত্রিত হবে অপেক্ষাকৃত বেশি। পশ্চিম বাঙলায় চিত্রিত হবে হিন্দু সমাজ। এ স্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে উল্লেখ করি, একশো বছর পূর্বে যখন বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমস্ত ভারতে ছড়িয়ে পড়ছিলেন তখন বাঙলা দেশের অনেকেই আশা করেছিলেন এঁরা তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ নগরের আলেখ্য অঙ্কন করবেন, অন্ততপক্ষে দূর দেশে বাঙালির জীবনধারা তাঁদের নির্মিত অশ্রুজলে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপগুলো রসের মাধ্যমে কিছুটা চিনতে শিখবে। সে আশা সম্পূর্ণ নিষ্ফল হয়নি ঠিক, সেইরকম পুব বাঙলা থেকে আমরা সার্থক সাহিত্য তো আশা করিই। তদুপরি সে সাহিত্যে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু অজানা অচেনা নয়া নয়া ছবি দেখতে পাবেন নিছক ফাউ হিসেবে গ্রেস মার্কের মতো। জয় বাঙলা।
কিন্তু উপস্থিত পুব বাঙলার মোট সর্ববৃহৎ সমস্যা এবং একদিন সে সমস্যা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সে সত্যও জানি– সেটা বাংলাদেশের তাবৎ সরকারি বে-সরকারি কাজকর্ম বাঙলারই মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায় কী প্রকারে? যেমন ধরুন, খাদ্য-সমস্যা। ঢাকায় খবর এল চাটগাঁয়ে চাল বড় আক্রা, রংপুরে ভালো ভালো ফসল হয়েছে। সে চাল তড়িঘড়ি ট্রেনে করে পাঠাতে হবে চাটগাঁ। ইতোমধ্যে ঢাকাতে টেলিফোনের নামকরণ হয়ে গেছে দূরালাপনী বা দূর-আলাপনী–দূরালাপী বোধ হয় নয়। আমি অবশ্য দূর-বাকী, দূর-বাচনী নাম দিতে চেয়েছিলুম, কারণ প্রয়োজন হলে উম্মা প্রকাশার্থে সন্ধি করে নিলেই হল, দুর্বাকী দুর্বাচী যা খুশি। কিন্তু কী দরকার। দীর্ঘ ঊ-কেহ করে দিলেই হল। দুরাশয়গণ অহরহ দুরালাপ করে, এই অর্থে দুরালাপনী বললে চলে যেতে পারে। কিন্তু অনপনেয় কালি দিয়ে নাম সই করবেন সত্যি প্রথম দর্শনে আমার মুখ কালিমাখা করে দিয়েছিল। কিন্তু ইনডেলবি-এর অন্য কী বাঙলা শব্দ হতে পারে? দূরপনেয় কলঙ্ক বাঙলাতে খুবই চলে। সে কলঙ্ক কষ্টসহ মুছতে হয় সেই ওজনে যে কালি কিছুতেই মোছা যায় না। অবশ্য উন্নাসিক সম্প্রদায় আপত্তি তুলতে পারেন। অনপনেয় কালিতে গুরুচণ্ডালি দোষ বিদ্যমান। বলা উচিত ছিল অনপনেয় মসি। তদুত্তরে বক্তব্য, ইহলোক ত্যাগ করার তিন বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ চলতি বাঙলা ভাষার একটা খতিয়ান নেন বা সিংহাবলোকন (সার্ভে) করেন; ইতোপূর্বে কবি বাঙলা ভাষা শব্দ-ধ্বনিতত্ত্ব ব্যাকরণ নিয়ে অজস্র রচনা প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু সেগুলো প্রধানত বা সর্বত সাধুভাষা নিয়ে। কিন্তু চলতি ভাষা এনে দিয়েছে নতুন নতুন সমস্যা। সে সমস্ত আদ্যন্ত আলোচনা করার পর বাঙ্ময় সম্রাট দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে রাজাদেশ প্রচার করেন।
সাহিত্যিক দণ্ডনীতির ধারা থেকে শুরুচণ্ডালি অপরাধের কোঠা উঠেই গেছে।
.
অপিচ
অমুকের কণ্ঠে গানে দরদ লাগে না বললে ঠিক কথাটি বলা হয়। গুরুচণ্ডালির শাসনকর্তা যদি দরদের বদলে সংবেদনা শব্দ চালাবার হুকুম করেন তবে অমান্য করলে অপরাধ হবে না। (বাংলা ভাষা পরিচয়, র র ২৬ খণ্ড পৃ. ৩৯৫ ও প.)
কিন্তু এহ বাহ্য। তবু যে এই সঙ্কটের কথাটা উল্লেখ করলুম, তার কারণ পুব বাঙলার লোক গুরুচণ্ডালি পত্তপ্রকর্ষতা দোষ সম্বন্ধে পশ্চিম বাঙলার চেয়ে ঢের বেশি সচেতন।
মোদ্দা কথা এই ফোন যন্ত্রটির পরিভাষা কী হল না হল তার চেয়ে ঢের বেশি মারাত্মক রেলের এঞ্জিনচালক, সিগনেল ম্যান, গার্ড সাহেব, বিজলির মিস্ত্রি ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য লোক তাদের তরো-বেতরো যন্ত্রপাতি কলকজার কী পরিভাষা নির্মাণ করছে। সামান্য ভুল বোঝাবুঝির ফলে দুর্ঘটনা ঘটাটা মোটেই অকল্পনীয় নয়।
ওদিকে প্রাচীন দিনের ব্যরোক্রেটরা রাতারাতি বাঙলাতে জটিল জটিল সমস্যার বিশ্লেষণ তাদের টীকা, প্রস্তাবের মুসাবিদা লিখবেন কী প্রকারে? সিকিশিক্ষিত এক ইমাম সাহেব। খামোখা বেমক্কা আমাকে বলেন, আপনি তো বাঙলা বাঙলা বলে চেল্লাচ্ছেন কবে সেই বাবা আদমের কাল থেকে– যদিও এ বাবদে আমাদের ইটের মান দিকধিড়িঙ্গে প্রামাণিক গ্রন্থে আপনার উল্লেখ নেই। আমি হাতজোড় করে বললুম, রক্ষে দিন, ইমাম সাহেব! আপনার পরবর্তী ইস্টিশন বেহেশতে ফিরিশতাদের বাঙলা বলতে হবে এহেন ফতোয়া তো আমি কখনও দিইনি। জানি, জানি। কিন্তু ওই যে আপনাদের সংবিধান না কী যেন তৈরি হল তার দুটো তসবির। একটা বাঙলাতে অন্যটা ইংরেজিতে। এবং সাফ জবানে বলা হয়েছে, অর্থ নিয়ে মতবিরোধ যদি হয়, তবে ইংরেজি তসবিরই প্রামাণিক আপ্তবাক্য। আমি বিশ্বাস করিনি এবং হলেও আমার কণামাত্র ব্যক্তিগত আপত্তি নেই।
কিন্তু এ বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, স্বয়ং শেখজি থেকে বিস্তর লোক হরহামেশা বাঙলার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেছেন। কিন্তু তাঁদেরও তো মাঝে মাঝে ধোকা লাগে, কোনও ইংরেজি শব্দের সঠিক বাংলা পরিভাষা কী। তখন ফোন করা হয়, কিংবা ডাক পড়ে প্রবীণ সাহিত্যিককে বা সাহিত্যিকদের। তারাই বা কজন সর্বসাকুল্যে বেঁচে আছেন তখনও টিক্কা, অল-বদর, শান্তি কমিটি, বেহারিদের টেলিস্কোপ মাইক্রোস্কোপ সংযুক্ত ডবল জালের ছাঁকনি এড়িয়ে! দেশের কাজকাম যদি বন্ধ হয়ে যায় হবে না, আমি জানি তবে,