নগদ যা পাও হাত পেতে নাও।
বাকির খাতায় শূন্য থাক!
দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে।
মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।
— (কান্তি ঘোষ)
ওদিকে আবার আছে তাদের দেদার নিউজপ্রিন্ট, নেই কিন্তু যথেষ্ট বই ছাপাবার কাগজ, এটা ওটা সেটা বিস্তর জিনিস। এবং টেকসট বই যে সর্বাধিকার পাবে সে তত্ত্ব তো তর্কাতীত।
এবং যে নিদারুণ সত্য পুব বাঙলায় তো বটেই, পশ্চিম বাঙলারও ভুলতে সময় লাগবে সেটা যখন ঠেকাবার শত চেষ্টা সত্ত্বেও স্মৃতিতে আসে তখন দেহমন যেন বিষিয়ে যায় : শহিদ হয়েছেন যেসব অগ্রণী পথপ্রদর্শক লেখক তাদের সংখ্যা আদৌ নগণ্য নয়, প্রতিভাবান উদীয়মান লেখক অনেক, ছাত্রসমাজের উজ্জ্বল উজ্জ্বল মণিরাশি, অসংখ্য গুণগ্রাহী পাঠক, বিত্তশালী পৃষ্ঠপোষক, আমার ভাগ্নের মতো শত শত যুবক-যুবতী যারা সাহিত্যিকদের সেবা করত সগর্বে সানন্দে, সাহায্য করত তাদের অতিশয় ক্ষীণতম বটুয়া থেকে যা বেরোয় তাই দিয়ে, বই কিনত সিনেমা জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে, বাঙলা ভাষার কণ্ঠবোধ করার জন্য পিণ্ডির হীন খল প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে যারা সম্পাদককে পাঠাতে স্বনামে তীব্রতম তীক্ষ্ণতম ভাষায় বেপরোয়া প্রতিবাদ– যার অধিকাংশ ছাপা হলে সম্পাদক লেখক গয়রহ নিঃসন্দেহে হতেন। গবর্নর মোনায়েম খানের রাজসিক মেহমান। এরাই ছিল পূর্ণার্থে সর্বার্থে স্পর্শকাতর। তাই এরাই ছিল সব প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোধা, এরাই মুক্তিযুদ্ধে আহ্বায়ক, সহায়ক এবং নায়করূপে প্রথমতম শহিদ। এদের অনেকেই বেরিয়েছিল বিচ্ছিন্নভাবে একা একা, বর্ষ তখনও হয় নাই শেষ, এসেছে চৈত্রসন্ধ্যা কিন্তু হায়, চৈত্রদিনের মধুর খেলা খেলতে নয়, সেই চৈত্র মুসলিম গণনায় ছিল মহরমের মাস, আদর্শের জন্য শহিদ মাস–
আমারে ফুটিতে হল
বসন্তের অন্তিম নিঃশ্বাসে
বিষণ্ণ যখন বিশ্ব
নির্মম গ্রীষ্মের পদানত,
রুদ্র তপস্যার বনে
আধো ত্রাসে আধেক উল্লাসে
একাকী বহিরি এনু
সাহসিকা অপ্সরার মতো।
—(সত্যেন দত্ত)*
পিশাচের দাবানলে ভস্মীভূত হবার জন্য।
[*উদ্ধৃতিতে ভুল থাকাটা আদৌ অস্বাভাবিক হবে না। ৫০/৫৫ বছর হল চম্পা কবিতাটি প্রথম পড়ি, তার পর এটি দৃষ্টিগোচর হয়নি। চম্পার প্রথম দর্শনেই কবিগুরু এমনি মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, সেটি তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। আমার বাসনা যায় জানতে আর কোন কোন বাঙালি কবির কবিতা তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। বহুকাল ধরে আমার আন্তরিক প্রার্থনা ছিল, সত্যেন দত্তের সম্পূর্ণ গ্রন্থাবলি সম্পাদন করার।]
.
উভয় বাঙলা– বাঙলা দেশের প্রধান সমস্যা
মাতৃভাষার ইতিহাস অধ্যয়ন, মাতৃভাষাকে জনসমাজে উচ্চাসন দান, সে ভাষাকে পূত-পবিত্র করার জন্য তার থেকে বিদেশি শব্দ লৌহ-সম্মার্জনী দ্বারা বিতাড়ন নানারূপে নানা দেশে বার বার দেখা দিয়েছে এবং দেবে। এ সঙ্গে অনেক স্থলেই রাজনীতি জড়িয়ে পড়ে, কিংবা বিদেশি রাজার প্রতাপে যখন প্রপীড়িতজনের আপন বলে ডাকবার আর কোনও কিছুই থাকে না তখন অনেক ক্ষেত্রেই নিছক আত্মানুভূতির জন্য আমি আছি, আমার কিছু একটা এখনও আছে সে তার শেষ আশ্রয় অবহেলিত মাতৃভাষার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে, তাকে পরিপুষ্ট করার জন্য দেশে আন্দোলন চালায়, চরমে পৌঁছে কভু বা মাতৃভাষা থেকে তাবৎ বিদেশি শব্দ ঝেটিয়ে বের করে, কভু বা মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষার মাধ্যমে যে বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করা হয় তাকে বয়কট করে, ২১শে ফেব্রুয়ারি সাড়ম্বরে উদযাপন করে, সেদিনটাকে বড়দিনের মতো সম্মানিত করার জন্য হয় হরতাল করে, নয় সরকারের ওপর চাপ আনে সেটাকে যেন হোলি ডে রূপে স্বীকার করা হয় ও হলি ডে রূপে অনধ্যায় দিবস বলে গণ্য করা হয়। আন্দোলন জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃভাষা বাবদে এযাবৎ উদাসীন সুবিধাবাদী পলিটিশিয়ানরা (সুবিধাবাদী বলাটা নিষ্প্রয়োজন– অমাবস্যার অন্ধকার রাত্রির বর্ণনাতে অন্ধকার না বললেও চলে) গুঁড়ি গুঁড়ি দলে ভিড়তে থাকেন এবং যারা সত্য সত্য মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগতবশত বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে আন্দোলনটাকে শক্তিশালী করে তুলেছিল তাদের হাত থেকে আন্দোলন পরিচালনা করার ক্ষমতা কেড়ে নেন।
এরপর যদি ধীরে ধীরে স্বরাজ আসে তবে মাতৃভাষার প্রতি অনুরক্ত তথা সে ভাষায় সুশিক্ষিত জন কিছুটা অবকাশ পান ভাষাটাকে গড়ে তোলার জন্য, যাতে করে স্বরাজ লাভের পর মাতৃভাষার সাহায্যেই সব শিক্ষাদীক্ষা রাষ্ট্রের সর্ব দৈনন্দিন কাজকর্ম সমাপন করা যায়। এ জাতীয় গঠনমূলক কর্মের জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা খবরের কাগজে ফলাও করে আত্মপ্রশস্তি গাওয়ার সুযোগ নেই, স্বরাজ লাভের পর তো আরও কম।
জনপ্রিয়, শ্রদ্ধেয় লেখক শঙ্কর মাস দুই পূর্বে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখ উপলক্ষে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, বাংলা ভাষা আজ ওপার বাংলাতেও তেমন প্রাণোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে না, যা কিছুদিন আগেও দেখা গিয়েছে। বাংলা ভাষাকে একাদশ কোটি মানুষের ভাবপ্রকাশের সার্থক মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে যে বিরাট কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন, তার সূচনা কোথায়?
পশ্চিম বাঙলা বাবদে তার ক্ষোভ : এক শ্রেণির উচ্চশিক্ষিত বাঙালি আবার মাতৃভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।… ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে, ইংরেজি গান শুনে… এঁরা অজান্তে নিজ বাসভূমে পরবাসী সৃষ্টি করছেন। এঁদের ধারণা সন্তানদের বাংলা শিখিয়ে লাভ নেই। চাকরির জন্য প্রয়োজন ইংরেজি ইত্যাদি।