পশ্চিম বাঙলার প্রকাশক লেখক ওই নিয়ে অত্যধিক প্রতিবাদ আর্তনাদ করেছিলেন বলে মনে পড়ে না। না করে ভালোই করেছেন। একে তো তাতে করে কণামাত্র লাভ হত না, উল্টো পিণ্ডি সেগুলো বিকৃতরূপে ফলাও করে পশ্চিম পাকে প্রপাগান্ডা চালাত– যে পশ্চিমবঙ্গ পুস্তকাদির মারফত পূর্ববঙ্গীয় মোহাচ্ছন মুসলমানদের ওপর তার সনাতন কাফিরি হিন্দু প্রভাব প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে আছে, তারা কিছুতেই বাঙালি মুসলমানকে খাঁটি মুসলমান হতে দেবে না। সম্পাদকরা অবশ্য তাঁদের মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন– সেটা করা তাদের কর্তব্যও বটে। পিণ্ডি তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার তখন করেছে। এখনও মি. ভুট্টো নানা কৌশলে এদেশের খবর, সম্পাদকীয় মন্তব্যের কদৰ্থ নিত্য নিত্য করে যাচ্ছেন।
আইয়ুব-ইয়েহিয়ার জন্টার জতো মি. ভুট্টো পরে নিয়েছেন- এইটকই সামান্য পার্থক্য। এমনকি জুন্টা পুব বাঙলার সম্মানিত নাগরিক মওলানা ভাসানী, শেখ সায়েবকেও প্রপাগান্ডা থেকে নিষ্কৃতি দেয়নি- ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর আগেও। ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে মওলানা ভাসানী কল্পনাতীত বিরাট এক জনসভাতে তুমুলতম হর্ষধ্বনির মধ্যে পূর্ব বাঙলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন– অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও মওলানাকে সমর্থন জানান। শেখ তখনও আপ্রাণ চেষ্টা দিচ্ছেন পশ্চিম পাকের সঙ্গে দেশের মর্যাদা রক্ষা করে একটা সমঝোতার আশায়। ভাসানীর ঘোষণা যেন ছাপ্পর ফোড় কর অপ্রত্যাশিতভাবে কিস্মতের কারণহীন বখশিশের মতো জুন্টার মস্তকে বর্ষিত হল। পিণ্ডি, লাহোর, করাচিতে তখন দিনের পর দিন ভাসানীর আপন দেশের অবিরল বারিধারার মতো, লাহোর পিণ্ডি ক্লাব-কাবারের উচ্ছ্বসিত মদিরাধারাকে পরাজিত করে চলল কুৎসা প্রচার : ভাসানী আসলে হিন্দু ভারতের এজেন্ট। ভারতেরই প্ররোচনায় লোকটা হাটের মাঝখানে হাঁড়ি ফাটিয়েছে। শুধু তার দলই যে পূর্ণ স্বাধীনতা চায় তাই নয়, ভাসানীর (একদা) সহকর্মী অনুগামী শেখও ঠিক এইটেই চায়, সমঝোতার নাম করে শুধুমাত্র ভণ্ডামির মুখোশ পরে আপন ন্যায়সঙ্গত সামান্যতম দাবির একটা কেস (আলিবি) খাড়া করতে চায় বিশ্ববাসীর সামনে, শেষটায় যাতে করে পাকিস্তানের নিতান্ত ঘরোয়া মামুলি মতভেদটাকে এক ভীষণ প্রলয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক সঙ্কটময় রূপ দিয়ে ইউএন ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, দু-একটা অর্বাচীন পকু-নিতম্ব ছোটাসে ছোটা দেশের দরদভি হাসিল করতে পারে। মোদ্দা কথা : ভাসানী যা শেখও তা।… যতদূর জানি আচারনিষ্ঠ মওলানা আপন সম্প্রদায়কে ভালোবাসেন, কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষবশত (যদি সে বিদ্বেষ তিনি পোষণ করেন। তিনি বিশেষ বিশেষ নিরপরাধ হিন্দুর প্রতি না-হক নির্দয় হবেন এটা চট করে মেনে নিতে মন চায় না। যা হোক, তা হোক– তাকে ভারতপ্রেমী আখ্যা দিলে তিনি খুব সম্ভব মৌল ইদের মতো তুর্কি নাচন আরম্ভ করবেন না, আত্মো পূর্ববৎ এটা চট করে গলতল করতে পারব না। কিন্তু এহ বাহ্য।
এদিকে কিন্তু ঢাকার প্রায় তাবৎ পাবলিশার মিশ্রিত উল্লাস বোধ করলেন বটে কিন্তু পশ্চিম বাঙলার কোনও বই-ই ছাপাতে পারবেন না– সে লেখক ভারতচন্দ্রই হোন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমই হোন। যাদের পুস্তকে কোনও কপিরাইট নেই, কাউকে কোনও রয়েলটি দিতে হবে না– সেইটে হল তাদের প্রধান শিরঃপীড়া। কিছু কিছু লেখক অবশ্য অবিমিশ্র আনন্দ উপভোগ করলেন। তাঁদের ধারণা : পশ্চিম বাঙলার সরেস বই গায়েব হয়ে গেলে তাদের নিরেস বই হু-হু করে, গরমকালে ডাবের মতো, শীতের সঝে চায়ের মতো বিক্রি হবে। এই কিছু-কিছুদের অনেকেই কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস করেন, তাঁদের সৃষ্টি আদৌ নিরেস নয়, বিশেষত যারা ইসলামি মদুন– সভ্যতা বৈদগ্ধ্য সম্বন্ধে কেতাব রচনা করতেন। একজন কথাসাহিত্যস্রষ্টা আমাকে বলেন, পূর্ব বাঙলার লোক যে কলকাতার বই পড়ে সেটা একটা বদঅভ্যাস মাত্র। সেই কফি হোঁস, গড়ের মাঠ, কলেজ স্ট্রিট, ট্রামগাড়ি, বোটানিকাল কিংবা ছেরামপুরী পাদ্রি, হেস্টিংসের কেলেঙ্কারি ওসব ছাড়া অন্য পরিবেশের বই, যেমন বুড়িগঙ্গা, রমনা মাঠ, নবাববাড়ি, মোতিঝিলের কর্মচঞ্চলতা, নারায়ণগঞ্জের জাত-বেজাতের বিচিত্রতা– এদের গায়েতে এখনও সেই রোমান্টিক শ্যাওলা গজায়নি, ব্রোনজ মূর্তির গায়ে প্ল্যাটিনার পলেস্তরা পড়েনি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললুম, পুব বাঙলার পরিবেশ, পূব বাঙলার জীবন নিয়ে যদি একটা সার্থক সাহিত্য গড়ে ওঠে তবে পশ্চিম বাঙলার কাছে সেটা হবে নতুন একরকমের রোমান্টিক সাহিত্য। পাঠক হিসেবে বলছি, আমার মতো বহু সহস্র লোক সেটা সাদরে গ্রহণ করবে। আর এই তো হওয়া উচিত। অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ডের এক বৃহৎ অংশ আর খাস জর্মনি তিন ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে জর্মন সাহিত্যের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধারা বয়ে আসছে বহুকাল ধরে পরিপূর্ণ সহযোগিতাসহ। টমাস মান-এর জন্ম-উত্তর জৰ্মনিতে অথচ জীবনের বেশিরভাগ কাটালেন সসম্মানে সুইটজারল্যান্ডে। সঙ্গীতে দেখি, বেটোফেনের জন্ম বন শহরে অথচ জীবন কাটালেন ভিয়েনাতে। পূর্ব বাঙলা যে একদিন নতুন গানের ঝরনা-তলা রসের ধারা নির্মাণ করবে সে বিষয়ে আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই।
কিন্তু কার্যত দেখা গেল ঢাকার প্রকাশকমণ্ডলী খেয়ালি পোলাও খাওয়ার জন্য অত্যুৎসাহী হতে চান না।