তাদের আসাটা অর্থহীন নয়, উভয়ার্থে। কিন্তু ক্ষতি যেটা হয় সেটা সুস্পষ্ট। কর্মকর্তাগণ, এবং তাদের চাপে পড়ে আকছারই ওস্তাদরাও অতি প্রচলিত হালকা, এমনকি তার চেয়েও নিরেস গানেই নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রাখেন, হোমরাদের প্রত্যর্থে। অচলিত দূরে থাক, অপেক্ষাকৃত বিদগ্ধ কিন্তু বহুজনপ্রিয় রাগ-রাগিণীও অবহেলিত হয়।
কিন্তু শ্ৰীযুত কেশকারের ফরমান আনল বিপরীত ফল। সরকারি প্রতিষ্ঠানমাত্রই ডেকে আন বললে বেঁধে আনাটাই প্রশস্ততম পন্থা বলে সমীচীন মনে করেন জাসট টু বি অন দি সেফ সাইড। তাবৎ ভারতের কুল্লে স্টেশন থেকে মার মার শব্দ ছেড়ে বেরুলেন কর্মচারীরা অচলিতের সন্ধানে। হাওয়ার গতি ঠাহর করে যতসব আজেবাজে গাওয়াইয়ারা অচলিত রাগ-রাগিণীর স্থলে বাঘ-বাঘিনীর লম্বা লম্বা ফিরিস্তি পাঠাতে লাগলেন বেতারের কেন্দ্রে কেন্দ্রে। তাঁরা গাইলেন সেগুলো, বহু ক্ষেত্রে কেন্দ্রেরই কর্মচারী রচিত নাতিদীর্ঘ বাগাড়ম্বর সমৃদ্ধ ভূমিকাসহ; সে অবতরণিকায় বোঝানো হল, এই ভয়ঙ্কর রাগটি কী প্রকারে যুগ যুগ ধরে অবহেলিত জীবন্ত থাকার পর অদ্য রজনীতে ওস্তাদস্য ওস্তাদ অমুক তাকে সগরসন্তানবৎ প্রাণদান করলেন। আমার মতো ব্যাক-বেঞ্চারের কথা বাদ দিন আমার কান ঝালাপালা– একাধিক বিদগ্ধজনকে দেখলুম, বেতারের কান মলে সেটাকে বন্ধ করতে।
কেউ শুধাল না, যুগ যুগ ধরে এসব রাগ জীবন্মুত ছিলই বা কেন আর মরলই-বা কেন?
একটা কারণ তো অতি সুস্পষ্ট। রসিক বেরসিক কারওরই মনে রসসঞ্চার করতে পারেনি বলে।
তুলনাটা টায় টায় মিলবে না, তবু সমস্যাটা কথঞ্চিৎ পরিষ্কার হবে। ঋতুসংহার নাকি টোলের ছাত্রেরা পড়তে চায় না; সর্বনাশ, ওটা অচলিত ধারায় পৌঁছে যাবে। বন্ধ কর মেঘদূত। চালাও ঋতুসংহার, জগদানন্দ জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেললেন বলে! বন্ধ কর চণ্ডীদাস, অষ্টপ্রহর গাও, ভনয়ে জগদানন্দ দাস। কী বললে, কবিগুরুর প্রথম কাব্য কবি-কাহিনী অনাদৃতা। বন্ধ কর পূরবী। চালাও দশ বছর ধরে কবিকাহিনী।
এইবারে আমি মোকামে পৌঁছেছি।
জানেন আল্লাতালা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই অচলিতের সন্ধান কী প্রকারে কখন মহানগরীর বিদগ্ধ সফিসটিকেটেড রবীন্দ্রসংগীত গায়ক-গায়িকার ভিতর সঞ্চারিত হয়ে গেল– আচম্বিতে। তাদের চেলারা লেগে গেলেন শতগুণ উৎসাহে। শুনেছি সেসব প্রাচীন গানের অনেকগুলিরই স্বরলিপি নেই এমনকি সামান্যতম রাগ-রাগিণীরও নির্দেশ নেই। খোঁজো খোঁজো অথর্ব বৃদ্ধবৃদ্ধাদের যারা হয়তো-বা কোনও দিন ব্ৰহ্মমন্দিরে ওইসব অচলিত গানের দু-চারটে শুনেছিলেন এবং কষ্ট করলে হয়তো-বা স্মরণে আনতে পারবেন। অবশেষে এই প্রচণ্ড অভিযানের ফলে এমন দিন এল যখন কেউ এস নীপবনে বা আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি গান ধরল আর সবাই,
কেহ বা তোলে হাই, কেহ বা ঢোলে,
কেহ বা চলে যায় ঘরে—
হয়তো-বা ফিসফিসিয়ে একে অন্যকে শুধোয়, এর চেয়ে হ্যাঁকনিড গান কি খুঁজে পেল না মেয়েটা?
প্রথম যুগের গানে উত্তম গান নেই এহেন প্রগলভ বচন বলবে কে?
আনন্দের দিনে, গানের মজলিশ শেষ হয়ে গিয়েছে, কবিও চলে গিয়েছেন, কিন্তু দীনেন্দ্রনাথ, ভীমরাও শাস্ত্রী, উৎসব উপলক্ষে কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত দু চার জন প্রবীণ গায়ক, অপেক্ষাকৃত নবীনদের ভিতর নুটুদি, হয়তো অনাদিদা– পরে হয়তো এসে জুটবেন কাঙালীচরণ– এরা তখন সবেমাত্র তেতে উঠেছেন। এঁদের মুখে তখন শুনেছি কিছু কিছু প্রাচীন দিনের গান। প্রধানত সুরের বৈশিষ্ট্য, অজানা কোনও বৈচিত্র্যের জন্য বা আমার অজানা অন্য কোনও কারণে, কিন্তু তারা বার বার ফিরে আসতেন প্রচলিত গানে। কিন্তু ভুললে চলবে না, এঁদের সকলেরই ছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অপর্যাপ্ত অধিকার। ১৯১৯ সালে সিলেটে কবিগুরুর কণ্ঠে শুনেছিলুম, বীণা বাজাও হে মম অন্তরে। তার কয়েকবছর পরে শুনলুম আরেক ওস্তাদের গলায়। মাত্র তিনটি ছত্র— গেয়েছিলেন প্রায় আধঘণ্টা ধরে … কিন্তু অচলিত গানের তরে এই উৎসাহেরও একটা মাত্রা থাকা উচিত। অবশ্য জানিনে অধুনা এ সফিসটিকেশন কোন সপ্তকে গিটকিরির টিটকিরি দিচ্ছে, বা অন্য কোনও সফিসটিকেশনে মেতে উঠেছে।
পুব বাঙলায় এ হাওয়া কখনও রয়েছে বলে শুনিনি! খুদ ঢাকা-ই সফিসটিকেটেড নয়– ছোট শহর গ্রামাঞ্চলের তো কথাই ওঠে না। একটা কথা কিন্তু আমি বলব, এ বাঙলার রসিকজন আমার ওপর যতই অপ্রসন্ন হন না কেন, পুব বাঙলার তরুণ-তরুণী যখনই রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রোগ্রাম তৈরি করে বা প্রাণের আনন্দে গান গায় তাদের নির্বাচন প্রায় ব্যত্যয়হীন চমৎকার। তারা লিরিকাল শব্দের সঙ্গে সুরের সামঞ্জস্য হৃদয় দিয়ে চিনে নেয় অক্লেশে, গান গায় অতি সহজ ভঙ্গিতে। মাস কয়েক পূর্বে টেলিভিশনে দেখলুম, শুনলুম, এক বিলিতি পাদ্রি সাহেব বরীন্দ্রসঙ্গীতে ব্যাপ্তিস্ম হয়ে গাইলেন, বাঙালের সরল ভঙ্গিতে : ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর, প্রভু। অপূর্ব! অপূর্ব!!
.
উভয় বাঙলা– অকস্মাৎ নিবিল
দেউটি দীপ্ততেজা রক্তস্রোতে
এ বাঙলার পুস্তক প্রকাশকরা অবশ্যই পাকিস্তানি ব্যান দ্বারা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হন। দেশবিভাগের পূর্বে পশ্চিম বাঙলায় প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তক, তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেফারেনস পুস্তক, কথাসাহিত্য, মাসিক, সাপ্তাহিক ইত্যাদি ইত্যাদি বিস্তর পুস্তক পুব-বাঙলায় নিয়মিত বিক্রি হত। একদা সাধনোচিত ধামে গত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে বলেন, কলকাতার পরই জেলা হিসেবে ধরলে সিলেটে তার কাগজ প্রবাসী সবেচেয়ে বেশি বিক্রি হত। প্রকাশক সম্পাদক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের চেয়েও বেশি বিপদে পড়ে লেখক। তখন কিছু লেখক বিক্রি বাড়াবার জন্য আরও জনপ্রিয় হতে গিয়ে লেখার মান নামিয়ে দেন। একাধিক সম্পাদক প্রকাশক পাণ্ডিত্যপূর্ণ পুস্তক, জটিল সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যাময় কথাসাহিত্য ছাপতে দ্বিধাবোধ করেন। পক্ষান্তরে হুজুগে বাঙালি কোনওকিছু একটা নিয়ে মেতে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে বিস্তর প্রকাশক সেটা নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাশি রাশি ফরমাইশি বই রাতারাতি ঝপাঝপ বাজারে ছাড়তে আরম্ভ করেন। তড়িঘড়ি লেখা ফরমাইশি কেতাব অধিকাংশ স্থলেই নিম্নমানের হতে বাধ্য। পাঠকের রুচিকে এরা নিম্নস্তরে টেনে নামায় এবং তথাকথিত গ্রেশামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উচ্চমানের পুস্তক সম্মান হারায় ও মুক্ত হট্ট থেকে বিতাড়িত বা অর্ধ-বহিষ্কৃত হয়।