রবীন্দ্র-স্পেশালিস্ট আমি নই, কাজেই শপথ করতে পারব না, কবির বর্ষাগীতিতে পুব বাঙলার অধিকতর বর্ণনা আছে। কিন্তু একথা সত্য খেয়াঘাট, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার, হে বিরাট নদী, এসব মোতিফ ভাটিয়ালি গীত মারফত বহুকাল ধরে পূর্ববঙ্গীয়ের নিত্যদিনের সখা। কভু বা পার্থিবার্থে চিন্তামণির সন্ধানে সে ওপারে যেতে চায়, কভু-বা সে নদীকে দেখে বৈতরণী রূপে। গহীন গাঙের নাইয়া, তুমি যদি হও গো নদী, তুমি কেবা যাও রে, লাল নাও বাইয়া, একখানা কথা শুনা যাও নীল বৈঠা তুল্যা, মানিকপীর ভবনদীপার হইবার লা– এসব দিয়ে গড়া তার হৃদয়। সেইখানেই তো রবির প্রথম আলোর চরণধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে তারা জেগে উঠে সাড়া দেবে– এতে আর কিমাশ্চর্যম?
.
উভয় বাঙলা– ফুরায় যাদেরে ফুরাতে
মেদিনীপুর, বাঁকুড়ায় অর্থাৎ রাঢ়ভূমির পশ্চিমতম প্রান্তে, অতএব উভয় বাঙলারই অস্তাচলে বসবাস করার সৌভাগ্য থেকে আমি বঞ্চিত, কিন্তু বাল্যে রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ সেবক ঈশ্বর রাজেন বন্দ্যো, নন্দলাল, অবন ঠাকুরের শিষ্য ওই পরিবারের চিত্রকর শ্ৰীযুত সত্যেন, শান্তিনিকেতন লাইব্রেরির আজীবন একনিষ্ঠ সেবক ঈশ্বর সত্য, পরবর্তীকালে তাঁর কন্যা উভয় বঙ্গে গণমোহিনী গায়িকা, স্বয়ং পূর্ববঙ্গের প্রতি সবিশেষ অনুরক্তা শ্রীমতী কণিকা মোহর, এদের সান্নিধ্য ও সাহচর্য লাভ করেছি কয়েক বৎসর ধরে। শ্ৰীযুত সত্যেনকে কলাজগতের বিস্তর রসগ্রাহী চেনেন সরল, নিরলঙ্কার, দৈনন্দিন জীবনের সহজ চিত্রকর রূপে, কিন্তু তাঁকে আমি পেয়েছিলুম উপগুরুর ছদ্মবেশে। আমার খাজা বাঙলা উচ্চারণ তিনি মেরামত করার চেষ্টা দিতেন কথাচ্ছলে, আমাকে অযথা আত্মসচেতন না করে দিয়ে। এবং একটু মৃদু হাস্য যোগ দিয়ে বলতেন, বাঁকড়োয় আমরা কিন্তু বলি…।
পূর্বতম প্রান্ত সিলেট-কাছাড় আমি ভালো করেই চিনি। দুই অঞ্চলে নিশ্চয়ই নানা বিষয়ে পার্থক্য আছে। বস্তুত প্রথম দর্শনে অনভিজ্ঞজনের চোখে পার্থক্যগুলোই ধরা পড়বে বেশি। কিন্তু একটু গভীরে তলালেই চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই হৃদয়ঙ্গম করে ফেলবেন যে সাদৃশ্যটাই ঢের বেশি। এবং এত বেশি যে ঠিক ওই কারণেই পার্থক্যগুলো আরও যেন স্পষ্টতর হয়। সাদৃশ্যের স্বচ্ছ জলে পার্থক্যের একটিমাত্র কালো চুল চোখে পড়ে। আবিল আবর্তে বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড লুকিয়ে থাকে। গুণীরা তাই বলেন, সাধুজনের অতি সামান্য পদস্খলন নিয়ে পাঁচজন সমালোচনা করে, অসাধুর পর্বতপ্রমাণ পাপাচার সম্বন্ধে মানুষ অপেক্ষাকৃত উদাসীন।
কথাপ্রসঙ্গে দুই বাঙলার পার্থক্যের প্রতি যদি আমি ইঙ্গিত করি তবে উভয় বাঙলার পাঠক যেন সাদৃশ্যের মূল তত্ত্বটা ভুলে গিয়ে অনিচ্ছায় আমার প্রতি অবিচার না করেন।
মহানগরী কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের সুদূরতম প্রান্তে, এমনকি পুব বাঙলারও কিয়দংশে যে প্রভাব বিস্তার করে সে তুলনায় মফঃস্বলের ওপর ঢাকার প্রভাব যৎসামান্য। তদুপরি কলকাতা যে শুধু ঢাকার তুলনায় বহুলাংশে বৃহত্তম তাই নয়, বোম্বাই মাদ্রাজ দিল্লিকেও অনায়াসে বহু বিষয়ে অপায়ে রেখে সে চীন-জাপানের সঙ্গে পাল্লা দেয়। কিন্তু সে আলোচনা আরেকদিন হবে। উপস্থিত আমার বক্তব্য, যদিও কলকাতা পরশুদিনের আপস্টার্ট নগর তবু ধীরে ধীরে তার একটা নিজস্ব নাগৰ্য বা নাগরিকতা গড়ে উঠছে। নাগরিক বলতে একটা শিষ্ট, ভদ্র, রসিক এবং বিদগ্ধজনকে বোঝাত। এমনকি চলতি কথাও নাগরপনা, নাগরালি এবং শহরবাসী অর্থে নগুরে, আজকাল বলি শহুরে, এককালে খুবই প্রচলিত ছিল। উর্দুতে কৃষ্টি, বৈদগ্ধ্য অর্থে ইদানীং তমদুন শব্দ ব্যবহার করা হয়। তারও মূল মদিনা বা শহর– আমরা মদিনা বলতে যে নগর বুঝি সেটার পূর্ণ নাম মদিনাতুন নবী অর্থাৎ নবীর (প্রেরিত পুরুষের) নগর।
উন্নাসিক নাগরিক জনের কত্রিম আচার-ব্যবহার সর্বদেশেই সুপরিচিত। তাই ইংরেজিতে সফিসটিকেটেড শব্দের অর্থে যেমন কৃত্রিমতার কদৰ্থ আছে তেমনি উচ্চাঙ্গের সার্থক জটিলতার সদর্থও আছে। ১৯৭১-এ আমরা প্রায়ই বিদেশি রিপোর্টারের লেখাতে পড়েছি, সাদামাটা রাইফেল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা কী করে লড়বে পশ্চিম পাক আগত সর্বপ্রকারের সফিসটিকেটেড হাতিয়ার, যেমন রাডার, স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান ইত্যাদির বিরুদ্ধে?… তাই হাফবয়েলড, অর্ধসিদ্ধ আসিদ্ধ সাফিসটিকেটেড জন, প্রাচীনার্থে নাগরিক যদি তার নাগরিমায় সত্যকার বৈচিত্র্য, উদ্ভাবনশীলতা না দেখাতে পারে তবে সে নিছক নতুন কিছু কর প্রত্যাদেশ মেনে নিয়ে অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন উদ্ভাবনায় লেগে যায়।
প্রাক্তন বেতার মন্ত্রী শ্ৰীযুত কেশকার একদা ফরমান দিলেন, যার ভাবার্থ : আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভূরি ভূরি রাগ-রাগিণী অনাদরে অবহেলায় লোপ পেয়ে যাচ্ছে। আকাশবাণী যেন অচলিত রাগ-রাগিণী যারা আজও গাইতে পারেন তাদের পরিপূর্ণ মাত্রায় উৎসাহিত করে।
একথা অবশ্যই সত্য, গণতন্ত্রের যুগে গানের মজলিসে আসে হরেক রকমের চিড়িয়া। তাই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে পারদর্শী শ্ৰীমতী অর্চনা রীতিমতো বিহ্বল বিভ্রান্ত হয়ে শুধিয়েছেন হাবিজাবি লোকের কথা বাদ দিলেও তিনি আদৌ বুঝতে পারেন না, সঙ্গীতের প্রতি যাদের কণামাত্র আকর্ষণ নেই সেসব হোমরাচোমরারা শাস্ত্রীয় উস্কৃষ্টতম সঙ্গীতের আসরে আদৌ আসেন কেন?