ধ্বনি মাত্রই ঠেকানো বড় কঠিন। কারণ ধ্বনির আসন আত্মন-ব্ৰহ্মণের পরেই।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে রাজর্ষি জনক ও ব্রহ্মর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য-সংবাদে আছে, জনক শুধোলেন, মানুষের জ্যোতি কী? অর্থাৎ তাদের বেঁচে থাকা, কাজকর্ম করা কিসের সাহায্যে নিষ্পন্ন হয়? যাজ্ঞবল্ক্য : সূর্য। জনক : সূর্য অস্ত গেলে? চন্দ্রমা। সূর্যচন্দ্র উভয়ই অস্তমিত হলে? অগ্নি। সূর্যচন্দ্র অস্তমিত, অগ্নি নির্বাপিত তখন কোন জ্যোতি পুরুষের সহায়ক হয়?
অস্তমিত আদিত্যে, যাজ্ঞবল্ক্য-চন্দ্রনসস্যস্তমিতে শাঞ্জেগ্নৌ কিং জ্যোতিরেবায়ং পুরুষ?
ধ্বনি। এই জন্যই যখন নিজের হাত পর্যন্ত ভালো করে দেখা যায় না, তখন যেখানে কোনও শব্দ হয়, মানুষ সেখানে পৌঁছতে পারে।
কলকাতা বেতারের ধ্বনি-তরঙ্গ সমস্ত পুব বাঙলায় দিনযামিনী সে দেশের বাতাবরণে সঞ্চারিত ছিল। সে ধ্বনি-তরঙ্গকে যন্ত্র সাহায্যে কোনও অবস্থাতেই বিকৃত অবোধ্য করা যে যায় না, তা নয়। যাজ্ঞবল্ক্যও জনকের শেষ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন শব্দও যদি নিরুদ্ধ হয়ে যায় তবে আত্মাই তখন তার জ্যোতি; আত্মজ্যোতি প্রসাদাৎ সে তখন সর্ব কর্ম সমাধান করে। কিন্তু ধ্বনিতরঙ্গ সংগ্রামে পিণ্ডি নামতে সাহস করেনি। কারণ পুব বাঙলার চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছে আমাদের যথেষ্ট বেতার-কেন্দ্র। আমাদের ভাণ্ডারে আছে প্রচুরতর। পিণ্ডি পুব বাঙলা থেকে আমাদের একটা কেন্দ্র জ্যাম করতে না করতেই আমরা তাদের ছটা কেন্দ্রকে। সম্পূর্ণ অবোধ্য করে দিতে পারব। ফলে পুব বাঙলা করাচি-পিণ্ডি থেকে প্রেরিত সংবাদ তো পুনঃপ্রচার করতে পারবেই না, তদুপরি নিজের দেশের সংবাদ সরকারি হুকুম কিছুই বেতার মারফত বিকিরণ করতেও পারবে না। এমনকি মিলিটারির গোপন বেতারে ফরমান আলির ফরমান পর্যন্ত অনায়াসে রুদ্ধশ্বাস করা যেত।
.
খ্রিস্ট বলেছেন, মানুষের পক্ষে রুটিই যথেষ্ট নয়। তার হৃদয়-মনেরও ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে।
বহু অভিজ্ঞতার পর আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, পুব বাঙলার তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী আমাদের তুলনায় আজ বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। এদের এবং আমাদের অনেকের কাছেই হয় তো কবির ছোটগল্প প্রিয়তর। কিন্তু পুব বাঙলায় একদিন এমন দুঃসময় এল যখন কবির কোনও পুস্তকই সগ্রহ করা তাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। শুনেছি, কোন এক হিন্দু কবি মুসলমান রমণী বিয়ে করার পর জন্মভূমি কাশীতে যখন ফিরলেন তখন পূজারি-পুরোহিত সমস্ত মন্দিরের দ্বার বন্ধ করে দিল। কবি নিরাশ হলেন না। মা গঙ্গার উদ্দেশে বললেন, তোমাকে মা রুদ্ধদ্বার করতে পারে এমন লোক আজও জন্মায়নি। কবি তাঁরই উদ্দেশে স্তোত্র রচনা করলেন।
হুবহু রবিতীর্থে যাত্রা করার জন্য সর্বপন্থা যখন রুদ্ধ হয়ে গেল তখন রইল শুধু কলকাতা বেতারের রবীন্দ্রসঙ্গীত। সেই হয়ে গেল তাদের সুরধুনী (যতদূর জানি ধুনী শব্দের অর্থ নদী), গঙ্গা। কবির গানেও আছে,
হাটের ধুলা সয় না যে আর
কাতর করে প্রাণ।
তোমার সুর-সুরধুনীর ধারায়
করাও আমায় স্নান।
হুবহু একই পদ্ধতিতে হয়ে গেল সমস্যার সমাধান– আংশিক, কিন্তু মধুর। পিণ্ডির রাজা রাজর্ষি জহ্ন নন যে সে-সুর-ধুনী পান করে নিঃশেষ করবেন।
আরও একাধিক কারণ, যোগাযোগ, জনপদসুলভ সহজাত হৃদয়াবেগ রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি পুব বাঙলায় আসক্তি নিবিড়তর করে তুলেছে, যেমন ধরুন সঙ্গীতজগতে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠতম উপহার– তাঁর বর্ষার গান। শান্তিনিকেতন বীরভূমে দীর্ঘ গ্রীষ্মের খরদাহনে দগ্ধপ্রায় বিবর্ণ জীবন্ত আতাম্র তৃণপত্র যখন মুহ্যমান বিষণ্ণ বিশ্ব যখন নির্মম গ্রীষ্মের পদানত, শুষ্ক কানন শাখে ক্লান্ত কপোত ডাকে, এবং রজনী নিদ্রাহীন দীর্ঘ দগ্ধ দিন, তুষাতপ্ত জনপদবধূ কাতর কণ্ঠে রুদ্রকে অনুনয় জানায়, সম্বররা এ চক্র তব, একচক্রা রথের ঠাকুর! রক্তচক্ষু অগ্নি-অশ্ব মূৰ্ছি পড়ে, আর তারে ছোটাবে কতদূর সে সময়কার শুষ্ক কালবৈশাখীর নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ, তার দু-তিন দিন পরেই যখন নামে প্রবল বেগে বারিধারা, আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল, সকালে উঠে দেখি, এ কী! কখন বাদল-ছোঁওয়া লেগে মাঠে মাঠে ঢাকে মাটি সবুজ মেখে মেখে–অকস্মাৎ এই কল্পনাতীত পরিবর্তন পুব বাঙলায় রাজশাহী বারোঞ্চল, আরও দু চারটি জায়গা ছাড়া অন্যত্র বিরল। কিন্তু পূর্ব বাংলার লোক বর্ষার যে রূপের সঙ্গে সুপরিচিত– ছাড়ল খেয়া ওপার হতে ভাদ্রদিনের ভরা স্রোতে, দুলছে তরি নদীর পথে তরঙ্গবন্ধুর, কিংবা হয়তো কে ডাকিছে বুঝি মাঝি রে, খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে, কারণ দুই কূল আকুলিয়া অধীর বিভঙ্গে যখন পদ্মা তরঙ্গে তরঙ্গে মেতে ওঠে তখন কী করে গাই, পথ চেয়ে তাই একলা ঘাটে বিনা কাজে সময় কাটে, পাল তুলে ওই আসে তোমার সুরের তরী– খেয়া ঘাট, ভরা পাল তুলে পাগল-পারা ছুটেছে তরী তার সঙ্গে কত না সুখ কত না দুঃখের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়– সে খেয়ার কর্ণধার তোমারে নিয়েছে সিন্ধু পারে আষাঢ়ের সজল ছায়ায়, তার সাথে বারে বারে হয়েছে আমার চেনা সঙ্গে সঙ্গে যেন এক কঠোর আঘাতে বুকের স্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়, কবি কী সামান্যতম ইঙ্গিতে স্মরণ করিয়ে দিলেন তিনি তাঁর কত না প্রিয়জনের অকারণে-অকালে তার পড়ল যখন ডাক তখন তাকে খেয়ায় একান্ত একাকী উঠতে দেখেছেন শোকাতুর চিত্তে, অশ্রুহীন শুষ্ক নয়নে। এখন তিনি সে খেয়ার সঙ্গে বেদনা বেদনায় এতই সুপরিচিত যে তিনি যেন প্রস্তুত হয়ে আছেন, ভাবছেন– নিয়ে যাব ইহার উত্তর নিজ হাতে করে আমি ওই খেয়া পার করি ভয়!