মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে, বিজ্ঞানের রাজ্যে এমন একখানা পুস্তক ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে, যার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এমন বই উভয় বাঙলায় পূর্বে বেরোয়নি, আগামী শত বৎসরের ভিতর বেরুবে কি না সন্দেহ। পণ্ডিত আব্দুল জব্বর রচিত এই তারা পরিচয় গ্রন্থখানিকে শতাব্দীর গ্রন্থ বলে তর্কাতীত দার্চসহ পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়। এ গ্রন্থের উল্লেখ আমি পূর্বেও করেছি, ভবিষ্যতে সবিস্তর বর্ণনা দেবার আশা রাখি। …কাজী কবির গ্রন্থাবলি ও এ গ্রন্থ উভয়ই প্রাগুক্ত আব্দুল কাদের যখন বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের কার্যাধ্যক্ষ ছিলেন, তখন তাঁরই উৎসাহে বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
এতক্ষণে পাঠক নিশ্চয়ই সম্যক হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার আপ্রাণ চেষ্টা দিয়েছিলেন, বাঙলা অ্যাকাডেমি, বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড জাতীয় কোনও প্রতিষ্ঠানই যেন জন্মগ্রহণ না করতে পারে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গোড়াতে ক্ষীণ কণ্ঠে বাঙলার ভাষা ও সাহিত্যের জন্য যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়, সেটাকে ঠেকাবার জন্য স্বয়ং মি. জিন্না ঢাকায় তশরিফ আনেন এবং ছাতির খুন বেকার বেফায়দা ঠাণ্ডা পানিতে বরবাদ অথবা শীতল জলে অপচয় করলেন– যেটা বরফের বেশি কাছাকাছি সেইটেই বেছে নিন– সেই দাবি প্রতিদিন কঠিনতর ভাষায় এবং সর্বশেষে রুদ্ররূপ ধারণ করল। আমরা এ বাঙলায় বসে তার কতটুকু খবরই-বা রাখতে পেরেছি। শুধু জানি, কয়েকটি তরুণ দাবি জানাতে গিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় নিহত হল– শহিদের গৌরব লাভ করল।
কিন্তু সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন অ্যাকাডেমি, বোর্ড, এমনকি এশিয়াটিক সোসাইটি অব ইস্ট পাকিস্তান, জাদুঘর (এরই নবীন হর্মের প্রস্তর স্থাপনাকালে গবর্নর মোনায়েম খান জাদু শব্দটা সংস্কৃত মনে করে তীব্র কণ্ঠে উম্মাভরে গোসসা জাহির করেন) সর্ব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা, ভিতর থেকে, সরকারের তথাকথিত ইসলামি মদুন (ইসলামি সভ্যতা–শব্দার্থে নাগরিকতা) দ্বারা অনুপ্রাণিত নির্দেশ সাবোটাজ করেছেন অমান্য করে, টালবাহানা দিয়ে ফন্দিফিকির মারফত বানচাল করে দিয়ে। এ সগ্রামের কাহিনী খুদ ঢাকাবাসীদের মধ্যেই জানেন অল্প লোক।
প্রাগুক্ত রাজমর্যাদায় আপ্যায়নের ফলে আমার মতো অকিঞ্চন জন পরিচিত, সম্পূর্ণ অপরিচিত লেখকদের কাছ থেকে প্রায় ষাটখানা পুস্তক-পুস্তিকা উপহার পায়। আমাকে (এসব সজ্জন) ভ্রমবশত পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যচর্চার অন্যতম প্রতীকরূপে ধরে নিয়েছিলেন, এবং সে চর্চার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ছিল। দেশ পত্রিকার সম্পাদক মহাশয় বলতে পারবেন, কত না দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর, লৌহযবনিকার ছিদ্র দিয়ে তার কাছে পৌঁছেছে পুব বাঙলার বই সমালোচনার জন্যে– চব্বিশটি বৎসর ধরে। পশ্চিম বাঙলার স্বীকৃতি ছিল তাঁদের হার্দিক কামনা।
লৌহযবনিকাপ্রান্তে পুস্তকগুলো বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবার ভয় তো আছেই, তদুপরি পুস্তক স্মাগলিং নামক পাপাচার প্রচেষ্ট ব্যক্তির যে ন্যূনতম শাস্তি– সেটা অর্থদণ্ড। সীমান্ত অতিক্রম করবার সময় যে বিংশতি মাত্র পাকিস্তানি মুদ্রা আইনত অনুমোদিত, সে মুদ্রা কটি অবশ্যই ওই অর্থদণ্ড পরিশোধ করার জন্য অপ্রচুর। ফলং শ্রীঘর বাস।
কিন্তু আল্লা মেহেরবান। সীমান্তেও কিছুসংখ্যক বঙ্গসন্তান ছিলেন যারা পূর্বোক্ত রাষ্ট্ৰাদেশ লনকারীদের ন্যায় সুচতুর এবং সদৃশ পাপী-তাপীদের প্রতি সদয়। তাই মমগ্রজদের লিখিত দু-চারখানা পুস্তক বৈতরণীর এ কূলে আনতে সক্ষম হয়েছি– প্রতিবার।
.
উভয় বাঙলা– স্বর্ণসেতু রবীন্দ্রসঙ্গীত
এ বিষয়ে কণামাত্র সন্দেহ নেই, যে এক বাঙলা আরেক বাঙলা থেকে যদি পাকেচক্রে কোনওদিন স্নেহপ্রীতির ভুবনে দুই দিনান্ত চলে যায়, এস্তেক ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে মোহনবাগানের ফুটবল খেলা বন্ধ হয়ে যায়, ঘটিমাত্রই ইহসংসারে বাঙাল নামক যে একটা প্রাণী আছে সে তত বেবাক ভুলে গিয়ে তাকে হাইকোর্টটা পর্যন্ত দেখাতে রাজি না হয়, এবং পদ্মার ওপারে কুটির সঙ্গে ঘটির ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি শুনে ঘোড়াটা যদি না হাসে, তবু একটি বেরাদরি রেওয়াজ দুই বাঙলা থেকে কিছুতেই লোপ পাবে না।
কেন্দ্রীয় পাক রবীন্দ্রসঙ্গীত।
সরকার উভয় বাঙলায় চলাচলের পথ প্রতিদিন দুর্গমতর করতে লাগল– আন্তর্জাতিক জনসমাজের নিতান্ত হাস্যাস্পদ হবে বলে বনগাঁ-যশোরের সঙ্কীর্ণ পথটিকে কণ্টকাকীর্ণ অগম্য করার জন্য দু-কান-কাটার মতো বে-আব্রু বে-হায়া হতে তার বাধল– খবরের কাগজ, বইপত্র, গ্রামোফোন রেকর্ড এমনকি আমাদের পরম শ্লাঘার ট্রপিকাল স্কুলের গবেষণাজাত অমূল্য তত্ত্ব তথ্য যেগুলো পূর্ব বাঙালির পক্ষে নিরঙ্কুশ অর্জনীয় যার স্থান নেবার মতো দম্ভাধিকার প্রাচ্য-প্রতীচ্যের কোনও প্রতিষ্ঠানই করতে গিয়ে বিশ্ব-বৈদ্য-সমাজে হাস্যাস্পদ হতে চাইবে না, সবকিছুরই আদানপ্রদান নিরন্ধ্র বন্ধ করে দিল তখনও কিন্তু কলকাতার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পুব বাঙলার যোগসূত্র ছিন্ন করতে পারল না। দিনের পর দিন, গভীর রাত্রি অবধি কলকাতা বেতার, পরে এক্কেবারে খিড়কিদরজার গোড়ায় জুটল আরেক বৈরী, আগরতলা-কেন্দ্র রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, যন্ত্রে সুর শোনায়, রেকর্ড বাজায়, পণ্ডিত পঙ্কজ সে সংগীত শেখান, অনুরোধের আসরে অকাতরে আমার পাপমনে কেমন যেন একটা সন্দ আছে পুব বাঙালির অনুরোধের প্রতি কলকাতা বেতারের একটু বিশেষ চিত্তদৌর্বল্য ছিল– একই রেকর্ড দশবারের স্থলে বিশবার বাজিয়ে কলকাতা বেতার যে প্রতিহিংসা-বিষে জবজবে হৃদয় দিয়ে বিঘ্নসন্তোষীর কৈবল্যানন্দ, বিজয়ী বীরের আত্মপ্রসাদ অনুভব করে নিজকে কৃতকৃতার্থ চরিতার্থ মনে করত। কারণ কলকাতা বেতার অবগত ছিল, পিণ্ডি-ভাতারের হুকুমে ঢাকা বেতারের রাধারানির তরে তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত কানুর পীরিতির মতো নিষিদ্ধ পরকীয়া প্রেম। কলকাতা বেতার তখন বললে, বটে! আচ্ছা দেখা যাবে, তুমি কালাচাঁদের বাঁশির সুরটি ঠ্যাকাও কী কৌশলে?