পাঠক, তুমি বড় সরল। বিলকুল ঠাহর করতে পারনি কার ঘুমন্ত হাত দিয়ে কে, কোন তৃতীয় ব্যক্তির তামাক চুপসে– না ভুল বললুম– সগর্বে খেয়ে গেল।
অ্যাকাডেমী পয়লা ধাক্কাতেই স্থির করলেন–একদম পয়লা ধাক্কাতে কি না আমার সঠিক মনে নেই কোনও একাদশ ভলুমি আরবি কেতাব (হয়তো অত্যুত্তম গ্রন্থ) বাঙলায় বেরুবে বিশ ভলুমি কলেবর নিয়ে। খাস বাঙালি সাহিত্যিক দল তদ্দণ্ডেই হয়ে গেলেন অপাঙক্তেয় খারিজ বাতিল ডিসমিস। কারণ তারা তো আরবি জানেন না। কোনও এক মৌলবি সাহেব অনুবাদকর্মের জন্য দক্ষিণা পাবেন ষাট না সত্তর হাজার টাকা!
বেচারি ডিরেক্টর! সে আপ্রাণ লড়েছে। শেষটায় বোধহয় মৌলবিরাই তার চাকরিটি খান।
আমি হলপ করতে পারব না বিশ ভলুমের অনুবাদ সমাপ্ত হয়েছিল কি না। ক-ভলুম এ তাবৎ বেরিয়েছে তা-ও বলতে পারব না। এ প্রতিবেদনে আরও ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের মতলব কী ছিল সেটা বুঝিয়ে বলাটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।
.
উভয় বাঙলা– গজভুক্ত পিণ্ডিবৎ
বড় বড় শহরের লোক বাইরের পৃথিবী সম্বন্ধে বড়ই বে-খবর। তাদের ভাবখানা অনেকটা যেন কুল্লে দুনিয়ার মেয়েমদ্দে যখন হুমড়ি খেয়ে আমাদের এই হেথায় জমায়েত হচ্ছে, তখন তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, আমরাই ইন্ট্রস্টিং, আমরাই ইমপর্টেন্ট। মা-কালী তো কালীঘাট ছেড়ে ধাক্কাধাক্কি খেয়ে ট্রামে-বাসে আসেন না আমার বাড়িতে, কিংবা মহরমের তাজিয়া-তাবুদ তো লাটবাড়ির বৈঠকখানায় বসে হা-পিত্যেস করেন না হুজুরকে একনজর দেখবার তরে।… এ বাবদে সবচেয়ে বেশি দেমাক ধরে প্যারিস। আর ধরবেই না কেন? যে মার্কিন মুলুক দুনিয়ার যে দেশকে খুশি রুটিটা-আণ্ডাটা বিলিয়ে দেয় মতলবটা কী সবসময় মালুম তক হয় না– সেই দেশের লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে ছোটে ছুটি কাটাতে, প্যারিসের তাজ্জব তাজ্জব এমারত-তসবির দেখতে, কুল্লে জাতে ভর্তি নানান রঙের নানা ঢঙের খাপসুরৎ খাপসুরৎ পটের বিবিদের মোলায়েম-সে-মোলায়েম হাত থেকে সাকির ভরা-পেয়ালা তুলে নিতে আর তারই সঙ্গে খাপ খাইয়ে খৈয়ামের স্মরণে বেখাপ্পা খাদে গান জুড়তে–
বিধি-বিধানের শীত-পরিধান
প্যারিস-আগুনে দহন করো।
আয়ু বিহঙ্গ উড়ে চলে যাবে
হে সাকি, পেয়ালা অধরে ধরো। (অনুবাদক?)
এ বাবদে আমরা, কলকাত্তাইয়ারা ঘোড়ার রেসে মোটেই ব্যাড থার্ড নই, অলসো র্যান বললে তো আমরা রীতিমতো মানহানির মোকদ্দমা রুজু করব।
আমরা তাই ঢাকা তথা পুব বাঙলার সাহিত্যচর্চা সম্বন্ধে চিরকালই কিঞ্চিৎ উদাসীন ছিলুম– দেশবিভাগের পর তো আর কথাই নেই। আর হবই না কেন- রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, শরৎচন্দ্র সবাই তো শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেই থানা গেড়েছেন। এস্তেক যশোরের বাঙাল মাইকেল।
পার্টিশনের পরে অবস্থাটা খারাপ হল। কবি জসীম উদ্দীন, চিত্রকর জয়নুল আবেদিন, উদীয়মান কবি/সাহিত্যিক আবুল হোসেন, শওকত ওসমান, গোলাম মুরশিদ, পণ্ডিত শহীদুল্লা– বোধহয় পূর্বেই চলে গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের শতাত্ত্বিক আবদুল হাই যাঁর অকালমৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, একাধিক মহিলা কবি আরও বহু বহু সাহিত্য-সঙ্গীত-কলাসেবক চলে গেলেন পুব বাঙলায়। এবং এঁরা যে পেনসেন নেওয়ার পর এবং/অথবা বার্ধক্যে, বিশেষ করে যাঁদের জন্মভূমি পশ্চিম বাঙলায় তারা যে সেসব জায়গায় বা কলকাতায় ফিরে এসে, মহানগরীর সুযোগ-সুবিধে নিয়ে বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতর সেবা করতে পারবেন সে আশাও রইল না!…বলা বাহুল্য আমার দেওয়া সাহিত্য সেবীদের এ ফিরিস্তি লজ্জাকর অসম্পূর্ণ।
পুব-বাংলার যেসব লেখক ও অন্যান্য কলাকার এখানে রয়ে গেলেন ও ওপার বাঙলা থেকে যারা এলেন, তাদের অধিকাংশই হিন্দু। কেউ কেউ পাঞ্জাবি-কণ্টকিত পাক সরকার কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়ে পুব বাঙলা ত্যাগ করতে বাধ্য হন, কিন্তু এঁদের সকলেই আপন আপন সহকর্মীদের প্রতি এবং মাতৃভূমি পুব বাঙলার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা পোষণ করেছেন। ৭১-এর নয় মাসে সেদেশে বুদ্ধিজীবী নিধনে এদের অনেকেই ভ্রাতার চেয়ে প্রিয়তম আত্মজন হারিয়েছেন। দার্শনিক গোবিন্দবাবু এবং তারই মতো একাধিক অধ্যাপকের নিষ্ঠুর হত্যা আমাকে ও তাঁদের অগণিত অনুরক্তজনকে কী গভীর বেদনা দিয়েছে, তা প্রকাশ করার ক্ষমতা বিধি আমাকে দেননি।
পূর্বোক্ত দুই পক্ষই এ বাঙলা থেকে যারা ও-বাঙলা গেলেন এবং ওদিক থেকে এদিক এলেন, এঁরাই ছিলেন উভয় বঙ্গের সর্বপ্রধান চিন্ময় বন্ধন, মূর্তিমান সেতু, পিণ্ডির পাশবিক বৈরী ভাব ছিল প্রধানত এঁদেরই প্রতি। তাই সে নির্মাণ করেছিল লৌহ্যবনিকা প্রস্তর-প্রাচীর।
অতীতেও নির্মিত হয়েছিল নিশ্চয়ই, নইলে নিউটন আক্ষেপ করলেন কেন–
হায়রে মানুষ।
বাতুলতা তব
পাতাল চুমি :–
প্রাচীর যত না
গড়েছো, সেতু তো
গড়োনি তুমি!
এই দুই পক্ষই সবচেয়ে বেশি খবর নিতেন উভয় বাঙলার সাহিত্যচর্চার। এদের কেউ কখনও অপর বাঙলায় যাবার দুরূহ অতএব বিরল সুযোগ পেলে সেখানে রাজমর্যাদায় আপ্যায়িত হতেন। পুববাঙলা স্বাধীন হওয়ার পূর্বে আমি ১৯৭০-এ যাই ঢাকা। মরহুম শহীদুল্লাহ তখন হাসপাতালে। ঢাকায় প্রকাশিত পুস্তক ও কলকাতায় প্রকাশিত একাধিক পুস্তিকা তিনি ৬৯-এই মমাগ্রজের গৃহে সেই বৃদ্ধ বয়সে স্বয়ং এসে আমাকে সস্নেহ আশীর্বাদসহ উপহার দিয়ে যান। (তাঁর কৃতী পুত্রেরও একাধিক পুস্তক তিনি তার সঙ্গে যোগ দেন) আঞ্চলিক অভিধানের প্রথম খণ্ড, হাফিজের অনুবাদ, চর্যাপদের আলোচনা কী না-ছিল তাঁর ত্রিপিটকপূর্ণ সওগাতে! গুণী আবদুল কাদের যে কী পরিশ্রম, অন্বেষণ ও অধ্যয়নান্তে কাজী নজরুল ইসলামের সম্পূর্ণ গদ্য-পদ্য সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন, সেটা বর্ণনাতীত। অনবদ্য এই মণিমঞ্জুষা। সম্প্রতি কাগজে দেখলুম, বাংলাদেশে প্রকাশিত তাবৎ পুস্তক বিক্রয়ের জন্য এখানে একাধিক কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। ত্বরা করুন, ত্বরান্বিত হোন, গৌড় সাহিত্যামোদীগণ! সর্বশেষে অঙ্গবস্ত্রটি অকাতরে চক্রবৃদ্ধিহারে কুসীদার্পণ প্রতিশ্রুতিসহ সমর্পণ করে প্রয়োজনীয় কার্ষাপণ সংগ্রহ করুন– অমূল্য এই গ্রন্থাবলি ক্ৰয়ার্থে। বিলম্বে হতাশ হইবেন– বিজ্ঞাপনের অতিরঞ্জিত অত্যুক্তি নয়, সকল শাস্ত্ৰবিচারদক্ষের অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী।