তার কীর্তিকাহিনী দীর্ঘ। আজ যেরকম পুব পাকের সেবা করে টিক্কা খান জঙ্গিলাটের আসন পেয়েছেন, ঠিক তেমনি ইনিও একদিন পুব বাঙলার বাঙালি সিভিলিয়ানদের সর্বনাশ করে ও পশ্চিমাদের সর্বানন্দ দিয়ে অখণ্ড পাকের ফরেন মিনিস্টার অ্যাডভাইজার আরও কত কী হন। সেসব থাক। আমার উদ্দেশ্য শুধু দেখানো পার্টিশন সত্ত্বেও উভয় বাঙলাতে যে চিন্ময়-বন্ধন ছিল সেটার সত্তানাশ মহতী বিনষ্টি কী প্রকারে করা যায় সেইটেই ছিল চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের গুরসম রাজধানী-দত্ত সাধনার চিন্তামণি। স্বদেশী আন্দোলনবৈরী পুলিশ কর্মচারী শামসুল (আলম? হুদা? হক) বন্দি দেশপ্রেমিকদের সঙ্গে প্রথম দোস্তি জমিয়ে বিস্তর গোপন তথ্য বের করে ওইগুলো দিয়ে নির্মাণ করেন সরকার পক্ষের মারণাস্ত্র। তাই আসামিরা তার উদ্দেশে বলত, ওহে শামসুল! তুমিই আমাদের শ্যাম তুমিই আমাদের শূল। আজিজের বেলা অতখানি টায় টায় ব্রিামীয় পান তৈরি হল না বটে, তবু আজিজ-এর অর্থ প্রিয় মিত্র; আহমদ-কে আমেদ, ইংরিজিতে ডি অক্ষরযোগে আমেডও লেখা হয়। দি ফ্রেন্ড আমেড– Ah! mad! কারণ প্রবাদ আছে, মূর্খ মিত্রের চেয়ে জ্ঞানী শক্র ভালো। এস্থলে মূৰ্থ মিত্র না, পুব বাঙলার উন্মাদ মিত্র।
তাঁর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা বিনাশ করা।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য : পুব বাঙলার লোক এ চর্চাতে অনুপ্রেরণা প্রায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে : বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহ্য বহুলাংশে পশ্চিমবঙ্গে গঠিত হয়েছে। অতএব উভয় বাঙলার মাঝখানে নির্মাণ করতে হবে অভেদ্য লৌহ যবনিকা।
তৃতীয় উদ্দেশ্য : ওই রবীনদরনাথ নামক লোকটির ইমেজ সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে হবে; সেস্থলে জাজ্বল্যমান করতে হবে পাঞ্জাবি কবি ইকবালকে, তার ইসলামি জোশসহ।
কিন্তু তিনি সেই কাষ্ঠখণ্ড পান কোথায় যেটা দিয়ে তিনি কুঠারটি নির্মাণ করতে পারেন? উচ্চপদের বাঙালি মুসলমান সিভিলিয়ানদের সেক্রেটারিয়েট থেকে খেদিয়ে তাদের পাঠানো হল ডিস্ট্রিকটগুলোতে এঁদের বেশিরভাগ এসেছিলেন শিলঙ সেক্রেটারিয়েট থেকে, সিলেটের লোক, হেথাকার রাইটারস বিল্ডিং থেকে উচ্চপদস্থ গিয়েছিলেন অল্প পরিমাণ ছিলেনই। অত্যল্প। পাঞ্জাবি-বেহারিদের আধা ভজন প্রমোশন দিয়ে দিয়ে ভর্তি করা হল সেক্রেটারিয়েট যতদূর সম্ভব। কিন্তু বাঙলার ক অক্ষর দেখলেই এরা সামনে দেখে করালী। তদুপরি এদের যুক্তি বাঙলাকো জড়সে উখাড়নেকে লিয়ে (উৎপাটন করতে) আমরা এসেছি জিহাদ লড়তে, আর বলে কি না, শেখো বাঙলা!… আজিজ দেখলেন, এরা সরকারি কাজই চালাতে অক্ষম, এদের দ্বারা সূক্ষ্ম প্রপাগান্ডা, রবীন্দ্রনাথের ইমেজ নাশ অসম্ভব। চাই বাঙালি।
মক্তবের মোল্লা, মাদ্রাসার নিম্নমানের মৌলবি ও ছাত্র এলেন এগিয়ে। এঁরা বাঙলা প্রায় জানেনই না। উর্দুজ্ঞান যৎসামান্য বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। এঁরাই ছিলেন উর্দুকে পুব পাকের রাষ্ট্রভাষারূপে চাপিয়ে দেবার তরে সবচেয়ে সরব। কলকাতা বা ঢাকার বিএ এমএ একবর্ণ উর্দু জানেন না। অতএব উর্দু চালু হলে মাদ্রাসার ম্যাট্রিক মানের পড়ুয়া হয়ে যাবে কমিশনার, ক্লাস সিসের ছোঁড়া হবে ডিএম! উর্দু জবান জিন্দাবাদ!
এরা দিল পয়লা নম্বরি ধাপ্পা আজিজ এবং তার প্যারা উর্দুভাষী ইয়ারদের। এরা কতখানি বাঙলা জানে, সে বাঙলা দিয়ে বাঙলা কৃষ্টি-ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে কি না সেটা বোঝবার মতো বাঙলা এলেম তো আজিজ গোষ্ঠীর নেই। এদেরই অনেকে পরবর্তীকালে অল-বদরে দাখিল হয়ে দক্ষতার সঙ্গে খান অফিসারদের খবর যোগায়, কোথায় কোন বুদ্ধিজীবী বাস করে, কাকে কাকে খুন করতে হবে। আত্মসমর্পণের দিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর সকালবেলা যখন যুদ্ধ সমাপ্তি তথা আত্মসমর্পণের দলিলাদি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। বলে আমারই পরিচিত দু জন বাঙলা-প্রেমী বুদ্ধিজীবী, এতদিন পালিয়ে পালিয়ে থাকার পর নিশ্চিন্ত মনে আপন আপন পরিবারে ফিরে এসে স্বস্তিতে ঘুমুচ্ছিলেন, তখন এই অল বদররাই মা, স্ত্রী, শিশু পুত্রকন্যার সামনে দুই হতভাগ্যকে বন্দুকের সঙ্গিন দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে চোখে পট্টি বেঁধে কোনও এক অজানা জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে নিষ্ঠুর অত্যাচারের পর তাদের গুলি করে মারে।
ওদিকে বাঙালি মুসলমান উঠেপড়ে লেগেছে, ভাষা আন্দোলন নিয়ে। তারা এটা চায় ওটা চায়, সেটা চায়। মারা গেল কিছু প্রাণবন্ত তেজস্বী ছেলে বন্দুকের গুলিতে। আন্দোলন তীব্রতর রূপ ধারণ করতে লাগল প্রতিদিন।
অতিশয় অনিচ্ছায় পাক সরকার দুধের ছলে কিঞ্চিৎ পিটুলি-গোলা পরিবেশন করলেন বাঙলা অ্যাকাডেমী নাম দিয়ে। তার ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন গোটা কয়েক বিচ্ছ– বিসমিল্লাতেই। এরা সেই মোল্লা মুনসির মতো যাদের কথা এইমাত্র নিবেদন করেছি– অত্যল্প শিক্ষিত নন। এঁরা বেশ কিছুটা শাস্ত্র জানেন, অল্পবিস্তর বাঙলাও লিখতে পারেন।
সরকার দিয়েছে টুইয়ে। এরা ধরলেন জেদ অ্যাকাডেমীর সর্বপ্রথম কর্তব্য রূপে স্বীকৃত হয়ে গিয়েছে (কে কখন স্বীকৃতি দিল, জানিনে) বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে হবে আরবি ভাষায় লিখিত বিবিধ শাস্ত্রগ্রন্থের বাঙলা অনুবাদ করে! প্রতিবাদ করেছ কী মরেছ! তদ্দণ্ডেই তোমার নামে কাফির ফৎওয়া জারি হয়ে যাবে। অথচ ভেবে দেখনি আমাদের সাহিত্য পরিষদ যদি জন্ম নেবার সঙ্গে সঙ্গে মেতে উঠত বেদ থেকে আরম্ভ করে ঘেরন্তসংহিতা আর খট্টাঙ্গ পুরাণের বাংলা অনুবাদ করতে, তবে লুপ্তপ্রায় বাঙলা পাণ্ডুলিপি থেকে অমূল্য গ্রন্থরাজি উদ্ধার করে খাস বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করত কে? কোন পাষণ্ড অস্বীকার করবে সংস্কৃত এবং আরবি প্রচুর গ্রন্থ বাঙলাতে অনুবাদ করা অতিশয় কর্তব্যকর্ম? কিন্তু প্রশ্ন, সেইটেই কি সাহিত্য পরিষদ বাঙলা অ্যাকাডেমীর সর্বপ্রধান ধর্ম?