এ বঙ্গদেশ ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা দ্বারা চিরকাল নিরুদ্ধ নিশ্বাস। উত্তরে হিমালয়, পূর্বে আরাকান, দক্ষিণে সমুদ্র। অথচ পশ্চিম থেকে যুগ যুগ ধরে শক হুণ তুর্ক পাঠান মোগল ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে হানা দিয়েছে দলে দলে। তাদের চাপ পড়েছে পাঞ্জাবের ওপর, সে দেশের লোক চাপ দিয়েছে উত্তর প্রদেশের ওপর করে করে সর্বশেষ চাপ পড়েছে বাঙলার ওপর। সে হতভাগা উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ কোনও দিকেই চাপ দিতে পারে না, পালাবার পথ পর্যন্ত তার নেই। সে তখন রুখে দাঁড়াবে না তো কী করবে? সেটা বিদ্রোহ নয়– এমনকি সেটাকে স্বাধীনতা সংগ্রাম আখ্যা দিলেও মোক্ষমতম তত্ত্বটি প্রকাশ পায় না। প্রতিবারেই তার রুখে দাঁড়ানোটা নিতান্তই, একান্তভাবে আপন জীবনরক্ষার্থে– ওসমানের সেই কোণঠাসা ছোট্ট চিড়িয়াটিকে ধরতে গেলে সে-ও ঠোকর মারত। এ প্রচেষ্টাকে স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ দেশাত্মবোধজাত আত্মাহুতি ইত্যাদি গম্ভীর অম্বরে যথা নাদে কাদম্বিনী সদৃশ উচ্চনামে ডাকুন আর না-ই ডাকুন, ওটাকে কাশ্মির কান্যকুজ পাঠান মোগল রাজন্যবর্গের মুখপাত্র হয়ে বিদ্রোহী নাম নিয়ে স্পর্শকাতর জনকে বিড়ম্বিত করবেন না। বলা বাহুল্য, সে পরাজিত হয়েছে একাধিকবার। সে তখন দেখেছে বিজয়ী বীরবৃন্দ তার পুত্র-ভ্রাতাকে হত্যা করেছে, অবলাদের ধনষ্ট করেছে, তার ক্ষেত ফসল কেড়ে নিয়েছে, তার শেষ রক্তবিন্দু শোষণ করার পর ক্রীতদাসরূপে তাকে বিদেশের হট্ট-পণ্যালয়ে নির্বাসিত করেছে।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে হল বিলকুল একটা নয়া খেল। হঠাৎ কোথা থেকে হাজার হাজার বিহারি দারওয়ান, মিস্ত্রি বাবুর্চি ঢুকল তাদের দেশে। এদেশে তারা যুদ্ধে জয় করে ঢুকলে সেটা অভূতপূর্ব অস্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হত না। তার ওপর এল পাঞ্জাবি, পাঠান সুদূর পশ্চিম ভারত থেকে, খোঁজাবোরা অতিদূর বোম্বাই-করাচি থেকে। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে আসতে হলে এদের যুদ্ধে পরাজয় করতে হত প্রথম হরিয়ানা, রাজধানী দিল্লি, তার পর উত্তরপ্রদেশ, তার পর বিহার, সর্বশেষ বঙ্গদেশ। এহেন স্ববীর্যে করায়ত্ত সমুদ্রে সেতু নির্মাণ না করে দুর্ধর্ষ রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, মেঘনাদ অজেয় জগতে বীরগণকে আত্মনাশা সর্বনাশা সংগ্রামে পর্যদস্ত না করে হনুমান এক লক্ষে বসে গেলেন রাবণের রাজসিংহাসনে!
বিনা যুদ্ধে যারা এল, এরা এক-একটা আস্ত হনুমান অবশ্যই ভিনার্থে অর্থাৎ মর্কটার্থে। না, মাফ চাইছি। মর্কটকুলকে অপমান করতে যাব কেন আমি? ওরা যারা এসেছিল তাদের যা বর্বর আচরণ তারা দেখাল কোনও মর্কট তো কস্মিনকালেও সে বর্বরতার সহস্র যোজন নিকটবর্তী হতে পারেনি। পরবর্তীকালে জঙ্গিলাটের পদ অলঙ্কৃত করেনি।
.
উভয় বাঙলা– শত্রুর তূণীর মাঝে খোঁজো বিষবাণ
গভীর বনানীর ভিতর দিয়ে যাচ্ছে এক কাঠুরে। হাতে একটা কুড়োল। সদ্য কিনে এনেছে গভীর বনের ওপারের গায়ে, কামারবাড়ি থেকে। তাই কুড়োলে এখনও কাঠের লম্বা হাতলটা লাগানো হয়নি। জল্লাদের হাতে তলোয়ার দেখলে যার মুণ্ডু কাটার বাদশাহি হুকুম হয়ে গিয়েছে, সে যেরকম কাঁপতে থাকে, লম্বা লম্বা আকাশছোঁয়া গাছগুলোও কাঠুরের হাতে নয়া কুড়োলের ঝকঝকে লোহা দেখে তেমনি দারুণ ভয় পেয়ে শিউরে উঠল। সেটা প্রকাশ পেল তাদের বাতাসহীন আবহাওয়াতে। অকারণে ডাইনে-বাঁয়ে দোলা লাগানো থেকে। মর্মরধ্বনি জেগে উঠল শাখায় শাখায়, পাতায় পাতায়। এই এল এই পড়ল কালবৈশাখী যখন বেগে ধেয়ে আসে বনস্পতিকে লণ্ডভণ্ড করে দেবার জন্য তখন যেরকম প্রথম সবচেয়ে উঁচু গাছগুলো আসন্ন কালবৈশাখীর আভাস পেয়ে মর্মর রবে কিশোর গাছগুলোকে হুশিয়ারি দেয়, তারা কচিগাছগুলোকে ঠিক তেমনি বলে খবরদার, বিনা বাতাসে বনে বনে ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে মর্মরে মর্মরে আসমানে মাথা হেনে হেনে কাঠুরের হাতে যে কুড়োল সেটা একে অন্যকে দেখিয়ে দিল এবং তারা যে এত শত বৎসর ধরে শান্তিতে দিন কাটিয়েছিল তার যে সমাপ্তি আসন্ন সেটাও বুঝিয়ে দিল।
তখন এক অতি বৃদ্ধ সুদীর্ঘ, ঈষৎ নজদেহ তরুরাজ চিন্তাপূর্ণ গম্ভীর মর্মরে সবাইকে বললে, বৎসগণ! আস্ত কুড়োলের ওই লোহার অংশটুকু মাত্র আমাদের বিশেষ কোনও ক্ষয়ক্ষতি করতে পারবে না। হয়তো সামান্য একটু আঁচড়-জখম আমাদের গায়ে লাগতে পারে– তাতে করে কাঠুরের কোনও লাভ নেই খামোখা সে মেহনত করতে যাবে কেন সে? মরণ আসবে আমাদের সেই কুক্ষণে যেদিন আমাদেরই একজন কাঠ হয়ে ওই লোহার টুকরোটিতে ঢুকে হাতল হয়ে তাকে সাহায্য করবে। তখন ওই কুড়োল হবে বলবান। কাঠুরের কঠিন পেশির সুপ্ত বল আমাদেরই একজনের মিতালিতে তৈরি হাতলের ভিতর দিয়ে সঞ্চারিত হয়ে আমাদের দ্বিখণ্ডিত করবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশে পুব পাকে নিযুক্ত পাঞ্জাবি-বেহারিরা উঠেপড়ে লেগে গেলেন পুব পাকের বাঙালি মুসলমান হাতলের সন্ধানে। এই পাঞ্জাবি বুদ্ধ ও বেহারি বিচ্ছেদের জন্য কুঠার-লৌহদণ্ড হয়ে এলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানি চিফ সেক্রেটারি তার প্রাতঃভসনীয় গোধূলি কর্তনীয় নাম মি, আজিজ আহমদ। এঁকে রাজধানী পাঠিয়েছিল পূর্ব পাকে অখণ্ড পাকিস্তানের দৃঢ় ভিত্তি নির্মাণের জন্য; তিনি পুঁতে গেলেন লক্ষাধিক টাইম-বম, সেগুলো ফাটল চব্বিশ বছর পর।