এর সব কটা অর্থই আমি মেনে নিয়েছি, কিন্তু বাঙালি কোষকারগণ যদিও হুজুতে বলতে প্রধানত কলহপ্রিয় অর্থেই ধরে নিয়েছেন তবু বহুক্ষেত্রে যেখানে হুজুৎ শব্দ ব্যবহার হয়েছে এবং হয় তার বাতাবরণ, পূর্বাপর, প্রাসঙ্গিকতা বিচার করে আমার মনে হয়েছে, শব্দটার অর্থ ঝগড়াটের চেয়ে ঢের ঢের ব্যাপকতর। কোনও স্থলে মনে হয়েছে এর অর্থ জেদিএকগুয়ে অবস্টিনেট দুর্দমনীয়, কিছুতেই বশ মানতে চায় না। মূল আরবিতে লেখারম্ভে নিবেদন করেছি, শব্দটার একটা অর্থ আপত্তি প্রকাশ করা এবং দৃঢ় কণ্ঠে মতদ্বৈধ প্রকাশ করা। সরল বাংলায় সহজ অর্থ বিদ্রোহ করা, দীর্ঘতর অর্থ অন্যান্য দাবির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা।
হুতোম যখন তাঁর প্রাতঃস্মরণীয় নকশাতে একটি ফারসিপ্রবাদ আংশিক অনুবাদ করে লিখলেন সাধারণ কথায় বলেন, হুনরে চীন ও হুৰ্জ্জুতে বাঙ্গাল তখন তিনি হুজুতে কী বুঝেছিলেন বলতে পারব না, কারণ এই তুলনাহীন গ্রন্থখানার লেখক শ্ৰীতালাহুল ব্ল্যাক ইয়ারের অনুগত তাঁবেদার মোসাহেব এ অধম সে গ্রন্থখানা বটতলা থেকে শুরু করে অনবদ্য শোভন সংস্করণ পর্যন্ত কতবার যে কিনেছে এবং তার কাছ থেকে কতবার ধারের ছলে চুরি হয়েছে সেকথা স্মরণে আনলেই সে তৎক্ষণাৎ পরশুরামের মতো শপথ গ্রহণ করে, এই গৌড়ভূমিকে সে বার বার নিন্দুস্তক-চৌর করবে–আমৃত্যু, এবং জন্মনি জন্মনি, প্রতি জন্মে।… এস্থলে কিন্তু লক্ষণীয় প্রবাদটির ফারসি মূলরূপ হুনর-ই-চীন ওয়া হুজ্জৎ-ই-বাঙ্গাল। অস্যার্থ স্কিল অব চায়না অ্যান্ড রেবেঁলিয়াসনেস (অবসটিনেসি) অব বেঙ্গল। কাজেই হুজ্জই-ই-বাঙ্গাল-এর মধ্যবর্তী ইটি হুজুতে-এর একার হয়ে বিশেষণে পরিবর্তিত হয়নি, যেরকম চাষাড়ে, ঝগড়াটে, তামাটে। এস্থলে– ই- টির অর্থ অফ। যেরকম মরহুম ফজলুল হকের জনগণদত্ত উপাধি ছিল শের-ই-হিন্দ টাইগার অব বেঙ্গল। বাঙলায় লেখা হত শেরে হিন্দ। এই সূক্ষ্ম ব্যাকরণগত পার্থক্য না করলেও অর্থ দাঁড়ায়, চীন বিখ্যাত তার নৈপুণ্যের জন্য, বঙ্গদেশ তার পৌনঃপুনিক বিরোধিতার (একগুয়েমির) জন্য। নীচ ইতর অর্থে না নিয়ে ঝগড়াটেও বলা যেতে পারে। শান্তস্বভাব বিদ্যাসাগর যবে থেকে বিধবাবিবাহের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন, সেই থেকে বড় ঝগড়াটে হয়ে গেছেন বললে তো ঝগড়াটে শব্দটি এস্থলে উচ্চাঙ্গের প্রশস্তিসূচক।
অথচ সত্যার্থে বাঙালি বিদ্রোহী নয়– অর্থাৎ উচ্ছল, স্বেচ্ছাচারী অর্থে যদি সে শব্দ ব্যবহার করা হয়। পুনরায় দ্রষ্টব্য, বিদ্রোহী শব্দটি কে ব্যবহার করছে তার ওপর এর সদর্থ, কদৰ্থ দুই-ই নির্ভর করছে। মাদজিনিকে ইতালির তকালীন সরকার, দ্য গলকে ভিশি সরকার বিদ্রোহী, দেশদ্রোহী পদবি দিয়ে জনসমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা দিয়েছে। ঠিক ওই একইভাবে কবে, কবেকার সেই গুপ্তযুগ থেকে যুগ যুগ ধরে বলা হয়েছে। অতঃপর বঙ্গদেশ বিদ্রোহ করিল। পাঠান যুগের বঙ্গদেশ নিত্যনিয়ত বিদ্রোহ করে বলে দিল্লি সরকার দুটি শব্দে এদেশের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত সে শব্দদ্বয় আমি ভুলে গিয়েছি কিন্তু সৌভাগ্যবশত প্রতিবারে যে অখণ্ড শ্লাঘা অনুভব করেছি সেটা ভুলিনি এবং অর্থটাও ভুলিনি; মোটামুটি বিদ্রোহী জনপদ উৎপাত-ভূমি জঙ্গিস্থান এই ধরনের কিছু একটা নিন্দাসূচক অধম গুষ্টিসুদু সে নিন্দা চন্দনের মতো শ্রীরাধার অনুকরণে সর্বাঙ্গে অনুলেপন করেছে। কিন্তু গভীর বিস্ময় ও ঘৃণা অনুভব করেছি এবং এখনও করি, যখন দেখি পাঠান-মোগল-ইংরেজ ঐতিহাসিকের দোহার গেয়ে বাঙালি আবার বলছি বাঙালি প্রখ্যাত বাঙালি ঐতিহাসিক অসঙ্কোচে মাছিমারা কেরানির মতো পুনঃপুন পুনরাবৃত্তি করেন, অতঃপর বঙ্গবাসী দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। পাঠান-মোগল ঐতিহাসিকের মুখে এহেন বাক্য স্বাভাবিক! তারা দিল্লীশ্বরের অনুগত দাস, দিল্লি সরকারের সঙ্গে তাদের একাত্মানুভূতি বিচিত্র নয়। কিন্তু বাঙালি ঐতিহাসিক আজ পর্যন্ত বাঙালির দৃষ্টিবিন্দু থেকে বরঞ্চ দৃঢ় প্রত্যয়সহ বলি বিশ্বমানবের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই বিদ্রোহটার রেজো দেত্র স্বতঃসিদ্ধ অস্তিত্ব হেতুটার অনুসন্ধান না করে নিন্দাসূচক বিদ্রোহ শব্দটা প্রয়োগ করেন কেন?
বার্ধক্যজনিত ভারবহনক্ষম বিদ্রোহী স্মৃতিদৌর্বল্যের ওপর নির্ভর করে নিবেদন, বাদশাহ জাগির যখন শেষ বিদ্রোহী বাঙালি পাঠানরাজ ওসমানকে আত্মসমর্পণ করার জন্য আদেশ পাঠালেন তখন ওসমান অতিশয় ভদ্রভাষায় উত্তরে যা লেখেন তার সারমর্ম : আপনি ভারতেশ্বর, আপনার রাজ্য সুবিস্তৃত, আপনার ক্ষমতা অসীম। আমি পড়ে আছি ভারতের এক কোণে। আমার স্বাধীনতা আপনার কোনওপ্রকারের ক্ষতিসাধনে সম্পূর্ণ অক্ষম। জঙ্গলের চিড়িয়াটাও স্বাধীন থাকতে চায়।
ওসমান বলতে চেয়েছিলেন, বনের পাখির স্বাধীনতা একান্তই স্বভাবজাত, নৈসর্গিক। সে স্বাধীনতা কারও প্রতি বৈরীভাব পোষণ করে না, পরধনলোভ সে স্বাধীনতার অন্তর্নিহিত স্বধর্ম নয়। কিন্তু তার চেয়েও মোক্ষম সত্য প্রকাশ করেছেন যখন বললেন, আমি ভারতের এককোণে পড়ে আছি। তার পূর্ণ অর্থ কী?
আর্যজাতি তার সর্বপ্রাচীন আদিবাস কেন্দ্র থেকে নির্গত হয়ে উত্তর দক্ষিণ পশ্চিম দিকে সঠিক কোন জায়গায় এসে আর অগ্রসর হল না সে বিষয়ে মতভেদ থাকতে পারে কিন্তু পূর্বদিকে বঙ্গদেশই যে তার সর্বশেষ অভিযান সীমান্ত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পূর্বদিগন্তে বাঙলাই শেষ আর্যভাষা।