দেশবিভাগের পর পাঞ্জাবিদের ভিতর দেখা দিল দুই প্রকারের আত্মম্ভরিতা। পাকিস্তান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র অতএব পাকিস্তানিরা বিশ্ব মুসলিমের প্রতিভূ, এবং যেহেতু তারা প্রতিভূ, অতএব তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলমান; বলা বাহুল্য, সেই সর্বশ্রেষ্ঠদের মুকুটমণি স্বভাবতই, অতি অবশ্যই পাঞ্জাবি মুসলমান। সূত্রটি সত্য কিন্তু তার থেকে যে দুতিনটি সিদ্ধান্ত হল সেগুলো যুক্তি ও ইতিহাসসম্মত নয়। কামাল আতাতুর্ক স্বদেশ তুর্কির কর্ণধার হওয়ার পূর্বে সে দেশের সুলতান ছিলেন বিশ্বমুসলিমের অধিনায়ক খলিফা। তুর্কির বর্তমান অধিবাসী সংখ্যা চার কোটির মতো। খলিফার আমলে মোটামুটি ওই ছিল। সেকালে একাধিক দেশে ঢের ঢের বেশি মুসলমান বাস করতেন। আর সংখ্যাগুরুত্বই যদি সর্বক্ষেত্রে স্পর্শমণি বা কষ্টিপাথর হয় তবে পাকিস্তানিরা খলিফার শূন্য আসনে তাদের রাষ্ট্রজনক জিন্নাসাহেব, বা পরে জাতভাই পাঞ্জাবি গুলাম মহম্মদ কিংবা মদ্যপ লম্পট ইয়েহিয়াকে বসাল না কেন? অক্সফোর্ডের অধ্যাপক সংখ্যা ৮৭০, ছাত্র ৬৯০০; মার্কিন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সংখ্যা ২১৭৪, ছাত্র ১০২৩৮। (এই অধ্যাপক-ছাত্র-শুমারি ১৯৫০-১৯৫২-এর) তারই জেরে হার্ভার্ড তো কখনও প্রাধান্য বা তার ছাত্রাধ্যাপক অক্সফোর্ডের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এমনতরো দাবি করেনি! মানুষের মাথা একটা, সে মাথাতে যদি উকুন থাকে তবে সে উকুন অসংখ্য।
পাঞ্জাবি মুসলমানরা পাক-ভারতে শ্রেষ্ঠ সর্বশ্রেষ্ঠ না– যোদ্ধা হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। পঞ্চাশাধিক বৎসর ধরে আমি সিভিল-মিলিটারি উভয় শ্রেণির পাঞ্জাবিকে চিনি এবং কস্মিনকালেও এই খ্যাতিতে বিশ্বাস করিনি। ইউরোপের বিখ্যাত যোদ্ধা য়ুঙ্কের (Junker) গোষ্ঠীর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে এবং তাদের এক পরিবারে বেশ কিছুকাল আমি বাস করেছি, ফরাসি অফিসারদের স্যাঁ সির মিলিটারি অ্যাকাডেমির কয়েকজনকে আমি চিনতুম, এক ইংরেজ কর্নেলের কাছে প্র্যাকটিসহীন, পুস্তকে সীমাবদ্ধ অ্যামেচার রণনীতিতে আমার হাতেখড়ি হয়, আফগান অফিসারদের চিনতুম ঝাঁকে ঝাঁকে, আমারই এক ছাত্র বাচ্চা-ই-সকওয়ের আ মি তে হয়ে গিয়েছিল রাতারাতি কর্নেইল এবং এই সর্বাঙ্গ গোষ্ঠীর ভিতর সবচেয়ে দুর্দান্ত ডাকু অফিসার ছিল জারের ফৌজে– ডুয়েল লড়া সামান্য অসম্মানে আত্মহত্যা করাটা যাদের ছিল নিত্যদিনের তুচ্ছ আচরণ। মত্তাবস্থায় শেষরাত্রে অন্ধকার ঘরে চেয়ার-টেবিলের আড়াল থেকে একজন ডাকলে কু–উ– উ, অন্যজন ছুড়বে সেদিকে পিস্তলের গুলি, এটা যাদের সর্বপ্রিয় খেলা (!) রাসপাতিনহন্তা গ্র্যান্ড ডিউক ইউসপফ এদেরই একজন– এদের কয়েকজনকেও ভালো করেই চিনতুম।
যে নাৎসিরা ইহুদিদের পাইকারি হারে খুন করে, তাদের সঙ্গে সনাতন আর্মির কোনও যোগ ছিল বলে শুনিনি– ব্যত্যয়গুলো অন্যান্য অফিসার কর্তৃক তীব্রকণ্ঠে তিরস্কৃত হয়েছে; যাদের ছিল তারা হিটলারের স্বহস্তে নির্মিত, নাৎসি পার্টির সদস্য দ্বারা গঠিত, হিটলারের নিজস্ব আর্মি এসএস— ব্ল্যাক কোট পরিহিত। কি সনাতন আর্মি, কি এসএস কেউই ধর্ষণকর্মে লিপ্ত হয়নি। নরেনবের্গ মোকদ্দমায় অপরাধের দফাওয়ারি যে ফিরিস্তি পেশ করা হয় সেটাতে ধর্ষণ নেই।
ইয়েহিয়ার একাধিক সেপাই দ্বারা পরপর ধর্ষিতা অগণিত নারী সঙ্গে সঙ্গে প্রাণত্যাগ করেছে। অফিসারদের জন্য প্রতি কেন্টনমেন্টে নির্মিত হয়েছিল ব্রথেল– অনেক মেয়েকেই লুঠ করে আনা হয়েছিল মেয়ে-বোর্ডিং থেকে। ঢাকাস্থ সাধারণ পাঞ্জাবি সেপাই ঢাকার সামান্য বাইরে মুক্তিফৌজের ভয়ে এমনই মুক্ত-পাজামা হয়ে গিয়েছিল যে আমার নিকটতম সৈয়দ আত্মজনকে অনুরোধ করত, তারা যেন আল্লার কাছে প্রার্থনা করে ওদের যেন মফঃস্বলে বদলি না করা হয়। এবং পরাজয় অনিবার্য জানামাত্রই অফিসার গোষ্ঠী প্রাইভেটদের না জানিয়ে প্লেন, হেলিকপ্টার, লঞ্চ চুরি করে পালায় এগুলো অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছিল আহত খান সৈন্যদের হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য। এদের আমি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বলি কী করে?
.
উভয় বাঙলা- ‘হুজ্জৎ-ই-বাঙ্গাল’
হুজ্জৎ কথাটা ন সিকে খাঁটি আরবি এবং অর্থ যুক্তি, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যুক্তি, আপত্তি প্রকাশ করণ ইত্যাদি। শব্দটির কোনও কদৰ্থ আরবিতে আছে বলে আমার জানা নেই। ইরানবাসীরা যখন শব্দটি তাদের ভাষা ফারসিতে গ্রহণ করল তখন তার স্বাভাবিক অর্থ তো রইলই, উপরন্তু শব্দটির একটা কদৰ্থ গড়ে উঠতে লাগল। মানুষের স্বভাব এই যে, সে বিপক্ষের যুক্তিতর্ক স্বীকার করতে চায় না। তদুপরি বিপক্ষ যদি নিছক যুক্তি ভিন্ন অন্য কোনওপ্রকারের বিবেচনা না দেখায়, যেমন ধরুন প্রমাণ করা গেল যে, সমাজে বিশেষ কোনও রীতি বা অনুষ্ঠান বহুকাল ধরে বিনা আপত্তিতে সর্বজনগ্রাহ্য, এমনকি সম্মানিত হয়েছে, যদ্যপি সে রীতি যুক্তিবিরুদ্ধ এবং তখনও সে বার বার একই যুক্তির দোহাই দিতে থাকে, তবে মানুষ স্বভাবতই বিরক্ত হয় এবং ব্যঙ্গ করে তাকে তর্কবাগীশের স্থলে তর্কবালিশ, দ্বন্দ্বপ্রিয়, ঝগড়াটে ইত্যাদি কটুবাক্যে পরিচয় দেয়। এবং মানুষের এই স্বভাবই তখন কটু থেকে কটুতর হতে হতে মূল যুক্তি (হুজ্জৎ) শব্দটাকে অযথা তর্ক, ভণ্ডাচরণের অজুহাত কদর্থেও ব্যবহার করতে থাকে। বাঙলা এই শব্দটা ফারসি থেকে গ্রহণ করার সময় এটাকে অহেতুক তর্কাতর্কি অর্থে নেওয়ার দরুন সেটার ওই ঝগড়াটে অর্থটাই জনপ্রিয় হয়ে গেল। তাই কবি হেমচন্দ্র বাঙালি মেয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে রচেছেন হুজ্জতে হারিলে কেঁদে, পাড়া করে জয়।