.
উভয় বাঙলা– নীলমণি
বিস্তর বিদগ্ধ পাঠক স্বভাবতই শুধোবেন, ইকবাল? ইকবাল তো পাঞ্জাবি! কবি হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি আছে। তা হলে পশ্চিম পাঞ্জাবিদের সঙ্গে উর্দুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই, বলা যায় কী প্রকারে? তুলনা দিয়ে বলা যায়, জোসেফ কনরাডের মাতৃভাষা ছিল পোলিশ। তিনি ইংরেজিতে সাহিত্যসৃষ্টি করে বিখ্যাত হয়েছেন। তাই বলে পোল্যান্ডবাসীর সঙ্গে ইংরেজির অন্তরঙ্গতা আছে, একথা বলা যায় না।
হেমচন্দ্রের স্থান বাঙলা সাহিত্যের কোন শ্রেণির আসনে সে সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বাক্যবিন্যাস করার অধিকার এ অর্বাচীন লেখকের আছে; আমার বিস্তর পাঠকের প্রভূত পরিমাণে থাকার কথা। কিন্তু উর্দু কাব্যের সঙ্গে আমার পরিচয় এতই সীমাবদ্ধ যে সে কাব্যে ইকবালের স্থান কোথায় সে সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করবার মতো কাব্যাধিকার আমার অত্যল্পের চেয়েও কম। তথাপি বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধশ্রেণিকে সাধ্যানুযায়ী পূর্ণতর করার উদ্দেশ্যে সেটা অবর্জনীয়।
ইকবাল, আমার যতদূর জানা আছে, জর্মন কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব সম্ভব মনিক থেকে দর্শন বিভাগে ডক্টরেট পান। কোনও কোনও পাঠকের কৃপাধন্য এ গর্দভও দর্শন বিভাগ থেকে ডক্টরেট পায়– জর্মনির অন্যতম বিখ্যাত বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এবং বললে পেত্যয় যাবেন নিশ্চিৎ মতুল্য এবং মদাপেক্ষা সহস্রগুণে খঞ্জতর ভূরি ভূরি গর্দভ-গর্দভী জর্মনি থেকে– জর্মনি কেন, সর্বদেশেই– নিত্যি নিত্যি ডক্টরেট পেয়েছে ও পাবে। অতএব ইকবাল ভক্ত মদোস্কট পঞ্চনদবাসী কবি ইকবালের ডক্টরেট নিয়ে যতই ধানাই-পানাই করুক, ঢক্কা-ডিণ্ডিম-নাদ ছাড়ুক তদ্বারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। বিশেষত আমরা যখন বিলক্ষণ অবগত আছি, উচ্চাঙ্গের কাব্য রচনার জন্য দর্শনশাস্ত্রের প্রয়োজন নেই, এবং ওই উদ্দেশ্যে মুনিক পানে ধাবমান হওয়াও বন্ধ্যাগমন। বস্তৃত কবি ইকবালের ঢক্কাবাদক পঞ্চনদ সম্প্রদায় তাঁর যেসব দার্শনিক কবিতার প্রশস্তিতে পঞ্চমুখ সেগুলো না দর্শন না কবিতা। অবশ্য আমার এই ধারণার মূল্য না-ও থাকতে পারে। তার বিশেষ ধরনের কবিপ্রতিভা ছিল, সে তথ্য সুবিদিত।
ইকবাল যেসব কবিতায় অতীতের মুসলিম সভ্যতা ও কৃষ্টির গুণ-কীর্তন করেছেন এবং তার যুগে মুসলিম জাহানের সর্বত্র সে-সভ্যতা ও কৃষ্টির অস্তমিত অবস্থার যে কারণ বর্ণনা দিয়েছেন সেগুলোই সবচেয়ে জনপ্রিয়। ইতিহাসের দৃষ্টিবিন্দু থেকে দেখলে সেগুলোতে ভুল-ত্রুটি নগণ্য এবং স্থলে স্থলে কবিজনসুলভ অতিশয়োক্তি নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য।
এক-এক জলজ পর্বতপ্রমাণ।
সাগর করিবে গ্রাস হয় অনুমান ॥
যে সাগরে জলজন্তু বাস করে সেই গোটা সাগরকে যদি সেই জলজন্তু গ্রাস করতে পারে তবে ইউক্লিডের মুখে ছাই দিয়ে স্বীকার করব, কোনও বস্তুর খণ্ডিত অংশ সেই বস্তু থেকে বৃহত্তর হতে পারে! কিন্তু কাব্য বিজ্ঞান নয়, দর্শনও নয়। যদিও আলঙ্কারিক দুনি তাঁর কাব্যাদর্শে মত প্রকাশ করেছেন, এ জাতীয় অসম্ভাব্য বর্জনীয়।
একতায় হিন্দুরাজগণ
সুখেতে আছিল সর্বজন
সে ভাবে থাকিত যদি
পার হয়ে সিন্ধু নদী
আসিতে কি পারিত যবন?
রঙ্গলাল বঙ্গভূমে একদা এই শ্লোক ছন্দে প্রকাশ করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ইকবালের শোকপ্রকাশশৈলী অপেক্ষাকৃত উচ্চাঙ্গের। কিন্তু যে মুসলিম কৃষ্টির ন্যায্য প্রশস্তি ইকবালের কাব্যে আছে তাতে পাঞ্জাবি মুসলিমদের অবদান সম্বন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন কি না, আমার মনে পড়ছে না। তবে একথা স্পষ্ট মনে আছে, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় প্রতি বৎসর একটা জব্বর ডিবেট হয়। বিষয় : কে শ্রেষ্ঠতর কবি?–ইকবাল না গালিব? এবং পাঞ্জাবিরা একদা দলে ভারী থাকত বলে ডিবেট শেষের ভোট-মারে গালিব প্রতি বৎসর মার খেতেন।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা সত্যই কবিতা কি না, এ নিয়ে যারা বক্তৃতা দেন কবি স্বয়ং তাঁদের নিয়ে মশকরা করেছেন। তদুপরি তাঁর কিংবা কোনও কবির কাব্য থেকে পছন্দমতো, যেটা লেখকের প্রতিপাদ্য বিষয়কে সাহায্য করে সেটা গ্রহণ, যেটা করে না সেটা বর্জন করে করে কবির জীবনদর্শন নির্মাণ করাটা তিনি নেকনজরে দেখতেন কি না, রসিকজন দেখেন কি না, সে বিষয়ে আমি শঙ্কা পোষণ করি। ইকবাল যখন গাইলেন, চীন ও আরব আমাদের হিন্দুস্থান আমাদের তখন এই আমাদের-এর আমরা খুব সম্ভব একমাত্র মুসলমানগণ, কারণ চীন ও আরবে হিন্দু আছেন বলে শুনিনি। পক্ষান্তরে তিনি যখন বলেন, হিন্দুস্থান সর্ব বিশ্বে শ্রেষ্ঠতম তখন নিশ্চয়ই তিনি আপন মাতৃভূমিকে (সে যুগে ভারত ইসলামের জন্মভূমি আরবের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর আসন দিচ্ছেন। অতএব তিনি প্রথমে মুসলিম তার পর ভারতীয়, না প্রথমে ভারতীয় তার পর মুসলিম এ সমস্যা থেকেই যায়– অন্তত আমার কাছে। সর্বশেষ প্রশ্ন, দেশ, ধর্ম, ভগবান ইত্যাদির প্রতি রচিত কবিতা আজ পর্যন্ত বিশ্বকাব্যে কতখানি সফল হয়েছে, কোন পর্যায়ে উঠতে পেরেছে, সেটাও পাঠক বিবেচনা করে দেখবেন।
রঙ্গলালের কবিতা বাঙালিকে অকস্মাৎ যবনবৈরী করে তুলেছিল বলে কখনও শুনিনি; ইকবালের কাব্য পাঞ্জাবি মুসলমানকে তার স্বধর্ম সম্বন্ধে শ্লাঘা অনুভব করতে সাহায্য করল। এটা প্রশংসনীয়। কিন্তু এই স্বধর্মাভিমান যখন অন্য ধর্মকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে এমনকি বৈরীভাবে দেখতে আরম্ভ করে বিশেষ করে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর তখন প্রতিবেশী ভারতীয় হিন্দুর প্রতি পাঞ্জাবিদের রাজনৈতিক আচরণও যে বৈরীভাবাপন্ন হবে সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক। এমনকি পাঞ্জাবে প্রচলিত ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের পাঞ্জাবি মুসলিমও নিপীড়িত হয়। তবে এর মূলে আছেন ইকবাল– এ অপবাদ আমি কখনও শুনিনি।