ব্যাপারটার গোড়াপত্তন কিন্তু এক নতুন পরিস্থিতি এবং তারই ফলে এক নতুন প্রয়োজনীয়তা থেকে। পুব বাঙলাকে যথারীতি শাসনশোষণ করার জন্য পশ্চিম পাক বিশেষত পাঞ্জাব থেকে নিরবচ্ছিন্ন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পর্যায়ের কর্মচারী পাঠাতে হলে মুশকিল এই যে তারা ন-পাক বাঙলা ভাষাটার সঙ্গে মোটেই পরিচিত নয় এবং যতদিন না সে ভাষা সম্পূর্ণ লোপ পায়– সে পুণ্যকর্ম করার জন্য সরকার অবশ্যই সদাজাগ্রত ও যত্নবান– ততদিন এদের তো কাজ চালাবার মতো বাঙলা শিখতে হবে। ওদিকে কলেজের ছাত্ররাও হৃদয়ঙ্গম করেছে, সিন্ধি বেলুচি বা পশতু শিখে বিশেষ কোনও লাভ নেই। সিন্ধু দেশে তো যথেষ্ট উচ্চশিক্ষিত সিন্ধিজন আছেই, তদুপরি অর্ধবর্বর পাঠানভূমি, বেলুচিস্তান এমনকি সিন্ধু প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় এতই ক্ষুদ্র যে সেখানে চাকরির সংখ্যা অতি অল্প। এবং এ কথাও সত্য বেলুচ-পাঠানের উপর ডাণ্ডা চালানো অতটা সহজ নয়। বেলুচিস্তানের উপর তো পরবর্তীকালের বুচার অব বেঙ্গল টিক্কা খান বোমা ফেলে বিমার অব বেলুচিস্তান খেতাব পেয়েছেন পূর্ব বাঙলার উপর এখনও বোমা ফেলতে হয়নি। অতএব শেখো বাঙলা প্রেমসে। করাচি, লাহোর এমনকি যে পাঠানের মাতৃভাষা পশতু, বলতে গেলে এখনও যে ভাষা লিখতে রূপ পায়নি সেই পাঠান উঠেপড়ে লেগে গেল পেশাওয়ার বিদ্যালয়ে বাঙলা শিখতে।
এ বড় মজার পরিস্থিতি। খুদ পশ্চিম পাকে বাঙলা শেখা হচ্ছে পূর্ণোদ্যমে, আর সেই বাঙলা ভাষাকে নিধন করার জন্য পুব পাকে গোপনে প্রকাশ্যে দমননীতির সঙ্গে সঙ্গে আইনকানুনও নির্মিত হল। তারই একটা ফরমান সম্পূর্ণ বেআইনি কায়দায় ঘোষণা করল পুব বাঙলা এলাকায় পশ্চিম বাঙলার জীবিত কি মৃত– মৃত লেখকের কপিরাইট তামাদি হয়ে গিয়ে থাকলেও কোনও লেখকের বই ছাপানো চলবে না এবং পশ্চিম বাঙলার প্রথম প্রকাশিত যে কোনও বই পুব বাঙলায় ছাপানো যাবে না। এর ফলে পুব পাকিস্তানের অধ্যাপক ও কবি জসীম উদ্দীনের কাব্য নক্সি কাথার মাঠ ইত্যাদি পূব বাঙলায় ছাপানো নিষিদ্ধ হল কি না স্মরণে আসছে না; কবির তাবৎ পুস্তকই তো কলকাতার ছাপাখানাতেই জন্ম নেয়, প্রথম প্রকাশ তো সেখানেই।
পশ্চিমবঙ্গের লেখকমণ্ডলী নিশ্চয়ই এ ব্যানের সংবাদ শুনে উল্লাস বোধ করতেন যদি তখন সেটা জানতে পেতেন। বিশেষ করে নীহার গুপ্তর মতো জনপ্রিয়, শঙ্করের মতো বহুদর্শী ও সমরেশের মতো নির্ভীক লেখক নিশ্চয়ই এ সংবাদ শুনে কথঞ্চিৎ শান্ত হতেন কারণ কালোবাজারের চোরাই সংস্করণের এঁরাই ছিলেন শিকারের প্রধান প্রধান বাঘসিঙি। কিন্তু ইতি গজটা এখনও বলা হয়নি। পশ্চিম বাঙলার বই পুব পাকিস্তানে ছাপানো ব্যান হল বটে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে ছাপানো ব্যান হল না।
কী কারণে কার স্বার্থে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। পাঞ্জাবের উদ্যোগী পুরুষসিংহরা– যদিও সিংহগুলো কালোবাজারি পুস্তক ছাপানোর অনৈসর্গিক ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণে রঞ্জিত– যাতে করে পুব বাঙলার বুক-মার্কেট পরিপূর্ণরূপে গ্রাস করতে পারেন। বিধি বলুন, বিজ্ঞান বলুন তিনি/তারা এঁদের প্রতি অকস্মাৎ সদয় হলেন। ফটো-ফ্ল্যাশ নামক পদ্ধতি ততদিনে আবিষ্কৃত হয়েছে যার প্রসাদে সরাসরি যে কোনও বই সস্তায় পুনর্মুদ্রণ করা যায় নতুন করে কম্পোজ-প্রুফরিডিং ইত্যাদির ঝামেলা পোয়াতে হয় না। প্রাগুক্ত পশ্চিম পাকের বাঙলাভাষা অধ্যয়নরত ছাত্রদের জন্য এঁরা সর্বপ্রথম ছাপলেন তাঁদের বাঙলা পাঠ্যপুস্তক ব্যাকরণ ও অভিধান। চটসে প্রকাশিত হল চলন্তিকা। কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ পশ্চিম পাকে বই বিক্রি হবে অল্প, পুব পাকের ভূমাতে শাস্ত্রসম্মত সুখম। ওদিকে উল্লেখ প্রয়োজন পশ্চিম পাক থেকে পুব পাক যে কোনও বই উর্দু হোক বাঙলা হোক, যে কোনও পরিমাণে আমদানি করতে পারে– তার ওপর কোনও ব্যান্ নেই। কাজেই পাঞ্জাবি উদ্যোগীরা ছাপতে লাগলেন, শরৎচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে বটতলা পর্যন্ত। রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কালে বা তার কিঞ্চিৎ পূর্বে কলকাতায় প্রকাশিত গীতাঞ্জলির একটি শোভন পকেট সংস্করণেরও অত্যুত্তম ফটোফ্ল্যাশ সংস্করণ তারা বাজারে ছেড়েছিলেন। সকণ্ঠে কাষ্ঠ হাসি হেসে বলি, গুণীজনের মনোরঞ্জনার্থে! বাজারটা কিন্তু খুব বেশিদিন বাঁচল না। ইতোমধ্যে লেগে গেল ১৯৬৫-র লড়াই। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় একাধিক প্রকাশক দুশমন মুল্লুকের তামাম মাল হালাল অর্থাৎ শাস্ত্রানুমোদিত এই অছিলায়। বেধড়ক ছাপতে শুরু করলেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রকারের পুস্তক। ইতোপূর্বে যে আদৌ করেননি তা-ও নয়, মি. ব্ল্যাক অনুচর স্মিথও অপাক্তেয় রইলেন না।… পুব পাক স্বাধীন হওয়ার পর এখনও কী পরিমাণ পাইরেটেড মুদ্রণের প্রচার ও প্রসার আছে তার অনুসন্ধান করিনি।
কী অদ্ভুত পরস্পর-বিরোধী পলিটিকস চালাল চব্বিশ বছর ধরে পশ্চিম পাকের দণ্ডধরগণ। পুব বাঙলায় পলিসি ছিল তার সাহিত্য ও ভাষার যথাসাধ্য বিনাশ করা এবং দ্বিতীয়ত পুব বাঙলা যেন পশ্চিম বাঙলার সঙ্গে কি সাহিত্যে কি সঙ্গীতে কোনও প্রকারের যোগসূত্র রক্ষা করতে না পারে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকে হবে বাঙলা বড় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের জন্য ছাপাতে দিল বাঙলা বই, অভিধান। ওদিকে কলোনি শোষণনীতি অনুসরণ করে পশ্চিম বাঙলার প্রকাশিত পুস্তক পাঞ্জাবে যদৃচ্ছ ছাপতে ও পুব বাঙলায় বে-লাগাম বিক্রয় করতে বাধা দিল না।