লেখিকার বড় মাসির সুফিতত্ত্বমূলক মারিফতি* গীতি (মিস্টি সস্) তাঁর অকালমৃত্যুর পর জনগণের স্বীকৃতি লাভ করে ও ঢাকা বেতার কয়েক বৎসর ধরে তাঁর সুফি পল্লিগীতি প্রচার করে আসছে। এই মাসির কনিষ্ঠপুত্র, লেখিকার অগ্রজ অক্লান্ত সাহিত্যসেবী, ভগ্নীর প্রতি সদা স্নেহশীল মরহুম অলির কাছ থেকে লেখিকা সাহিত্যের যাত্রাপথে পদার্পণের প্রথম উষাকাল থেকে অকুণ্ঠ উৎসাহ ও সর্বাধিক অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। অতিশয় নিরীহ, সত্যার্থে বিরলতম এই অজাতশত্রু অলিভাইকে খানরা গুলি করে মারে তাদের বর্বর অভিযানের সঙ্গে সঙ্গেই– চট্টগ্রামে। শোকাতুর লেখিকা তাঁর জনপদকল্যাণী মাসিকে স্মরণে এনে অশ্রুসিক্ত নয়নে পুস্তিকাটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর প্রিয় দাদাভাই সাহিত্যসখা অলিকে। কবিতাগুচ্ছের অনেকগুলোই অশ্রুশিশিরে সিক্ত।
[*সালমা চৌধুরী, ‘অংশীদার আমি’, সিলেট, ১৩৭৯।]
শতাধিক বৎসর পূর্বে এই চট্টগ্রামেরই আরেক নারী, রহিমুন্নেসা তার ভ্রাতার অকাল মৃত্যুতে কাতর হৃদয়ে বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছিল :
নয়া সন নয়া মাস ফিরে বার বার,
মোর জাদু চলি গেল ফিরিল না আর।
.
উভয় বাঙলা– সদাই হাতে দড়ি, সদাই চাঁদ
গত শতকের শেষের দিকে, এবং এ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজ চিন্তামগ্ন ভারতবর্ষকে আর কোন কোন দ্রব্যে শোষণ করা যায়। একাধিক চতুর লোকের মাথায় খেলল বাঙলা মুল্লুকের মাছ। মৎস্যের প্রতি যে বাৎসল্য বাঙালির আছে, সেরকম উদাহরণ পৃথিবীর কোনও জাতের কোনও বস্তুর প্রতি আছে কি না সেটি গভীর গবেষণার বিষয়। অতএব ভারত সরকারের পুরো মদদ, পুলিশের কড়া শাসনের ছত্রচ্ছায়ায় দুই ইংরেজ মাছের ব্যবসা খুলতে গেল, দুটি কলের জাহাজ নিয়ে। কথিত আছে অস্মদেশীয় নমস্য ভেড়িওয়ালারা (শব্দটি আমি হরি, জ্ঞান রাজ কারও অভিধানে পাইনি- মৎস্য উৎপাদনকারী অর্থে যে অর্থে অর্বাচীন লেখক এস্থলে সভয়ে ব্যবহার করছে) মহুরতের পূর্বরাত্রে দুটি জাহাজ পুড়িয়ে দিলেন পুলিশকে বিশেষ অঙ্গুলি প্রদর্শন করত এবং সরকারকে উভয় হস্তের। অতঃপর আবার ইংরেজ চেষ্টা দিল দুশমনদের আওতার বাইরে চিল্কা হ্রদে। কথিত আছে, সর্ব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হবার প্রাক্কালে কে বা কাহারা চিল্কাপারের সরকারি বিশ্রামাগারে গভীর নিশীথে একাধিক ইংরেজ হনু মৎস্য ব্যবসায়ীকে পেঁদিয়ে লম্বা করে দিয়ে যায়। অবশ্য ভেড়িওয়ালাদের এহেন অপ্রশংনীয় আচরণের মধ্যে অন্তত একটি প্রশংসনীয় দ্ৰস্ততা ছিল : উভয় প্রচেষ্টার প্রারম্ভেই তাঁরা গোরারায়দের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, এ ধরনের প্রচেষ্টা তাঁদের স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক না-ও হতে পারে… অর্বাচীন বঙ্গীয় ইতিহাসে এর চেয়ে বিস্ময়জনক ঘটনা আমার জানা নেই; কোথায় তখন স্বদেশী, ক্ষুদিরাম, গান্ধী ইংরেজের সেই দোর্দণ্ডতম প্রতাপের মধ্যাহ্নে? যদি অনুমতি পাই তবে নির্ভয়ে নিবেদন, কম্যুনিজম ফ্যাসিজম সাংখ্যবেদান্ত মাকালী মৌলা আলি এঁদের কারওরই প্রতি আমার অখণ্ড বিশ্বাস নেই এবং সঙ্গে সঙ্গে সভয়ে নিবেদন আমার সাতিশয় অবিচল দৃঢ়তম বিশ্বাস, ভারত এবং কিংবা বাঙলা সরকার এমনকি প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মৎস্য রপ্তানির আশ্বাসে বলীয়ান হলেও তাঁরা কস্মিনকালেও আমাদের ভেড়িওয়ালাদের আয়ত্তে এনে মৎস্য মূল্য দ্রজনোচিত স্তরে আনতে পারবেন না, না, না। নিতান্তই যদি শিলা জলে ভেসে যায় ধরনের অসম্ভব কল্পনাবিলাস করতেই হয়, তবে বলি, যদি কখনও পারেন, তবে সেই সন্ধ্যায়ই ভারতের তাবৎ ট্রেড ইউনিয়ন করায়ত্ত হবে, আহমদাবাদি, অন্যান্য কোটিপতি তথা কালোবাজারিরা পড়িমরি হয়ে কিউ লাগাবেন গত পঞ্চাশ বছরের ঠকানো ইনকাম ট্যাক্স শোধ করতে, যাবতীয় কার্টেল মনপলিকে নিধন করতে সরকারের এক মাসও লাগবে না, গরিব চাষাকে দাদন দিয়ে তার সর্বনাশ সাধনরত সট্টাবাজার– এক কথায় এমন কোনও সংগঠনই তখন নির্বিঘ্নে আপন অসামাজিক আচরণে লিপ্ত থাকতে পারবে না। ভূমণ্ডল প্রদক্ষিণ না করেও সাধারণ পর্যটকের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের ভেড়িওয়ালাদের ঐক্য ও তজ্জনিত শক্তির সঙ্গে তুলনা দিতে পারি এমন কোনও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সমন্বিত শক্তি আমি কোথাও দেখিনি, পড়িনি, শুনিনি। ঈশ্বর তাদের মঙ্গল করুন এবং আমাকে যেন পরজন্মে ভেড়িওয়ালাকুলে স্থান দেন।
বোহরা, খোজা তথা পাঞ্জাবিরা যখন পুব বাঙলার পাট, চা, চামড়া থেকে আরম্ভ করে বিদেশির সহায়তায় নির্মিত আলপিন তক তার মারফত তাদের রসাল কলনিটির আঁটিতে কামড়াতে আরম্ভ করেছেন তখন কতিপয় উদ্যোগী পাঞ্জাববাসীর মনে একটি অতিশয় মৌলিক অভিযানচিন্তা উদিত হল। পূরব পাকিস্তানের মর্দ-লোগ তো বটেই ঔরলোগভি বহু বহুৎ কিতাব পড়ছে। এই কিতাব-মার্কেটটাকে যদি কজাতে আনা যায় তবে কুলে পাকিস্তানে যে বাইশটি পরিবার দেশের অধিকাংশ ধনদৌলতের মালিক আমরা তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারব। মাছের বেলা যেরকম ইংরেজ উদ্যোগী পুরুষদের পশ্চাতে আপন সরকার দাঁড়িয়েছিল তাদেরই বা মদদ দেবে না কেন পিণ্ডি-ইসলামাবাদ? পূর্ববঙ্গে তখন পুস্তকোৎপাদনে ভেড়ি দূরে থাক, কটা এঁদোপুকুর ছিল, এক আঙুলে গুনে বলা যেত।