বাংলাদেশেও একই হাল। হয়তো পরিসংখ্যা বৃহত্তর। তবে তাঁদের চক্রটির পরিধি কতখানি বিস্তৃত সেটা জরিপ করা সুকঠিন কর্ম। অবশ্য একথা অতীব সত্য, ঢাকার অসংখ্য দৈনিকের প্রায় সব কটিই রবিবাসরীয় তথা সাহিত্য সংখ্যায় ভূরি ভূরি গবিতা ছাপে। যে কটি বিখ্যাত-অখ্যাত গবির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা, গবিতার তরে কলিজার খুন দিয়ে শহিদ হবার জোশ পশ্চিমবঙ্গের গবিকুলকে দস্তুরমতো ভেল্কিবাজি দেখাতে পারে। পুব বাঙলার বাজারে পশ্চিমবঙ্গের পুস্তক-মাসিকের নিদারুণ অনটন সত্ত্বেও ঢাকার গবি সম্প্রদায় এ বাঙলার গবিদের নাম জানেন, ও একাধিকজনের রচনা মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করেছেন, এঁদের সম্বন্ধে তত্ত্ব ও তথ্যসহ উচ্চাঙ্গের আলোচনা করতে পারেন এবং সহৃদয় পরিবেশ পেলে করেও থাকেন। এঁদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় যে তাঁরা আমাদের মতো গবিতাউদাসী এবং যারা আগাপাশতলা গবিতাবৈরী কাফের তাঁদের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য অবলম্বনে একাধিক গবির ন্যায় তাচ্ছিল্যি প্রকাশ প্রায় করেনই না এবং আমরা যে নিতান্তই হতভাগ্য গৈলানন্দ থেকে বঞ্চিত, অশিক্ষিত জড়ভরত সেকথা আভাসে-ইঙ্গিতে স্মরণ করিয়েও দেন না। কলকাতা ফিরে সবিস্ময়ে লক্ষ করলুম, এ বঙ্গের একাধিক গবিও ও-বাঙলার বেশকিছু গবি সম্বন্ধে ওকিবহাল এবং আশ্চর্যের বিষয় নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে ও-বাঙলার গবিতার বই বেশ কিছু পরিমাণে এদেশে এসে পৌঁছেছে। আমার মনে হয়, কথাসাহিত্যের জনপ্রিয়তা স্মরণে রাখলে দেখা যাবে, গবিতার ন্যায্য হিসেবে যা পড়ার কথা তার চেয়ে ঢের বেশি গাব্য পুস্তিকা দুই বাঙলাই পাচার ও লেনদেন করেছে। অবশ্য গবিতার প্রতি কালাপাহাড়ি মনোবৃত্তিসম্পন্ন বিশ্বনিন্দুকরা বলে, এই গদ্য কবিতা বিনিময় নির্ভেজাল গাব্য রসাসক্তি বশত নয়, এর মূল কারণ অন্যত্র ও সন্তর্পণে লুক্কায়িত। উভয় বঙ্গের গবিকুলের অনেকেই কমুনিস্ট এবং তারা একে অন্যের সঙ্গে রাজনৈতিক ভাব বিনিময় লেনদেনের সময় গবিতা-রস এপিটাইজিং ফাউরূপে এস্তেমাল করেন।
বাংলাদেশের অপেক্ষাকৃত বয়স্ক গবিদের এ বাঙলার অনেকেই চেনেন- আমাদের মতো অপাঙক্তেয় অরসিকদেরও দু একজন। কবি আবুল হোসেনের শিক্ষা-দীক্ষা কলকাতায়। দেশ বিভাগের পূর্বেই তাঁর প্রতিভা উভয় বাঙলার অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভাষার ওপর দখল, স্পর্শকাতর হৃদয় দিয়ে বিষয়বস্তু চয়ন, অনাড়ম্বর পদ্ধতিতে সৃষ্ট রস পরিবেশন তাঁর অধিকাংশ রচনাতেই যেন আধা-আলোতে লুকিয়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি দক্ষিণপূর্ব-এশিয়ায়। সে যুদ্ধ তাঁর অন্যতম সংকলনে প্রকাশ পেয়েছে। নয়টি মাসের ইয়েহিয়া নৃত্য কিন্তু এখনও তাঁকে নব সৃষ্টির জন্য তাড়না লাগাতে পারেনি। কিংবা হয়তো তাঁর পিতার অকারণ, মর্মান্তিক পরলোকগমন তাঁর চৈতন্যলোকে ট্রাউমা হয়ে সেখানে সর্বরসধারা আসুরিক পদ্ধতিতে রুদ্ধ করে দিয়েছে। আশা রাখি, এ ট্রাউমা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
রাজনীতির প্রতি পূর্ণ উদাসীন, আচারনিষ্ঠ বৃদ্ধ পিতা খবর পেয়েছিলেন যে, খানসেনা তাদের গ্রামে প্রবেশ করছে। হয়তো ভেবেছিলেন– সেইটেই স্বাভাবিক সর্বপ্রকারে রাজনৈতিক কর্মে সম্পূর্ণ অক্ষম এই অথর্ব বৃদ্ধের প্রতি কি খানসেনা, কি লীগ এমনকি পেশাদার খুনি গুণ্ডারও বৈরীভাব পোষণ করার মতো কোনও স্বার্থ, দ্বেষ বা অন্য হেতু থাকতে পারে না। গ্রামের সদর রাস্তা দিয়ে মার্চ করে যাবার সময় খানরা তাঁকে দেখতে পেল বৈঠকখানায়। বাক্যব্যয় না করে তাকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারে।
আবুল হোসেনের সমসাময়িক আরও উত্তম উত্তম কবি আছেন। তাদের পরবর্তীকালের রচনা হাতে আসেনি–যোগাযোগ ছিল না বলে।
সর্বাধুনিক গবিদের ভিতর ব্যাহ্যত কিশোরসম, আমার তথা সর্ব বয়স্কজনের স্নেহের পাত্র মিঞা শন্সর রহমানের রচনা সরল ও সরস, ছত্রে ছত্রে যেন নতুন নতুন ডাক দিয়ে যায় বাঁকে বাঁকে, দেখায় অপ্রত্যাশিত বিচিত্র ছবি; যদিও একাধিকবার আমার মনের কোণে জেগেছে একটি ধারণা : মিঞা শমস্-এর গবিতার বিষয়বস্তু এত বেশি রোমান্টিক যে এগুলো সাবেক পদ্ধতির কবিতায় চিত্রাঙ্কন একাডেমিক স্টাইল নামে যে টেকনিক পরিচিত– রচিত হলে তাঁর বিচিত্র অনুভূতি সুডৌল নিটোল রূপে ব্যাপকতর আত্মপ্রকাশ করতে পারত।
মননশীল প্রবন্ধ, বিশেষত সাহিত্যের ইতিহাসবিষয়ক তথা পূর্ববঙ্গীয় লেখিকাদের সৃষ্টি নিয়ে তাঁর রচনা কয়েক বৎসর পূর্বেই বানু সালমা চৌধুরীকে তথাকার সাহিত্য জগতে সম্মানের আসন দিয়েছিল। সম্প্রতি তিনি একখানি চটি গবিতা পুস্তিকা প্রকাশ করে ইতোমধ্যেই তাঁর সৃষ্টির বহুমুখী ধারা, বহুবিচিত্র বিদগ্ধ তথা জানপদ শব্দ চয়নদ্বারা সমৃদ্ধ ভাষা-শৈলী, ঐতিহাসিক নয় মাসের বিভীষিকাময়ী সুদীর্ঘ লক্ষ যামা করাল রজনী, সর্বোপরি লেখিকার আম্মা, নানী, বৃদ্ধা মাতৃসমা পরিচারিকাটির ভিন্নেসহ আচারনিষ্ঠ, শান্ত, নম্র পঞ্চোপাসনান্তে লব্ধ অবকাশে নিত্য চারু-কলারত একটি মুসলমান পরিবারের যে চিত্রটি লেখিকা দরদি হৃদয় দিয়ে এবং প্রধানত ব্যঞ্জন ও সুনিপুণ পরিচালনা দ্বারা অঙ্কন করেছেন, সে ছবিটির বৈচিত্র্যগুণ রগ্রাহীজনের সপ্রশংস চিত্তাকর্ষণ করেছে। বস্তুত সদ্য প্রস্ফুটিত বুদ্ধিবৃত্তি তথা নীতি-বিকশিত স্পর্শকাতরতাসহ কিশোরীর প্রাগুক্ত সাহিত্যিক রচনার চেয়েও।