[*হুবহু শিরোনামাটি আমার মনে নেই বলে দুঃখিত।]
এই দ্বিজেন্দ্রনাথ বাঙলায় শর্টহ্যান্ড বই ছাপিয়েছিলেন। তার ১২-১৪ বছর পর রামানন্দের অনুরোধে বৃদ্ধ দ্বিজেন্দ্রনাথ সেটি আবার নতুন করে লেখেন। রামানন্দ তাবৎ বইখানা নিজের খর্চায় ব্লক করে ছাপান (কারণ এতে প্রতি লাইনে এত সব সিম্বল বা সাঙ্কেতিক চিহ্ন ছিল যে এছাড়া গত্যন্তর ছিল না)। এটা আরেকটা লস্ট ক। এরকম বই কেউ পড়েও না। কিন্তু রামানন্দ ঘন ঘন তাড়া না লাগালে এই অতুলনীয় পুস্তক সৃষ্ট হত না।
আবার অন্যদিকটা দেখুন। পাবলিসিটি কারে কয় সেটা মার্কিনদের পূর্বেই রামানন্দ জেনে গিয়েছিলেন। সে যুগের যেকোনো প্রবাসী সংখ্যা নিলেই পাঠক তত্ত্বকথাটি বুঝে যাবেন।
রামানন্দ কোহিনূর বেচতেন আবার সঙ্গে সঙ্গে মুড়িও বেচতেন। কিন্তু কখনও ভেজাল বেচেননি।
এই পাবলিসিটি ব্যাপারে স্বর্গত চারু বাড়ুয্যেকে স্মরণে এনে সশ্রদ্ধ নমস্কার জানানো উচিত।
প্রবাসীর কথা (এবং সুদ্ধমাত্র যেকথা লিখতে গেলেই পুরোপুরি একখানি ভলুম লিখতে হয়; আমার মনে হয় প্রবাসীর কর্মকর্তারা যদি প্রবাসী সঞ্চয়ন জাতীয় একটি ভলুম বের করেন তবে বড় ভালো হয়। এতে থাকবে প্রবাসী থেকে বাছাই বাছাই জিনিস) বাদ দিলেই আসে মডার্ন রিভুর কথা। তখনকার দিনে মডার্ন রিভ খাস লন্ডনে প্রচারিত যেকোনো কাগজের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত। আজও প্রাচ্যভূমিতে এর চেয়ে সেরা ইংরেজি মাসিক বেরোয়নি।
প্রবাসী ও মডার্ন রিভ্যু (বিশাল ভারতের সঙ্গে আমি পরিচিত নই; পণ্ডিত হাজারীপ্রসাদ নিশ্চয়ই এ সম্বন্ধে হিন্দির পৃষ্ঠপোষক রামানন্দ–লিখবেন) এই একাধিক পত্রিকার মাধ্যমে রামানন্দ ভারতের রাজনৈতিক চিন্তায় এনে দেন স্পষ্ট চিন্তন, স্পষ্টভাষণ ও সর্বোপরি নির্ভীকতম সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার প্রচার। আমার মতো বহু মুসলমান তখন রামানন্দকে চিন্তার জগতে নেতা বলে মেনে নিয়েছিলেন।
তার পর এমন একদিন এল যখন তাকে অনুসরণ করা আমার পক্ষে আর সম্ভবপর হল না। কিন্তু একশবার বলব, তিনি তাঁর বিবেকবুদ্ধিতে যেটি সত্য পথ বলে ধরে নিয়েছিলেন সেই পথেই এগোলেন। কোনও সস্তা রাজনীতির চাল তাতে এক কানাকড়িও ছিল না।
বিশ্বভারতীতে আমি ছাত্র থাকার সময় পরম শ্রদ্ধেয় স্বর্গত রামানন্দ কিছুদিনের জন্য অধ্যক্ষ ছিলেন। সে সময়ে তাঁর সাক্ষাৎ শিষ্য না হলেও তাঁর সংস্পর্শে এসে ধন্য হয়েছি। অন্য সব কথা বাদ দিন, আমাকে স্তম্ভিত করেছিল তার চরিত্রবল। এবং সঙ্গে সাতিশয় মৃদুকণ্ঠে কঠোরতম, অকুণ্ঠ সত্যপ্রচার।
***
এদেশে এরকম একটি লোক আজ চাই। কর্তাদের কানে জল ঢেলে দেওয়ার জন্য।
***
ওঁ শান্তি; শান্তি; শান্তি।
‘কথাসাহিত্য’ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭২
.
অনাদিদেব! অনন্ত ভব!
শতং জীব! সহস্রং জীব!!
একদা শান্তিনিকেতন আশ্রমে সঙ্গীতের কর্ণধার ছিলেন– অবশ্য কবিগুরুকে বাদ দিয়ে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী। পরম শ্রদ্ধেয় সমাজসম শ্ৰীযুত অনাদিকুমার দস্তিদার (শতং জীব, সহস্রং জীব!) তখন ছাত্র। কিন্তু আমি তাঁকে কখনও ছাত্র বলে ভাবতেই পারিনি। তার আসন কার্যত এই দুই গুরুর পদপ্রান্তে ছিল বটে, কিন্তু অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় ফরাসি-ইংরেজি-বাংলা ক্লাসে আমার সতীর্থা, সুকণ্ঠী, সুবিনয়ী অনন্ত সুরলোকবাসিনী শ্রদ্ধেয়া রমা মজুমদার যার অকাল মৃত্যুতে কবিগুরুর শোক তার পরমাত্মীয়া-বিয়োগ শোককেও প্রায় অতিক্রম করেছিল একমাত্র ইনি ছাড়া শ্ৰীঅনাদি ছিলেন অনেক উচ্ছে; দুই গুরুর আদেশনির্দেশ শিক্ষাদান ব্যবস্থা প্রভৃতি সর্বকর্মের অব্যবহিত প্রধান। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনায় মনোনিবেশ করলেন। অভিজ্ঞজনমাত্রই জানেন, এক সঙ্গীতসাধনাই মানুষকে অজগরের মতো আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে, তদুপরি তার স্কন্ধে চাপানো হল বিশ্বভারতীর সাহিত্য সভার সম্পূর্ণ কর্মভার। ওইটিই ছিল সেকালে বিশ্বভারতীর মায় কলাভবনাদির বয়স্ক ছাত্রছাত্রী তথা শিক্ষকদের সাহিত্যচর্চার একমাত্র মুক্ত, পাঞ্চজন্য প্রতিষ্ঠান। গুরুদেব শান্তিনিকেতনে থাকলে সর্বদাই এর অনুষ্ঠানাদির সভাপতিত্ব করতেন। একে তো অধিকাংশ আশ্রমবাসী, সহজেই অনুমেয় কারণে, শুরুদেবের সম্মুখে প্রবন্ধ পাঠ করতে সংকোচ এমনকি কিঞ্চিৎ শঙ্কা অনুভব করতেন, তদুপরি গুরুদেবের নিয়মনিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, রুচিসম্মত পদ্ধতিতে সভার আয়োজন করা, পরবর্তী সভায় পূর্ব সভার সুষ্ঠু প্রতিবেদন রচনা করা যেকোনো আর্টস্ বিভাগের ছাত্রদের পক্ষেই নিঃসন্দেহে সুকঠিন কর্মরূপে বিবেচিত হত; এবং অনাদিদা ওই সময়ে যুগপৎ অভ্যাস করছেন শাস্ত্রীয় ও রবীন্দ্রসঙ্গীত, তদুপরি নবাগতদের সঙ্গীতে শিক্ষাদান, এবং স্বরলিপি রচনায় প্রচুর কালক্ষেপণ। ইতোমধ্যে যদি বাইরের কোনও কলেজ থেকে ক্রিকেট বা ফুটবল টিম খেলার নাম করে শান্তিনিকেতনের চিড়িয়াখানা দেখতে আসত তখন অনাদিদার ওপরেই ভার পড়ত সন্ধ্যাবেলায় তাদের জন্য সঙ্গীতামোদের ব্যবস্থা করা।
অজাতশত্রু নিরীহ, স্বল্পভাষী এই লোকটির স্কন্ধে যে কতপ্রকারের গুরুভার বে-দরদ চাপানো হয়েছিল তার ফিরিস্তি তিনি, স্বয়ং, আজ আর দিতে পারবেন না।