রবীন্দ্রনাথ তার যে-ভাইপোকে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, তার চেয়ে মাত্র এগারো বছরের ছোট সুরেন্দ্রনাথ গত হলেন ঠিক তার এক মাস পরে, কবির জন্মদিনের মাত্র চারদিন পূর্বে :
আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি
প্রিয়-মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ
সর্বশেষে লিখছেন, শেষ জীবনে সুরেন্দ্রনাথের ভাগ্য বিপর্যয়ের স্মরণে, যেটি পূর্বেই উল্লেখ করেছি,
তাঁর মৃত্যুর জ্বলন্ত শিখার
আলোকে তাহার দেখা দিল
অখণ্ড জীবন, যাহে জন্ম মৃত্যু এক
হয়ে আছে;
সে মহিমা উদবারিল যাহার উজ্জ্বল
অমরতা
কৃপণ ভাগ্যের দৈন্যে দিনে দিনে রেখেছিল ঢেকে।
শোকের পর শোক, প্রতি শোকে কবি উদ্ভ্রান্ত হয়ে বারবার অনুসন্ধান করছেন– এ কি সব অর্থহীন? এর চরম মূল্য কি কোনওখানেই নেই?
অথচ তিনি অতি উত্তমরূপেই জানতেন, এ সংসারে এমন কোনও মহা সুপারম্যান অবতীর্ণ হননি যার তিরোধানবশত তাবল্লেক গভীর শোকসাগরে নিমজ্জিত হবে, কিম্বা আপন আপন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দের দ্বার খুলে তার থেকে নিষ্কৃতির পথ খুঁজে নেবে না। তাই তার শেষ জন্মদিনের প্রাক্কালে বলছেন :
জানি জন্মদিন
এক অবিচিত্র দিনে ঠেকিবে এখনি,
মিলে যাবে অচিহ্নিত কালের পর্যায়ে
পুষ্পবীথিকার ছায়া এ বিষাদে করে না করুণ,
বাজে না স্মৃতির কথা অরণ্যের মর্মরে গুঞ্জনে
নির্মম আনন্দ এই উৎসবের বাজাইবে বাঁশি
বিচ্ছেদের বেদনারে পথপার্শ্বে ঠেলিয়া ফেলিয়া।
অতি সত্য কথা। কিন্তু যে লোকটা আমাদের এত কিছু দিয়ে গেল, অনাগত যুগের তরেও তুলনাহীন বৈভব রেখে গেল, তাঁকে স্মরণ করব না এই দিনে? এই দ্বন্দর কি কোনও সমাধান নেই? যে এত দিল তাকে স্মরণে না-আনা সে তো ছলনা।
কবিগুরুর সর্বশেষ কবিতা স্মরণে আনিঃ
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা জালে,
হে ছলনাময়ী!
একদিকে বিচ্ছেদ বেদনা, অন্যদিকে নির্মম আনন্দ এ তো ছলনা। তাই
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার ॥
‘পূর্বদেশ’ ৫.৮.১৯৭৩
.
রামানন্দ-তর্পণ
স্বর্গত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তার প্রাপ্য সম্মানের শতাংশের একাংশও পাবেন বলে আমি আর আশা করি না।
এই যে আজ আমরা অজন্তা বাঘ গুহার ছবি নিয়ে এত দাপাদাপি করি, অবনীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথ নন্দলাল বসুর কীর্তিকলাপ নিয়ে গর্ব অনুভব করি আমাদের চোখের সামনে এদের তুলে ধরল কে? এবং তখন তাকে কী অন্যায় প্রতিবাদের সামনে না দাঁড়াতে হয়েছিল! শুধু প্রতিবাদ নয়, নীচ আক্রমণ।
আজ আর তাই নিয়ে ক্ষোভ করি না। তার কারণ, প্রতিবাদ এবং ভিন্নমত (অপজিশন) থাকলে অসৎ মানুষ যে আরও কতখানি অসতোর দিকে এগিয়ে যায় সে তো আজ চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পারছি। রামানন্দের শতদোষ থাকতে পারে কিন্তু তিনি অসৎ একথা বললে আমাদের মতো লোক মানবজাতির ওপর শ্রদ্ধা হারাবে। তিনি সৎ ছিলেন তৎসত্ত্বেও তার অপজিশনের দরকার ছিল। পেয়েছিলেন পূর্ণমাত্রার চেয়েও বেশি।
এই বক্তব্যটি আবার উল্টো করেও দেখা যায়।
আশুতোষ কৃতী পুরুষ। রামানন্দ ও আশুতোষের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন। কিন্তু একটি বিষয়ে দু জনাতে বড়ই মিল। দু জনাই জহুরি। ভারতের সুদূরতম প্রান্তের কোন এক নিভৃত কোণে কে কোন গবেষণা নিয়ে পড়ে আছে, আশুতোষ ঠিক জানতেন। তাকে কী করে ধরে নিয়ে আসা যায় সেই সন্ধানে লেগে যেতেন। রামানন্দের বেলাতেও ঠিক তাই। কোথায় কোন এক অখ্যাতনামা কাগজে তার চেয়েও অখ্যাতনামা এক পণ্ডিত তিন পৃষ্ঠার একটি রচনা প্রকাশ করেছে ঠিক ধরে ফেলতেন রামানন্দ! আপন হাতে চিঠি লিখে তাঁকে সবিনয় অনুরোধ জানাতেন তার কাগজে লেখবার জন্য। শুধু তাই নয়, এ পণ্ডিত কোন বিষয়ে হাত দিলে তার পাণ্ডিত্যের পরিপূর্ণ জ্যোতি বিকশিত হবে সেটি ঠিক বুঝতে পারতেন– সেদিকে ইঙ্গিতও দিতেন কোনও কোনও স্থলে।
তাই রামানন্দ ছিলেন আশুতোষের অপজিশন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখন কৈশোরে পা দিয়েছে। ত্রুটি-বিচ্যুতি অতিশয় স্বাভাবিক। আশুতোষ তার গুরু, রামানন্দ তার গার্জেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় সৌভাগ্য যে সে এই মণিকাঞ্চন সংযোজিত বিজয়মাল্য একদিন পরতে পেরেছিল।
***
সে যুগের প্রবাসীতে এক মাসে যা নিরেট সরেস বস্তু বেরুত, এ যুগের কোনও মাসিক কোনও সাপ্তাহিক পত্রিকা পূর্ণ এক বছরেও তা দেখাতে পারবে না। অবশ্য একথাও স্বীকার করি–ঈশান ঘোষ জাতক অনুবাদ করলেন বাঙলায় (জর্মন, হিন্দি বা অন্য কোনও অনুবাদ তার শত যোজন কাছেও আসতে পারে না) এবং তার সমালোচনা করলেন বিধুশেখর। এ যুগে কই ঈশান, কোথায় বিধুশেখর? এ সুবাদে আরেকটি কথার উল্লেখ করি। রামানন্দের উৎসাহ না পেলে বহু পণ্ডিতই হয়তো তাদের গবেষণা ইংরেজিতে প্রকাশ করতেন; বাঙলা সাহিত্যের বড় ক্ষতি হত।
***
রামানন্দ ছিলেন চ্যাম্পিয়ন অব লস্ট কজেস তাবৎ বাঙলা দেশে দু জন কিংবা তিনজন হয়তো লেখাটি পড়বে, তিনি দিতেন ছাপিয়ে, কারণ দার্শনিক রামানন্দ জানতেন কান্টীয় দর্শন ও পতঞ্জলির পথমধ্যে কোলাকুলি* জাতীয় প্রবন্ধ লিখতে পারে এমন লোক দ্বিজেন্দ্রনাথের মতো আর কেউ নেই। আমাদের বড় সৌভাগ্য যে রামানন্দ মাসের পর মাস দ্বিজেন্দ্রনাথের অপাঠ্য প্রবন্ধরাজি প্রকাশ করেছিলেন, কারণ দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রায়ই কোনও প্রবন্ধ লেখার কিছুদিন পরেই সেটি ছিঁড়ে ফেলতেন। (ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে আমার যেটুকু সামান্য জ্ঞান সে দ্বিজেন্দ্রনাথের কাছ থেকে। বাকিটুকু রমন মহর্ষির কাছ থেকে ও বিবেকানন্দ পড়ে। হিন্দু দ্বিজেন্দ্রনাথ আমাকে সুফিতত্ত্বের মূল মর্মকথা বুঝিয়ে দেন। সুফিতত্ত্বে তার হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে)।