এক যে ছিল চাঁদের কোণায়
চরকা-কাটা বুড়ি,
পুরাণে তার বয়স লেখে
সাতশ হাজার কুড়ি।
রবীন্দ্রনাথ ১৯২১-এ যখন এ-কবিতাটি লেখার পরদিন আমাদের পড়ে শোনান, তখন বুড়ি সেখানে উপস্থিত ছিল। পাঁচবছর বয়সের বুড়ি কবিতাটির আর কতখানি বুঝবে। তবে তার দাদা নীতুর বয়স নয়। সে নিশ্চয়ই অনেকখানি বুঝেছিল। মাঝেমধ্যে বুড়িকে বুড়ি বুড়ি বলে ক্ষ্যাপাত বলে ওই কবিতার শেষের দিকে আছে :
বয়সখানার খ্যাতি তবু
রইল জগৎ জুড়ি
পাড়ার লোকে যে দেখে সেই
ডাকে, বুড়ি বুড়ি।
নীতুর মতো সুন্দর প্রিয়দর্শন ছেলে আমি জীবনে কমই দেখেছি। তার বিশেষ বন্ধু ছিল, আমার রুমমেট চাটগাঁয়ের (বোধহয় পাহাড়তলী অঞ্চলের) জিতেন হোড়। নীতু প্রায়ই আমাদের রুমে এসে গালগল্প জমাত। সে ছিল স্বল্পভাষী, আর জিতেন কথা কম বললেও ছিল বাক-চতুর। রবীন্দ্রনাথ তার আপন পুত্র-কন্যাকে কতখানি ভালোবেসেছিলেন সে আমার জানার কথা নয়, কিন্তু নীতুকে তিনি তার সমস্ত হৃদয় উজাড় করে যে কতখানি ভালোবেসেছিলেন তার সাক্ষ্য দেবে সে যুগের দু পাঁচজন যারা এখনও এপারে আছেন।
পাঠকের মনে থাকতে পারে কবির ঠাকুরদা গল্পে নয়নজোড়ের বাবুদের কাহিনী। সে বাবুদের শেষ বংশধর পাড়ার ঠাকুরদা অর্থাভাবে ভৃত্যাভাবে অনেক সময় ঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া তিনি নিজের হস্তে অতি পরিপাটি করিয়া ধুতি কেঁচাইতেন এবং চাদর ও জামার অস্তিন বহু যত্নে ও পরিশ্রমে গিলে করিয়া রাখিতেন–।
রবীন্দ্রনাথের ভত্যাভাব ছিল না এবং তার উড়িয়া সেবক বনমালী যে পাঞ্জাবির আস্তিন ও ধুতির কোচা খুব একটা সাধারণভাবে গিলে করত তা নয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নিপুণ হাতের সুচিকুণ গিলে করার পদ্ধতির সঙ্গে সে পাল্লা দিতে পারবে কেন? একদিন নীতু এসেছে আমাদের রুমে। পরনে গিলে করা অতি পরিপাটি সিল্কের ধুতি পাঞ্জাবি, কাঁধে সিঙ্কের উড়ুনি। আমাদের জানাল সে দিনটা তার জন্মদিন। শেষটায় ধরা পড়ল, স্বয়ং দাদামশাই স্বহস্তে কাপড়-জামা গিলে করে তাকে সাজিয়ে দিয়েছেন।
১৯৩১-৩২-এ নীতু জর্মনিতে গেল পড়াশুনো করতে। কয়েক মাসের ভিতরই হল ক্ষয়-রোগ। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর সখা সি এফ এনড্রজ বিলেত থেকে জর্মনি গেলেন তার দেখভাল করতে। অবস্থা খারাপের দিকে খবর পেয়ে মীরা দেবীও গেলেন জর্মনি। ওই সময় বরানগরে রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন কাটাতে এসেছেন প্রশান্ত-রাণী মহলানবিশের সঙ্গে। ৭ অগস্ট (আমি প্রচলিত বইপত্রে সঠিক তারিখ বের করতে পারিনি। নীতু মারা গেল।
রাণী মহলানবিশ লিখছেন, পরদিন রয়টারের টেলিগ্রামে দেখলাম জার্মানিতে নীতুর মৃত্যু হয়েছে। এ খবরটা রবীন্দ্রনাথের কাছে ভাঙা যায় কী প্রকারে?
শেষে স্থির হল খড়দায় কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীকে ফোন করে আনিয়ে আমরা চারজন একসঙ্গে কবির কাছে গেলে কথাটা বলা হবে। প্রতিমাদিরা এলে সবাই মিলে কবির ঘরে গিয়ে বসা হল। রথীন্দ্রনাথকে কবি প্রশ্ন করলেন, “নীতুর খবর পেয়েছিস? সে এখন ভালো আছে, না?” (এর কারণ কবি তার আগের দিন, এনড্রজের কাছ থেকে চিঠি পান– তখনও আর মেল চালু হয়নি– যে, নীতু তখন একটু ভালোর দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে– লেখক) রথীবাবু বললেন, “না, খবর ভালো না।” কবি প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারলেন না। (ওই সময় থেকেই কবি কানে একটু খাটো হয়ে গিয়েছিলেন– লেখক)। বললেন, “ভালো? কাল এনড্রজও আমাকে লিখেছেন যে নীতু অনেকটা ভালো আছে। হয়তো কিছুদিন পরেই ওকে দেশে নিয়ে আসতে পারা যাবে।” রথীবাবু এবার চেষ্টা করে গলা চড়িয়ে বললেন, “না, খবর ভালো নয়। আজকের কাগজে বেরিয়েছে।” কবি শুনেই একেবারে স্তব্ধ হয়ে রথীবাবুর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। একটু পরেই শান্তভাবে সহজ গলায় বললেন, “বউমা আজই শান্তিনিকেতনে চলে যান, সেখানে বুড়ি একা রয়েছে।”
এটা যে কত বড় শোক তার জন্যে কোনও মন্তব্য বা টীকার প্রয়োজন হয় না। ওই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর মেয়ে মীরার জন্য যে দুটি কবিতা লেখেন, তিনি বা মীরাদি তখন কোনও পত্রিকায় সে দুটি প্রকাশ করেননি। প্রকাশিত হয় তিন বৎসর পরে বীথিকা কাব্যগ্রন্থে; তাই অনেকেরই দৃষ্টি এ কবিতা দুটির প্রতি আকৃষ্ট হয়নি।… সকলেই জানেন, ঈশ্বরে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল অতিশয় গভীর। দুর্ভাগিনী কবিতায় স্তম্ভিত হয়ে দেখি, সে বিশ্বাসে চিড় লেগেছে।
–চিরচেনা ছিল চোখে চোখে
অকস্মাৎ মিলালো অপরিচিত লোকে।
তখন দুর্ভাগিনী মাতা যখন সান্ত্বনার জন্য ইষ্টদেবতার সম্মুখীন হল তখন কী পেল সে।
–দেবতা যেখানে ছিল সেথা জ্বালাইতে গেলে ধূপ, সেখানে বিদ্রূপ।
ঈশ্বর-বিশ্বাসীজন এর চেয়ে নির্মম নিষ্ঠুর কী বলতে পারে! ঈশ্বর স্ক্রিপ করেন।
এখানেই কি শেষ? প্রায় তাই। কিন্তু দীর্ঘ পরমায়ু লাভ করলে তার মূল্যও দিতে হয়। একে একে অনেক বন্ধু চলে গেলেন ওপারে। এদিকে তার শরীরও ভেঙে পড়েছে। মৃত্যুর ষোলো মাস পূর্বে খবর এল কলকাতায় এনড্রজ গত হয়েছেন। বন্ধুত্ব তো ছিলই কবে, সেই নোবেল প্রাইজ পাওয়ার আগের থেকে, তদুপরি বিশ্বভারতীর বছরের পর বছর ব্যাপী অর্থকষ্ট কঠিন সঙ্কটে পৌঁছলেই কবিকে না বলে, এনড্রজ তার মিত্র মহাত্মা গান্ধীর মাধ্যমে অহমদবাদের কোটিপতিদের কাছ থেকে বিপদতারণ অর্থ সংগ্রহ করতেন। এনড্রজের স্বাস্থ্য ছিল কবির চেয়ে অনেক ভালো। কবির মানসপুত্র, বিশ্বভারতীর খুল্লতাত চলে গেলেন জনকের আগে। আমি অতি ক্ষুদ্র প্রাণী, কিন্তু পাঁচটি বৎসর তিনি আমাদের সেই গ্রিক-লাতিন থেকে আরম্ভ করে বর্তমান ইংরেজি সাহিত্য পড়িয়েছেন। আরও কত কী! সে তো ভোলা যায় না।