বিদ্যেসাগর অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্রকণ্ঠে ব্যত্যয়হীন বিরোধিতা প্রকাশ করতেন বলে তাকে অজ্ঞজন রূঢ়স্বভাবের লোক বলে কখনও কখনও মনে মনে সন্দেহ করেছে। এ স্থলে কবি ভর্তৃহরির দুটি ছত্র তুলে দিলেই বিষয় সরল হবে :
আচারনিষ্ঠ ভণ্ড বলেছে,
ধীরজনে ভীরু, সরলে মূঢ়
প্রিয়ভাষীজনে ধনহীন গোণে,
বীরেরে নির্দয়, তেজীরে রূঢ়।
(সত্যেন দত্তের অনুবাদ)
এই ব্যর্থশক্তি নিরানন্দ জীবনধনদীন যুগে একথা স্মরণে এনে বড় আনন্দ পাই যে বিদ্যাসাগরের মতো রূঢ়তাবর্জিত তেজিজন এদেশে জন্ম নিয়েছিলেন। আমি বিদ্যাসাগরচরিত্র যদি কণামাত্র চিনে থাকি তবে রূঢ়তম কণ্ঠে রূঢ়তার প্রতিবাদ জানিয়ে বলব, তার মতো বিনয়ী লোক ইহসংসারে হয় না।
রামকৃষ্ণের মুগ্ধ মন্তব্যের উত্তরে বিদ্যাসাগর হেসে বলেছিলেন, সাগরেই যখন এসেছেন তখন খানিকটে লোনা জল নিয়ে যান। রামকৃষ্ণ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সুস্পষ্টভাষায় প্রতিবাদ করেছিলেন।
পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বৎসর ধরে দেশে-বিদেশে যখনই আমি কাউকে চোখের জল ফেলতে দেখেছি তখনই আমার মনে জেগেছে প্রথম দিনের প্রশ্নটা, করুণাসাগর লোনা জল বলতে সেদিন কী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?
তবে কি বলতে চেয়েছিলেন, তার সর্বসত্তাতে আছে শুধু চোখের জল, অশ্রুধারা লোনাজল?
বেতার বাংলা, জুলাই ১৯৭৩
ছবি। পেজ ১৯-২৪
.
বিচিত্র ছলনাজাল
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে বলতে শুনেছি, স্বকর্ণে একাধিকবার, তাঁর মৃত্যুদিন যেন পালন না করা হয়। করতে হয় তো করি যেন তার জন্মদিন।
স্বভাবতই আমাদের সকলের মনে প্রশ্ন জাগবে, কেন?
রবীন্দ্রনাথ তো চার্বাকপন্থি ছিলেন না। চার্বাক বলতেন, দেহ ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ার পর পুনরাগমন কোথায়? এ স্থলে পুনরাগমন সমাসটি পুনর্জন্ম বা শেষ বিচারের দিন, যেকোনো অর্থে নেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ তো এতখানি জড়বাদী ছিলেন না।
বরঞ্চ তিনি বারবার কতবার যে বলেছেন, মৃত্যতে একদিকে আছে পরিসমাপ্তি অন্যদিকে আছে নব-অভ্যুদয়। তার অতিশয় অন্তরঙ্গ সখা ও শিষ্য, কবি সত্যেন্দ্রনাথের তিরোধানে তিনি যেন, যে অমর্ত্যলোকে তার প্রিয় কবি নতুন আনন্দ গান ধরেছেন তার সুর শুনতে পাচ্ছেন :
— সে গানের সুর
লাগিছে আমার কানে অশ্রুসাথে
মিলিত মধুর
প্রভাত আলোকে আজি;
আছে তাহে সমাপ্তের ব্যথা,
আছে তাহে নবতম আরম্ভের
মঙ্গল-বারতা;
আছে তাহে ভৈরবীতে
বিদায়ের বিষণ্ণ মূর্ছনা,
আছে ভৈরবের সুরে
মিলনের আসন্ন অর্চনা।
শুধু কি তাই? যারা এ জীবনে কৃপণ ভাগ্য বশে বিড়ম্বিত হয়েছে, কবি তাদের মৃত্যুতে তাদের জন্য বিরাট একটা অপ্রত্যাশিত বৈভব গৌরব দেখতে পাচ্ছেন। আল্লাহতালা রবীন্দ্রনাথকে তার অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে বহু বিচিত্র অমূল্য সম্পদ দিয়েছিলেন কিন্তু একটি অতি সাধারণ ব্যাপারে তাঁর প্রতি বিমুখ। তাঁর পত্নী, দুই কন্যা, এক পুত্র (অন্য পুত্র রথীন্দ্রনাথ নিঃসন্তান, এক কন্যা মীরা দেবী)- এই চারজন পরপর মারা যান। এঁদের বয়স যথাক্রমে, স্ত্রী উনত্রিশ, কন্যা-তেরো (নিঃসন্তান), পুত্র- এগারো, কন্যা-বত্রিশ (নিঃসন্তান)। এরপরও রবীন্দ্রনাথ রেহাই পাননি। পুত্র রথীন্দ্রনাথ তো নিঃসন্তান–রবীন্দ্রনাথ জানতেন তার পুত্রবধূর কোনও সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অন্য পুত্র এগারো বৎসর বয়সে গত হয়েছে কলেরায়। পুত্রের দিক দিয়ে তার কোনও সন্তান-সন্ততি নেই। আছে কেবল কন্যা মীরার একটি পুত্র ও কন্যা। রবীন্দ্রনাথের আশা ছিল এই মেয়ের দিক দিয়ে তার বংশ রক্ষা হবে। আমাদের হজরতের বেলা যা হয়েছে। ছেলেটির নাম নীতীন্দ্রনাথ, ডাক নাম নীতু। মীরা দেবী দাম্পত্যজীবনে সুখী হতে পারেননি বলে পুত্রকন্যা নিয়ে পিতার কাছে চলে আসেন ১৯১৯/২০-তে। বলা বাহুল্য ২৭ বছর বয়সে কোনও কন্যা যদি চিরতরে পিত্রালয়ে চলে আসে তবে পিতার মনের অবস্থা কী হয়; মীরা দেবীর বিবাহিত জীবনের কঠোর দ্বন্দ্বের অনেকখানি সন্ধান পাঠক পাবেন যোগাযোগ উপন্যাসে। কিন্তু সেখানে কুমুদিনীর পিতার মৃত্যু তার বিবাহের পূর্বেই হয়ে গিয়েছিল বলে, রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে কন্যা মীরার প্রত্যাবর্তন কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, সেটা উপন্যাস থেকে জানবার উপায় নেই। পাছে কেউ ভুল বোঝেন, তাই বলে রাখা ভালো, কুমুদিনীর পিতা এবং মীরা দেবীর পিতা রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে বিন্দু-বিসর্গের মিল নেই।
এতদিন এসব বিষয়ে আমি সবিস্তর আলোচনা করাটা যতখানি পারি এড়িয়ে গিয়েছি কারণ মীরাদির স্নেহ আমি বাল্যবয়সে পেয়েছি। তাঁর মেয়ে নন্দিতা, ডাকনাম বুড়ি-কে আমি তার পাঁচ বৎসর বয়স থেকে চিনি। আমার বয়স তখন ষোলো (নীতুর বয়স নয়); পাঁচ বৎসর ধরে নানা মান-অভিমানের ভিতর দিয়ে আমাদের প্রতি সম্পর্ক নিবিড়তর হয়। এর প্রায় ত্রিশ বৎসর পর দিল্লিতে আমরা যখন প্রতিবেশী তখন তো আর কথাই নেই। এর দশ বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ গত হয়েছেন। বুড়ির সঙ্গে শেষ দেখা হয় বছর-চারেক পূর্বে। বুড়ি নিঃসন্তান বলে কথাবার্তার সময় আমি কাচ্চাবাচ্চাদের প্রসঙ্গ কখনও তুলতুম না। এখন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ, তার স্ত্রী প্রতিমা দেবী, মীরা দেবী, তাঁর সন্তানদ্বয় কেউ আর এ-লোকে নেই; আমার অক্ষম লেখা কারও পীড়ার কারণ হবে না।