ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু, ইজা নুদিয়া লিস্সলাতি মিনি-ইয়োমিল জুমুয়া (তি), ফাস্ আও ইলা জিরিপ্লাহ (ই)
হে ইমানদারগণ, যখন জুমার (সম্মিলন দিবসের) নমাজের জন্য তোমাদের প্রতি আহ্বান (আজান) ধ্বনিত হয় তখন আল্লাকে স্মরণ করার জন্য ধাবমান হও।
শব্দার্থে ধাবমান হয়েছিলেন আমার এক বন্ধুর পরহেজগার প্রতিবেশী ২৬ মার্চ জুমার নমাজের দিনে। তিনি জানতেন যে পুরোদিনের তরে কারফু। তাঁর স্ত্রী তাকে বারবার মানা করেছিলেন। বাড়ির সামনের রাস্তা জনশূন্য। অপর ফুটের হাত পাঁচেক ডাইনে মসজিদ। তিনি বিবিকে বললেন, আমি এক দৌড়ে মসজিদে পৌঁছে যাব। রাস্তা যখন প্রায় ক্রস করে ফেলেছেন তখন তীর বেগে এল মিলিটারি গাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে গুলির শব্দ। আরেকটি শহীদ। ইনি অতিশয় উচ্চপর্যায়ের শহীদ। কারণ আল্লার আদেশ অনুযায়ী শব্দে শব্দে ধাবমান হয়েছিলেন তিনি আল্লার নাম জির করতে। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করে, আল্লার আদেশ পালন করতে যে বাধা দেয় (কারফু জারি করে), যে মানুষের আদেশে আল্লার আদেশ লজ্ঞান করে তাকে খুন করে সে মানুষ শহীদহন্তারূপে কী খেতাব পায়! এবং এই ইয়াহিয়াই ডিসেম্বর মাসে পরাজয় আসন্ন জেনে আপন শিয়া ধর্মকে জলাঞ্জলি দিয়ে সুন্নিদের মসজিদে গেলেন জুম্মার নমাজ পড়তে। সুন্নিদের ভিতর তখন গুঞ্জরণ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, এই শিয়াটাই যত নষ্টের গোড়া যেন হুজুররা অ্যাদিন ধরে জানতেন না ইয়াহিয়া খান পুরো পাক্কা কিজিল পাশ শিয়া।
বিশ্বধর্মে দীক্ষিত ঈশ্বরচন্দ্র আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি উদাসীন ছিলেন কিন্তু ধর্ম নিয়ে প্রতারণার প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম ঘৃণা। তাই একদা তিক্ত কণ্ঠে তিনি ব্যঙ্গ করেছিলেন,
প্রতারণাসমৰ্থে বিদ্যয়া কিং প্রয়োজন?
প্রতারণাসমৰ্থে বিদ্যমা কিং প্রয়োজন?
পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, দুটি ছত্রই হুবহু একই বানানে লেখা, কিন্তু অর্থে আসমান-জমিন ফারাক, এবং দুই ছত্রে মিলে একই সত্য নির্ধারণ করে।
প্রতারণা-সমর্থ জনে, যে প্রতারণা করতে সমর্থ তার (শাস্ত্র) বিদ্যার কী প্রয়োজন? প্রতারণা দ্বারাই সে সবকিছু গুছিয়ে নেবে। দ্বিতীয় ছত্রে কিন্তু পড়তে হবে প্রতারণা অসমর্থ। এখানে সন্ধি করলে পূর্ব ছত্রের মতোই প্রতারণাসমর্থ রূপ নেয়। অর্থ : প্রতারণা করতে যে জন অসমর্থ কোনও বিদ্যাই তার কোনও কাজে লাগবে না। অর্থাৎ বিদ্যা কোনও অবস্থাতেই কারও কোনও কাজেই লাগে না। কাজ হাসিল হবে প্রতারণা মারফত। বড্ড সিনি-এর মতো তত্ত্বটি প্রকাশ করলেন বিদ্যাসাগর। বিশেষ করে বোধহয় এই কারণে যে তাকে বিদ্যার সাগর উপাধি দেওয়া হয়েছিল। এবং হয়তো-বা ওই সময়েই মাইকেল তার প্রশস্তি আরম্ভ করেন। বিদ্যার সাগর তুমি, বিখ্যাত ভারতে শ্রীমধুর মধুময় ছত্রটি বিদ্যার সাগর দিয়ে আরম্ভ হয়। সর্বশেষে এ তথ্যটিও প্রাতঃস্মরণীয় যে, বহুলোক বহু উপাধি পায় কিন্তু সেগুলো এ রকম টায় টায় খাপ খায় না বলে লোকে উপাধিধারী কাউকে কখনও তার পদবি যেমন বাড়য্যে কখনও কালীকৃষ্ণ কখনও ন্যায়রত্ন বলে উল্লেখ করে। কিন্তু বিদ্যাসাগরকে কখনও বড়য্যে মশাই (যতদূর মনে পড়ে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ দু জনাই বন্দ্যোপাধ্যায়, সংক্ষেপে বাড়য্যে, হয়তোবা রামমোহনও) বা ঈশ্বরচন্দ্র বলে উল্লেখ করেনি। প্রবন্ধ লেখার সময় আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ বলে উল্লেখ করি ভাষার অনুপ্রাস, কবিতার ছন্দ শ্রুতিমাধুর্য বা অর্থগৌরব অনুযায়ী যখন যেরকম মণিকাঞ্চন্ন সংযোগ হয়–হয়তো-বা কিঞ্চিৎ হার্দিক নৈকট্যের ইঙ্গিতসহ। কিন্তু বিদ্যাসাগর নিত্যদিনের চিরন্তন বিদ্যাসাগর। শুনেছি বিধবা-বিবাহ আইন পাস হবার পর ফরেসডাঙ্গার (চন্দননগর) তাঁতিরা কাপড়ের পাড়ে বোনে বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে তুমি। এবং এ উপাধি যে কত সত্য কত গভীর তার চরম স্বীকৃতি দিয়েছেন সে-যুগের অন্যতম ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংস। তিনি স্বয়ং এসেছিলেন বিদ্যেসাগরের দর্শন লাভার্থে তার ভবনে। উভয়ের পন্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। রামকৃষ্ণ সাধক, আর বিদ্যাসাগর ছিলেন মোক্ষ, মুক্তি, বৈকুণ্ঠলাভ বা শিবত্ব প্রাপ্তি বাবদে নিরঙ্কুশ উদাসীন। বিদ্যাসাগর অতিশয় সযত্নে রামকৃষ্ণকে সম্মুখের আসনে বসালেন। রামকৃষ্ণ মুগ্ধ নয়নে এক দৃষ্টিতে দীর্ঘকাল তার দিকে
তাকিয়ে শেষটায় ভাবোদ্বেল কণ্ঠে বললেন, এতদিন দেখেছি শুধু খাল বিল ডোবা; এইবারে সত্যই সাগর দর্শন হল। রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর না দয়ার সাগর–শ্রীমধুর মধুর ভাষায় করুণার সিন্ধু তুমি!–বা উভয়ার্থে বলেছিলেন সেটা পরিষ্কার হয়নি; আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস উভয়ার্থে। বলা নিতান্তই অনাবশ্যক যে, রামকৃষ্ণ স্পষ্টভাষী ছিলেন। সে যুগের বহুজন সম্মানিত বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত্র তথা নব-হিন্দু ধর্মব্যাখ্যান মাসের পর মাস লিখে যাচ্ছেন তখন তিনি প্রায়ই রামকৃষ্ণের সঙ্গে তত্ত্বালোচনা বা যাই হোক, সে সন্ধানে যেতেন তার আশ্রয়স্থলে বিদ্যাসাগর কখনও যাননি। একদিন রামকৃষ্ণ হঠাৎ বঙ্কিমচন্দ্রকে বললেন, আপনার নাম যেরকম বঙ্কিম, আপনি ভিতরেও বাঁকা বটে। সম্পূর্ণ মন্তব্যটি আমার মনে নেই। তবে সেটা যে অতিশয় শ্রুতিমধুর ছিল না তা আমার স্পষ্ট মনে আছে।