নিঃসঙ্কোচে বলব, চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর হিন্দু সমাজের ইনিই সর্বোত্তম মহাপুরুষ। রবীন্দ্রনাথ যেসব মহাত্মাদের জীবনী লিখেছেন তার মধ্যে সর্বাধিক বিস্তীর্ণ স্থান দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্রকে। তিনি বলেছেন, বিদ্যাসাগর নিজের চরিত্রকে মনুষ্যত্বের আদর্শরূপে। প্রস্ফুট করিয়া যে এক অসামান্য অনন্যতন্ত্রত্ব প্রকাশ করিয়াছেন তাহা বাংলার ইতিহাসে অতিশয় বিরল; এত বিরল যে, এক শতাব্দীর মধ্যে কেবল আর দুই-একজনের নাম মনে পড়ে এবং তাহাদের মধ্যে রামমোহন রায় সর্বশ্রেষ্ঠ।
আমার সবিনয় নিবেদন, আমি গুরুর সঙ্গে একমত নই। অবশ্য আর দুই একজন বলতে গিয়ে গুরু যদি ঈশ্বরচন্দ্রকে বাদ দিয়ে রামমোহনকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে থাকেন তা হলে সে অভিমত সম্বন্ধে আমার কোনও বক্তব্য নেই।
গত দুই শতাব্দীতে যেসব মহাপুরুষ বঙ্গদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন রামমোহন থেকে বিবেকানন্দ– তাঁরা সকলেই হিন্দুধর্মের মূর্তমান প্রতীক। ঈশ্বরচন্দ্র তা নন। হিন্দুশাস্ত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের জ্ঞান গত আড়াই শতাব্দীর কারও চাইতে কণামাত্র কম ছিল না। বরঞ্চ হিন্দুশাস্ত্রে আমার যে নগণ্য যৎসামান্য জ্ঞান আছে তার পথপ্রদর্শক ঈশ্বরচন্দ্র। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, শাস্ত্রাধ্যয়ন-লব্ধ পাণ্ডিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র অতুলনীয়। বঙ্গদেশ বাদ দিন, সব ভারতের হিন্দু শাস্ত্রাধ্যয়নের কেন্দ্রভূমি কাশীর শাস্ত্রীরা তাঁকে সমীহ করে চলতেন; ঈশ্বর যখন বিধবা-বিবাহ হিন্দুশাস্ত্রসম্মত বলে বিধান দিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন, কাশীর শাস্ত্রীরা মল্লভূমিতে নামতে সাহস পাননি।
অথচ, পাঠক বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন ঈশ্বরচন্দ্র শাস্ত্র মানতেন না। তার ঋজু, সত্যশীল, দৈনন্দিন আচার-আচরণ সর্বধর্ম, বিশ্ব ধর্মসম্মত ছিল হিন্দু শাস্ত্রের বিধান তিনি সর্বজন সমক্ষে পুনঃ পুনঃ লঙ্ঘন করেছেন– অথচ সে যুগের হিন্দু সমাজপতিরা হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞ বিধবা-বিবাহ বিরোধী সমাজপতিগণ তাঁকে সমাজচ্যুত করার দুরাশা স্বপ্নেও স্থান দেবার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারেননি। তিনি তাঁর অন্নত্রে ভোজনকারিণী মুচি হাড়ি ডোম প্রভৃতি অপকৃষ্ট ও অস্পৃশ্য স্ত্রীলোকদের মাথায় তৈলাভাবে বিরূপ কেশগুলিতে স্বহস্তে তৈল মাখাইয়া দিতেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখছেন বর্ধমান-বাস-কালে তিনি তাহার প্রতিবেশী দরিদ্র মুসলমানগণকে আত্মীয়-নির্বিশেষে যত্ন করিয়াছিলেন। এস্থলে রবীন্দ্রনাথ ভাবোচ্ছাসে আত্মহারা হয়ে আত্মীয়-নির্বিশেষে বাক্য প্রয়োগ করেননি করেছেন সজ্ঞানে সসম্মানে শব্দার্থে। বঙ্কিমচন্দ্র বিধবা-বিবাহ বিরোধী ছিলেন। তার এক উপন্যাসে তিনি ওই নিয়ে কিঞ্চিৎ কৌতুক করেছেন। অথচ ঠিক ওই সময়ই বঙ্কিমের অগ্রজ সদানন্দ, সাম্প্রদায়িক হীনমন্যতামুক্ত সঞ্জীবচন্দ্র অনুজ বঙ্কিমকে নিয়ে বর্ধমানে ঈশ্বর সকাশে উপস্থিত হয়ে কুশলাদির পর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভোজনেচ্ছু হন। ঈশ্বরচন্দ্র মোগলাই পদ্ধতিতে উত্তম মাংসরন্ধনে সুপটু ছিলেন। সঞ্জীব আহারের সময় বিদ্যাসাগরের রন্ধননৈপুণ্যের প্রশংসা করে বলেন, তিনি যে বহুগুণধারী, সে তথ্য সঞ্জীব জানতেন, কিন্তু রন্ধনেও যে তিনি সুপটু সে তত্ত্ব তাকে বিস্মিত করেছে। বার্ধক্যে স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ছলনাময়ী। তারই ওপর নির্ভ করে সঠিক বলতে পারছি না, বিদ্যাসাগর কিন্তু আপনার ভায়া তো ভাবেন, আমি– বলার পর মূর্খ না ঠিক ঠিক কোন বিশেষণটি প্রয়োগ করেছিলেন। এর কিছুদিন পূর্বে বঙ্কিম ঈশ্বরচন্দ্রকে যে পত্র লেখেন তার সারমর্ম এই যে, আপনি শাস্ত্র-দ্বারা কেন প্রমাণ করতে গেলেন, বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন করা উচিত! ঈশ্বরচন্দ্র আত্মম্ভরী বা স্ত্রী ছিলেন না, কিন্তু তিনি আত্মদ্রষ্টা ছিলেন, তাই বিলক্ষণ অবগত ছিলেন, বঙ্কিম প্রভৃতি নব হিন্দুধর্মের প্রবর্তকগণ কি ব্যক্তিগত জীবন যাপন পদ্ধতিতে, কি শাস্ত্রজ্ঞানে, কি প্রকৃত ধর্মতত্ত্বানুশীলনে তাঁর বহু বহু পশ্চাতে। ঈশ্বরচন্দ্র সে পত্রের উত্তর দিয়ে বঙ্কিমকে অহেতুক সম্মান দেখাবার প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু এর প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পর ঈশ্বর ও বঙ্কিম উভয়ই যখন পরলোকে তখন রবীন্দ্রনাথ মল্লভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে লিখেছিলেন, “অনেকে বলেন, তিনি (ঈশ্বরচন্দ্র) শাস্ত্র দিয়েই শাস্ত্রকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু শাস্ত্র উপলক্ষ মাত্র ছিল; তিনি অন্যায়ের বেদনায় যে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সে তো শাস্ত্রবচনের প্রভাব নয়। এ যে কী মোক্ষম সত্য আমার গুরু আপ্তবাক্যপ্রায় বলেছেন, সে আমার অক্ষম লেখনী কী করে প্রকাশ করবে! প্রকৃত গুণী, মোহমুক্ত সত্যদ্রষ্টাই শাস্ত্রের এই জটিল তর্কজাল ছিন্ন করে মানুষকে ইঙ্গিত দেন, শেষ সত্যের উত্সস্থল কোথায়? কবি বলছেন, তিনি (ঈশ্বরচন্দ্র) তাঁর করুণার ঔদার্যে মানুষকে মানুষরূপে অনুভব করতে পেরেছিলেন, তাকে কেবল শাস্ত্রবচনের বাহকরূপে দেখেননি। শাস্ত্র মানুষকে সত্যের দিকে পথনির্দেশ করে, হয়তো-বা অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে উপদেশ দেয়, কিন্তু শাস্ত্র কবে কোন মানুষের পাষাণ-হৃদয়কে করুণা ধারায় প্লাবিত করতে পেরেছে?
***
এতক্ষণ অবধি যারা আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন তারা হয়তো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। শাস্ত্র, তা-ও হিন্দুশাস্ত্র, সে-ও গত শতাব্দীর পুরনো এক সমস্যা নিয়ে এত কচকচানি শুনে কীই-বা এমন চরম মাক্ষ লাভ হবে? কিচ্ছুটি না। তবে শুধু স্মরণে এনে দিতে চাই, মাত্র দুটি বত্সর আগে স্বৈরাচারী নরঘাতক সম্প্রদায় আমাদের মুসলিম শাস্ত্র নিয়ে পেশাওয়ার থেকে সিলেট অবধি কী প্রতারণাই না করেছিল। আমাদের জনপ্রিয় নেতা, মুক্তি ফৌজের আত্মোৎসর্গ, জনপদবাসীর বিদ্রোহ এর সবই নাকি ছিল ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ! আমরা ইংরেজি পঞ্জিকার ওপর নির্ভর করে দিবারাত্রির নামকরণ করাতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে এখনও বলি ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার রাত্রি এগারোটার সময় অভূতপূর্ব তাণ্ডবনৃত্য আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম পঞ্জিকানুযায়ী বৃহস্পতিবারের সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয়েছিল পবিত্র জুম্মাবার, শুক্রবারের রাত্রি। তার পর এল শুক্রবারের দিন। আল্লাতালার আদেশ :