আশ্চর্য! মাইকেল খ্রিস্টান। তিনি বাঙলা ভাষার বৈরীদের সঙ্গে করলেন আমৃত্যু সংগ্রাম। তিনি আহরণ করতেন অসংখ্য রতনরাজি বহুতর ভাষা থেকে কিন্তু কি ইংরেজি, কি সংস্কৃত তাঁর মাতৃভাষা বাঙলার আসন দখল করে সেটা তিনি এক লহমার তরে বরদাস্ত করতে পারতেন না। তার তিনশত বৎসর পূর্বে আরেক অহিন্দু-মুসলমান, তারই মতো বাঙাল সৈয়দ সুলতান বহুবিচিত্র সম্পদ আহরণ করতেন আরবি-ফারসি থেকে, কিন্তু তাঁর সাধনার ধন বাঙলাকে যারা স্থানচ্যুত করতে চায় তাদের স্মরণে এনে দিচ্ছেন অপূর্ব সুভাষিত,
যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন।
সে-ই তার মাতৃভাষা, অমূল্য সে ধন ॥
অথচ শ্রীমধু স্কুলে পাঠ্যাবস্থায় স্বপ্ন দেখতেন ইংলন্ডের। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার হাতের কাছে অল-ওস্তাদ ড. মনিরুজ্জামান সাহেব কর্তৃক সম্পাদিত মধুসূদনের নাট্যগ্রন্থাবলিখানি আছে মাত্র। অর্থাৎ ব্রজাঙ্গনা, মেঘনাদ, গয়রহ একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ নেই। অতএব তাবৎকাব্য-উদ্ধৃতি আমার জরাজীর্ণ স্মৃতিদৌর্বল্যের ওপর নির্ভ করে এস্থলে লিখতে হচ্ছে–মায় সুলতানের সুভাষিত।
বিলেতের স্বপ্নে বিভোর শ্রীমধু তখন আকুল হৃদয়ে ইংরেজিতে কবিতা লিখছেন (বয়স চোদ্দ/পনেরো, পৃথিবী, না প্রথিবী কোনটা শুদ্ধ জানেন না; পরবর্তীকালে নিজেই বলছেন সে সময় কেউ শিব না লিখে যীব লিখলে সেটাকে তিনি উদ্ভট মনে করতেন না)
I sing for the distant Albion shore
Its valley green its mountains high,
Though friends none reliations have I nor
In that far clime, yet oh! I sigh
To cross the vast Atlantic wave,
For glory or a nameless grave!
(উদ্ধৃতি নিশ্চয়ই ভুল আছে)
অনেক বৎসর পরে কবিগুরু রবির অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এর অনুবাদ করেন :
দূর শ্বেতদ্বীপ তরে পড়ে মোর
আকুল নিঃশ্বাস,
যেথা শ্যামা উপত্যকা, উঠে গিরি
ভেদিয়া আকাশ।
নাহি সেখা আত্মজন, তবু লঙ্ঘি গ
অপার জলধি,
সাধ যায় লভিবারে যশ, কিংবা
অ-নামা সমাধি ॥
গিয়েছিলেন মধু। গিয়েছিলেন বলেই বিদেশি ভাষার প্রতি সমসাময়িক সর্বজনীন চিত্ত-দৌর্বল্যজনিত মোহ থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন অতি সত্বর। বিদেশের প্রতি তাঁর কুহেলিকাচ্ছন্ন চক্ষুঃজ্যোতিও নিরাবিল হয়ে যায় যুগপৎ।
বস্তৃত কলকাতায় ফিরে এসেও মধু সেই পরবাসীই থেকে গেলেন। শ্রীমধু চিরকালই খাঁটি যশোরে বাঙাল। কলকাতার ঘটি-রাজরা যখন তাকে তার সরস তথা দার্টগুণসম্পন্ন, সরল অপিচ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভব প্রকাশে পটিয়ান, মধুর অপরঞ্চ গুরুগম্ভীর, অকৃত্রিম বিদগ্ধ বঙ্গভাষার সর্বাধিকারাধার প্রতিভূরূপে নতমস্তকে স্বীকার করে নিয়েছেন তখন অকস্মাৎ নয়া এক ভেল্কিবাজি দেখিয়েছিলেন যশোরের খাঁটি বাঙাল। পশ্চিমবঙ্গের অকৃত্রিম ঘটির ভাষা পেরিয়ে মধু ছাড়লেন বাঙাল ভাষার রঙ বেরঙের আতশবাজি।
শ্রীমধু মাতৃভূমি সাগরদাড়ি ছাড়েন বাল্যে। কিন্তু এ কী তিলিস্মাৎ, কী অলৌকিক কাণ্ড! শুধু যে যশোরের হিন্দু ভদ্রলোকের ভাষা (ভক্তপ্রসাদের ভাষা) স্মরণে রেখেছেন তাই নয়, হিন্দু চাকরের ভাষা (রাম), বামুন পণ্ডিতের সংস্কৃতে ভেজা সপসপে ভাষা (বাচস্পতি), মুসলমান চাষার ভাষা (হানিফ), তার বউয়ের ভাষা (ফতেমার ভাষাতে বিদেশি-শব্দ হানিফের তুলনায় কম)- কে কতখানি সংস্কৃতে ভরা ভাষায় কথা বলবে, কে কোন পরিমাণে আরবি-ফারসি এস্তেমাল করবে তার ওজন করে শ্রীমধু চালাচ্ছেন একসঙ্গে গোটা পাঁচ-ছয় মূলত যশোরি ভাষার ভিন্ন ভিন্ন আড় বা ঢং যাদুকর যেরকম ছ টা বল নিয়ে খনে এক হাতে খনে দু হাতে নাচায়। এমনকি সদ্য কলকেতা ফেৰ্তা কলেজের ছোকরাকেও দিব্য চেনা যাচ্ছে। বলছে, এমন ক্লেবর ছোকরা দুটি নেই। ওদিকে ভক্তপ্ৰসাদ জমিদারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে বরঞ্চ যাবনিক শব্দ দিব্য চেনেন। তাই ক্লেভার শব্দের দু দুটি প্রতিশব্দ সুচতুর মেধাবীও তার পছন্দ হল না। বললেন, “জহীন” কিংবা “চালাক” বললে বুঝতে পারি।- আজ আর জহীন শব্দ কোনও বাঙলার লোকই বোঝে না। আরবি জেহন দু একখানা কোষে পাওয়া যায়। বলা নিতান্তই বাহুল্য চালাক ফারসি।
একাধিক লেখক ইয়োরোপীয় সাহিত্যে একাধিক ভাষা নিয়ে কারচুপি দেখিয়েছেন কিন্তু শ্রীমধুর ন্যায় এরকম ভেল্কিবাজি, কেউই দেখাতে পারেননি।
কলকাতার বুকের উপর বসে তিনি নির্ভয়ে বাংলা দেশের বাঙাল ভাষার ভিন্ন ভিন্ন রূপ শুধু যে পাক্তেয় করে তুললেন তাই নয়, তারা সেদিন যেসব উচ্চাসনে বসেছিল সেসব আসন নিয়ে খাস কলকেত্তাই বা অন্য কোনও আঞ্চলিক ভাষা-উপভাষা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি।
যদ্যপি শান্তিনিকেতনের গীতিরস-পরিবেশে আমার কৈশোর কেটেছে, তবু শ্রীমধু আমার বড়ই প্রিয় কবি। তাই এতখানি লেখার পরও দেখি কই, কিছুই তো বলা হল না? মনস্তাপ রয়ে গেল।
সেটা হালকা করার জন্য অবনী ঠাকুরের অনুকরণে গান জুড়ি
শ্রীমধুরে ঠ্যাকায় কেডা
খুনে যশোর কইলকেতা!
বেতার বাংলা, জুন ১৯৭৩
.
অশ্রুসিক্ত সিন্ধুবারি
এই ক্ষুদ্র রচনাটির অবতরণিকাতেই আমার একটি সামান্য কৈফিয়ত নিবেদন করার আছে। যদিও বহু বৎসর ধরে আমার লেখা কেউ বড় একটা পড়ে না, তবুও বেতার বাংলার সম্পাদকমণ্ডলীতে দু একজন নিতান্তই অকালবৃদ্ধ সজ্জন, তথা তাদের বড় কর্তা আমার প্রতি নিতান্ত অকারণ সদয়। বেতার বাংলাই স্বাধীনতার পর এই অনারারি পেনশনপ্রাপ্ত অস্তমিত লেখকের কাছ থেকে সসম্মানে দাক্ষিণ্যসহ একটি রচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমারও স্পর্ধা বেড়ে গেল। জীবনে যা কখনও করিনি, সেই নিবেদন জানালুম; আসছে শ্রাবণের ১০ তারিখ (২৯ জুলাই) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুদিবস। তার সম্বন্ধে সামান্য কিছু নিবেদন করতে চাই। তারা সম্মত হয়েছেন।