***
নিজাম উদ-দীনের দরগায় গোরের জায়গা যোগাড় করা সহজ নয়। সম্রাটনন্দিনী জাহানারার গোর এখানেই। দৈর্ঘ্যে ১৩ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রন্থে ১১ ফুট ৬ ইঞ্চি। এইটুকু জায়গায় জন্য তিনি তিন কোটি টাকা দাম হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করে প্রমাণ করলেন, ভ্রাতার হক দুই-তৃতীয়াংশ টাকার ওপর। তাই তিনি দাম দিলেন এক কোটি।
কবরের কাছে ফারসিতে লেখা :
বগৈরে সবজে ন পুশদ কসি মজার মরা,
কে কর-পুশে গরিবা হমি গিয়া বস্ অন্তু।
বহুমূল্য আভরণে করিয়ো না সুসজ্জিত
কবর আমার
তৃণ শ্রেষ্ঠ আভরণ দীনা আত্মা জাহানারা
সম্রাট-কন্যার।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ২৩.০১.১৯৫২]
.
হ য ব র ল
০১.
সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের পক্ষ হইতে অর্থসাহায্য চাওয়া হইয়াছে।
সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের সহকারী সভাপতি শ্ৰীযুত জানকীনাথ শাস্ত্রী লিখিতেছেন–
পূর্বে পরিষদে উপযুক্ত মেধাবী ছাত্রদিগকে আহার ও বাসস্থান দিয়া অধ্যয়নের সুযোগ দেওয়া হইত। কিন্তু বর্তমানে জরুরি অবস্থায় আর্থিক অসুবিধার জন্য সে ব্যবস্থা রহিত করিবার উপক্রম হইয়াছে। যদি তাহাই করিতে হয় ও মেধাবী ছাত্রেরা সংস্কৃত অধ্যয়ন ত্যাগ করে, তবে পরিষদ চলিবে কাহাদের লইয়া? ধনী মেধাবী ছাত্র তো বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। দেশের বিত্তশালীদের বিবেচনা করিতে অনুরোধ করি যে, আজও বাজারে যে সমস্ত সংস্কৃত পুস্তকরাজি পাওয়া যায়, তাহা কাহার অধ্যবসায়ের ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সংস্কৃতের জন্য কতটুকু করিয়াছেন ও এইসব চতুম্পাঠী, টোল পরিষদ কতটুকু করিয়াছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা তো দুইখানা কাব্য তিনখানা নাটক লইয়া নাড়াচাড়া করেন, ভারতীয় দর্শনের জন্য তো রহিয়াছেন ইংরেজিতে রাধাকৃষ্ণণ ও দাশগুপ্ত। সরকার সাহায্যবর্জিত দেশীয় এই প্রতিষ্ঠানগুলি ও ইয়োরোপের, বিশেষত জর্মন পণ্ডিতমণ্ডলীই তো সংস্কৃতের শতকরা ৯৫ খানি পুস্তক বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও যাহারা দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত হিসাবে গণ্য হইয়াছেন, তাহাদের মধ্যে কয়জন টুলো আর কয়জন নির্জলা মেড ইন বিশ্ববিদ্যালয়? উইনটারনিক্স-লেভিকে যেসব হিন্দু ও জৈন পণ্ডিতের দ্বারস্থ হইতে দেখিয়াছি, তাহারা তো খাঁটি টুলো। অনেকে ইংরেজি পর্যন্ত জানিতেন না। এ যুগের জ্ঞানীদের শিরোমণি প্রাতঃস্মরণীয় দ্বিজেন্দ্রনাথও তো টুলো।
আশ্চর্য যে, পাঠান-মুঘল যুগের ভিতর দিয়া চতুম্পাঠী, টোল সুস্থ শরীরে বাহির হইয়া আসিল। পণ্ডিতেরা অধ্যয়ন অধ্যাপনা করিলেন, পাণ্ডুলিপি বাঁচাইয়া রাখিলেন, নতুন টীকা-টিপ্পনী লিখলেন আর আজ ধর্মগন্ধ-বিহীন সদাশয় ইংরেজের আমলে, দেশে যখন জাত্যাভিমান বাড়িয়াছে, জাতীয়তাবাদের জয়পতাকা উড্ডীয়মান, দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হইবার জন্য হার্দিক প্রচেষ্টা সর্বত্র জাজ্বল্যমান, তখন অর্থাভাবে আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলি লোপ পাইতে বসিয়াছে। যদি লোপ পায়, তবে এ-ও বলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সংস্কৃতের বৈদগ্ধ্য বাঁচাইয়া রাখিতে সম্পূর্ণ অক্ষম।
***
এই সম্পর্কে আরেকটি কথা মনে পড়িল। কুলোকের বসায় পড়িয়া সেদিন বায়স্কোপে গিয়াছিলাম একখানা পৌরাণিক ছবি দেখিতে। যাহা দেখিলাম, সে সম্বন্ধে মন্তব্য না করাই প্রশস্ত। কিন্তু একটি জিনিস লক্ষ করিলাম। হিন্দিতে যে সংস্কৃত শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ হয় তাহা বাঙালি শ্রোতা দিব্য বুঝিতেছেন ও অর্ধশিক্ষিতা বাঙালি অভিনেত্রীরাও দিব্য শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে মন্ত্র পড়িতেছেন। তাহা হইলে কি বাঙলা দেশের স্কুল-কলেজে এখনও শুধু সংস্কৃত উচ্চারণ শিখাইবার সময় হয় নাই? মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কাশী হইতে পণ্ডিত আনাইয়া বাঙালিকে বেদমন্ত্র শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করিতে শিখাইয়াছিলেন। সে ঐতিহ্য আজ ক্ষীণ। মফঃস্বলের ব্ৰহ্মমন্দিরে সংস্কৃত উচ্চারণে বাঙলা পদ্ধতি আবার আসর জমাইয়াছে। বোম্বাইয়ের স্টুডিয়োর আবহাওয়া যদি বাঙালি অভিনেত্রীকে সংস্কৃত উচ্চারণ শিখাইতে পারে, তবে বাংলা দেশের স্কুল-কলেজ তাহা পারে না, সে কি বিশ্বাসযোগ্য?
গুরুজনদের মুখে শুনিয়াছি, গিরিশবাবুর কোরানের তর্জমা এককালে নাকি বহু হিন্দু পড়িতেন এবং তখন নাকি সে তর্জমার কদর হিন্দুদের মধ্যে বেশি ছিল; কারণ মুসলমানেরা তখনও মনস্থির করতে পারেন নাই যে, কোরানের বাংলা অনুবাদ করা শাস্ত্রসম্মত কি না।
পরবর্তী যুগে মীর মশাররফ হোসেন সাহেবের বিষাদ-সিন্ধু বহু হিন্দু পড়িয়া চোখের জল ফেলিয়াছেন (পুস্তকখানা প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থ নহে; অনেকটা পুরাণ জাতীয়, বিস্তর অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনায় পরিপূর্ণ)। ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিলেন। পরবর্তী যুগে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন দত্ত, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মণি গঙ্গোপাধ্যায় আরবি-ফারসি শব্দযোগে তাদের লেখায় কিঞ্চিৎ মুসলমানি আবহাওয়ার সৃষ্টি করিয়াছেন। শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ইহারা লোকপ্রিয়তা হারাইলেন। তার পর আসিলেন নজরুল ইসলাম। সাধারণ বাঙালি হিন্দু তখন প্রথম জানিতে পারিলেন যে, মুসলমানও কবিতা লিখিতে পারেন; এমনকি, উক্তৃষ্ট কবিতাও লিখিতে পারেন। কাজী সাহেবের কবিতার ব্যঞ্জনা বুঝিবার জন্য প্রচুর হিন্দু তখন মুসলমান বন্ধুদের শহিদ কথার অর্থ, ইউসুফ কে, কানান কোথায় জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কাজী সাহেব তাহার ধূমকেতু কাগজে মুসলমান সমাজের পঙ্কিল দিকটা যত না আক্রমণ করিলেন, তাহার অপেক্ষা বহু কম করিলেন ইসলামের সুন্দর ও মঙ্গলের দিকের বর্ণনা। ইতোমধ্যে মৌলানা আকরম খান প্রমুখ মুসলমান লেখকেরা ইসলাম ও তত্সম্বন্ধীয় নানা পুস্তক লিখিলেন। খুব কম হিন্দুই সেগুলি পড়িয়াছেন। তখনও মাসিক মোহাম্মদীতে ভালো ভালো প্রবন্ধ বাহির হয়, কিন্তু সাধারণ হিন্দু মোহাম্মদী কিনেন না; বিশেষত পদ্মার এপারে। সুখের বিষয়, মৌলবি মনসুরউদ-দীনের হারামণিতে সংগৃহীত মুসলমানি আউল-বাউল-মুরশিদিয়া গীত হিন্দু-মুসলমান গুণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ লইয়া সঞ্চয়নখানি প্রকাশিত হয়।