আমি বললুম,– জলদি চলো– বাবুকা মাল লেকর কোঁও ইতনা দেরি করতা হ্যায়?
সে বলল, ক্যা চিল্লাতে হো, মেরা পাস্ তো ইন্ সাহেবকা মাল হ্যায়। বাবুকা মা ওঁহা রাখ ছোঁড়া। দেখলুম আগে একটি সাহেব যাচ্ছে। আর বাবুর বাক্স নদীর পারে গড়াগড়ি দিচ্ছে। আমি বললুম, চলো য়্যহ মাল লেকর জেয়াদা পয়সা দেগা।
কুলি কোনও কথা না বলে চলে গেল। ভারি মুশকিলে পড়লুম, কী করা যায়? পাশে কোনও কুলিও নেই। জাহাজও তখন ছাড়বার জন্য ফোঁস ফোঁস কোরছে। কী আর করি। নিজেই বিছানা ট্রাঙ্ক ঘাড়ে ও গয়নার বাক্স হাতে করে চললুম। খানিকটা যেতেই ঘাড় টনটন কোরতে লাগল। মনে হল কেন এই কুবুদ্ধি চেপেছিল।
সিঁড়ির সামনে আসতেই বাবু তাড়াতাড়ি বাক্স ধরে বললেন, হা হা, করেন কী। আপনি কেন কষ্ট কোরছেন? কুলি বেটারা- আমি এক্ষুনি স্টেশনমাস্টারের কাছে যাচ্ছি। পাজি ব্যাটারা মাল নিয়ে শেষকালে ফেলে দেয়! আমি এক্ষুনি যাচ্ছি, বলে তক্ষুনি ঝুপ করে আমার বিছানায় বসে পড়লেন। আমি শুধু না, না বলে দাঁড়িয়ে রইলুম।
ভালো করে তাকিয়ে দেখি ততক্ষণে ভদ্রলোক তার গিন্নি সমেত আমার বিছানায় জাঁকিয়ে বসেছেন। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, বসুন, বসুন।
এই তো একটুক্ষণ থাকতে হবে, কোনও রকমে চলে যাবে। বিছানার একপাশে বসে পড়লুম।
বাবুটি বললেন–কোথায় যাওয়া হবে।
কোলকাতা।
সেখানে পড়েন বুঝি?
প্রশ্ন এড়াবার জন্য শুধু মাথা নাড়লুম। তাতে হা-না দুই-ই বোঝাল। বাবু বললেন না, আমার একটি ভাইপোও কলকাতায় পড়ে। ছেলেমানুষ– গেল বছর মেট্রিক পাস্ করে গিয়েছে। পড়াশুনায় বেশ ভালো। আপনার বাবা কী করেন?
চাকরি।
বেশ বেশ। আমিও সরকারি চাকরি করি। মাইনে নেহাত কম। কোনও রকম কায়ক্লেশে চলে যায়। আমার যে ভাইপোটির কথা বললুম তার বাবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ছ শো টাকা পায়। তার বিয়ে হয়েছে ফেনীতে। তার শ্বশুর… ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা জ্বালায় পড়লুম! কী করা যায়! ফেরিওলা যাচ্ছিল। একটা কাগজ নিয়ে মুখ ঢেকে পড়তে লাগলুম।
বাবু বোললেন–কী পড়ছেন? আমি শুধু মাথা নাড়লুম।
তিনি বললেন আনন্দবাজার? বলেই- দেখি কাগজখানা। ভাবলুম বাঁচা গেল। বাবু কাগজ পড়বেন। কিন্তু ভদ্রলোক প্রথম লাইন চেঁচিয়ে পড়েই আবার বক্তৃতা জুড়ে দিলেন।
জগৎগুরু মহাত্মা গান্ধীর কারাবাস- আজ ২২৫ দিন। তাহার বিদায়বাণী, খদ্দর পরিধান—ছুঁৎমার্গ পরিহার।
দেখলেন মশাই, দেখলেন। এই দুটো জিনিস বলে গেছেন– তাও হতভাগা দেশে কেউ কোরবে না। খদ্দর পরলে কী দোষ রে বাবা! টেকেও তো বেশি; দামও কম।
আমাকে তার কাপড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জিত হয়ে বললেন, কী কোরব! ছাপোষা মানুষ। খদ্দর কিনে কুলিয়ে উঠতে পারিনে, আবার অফিসের সাহেব দেখলে চটে। বেটা যেন কসাই। সে কথা যা। কিন্তু আমি ছোঁয়াছুঁয়ি মানিনে। ওতে তো আর কোনও খরচ নেই। কেনই বা মানব? কেন মুচি-মুসলমান কি মানুষ নয়? ওদের সঙ্গে বসে কেন খাব না? খুব খাব– আলবৎ খাব।
তার পর এদিকে ওদিকে তাকিয়ে স্ত্রীকে বললেন- তা হলে জলখাবার
স্ত্রী তাড়াতাড়ি বাক্স খুলতে লাগলেন। ততক্ষণ তার ঘোমটা প্রায়ই আড়াই ইঞ্চি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। একখানা প্লেটে হাঁড়ি থেকে বের করে সন্দেশ রাখতে লাগলেন। আমি তখন উঠবার বন্দোবস্ত করতে শুরু করেছি। বাবু তা দেখে বললেন, বসুন, বসুন, জলখাবারটা এখানেই সেরে নিন।
আমি মাথা চুলকাতে লাগলুম। তিনি থালাখানি গিন্নির হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আমার দিকে একটু এগিয়ে খান বলে টপ করে একটি রসগোল্লা আমার মুখে ফেললেন। আমিও আস্তে আস্তে খেতে লাগলুম। তিনি অনর্গল বকে যেতে লাগলেন।
খাওয়া শেষ হলে বললেন, আমাদের তো এসে পড়ল– নেক্সট স্টেশন–তারপাশা। আপনার তো কোলকাতা পৌঁছুতে অনেক দেরি হয়ে যাবে- তা আপনি কোথায় উঠবেন? সোজা মেসে যাবেন বুঝি?
আমি হুঁ বলে উঠে পড়লুম। প্রতিজ্ঞা করলুম তারপাশা স্টেশনে না আসা পর্যন্ত আর ও-মুখো হবে না।
দূর থেকে দেখলুম বাবু গিন্নির সঙ্গে খুব আলাপ জুড়ে দিয়েছেন।
ঘণ্টাখানেক পরে তারপাশা দূরে দেখা গেল। ভাবলুম এইবার বাবুর খোঁজ নিই। গিয়ে দেখি তিনি তখন কাগজ পড়ছেন। আমাকে দেখে বললেন– এই যে তারপাশা। তার পর স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, ওগো সব গুছিয়ে নাও।
জাহাজ থামল। তিনি পারের দিকে আধঘণ্টা ধরে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ একটি লোককে দেখে– যুগপৎ হাত-পা নেড়ে চেঁচাতে শুরু করলেন। লোকটি কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। বাবু দুই হাত নেড়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কুলি ডেকে মালগুলো তুলে দিয়ে আমিও সঙ্গে সঙ্গে নাবলুম। পারের লোকটি তখন জাহাজে উঠেছে। বাবুটি পারে নাবতে যাবেন এমন সময় ফিরে বললেন- চিঠিপত্র লিখুবেন আপনার ঠিকানা? তাই তো নামই জানা হল না। আপনার নাম?
আবদুল রসুল।
থমকে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলেন- কী?
আবদুল রসুল।
তুমি মুসলমান?
আমি বললুম, হ্যাঁ, কেন?
দ্রলোক মুখ খিঁচিয়ে বললেন, কেন?–কেন জাতটা মারলে? খাবার সময় বললে না কেন তুমি মুসলমান? উল্লুক!
আমি অবাক হয়ে বললুম, আপনি যে বললেন, জাত মানেন না!
তিনি তেড়ে এসে আমার নাকের কাছে হাত নেড়ে বললেন, মানিনে, খুব মানি। আলবৎ মানি। সাত পুরুষ মেনে এসেছেন আর আমি মানিনে। আবার প্রাচ্চিত্তির ফেরে ফেললে! হতভাগা– নেড়ে!
পরিশিষ্ট – ১১
মুজতবা আলীর মাতা- আয়তুল মান্নান খাতুন। (১৮৭৯-১৯৪২) ছিলেন বাহাদুরপুর পরগণার রাগ প্রচণ্ড খা গ্রামের জমিদার মোহসেন চৌধুরীর কন্যা।