আমি জানি এ-সব প্রগলভতা। কিন্তু আপনিই বিবেচনা করে বলুন, আপনার মতো গুণী লোকের সামনে না করে কার সামনে করব? অন্যে ভুল বুঝবে, নিন্দা করবে। আপনি সস্নেহে মাফ করে দেবেন। তুলসীও বলেছেন, শিশুর আধো-আধো বুলি বাপ-মা গদগদ হয়ে শোনে। ক্রুর কুটিল কুবিচারী কিন্তু হাসে।
জো বালক কহে তোতরী বাতা
শুনত মুহিত নেন দিনু অছ মাতা
হাসি হাসে ক্রূর কুটিল কুবিচারী
জে পরফুল মুখশধারী–
তাই নিতান্ত স্বার্থপরের মতো বলছি, আপনি শতায়ু হন, সহস্ৰায়ু হন। আমাদের অক্ষম লেখার তোতরী বাতা একমাত্র আপনিই মুদিত নয়নে প্রসন্ন বয়ানে আশীর্বাদ করতে পারেন।
—গুণমুগ্ধ বশংবদ
সৈয়দ মুজতবা আলী
[এটাই রাজশেখর বসুকে লেখা মুজতবা আলীর শেষ চিঠি। উত্তর বোধহয় পাননি– কারণ তাহলে চিঠির ওপর উঃ… লেখা থাকত।
এর মাসখানেক পরে রাজশেখরের মৃত্যু হয় (২৭-৪-১৯৬০)।]
সংযোজন : অপ্রকাশিত গল্প – নেড়ে
পুজোর ছুটির পর কলকাতায় ফিরছিলুম। চাঁদপুর স্টেশনে আসবার একটু আগেই জিনিসপত্র গোছাতে লাগলুম। সঙ্গে ছিল শুধু একটি বেতের বাক্স আর সতরঞ্চি জড়ান বিছানা। যাদের সচল অচল অনেক লাটবহর থাকে, তাদের ট্রেন ছেড়ে জাহাজে উঠতে দেরি হয়। কাজেই আমার মতো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিবিহীন ব্যক্তি মাত্রেই ছুটে গিয়ে জাহাজ দখল করে বসে। এ অবশ্য আমি গান্ধি-ক্লাসের যাত্রীদের কথা বলছি।
চাঁদপুরে গাড়ি থামল। তাড়াতাড়ি নেবে পড়লুম। কুলি না ডেকে মোট ঘাড়ে করে ছুটে চললুম। বিস্তর যুদ্ধের পর জাহাজে উঠলুম। ভেবেছিলুম বেশ খালি পাব; কিন্তু দেখলুম পৃথিবীতে একমাত্র হুঁশিয়ার লোক আমিই নই। অনেকেই আমার ঢের আগে এসে ভালো জায়গাগুলো দখল করে বসে আছেন। আরও দেখলুম আমার অপেক্ষাও অল্প লাটবহর বিশিষ্ট বঙ্গসন্তান। তাদের সম্পত্তির মধ্যে একখানা খবরের কাগজ খানা বিছিয়ে হাতে মাথা দিয়ে শুয়ে আছেন।
থাক্, অনুতাপ করে লাভ নেই। বেশ কসরত করে সিঁড়ির পাশে জায়গা দখল করে বিছানা বিছিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লুম। তার পর জামার বোতাম খুলে, ডান পা-খানা সোজা করে, বা পা তার উপর তুলে নাচাতে শুরু করে বিজয়গর্বে চারিদিকে তাকাতে লাগলুম। হঠাৎ মনে হল ব্যুহ তো তৈরি করা হয়নি। তাড়াতাড়ি উঠে বিছানার একপাশে জুতা আর একপাশে বাক্স ও মাথার দিটা রেলিংয়ের সঙ্গে ঠেকিয়ে রাখলুম। এইবার ঠিক হল। আর কোনও সামন্ত-যাত্রী-রাজা আক্রমণ করতে পারবেন না। চৌহদ্দি ঠিক করে নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে পড়ে বিজয়গর্বে আবার ঠেঙ নাচাতে শুরু করলুম। চারিদিকে তখন হৈ হৈ কাণ্ড। জায়গা দখল নিয়ে ঝগড়া, কুলির সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ। নানা প্রকারের চিৎকারে চারিদিক তখন বেশ সরগরম।
জাহাজ ছাড়ে ছাড়ে– ভাবলুম যাক একটু কবিত্ব করা যাক– অমনি।
হে পদ্মা আমার
তোমায় আমায় দেখা—
বাকিটা আর আওড়ানো হল না। দেখি একটা ভদ্রলোক মরিয়া হইয়া সিঁড়ি দিয়া উঠতে চেষ্টা কছেন। পেছনে তার আবরু-অবগুণ্ঠিতা স্ত্রী কিছুতেই তাল সামলে তাঁর সঙ্গে চলতে পাচ্ছেন না। ভদ্রলোকের সে-দিকে দৃষ্টি নেই।
এগিয়ে চলার আনন্দে তিনি তখন মশগুল। আনন্দ বললুম বটে কিন্তু থাচ্ছো কেলাসের যাত্রী মাত্রেরই এ আনন্দের ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়।
যাক্। শেষ পর্যন্ত তিনি উপরে উঠলেনই। বাঙালির ধৈর্য নেই, যুদ্ধ করতে পারে না– একথা ডাহা মিথ্যে। সেই ভদ্রলোককে দেখলে উপরোক্ত কুসংস্কার কারুরই থাকবে না। উপরে উঠেই তিনি চারিদিকে তাকাতে লাগলেন।
কিন্তু–
স্থান নেই স্থান নেই ক্ষুদ্র সে তরী
মেড়ো, খোট্টা, বাঙালিতে সব গেছে ভরি।
ততক্ষণে তার স্ত্রী এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন। বাবু তখন পেছনে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলেন। বুঝতে পারলুম কুলি চম্পট–বললুম কী মশাই, কী হয়েছে?
ভদ্রলোকটি কাঁদ কাঁদ হয়ে বললেন, কুলি-কুলি, কোথায় গেল, এই—
আমি বললুম, নম্বর মনে আছে?
আমার কথায় কান না দিয়ে বলতে লাগলেন, অ্যাঁ, তাই তো, কুলি কোথায় গেল– বাক্স-টাক্স সব নিয়ে গয়নার বাক্স হায় হায়।
গয়নার বাক্সর কথা মনে হতেই তার শোক দ্বিগুণ হয়ে উঠল, আমি বিরক্ত হয়ে বললুম,
নম্বর কত ছাই বলুন না?
এ্যাঁ, তাই তো নম্বর, হা নম্বর! নম্বর এই– তাই তো! ভুলে গিয়েছি।
বেশ কোরেছেন! এইবার তার স্ত্রীর গলা থেকে গড়গড় কোরে একটা আওয়াজ বেরুল। কিন্তু, সেটা কি কোনও ভাষা না শুধু আওয়াজ মাত্র তো বোঝা গেল না।
ভদ্রলোকটি তাড়াতাড়ি সেই দিকে ঝুঁকে বললেন।
কী, কী, মনে আছে?
আবার একটু গড়গড়। তার পর শুনতে পেলুম এগারো।
আমি আর অপেক্ষা না করে একপাটি জুতা পায়ে ঢুকিয়ে অন্যটা ঢুকাতে ঢুকাতে ছুটে চললুম। ফিতে বাঁধা ছিল না বলে ডান পায়ের জুতোর নিচে ফিতে আটকে যাওয়ায় দড়াম করে সিঁড়ির উপর মুখ থুবড়ে পড়লুম। জুতোর ওপর ভীষণ চটে গেলুম। কিন্তু মনকে সান্ত্বনা দিলুম পরোপকার কি বিনা মেহনতে হয়। যা হোক আবার উঠে ভিড় ঠেলে গ্যারহ নম্বর কুলি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে চললুম। কিন্তু কোথায় গ্যারহ নম্বর কুলি। প্রত্যেক কুলির নম্বর যদি খুঁজতে যাই তবে সে কাজটি আর সেদিন শেষ হবে না। কাজেই শুধু চেঁচিয়ে চললুম।
নদীর পারে উঠে চেঁচাতেই কুলি বললে- ক্যা বাবু। কোঁও চিল্লাতে হো? আমি বললুম তুমি গ্যারূহ নম্বর কুলি? সে বলল, হ্যাঁ, ক্যা চাইতে হো?