এই গুরুবাদের ব্যাপারে আমি আরেকটা জিনিস লক্ষ করেছি। ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীত আমি য-ই শিখতে যাই না কেন, গুরুর চেষ্টা থাকে, কত শীঘ্র আমাকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে পারেন, অর্থাৎ নিজেকে useless করে তুলতে পারেন, আমাকে বলতে পারেন, বৎস, এইবারো তুমি চরে খাও। শুধু ধর্মের গুরু একেবারে মাথার রতন ন্যাপ্টে থাকেন আঠার মতন। সেই কোথায় গৌহাটি থেকে শিষ্য গুরুকে চিঠি লিখবেন পিণ্ড-দাদন-খানে এটাতে কী করব, ওটার কী হবে? আর গুরুও শেষ দিন পর্যন্ত উপদেশ-হুঁকুম ঝাড়তে থাকেন। তাই বোধহয় দক্ষিণের রমন মহর্ষি কোনও শিষ্য নিতেন না, পারতপক্ষে কাউকে কোনও উপদেশ দিতেন না, হুকুম তো শিকেয়। তাঁর চতুর্দিকে যে আশ্রম গড়ে উঠেছিল এবং সেখানে যে-সব কর্ম-কীর্তি হত তা দেখে ভদ্রলোক মর্মাহত হতেন। কিন্তু তিনি নিরুপায়। আশ্রম থেকে পালিয়ে গিয়ে যেখানেই যান না কেন, সেখানে গড়ে উঠবে বিরাটতম আশ্রম, সেখানে exploitation হবে নিদারুণতর। ওদিকে তিনি জরাজীর্ণ বৃদ্ধ। গভীর অরণ্যে একা থাকা অসম্ভব। এবং মানুষকে বিপদ-আপদে সাহায্য করার প্রবৃত্তিটিও তাঁর বিলক্ষণ ছিল। আরেকজন লোক দেখেছি, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাকে বলে ঋষিতুল্য। Learning, Wisdom, Art,- এর কী অদ্ভুত সমন্বয় এবং সর্বোপরি আচার-ব্যবহারে শিশুটির মতো কী সরলতা। তাঁর কপাল ভালো। রবির দিকে সকলের দৃষ্টি– তাকে অল্প লোকেই লক্ষ করত। তাকে গুরু হতে বললে তিনি হয়তো ঠা ঠা করে হেসে উঠতেন। (তার হাসি হেসেখেলে ফার্লঙ খানিক ডিঙোতে পারত)। গাঁধী-ব্রজেন্দ্র শীল একে বড় শ্রদ্ধা করতেন। শুনেছি, কে নাকি একবার বক্রোক্তি করে অরবিন্দ ঘোষকে শুধিয়েছিল, ব্রাহ্মসমাজের কেউ কি ভগবানকে 696309a And Pat came the reply, why? To begin with Dwijendranath Tagore? অবশ্য ভগবানকে পাওয়া-না-পাওয়া দূরের কথা। গর্কি যা বলেছিলেন তাই যথেষ্ট। টলস্টয়ের সঙ্গে একদিন দীর্ঘ আলাপচারির পর গর্কি লিখেছিলেন, And looking at him I, who am an atheist, said to myself, This man is God-like!
আপনাকে আর বিরক্ত করব না। আপনার কাছ থেকে চিঠির উত্তরও প্রত্যাশা করি না। আপনার কাছ থেকে আমার একটি মধ্যাহ্ন কিংবা নিশিভোজন পাওনা আছে। এবারে কলকাতায় এসে সেটি ছাড়ব না। ২৪ ঘণ্টা আগেই কী কী খাব, তা জানিয়ে দেব। এবং এ কথা জানাবার প্রয়োজন বোধ করিনে যে খাওয়ার ব্যাপারে আমার এক ভাগ্নীর ভাষায়– মামুর শুধু মুখে মুখেই হাইজাম্প লঙজাম্প। তবে আমি পাতিপুরের রাজাবাহাদুরের মতো পাতিনেবু দিয়ে বার্লিও খাইনে। যদিও এই পোড়ার শান্তিনিকেতনে আমার সাতিশয় প্রিয় কইমাছ আদপেই পাওয়া যায় না। কলকাতায়ও এত মাগ্যি যে এ জমানার মেয়েরা ও-জিনিসটে রান্না করার সুযোগও পায়নি। এখন দু মুঠো অন্ন ভালো করে খেতে হলে ঢাকা যেতে হয়। সেখানে এখনও সবকিছু পাওয়া যায়। নবাব-বাড়ির কল্যাণে রান্নার standard উঁচু– কি হিন্দু কি মুসলমান, উভয় হেঁসেলেই। ভালো ভালো কবরেজও সেখানে আছে। শুধু বাছাই বাছাই পথ্যি করিয়ে বিস্তর ব্যামো সারিয়ে দেয়। আপনার সেই ভাইজী দুর্গাদেবী৭ তো আমাকে তার কোনও লেখার খবর দিলেন না? আপনি শীঘ্র সেরে উঠুন এই প্রার্থনা করি।
— গুণমুগ্ধ
সৈয়দ মুজতবা আলী
[১. দাদুকে লেখা এই চিঠিটা পড়েই সৈয়দ মুজতবা আলীকে প্রথম চিঠি লিখি। (তাতে অবশ্য জানিয়েছিলুম অগণিত কাচ্চাবাচ্চার মধ্যে আমিই বাড়িতে একলা। বাকি সব রবাহূত।) পত্রপাঠ দু পাতার উত্তর পেয়েছিলুম আমার চিঠির ১ নং দ্রঃ। তারপর ছ বছর ধরে পত্রালাপ। অবশ্য তার ফাঁকে অসংখ্যবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখোমুখি বসে কথাও হয়েছে।
২. এখানটায় একটু বেশি আলঙ্কারিক প্রয়োগ হয়ে গেছে। দাদু কখনও হুঙ্কার দিয়ে কথা বলেননি। অন্য কাউকে কখনও কিছু পড়ে শোনাতেও বলেননি। নিজেই পড়তেন। এবং পড়তে পড়তে ঘুম কল্পনাতীত।
৩. পরশুরামের স্বয়ম্বরা ও শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড গল্পের দুটি চরিত্র।
৪. কৃষ্ণকলি যন্থের ভবতোষ ঠাকুর গল্পের শেষ লাইন : … সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের একটা লেখায় পড়েছি– পীর কখনও ওড়েন না, তাঁর চেলারাই তাঁকে ওড়ান।… এটা পড়েই এই বিস্তীর্ণ আলোচনা।
৫. চিঠির উত্তর কিন্তু পেয়েছিলেন। কপি নেই। আর আমি লিখেছিলুম আজই কইমাছ এসেছে। তার পর অনেকদিন ধরে এসে খাওয়ার কথা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোনও দিনই হয়নি।
৬. পরশুরামের রাজভোগ গল্প থেকে উদ্ধৃতি।
৭. গিরীন্দ্রশেখর-কন্যা দুর্গাবতী ঘোষ।]
০৩.
শান্তিনিকেতন
১৫।৩।৬০
পরম শ্রদ্ধাস্পদেষু,
আপনার জন্মদিনে আমার মনে কী আনন্দের সঞ্চার হচ্ছে সেটা বুঝিয়ে বলার মতো ভাষা আমার নেই। আমার অজানা নেই যে আপনার শরীর সুস্থ নয় এবং এই জন্মদিন আপনার কাছে অল্প আনন্দই বহন করে আনছে, কিন্তু আপনি যিনি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে আমাদের আনন্দ দিয়ে আসছেন আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে আপনি যে আমাদের মাঝখানে আছেন তাতেই আমাদের গভীর আনন্দ। আমরা স্বার্থপরের মতো কথা বলছি, একথা সত্য। কিন্তু আমি স্বার্থপরতায় বিশ্বাসী। দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ কর, সমাজের জন্য স্বার্থপরতা ছাড় এসব বড় বুলি আমার কখনও ভালো লাগেনি। আমি বরঞ্চ বলেছি, একটুখানি স্বার্থপর হও, তা হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা লাগবে, ফলে দেশের কমপিটেস্ বেড়ে যাবে। আপনাকে বলছি এই যে চূর্ণ-বিচূর্ণ জর্মনি পাঁচ বছরের ভিতর ফের আপন পায়ে দাঁড়িয়ে উঠল, পনেরো বছরের পর এক আমেরিকা ছাড়া সবাইকে টাকা ধার দিতে চায় (কুলোকে বলে ফ্রান্সের এটম বমের রেস্ত যুগিয়েছে জর্মনি!), সে তো আত্মত্যাগ স্বার্থত্যাগের বুলি একবারও কপচায়নি। এ বিষয় দীর্ঘ লেকচার শোনার মতো আপনার মনের অবস্থা নয় কিন্তু ভবিষ্যতে যখন দেখা হবে তখন আমার কথাটা যে ঠিক সেই আমি উত্তম উত্তম ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রমাণ করে দেব। ধর্মগ্রন্থ এই কারণে বললুম, সচরাচর লোকের বিশ্বাস ধর্ম বুঝি বেপরোয়া স্বার্থত্যাগ করতে উপদেশ দেয়, দ্বিতীয়ত আমার জীবনের বেশিরভাগ কেটেছে ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করে– তবে আপনাকে ভরসা দিচ্ছি, ধর্ম আচরণ করে নয়।