মুজতবা আলীর জীবনের শেষ ৭।৮ বছর আর আমার সঙ্গে কোনও পত্রালাপ বা দেখা হয়নি। কী করে যে কোনও ঝগড়া না করেও এতদিনের অন্তরঙ্গতা হারিয়ে গেল… এটাই বোধহয় জাগ্রত বাস্তব।
॥ দীপংকর বসু ॥]
.
রাজশেখর বসুকে লেখা
০১.
শান্তিনিকেতন,
৪।১।৫৯
শ্রদ্ধাস্পদেষু,
জন্মদিনে তাপনাকে আমার ভক্তিপূর্ণ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি। আপনি বঙ্গসাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি করুন, আমাদের আনন্দ বর্ধন করুন। আপনার কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ, আপনি শতায়ু হোন, সহস্ৰায়ু হোন।
—গুণমুগ্ধ
সৈয়দ মুজতবা আলী
[এই পত্রটি সৈয়দ মুজতবা আলী রাজশেখর বসুকে লেখেন। পরের পত্রটি রাজশেখর বসুর উত্তর। এই দুটিও শ্রীযুক্ত দীপংকর বসুর সৌজন্যে পাওয়া গেছে।]
০২.
শান্তিনিকেতন,
১২।১।৬০
শ্ৰদ্ধাস্পদেষু,
আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানবেন, শুনে শঙ্কিত হলুম, আপনি অসুস্থ। তবু বসুধারা পত্রিকায় যখন আপনার লেখা বেরুচ্ছে তখন বিবেচনা করি, আপনার বাড়ির অগণিত বাচ্চা-কাচ্চাদের কেউ না কেউ হয়তো আপনাকে এ চিঠিখানা পড়ে শুনিয়ে দিতে পারে। একদা আপনারই আদেশ অনুযায়ী এদের গল্প শুনিয়েছিলুম– এ উপকারটা করে দিতে তারা হয়তো নারাজ হবে না।
কিন্তু ইতিমধ্যে আমার মনে আরেকটা শঙ্কার উদয় হল। তুলনা দিয়ে নিবেদন করি। রোগশয্যায় রবীন্দ্রনাথকে অনেকেই সেবা করতে চাইতেন। ইয়া ধুমসো কামারের মতো কঠিন হাত দিয়ে হঠাৎ তার পা টিপতে আরম্ভ করতেন– যে পদযুগল ইন্দুমতীদের করস্পর্শ ছাড়া অন্য কোনও উৎপীড়ন কখনও সয়নি। কবি নাকি তখন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সয়ে যেতেন– সঙ্কোচবশত কিছু বলতে পারতেন না। আমার ভয় হচ্ছে, আমার চিঠি হয়তো সেইরকম বেদনাই দেবে। বিশেষত আমার ভাষার ত্রুটি-বিচ্যুতি আপনার কানকে পীড়া যখন দেবে তখন সেই পুরনো বাধতি বাধতে আবার মামদো হয়ে দেখা দেবে। (মামদো কথাটা আপনার অভিধানে পেলুম না– শুনেছি, কথাটা মুহম্মদ মুহম্মদী থেকে এসেছে, অর্থাৎ খাস মুসলমানি ভূত)। অথচ আমি ভাবছি রোগশয্যায় চিঠি পেতে অনেকেই ভালোবাসেন। আপনিও হয়তো অপছন্দ করবেন না।
আমি কোনও স্বার্থ নিয়ে এ চিঠি লিখছি না। খন্বিদং, বিরিঞ্চি বাবাদের আশীর্বাদ না থাকা সত্ত্বেও আমার অভাব-অনটন বিশেষ নেই। এমনকি কবি হাইনের মতো আমার নিম্নলিখিত প্রার্থনাও নেই- 0, God, you know, I am a Poet and have few needs indeed. All I want is a cottage and home-made bread and butter. Being a Poet, however, I should love to have a row of poplar trees in front of my cottage so that I may look at the trees and derive inspiration from them, and shouldst thou, O Lord, in the glory, want to make may happiness complete so that my cup runneth over, I should, like some of my enemies to be hanged to their loftiest branches, so that I could look at their dang line legs and contemplate over the glory! Of course Christ has ordered us to forgive our enemies and I shall, in the fulness of my heart, certainly forgive them but only after they are hanged! (এ স্থলে বলা আবশ্যক মনে করি যে বেচারা হাইনে বহুদিন ধরে তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত অযথা প্রচারিত নিন্দাবাদ চুপ করে শুনেছিলেন; শেষটায় যখন তার জাত তুলে, অর্থাৎ তার ইহুদিত্ব নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আরম্ভ হল তখন তিনি অস্ত্রধারণ করলেন এবং যে কী অস্ত্র! হাইনে নিজেই জানতেন না তিনি এরকম ব্যঙ্গ– satire লিখবার ক্ষমতা ধরেন এবং গোড়ার দিকে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ তাঁর মতো মোলায়েম প্রেমের কবিতা পৃথিবীতে খুব অল্প লোকই লিখেছেন। তাঁর মায়ের উদ্দেশে লেখা কবিতাগুলো যে কী সুন্দর সে মূলে না পড়লে বোঝা যায় না। এই যে আমরা professional মা মা করনেওলা বাঙালি, আমরাও এরকম কবিতা লিখতে পারিনি– ইয়োরোপীয়রা তো পারেইনি। ইয়োরোপে মা-এর প্রতি ভালোবাসা বিরল– অন্তত আমার তা-ই মনে হয়েছে। হাইনে আসলে oriental– ইহুদি।)
আপনি আমার লেখা পড়বেন এ আশা আমি করিনে, আবার, আমার একটি লেখাও আপনার সামনে পড়ছে না এটা ভাবতেও ভালো লাগে না। আপনি মুরুব্বির মতো আছেন, হয়তো কখনও হুঙ্কার দিয়ে বললেন, মুজতবা আলীর কোনও বইটই বেরুল? কেউ এক পাতা পড়ে শোনাতে না শোনাতেই আপনি ঘুমিয়ে পড়লেন, এই বা মন্দ কী? আমি জানি, আমি আপনার জন্য লিখি না। আমি লিখি টাঙা-ওলা বিড়িওলাদের জন্য অন্তত আমার ইচ্ছে, আমি যেন এমন সরল করে লিখতে পারি যে তারা আমার লেখা বুঝতে পারে। তা কিন্তু হয়ে উঠবে না। আপনি এত সরল সহজ লেখেন যে তার অর্থ বের করা এবং রসগ্রহণ কিছুমাত্র কঠিন কর্ম নয়, তবু প্রত্যয় যাবেন না, আমার একজন সমঝদার বন্ধু জনৈক বাঙলাতে এম.এ. পাস যুবককে আপনার লেখা বুঝিয়ে বুঝিয়ে পড়ালেন। আপনার আর সুকুমার রায়ের একই অবস্থা। এ tragedy কেন হয় আমি বুঝে উঠতে পারি নি। আপনি কি চিন্তা করেছেন? আমি সূক্ষ্ম কাজের কথা ভাবছিনে– জোয়ান জিল্টার বা বিলাতের সায়েবের কেন কোলড় হ্যাম– নাম হয়, এসব নয় মাথার উপর দিয়ে গেল কিন্তু অন্যান্য জিনিস? আপার কৃষ্ণকলির ভবতোষ ঠাকুর কেন উড়লেন না, সে বাবদে আমার একটি ঘটনা মনে পড়ল। এমিল জোলার নাম যখন ফ্রান্সের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তখন রুচিবাগীশ তাঁর কয়েকজন বন্ধু অনুরোধ করলেন একখানা clean বই লেখার জন্য। বিজ্ঞাপনের ভাষায় যেটি নির্ভয়ে পুত্রকন্যার হাতে তুলে দেওয়া যায়। জোলা লিখলেন। আনাতোল ফ্রস তার সমালোচনা লিখতে গিয়ে বললেন, জোলা শূয়রের মতো কাদা-ময়লার ভিতর চমৎকার wallow করতে পারেন। ফিরিস্তার মতো উড়তে গেলে শূয়রের যে হাস্যকর অবস্থা হয় এই clean বইয়েতে জোলার তাই হয়েছে। We prefer to see Zola wallow in the dirt.