শবনম পড়ে তোমার ভালো না লাগলেও তার একটা জিনিস তোমার ভালো লাগার কথা। বিস্তর খেটেখুটে অনেক সুন্দর সুন্দর ফার্সি দোহা চৌপায়ী জোগাড় করে বাঙলায় তার অনুবাদ করে এ উপন্যাসে লাগিয়েছি। অনুবাদে একটিমাত্র শব্দ বাড়াই-কমাইনি, শুধু বাঙলায় দীর্ঘস্ব নেই বলে ফার্সি ছন্দ বজায় রাখা অসম্ভব।
আমার চিঠি ছাপাবে, তার আর কী? কিন্তু তোমাকে আত্মজনরূপে মেনে নিয়ে হয়তো নিজের কথা, নিজের দম্ভ প্রকাশ করে বসে আছি। সেটা ছাপানো কি যুক্তিযুক্ত হবে? অবশ্য কলকাতার সাহিত্যিকবৃন্দের ভিতর আমি এমনিতেই মারাত্মক রকমের popular নই– কাজেই মড়ার উপর এক মনও মাটি একশ মনও মাটি (এটা খাস মুসলমানি-প্রবাদ–কারণ মুসলমানেরই গোর হয়)। তবে অপ্রয়োজনীয় অংশ কেটে দিয়ে তুমি edit করে ছাপিয়ে দিতে পার। আমার কণামাত্র আপত্তি নেই।
ছেলেবেলায় যখন কোনও কৃতী পুরুষের মৃত্যু হত তখন সেটা মনের ওপর কোনও দাগ কাটত না– কারণ তাঁর কৃতিত্ব সম্বন্ধে ছেলেমানুষ অচেতন। এখন যখন বিধুশেখর, হরিচরণ, ক্ষিতিমোহন, রাজশেখর চলে যান তখন এঁদের মূল্য বুঝি বলে বড় বাজে। বিধুশেখর নেই- বেদ এবং আবেস্তা তথা বীজধর্ম সম্বন্ধে কাকে প্রশ্ন শুধাই? হরিচরণ নেই–ছাতাটা বগলে নিয়ে চটিটা টানতে টানতে মাস্টারমশাই, বলুন তো–?
[ সাগর = সাগরময় ঘোষ, দেশ পত্রিকার সম্পাদক। ক্ষিতি = ক্ষিতিমোহন সেন। বিধুশেখর = বিধুশেখর শান্ত্রী। হরিচরণ = হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। রাবেয়া = রাবেয়া আলী, লেখকের পত্নী। ফিরোজ = সৈয়দ মুশাররফ আলী, ফিরোজ ডাকনাম, লেখকের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ভজু = সৈয়দ জগলুল আলী, ভজু ডাকনাম, আর এক প্রচলিত ডাকনাম কবীর, লেখকের কনিষ্ঠ পুত্র।]
এই যে সৈয়দ, এস এস। এক্ষুণি তোমার কথা ভাবছিলাম। কাল সন্ধেয় তোমার বউ এসেছিল তোমার দুই ছেলে নিয়ে। বউমা আমায় বললে, আশীর্বাদ করুন, আমার ছেলে যেন আপনার মতো পণ্ডিত হয়। হাঃ, হাঃ। আমি কী বললুম, জানো–
সে কথা থাক্। বলুন তো, জলপাই শব্দটা- ইত্যাদি।
তাঁর বয়স তখন নব্বই। সম্পূর্ণ অন্ধ। Headcrystal clear.
রাজশেখরবাবু সম্বন্ধে লিখব। লিখব বইকি, লিখব। কিন্তু কী কঠিন তুমি জান না। তাঁর, ক্ষিতিমোহনবাবুর যেখানে পাণ্ডিত্য সেটা বরঞ্চ চৌহদ্দিতে ফেলা যায়, কিন্তু রাজশেখর যেখানে বুজরুক, effeminiate (কচি সংসদ) অর্থগৃধনু (সিদ্ধেশ্বরীর অগা রায় বাহাদুর), corrupt politician (দক্ষিণ রায়) ইত্যাদিকে আর্টের পর্যায়ে তোলেন তাকে sum up করা বড় কঠিন। তাছাড়া পদে পদে bizarrerie–যত্রতত্র ছড়ানো যে রকম-সায়েব মেম নাচছে, চাটুয্যে ধরলেন রামপ্রসাদী। Bizarrie জিনিস বাঙলায় অতি কম। Grotesque আছে, anachronistic humour-ও আছে, এমনকি weird-ও আছে (ফ্রেমে কেন বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা?)। আরও বহু বহু বিদকুটে রস। বড় কঠিন, বড় কঠিন। তুমি বুঝবে না।
তোমাকে প্রথম চিঠি লেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ভেবেছিলুম যতীনবাবুকে লিখব (ওঁকে আমার বড় ভালো লেগেছিল। কিন্তু ঠিকানা জানতুম না। এখন লেখা যায়? আমার দ্বিতীয় চিঠি পেয়েছিলে?
এখানে আরও দিন পনেরো তো থাকতে হবে। এখানে আমি মালিক নই। (রাবেয়া তোমার মায়ের সহপাঠিনী) বিবি আমাকে প্রায় সূ সূ সূ (রাতারাতি) করে ডাকেন।
–সৈ. মু. আ.
.
(৭)
শান্তিনিকেতন স্নেহাস্পদে,
আমি অতিশয় দুরাবস্থার* ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। অবর্ণনীয়। আমি দু মাস বাইরে থাকার সময় আমার উঠতি এবং উড়ুক্কু বয়সের ছোকরা পাঁচক cum ভৃত্যটি রসাতলে গেছেন। এমনই চরমে পৌচেছে যে একাধিক প্রতিবেশী আমার কাছে ফরিয়াদ করে গেছেন। সে-ও না হয় সামলাতে পারি কিন্তু রাত দুটোয় বেলেল্লাপনা করে ফিরলে পরের দিন কাজ কী রকম হয় সে তো বুঝতেই পারছ। আগে রান্নাটা অন্তত মন দিয়ে করত– এখন সে ইয়ারদের সঙ্গে দোকানে চপ-কাটলিস খেয়ে বাড়ির খাবার অবহেলায় রাঁধে। অসহ্য সে খাদ্য। সবচেয়ে বিপদ ওকে বিশ্বাস করে কলকাতা যাওয়া অসম্ভব। সে সঙ্গে সঙ্গে অষ্টপ্রহর বাইরে কাটাবে। রেডিয়ো, টাইপকল, সাইক্ল চুরি যাবে। ব্যস্।
[*দুরাবস্থা– দুরবস্থা শব্দের অশুভ রূপ। জনৈক ব্যক্তি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বলেন, তিনি খুব দুরাবস্থায় আছেন। ঈশ্বরচন্দ্র উত্তরে বলেন, তা আকারেই (অর্থাৎ–কারের অশুদ্ধ প্রয়োগে) বুঝতে পারছেন। এই রসিকতাটি লেখকের প্রিয় ছিল। মাস্টার– লেখকের পোষা কুকুর]
মাস্টার অযত্নে থেকে সর্বাঙ্গে পোকা নিয়ে বসে আছে। অষ্টপ্রহর তার খেদমত করছি। বাড়িময় পোকা- flit, gemaxin D.D.T. তিন বন্ধু Spray powder করছি অবিরাম।
তুমি মেয়েছেলে হলে তোমাকে স্বয়ংবরী করে এই বৃদ্ধ বয়সে বলতুম, ভাই, দুটো ভাত সেদ্ধ করে দে।
চরমে চরমে!
তোমার কাছে বিশ্বাসী cook আছে পাঠিয়ে দাও না। আমি তা হলে অন্তত কিছুদিনের জন্য হাজরা রোড যাই। সে খাবে দাবে, বাড়ি আগলাবে, আর মাস্টারকে দেখবে। রান্নাঘর আলাদা। আমি সেখানে ঢুকি না। তার জাত যাবে না। আর মসলা হলে তো কথাই নেই। জাতভাই।
শবনমের শেষ কিস্তি বেরুবে ২০ আগস্ট। সঙ্গে সঙ্গে বই। ত্রিবেণী প্রকাশনী শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট। তোমার মাকে যেটা পাঠাব সেটা একটু দেরিতে পৌঁছবে। কলকাতা থেকে আসবে– তা-ও প্রকাশক বই দেয় author-কে প্রথম বিক্রির ধাক্কা সামলে নেওয়ার পর আবার এখান থেকে যাবে।