এবারে বল তো বত্স, রবীন্দ্রনাথ তার গানের অন্তর মন বিকশিত করো-তে নন্দিত করো, নন্দিত করো হে কোত্থেকে লোপাট চুরি করেছেন? (উত্তর শেষ পৃষ্ঠায় উল্টো করে লেখা)।
ধর্মশিক্ষা এখনও পাইনি। নিশ্চয়ই পড়ব। ধার্মিকরা চটুন, কোনও আপত্তি নেই। আর আমরাও মহেশ বা হরিনাথ নই। আর তোমরা তো কায়স্থ। তোমাদের মহা সুবিধে কোনও ধর্মকর্ম করার আদেশ তোমাদের ওপর নেই। কিঞ্চিৎ আতপ চাল আর দুটো কাঁচকলা বামুনকে ডেকে দিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। হিন্দুধর্ম বড় Specialist-দের ধর্ম। বামুনরা Specialist- (যে রকম ধর Cancer-এর স্পেশালিস্ট হয়) সেই Specialist যখন রয়েছে তখন তুমি-আমি খামকা অত তকলিফ বরদাস্ত করে আনাড়ির মতো এমেচারি করতে যাব কেন? Specialist মোটর মেরামত করে, তবে Specialist-ই স্বর্গে যাবার সিঁড়ি তৈরি করে দেবে না কেন? ভূশণ্ডীর মাঠে খামকা ক্ষীরি বামনীর ভিটেতলা থেকে সোজা যেখানে দেবদূতরা গোলাপি উড়ুনি পরে ফটাফট সোডার বোতল খুলছে, সেখানে যাবার পথ ওরা যখন জানে তখন ওদের হাতে দু পয়সা ঠেকিয়ে দিলেই হয় বাংলা কথা! আমার অবশ্য সমূহ বিপদ। একে তো সব মুসলমানকেই পাঁচ বেকৎ নামাজ করতে হয়, তার ওপর আমি আবার সৈয়দ, মুহম্মদের বংশধর (সাবধান! চাট্টিখানি কথা নয়– তোমার দাদু এ বাবদে প্রশ্ন শুধোলে আমি বলেছিলুম, ক্যান মশায়, আপনারা যদি চন্দ্রবংশ, সূর্যবংশ হতে পারেন–অর্থাৎ চন্দ্র-সূর্যের পুত্র হতে পারেন তবে আমার claim তো অনেক modest. আমি একজন মানুষ মাত্র পূর্ব-পুরুষ হিসেবে চাইছি!), তার ওপর আমাদের বংশ শুরুবংশ (যদিও থিয়েটারে আবদালা সাজিনে– খল্বিদং দ্রষ্টব্য ওটা দিলীপ রায়– নাঃ) Religiosity-র worst example ওই লোকটা! বাপস!), এবং finally কাইরোর ভুবন-বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝাড়া দেড়টি বছর সুদ্ধমাত্র স্মৃতি (মাকড় মারলে ধোকড় হয়– নবমীতে অলাবু ভক্ষণ, পশ্চিমে যাত্রা নাস্তি) নিয়ে research করেছি।
আমার মতো জ্ঞানপাপী এ জগতে দুর্লভ। আমার কী গতি হবে, বল তো। জাবালি? মহেশ?
আচ্ছা, বল তো, আমি কেন অত শত ধর্মগ্রন্থ পড়েছি, এবং এখনও পড়ি? আমার ডক্টরেটও History of Religion-এ। জর্মন মাল, বাবা, চালাকি নয়– ছে ছে পয়সা জাপানি মাল নয়। বলতে পারলে বুঝি তোমার পেটে কত এলেম।
তোমার দাদু রসিক লোক, রসজ্ঞ ব্যক্তি, তাঁর রসবোধ আছে। এ কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু রসশিল্পী বা রসসাহিত্যিক বলার কোনও অর্থ হয় না। শিল্পী রস বানাবে না, তবে কি কচুপোড়া তৈরি করবে! রম্যরচনা-ও ওই একই দরের কথা। এখানকার গাড়লরাও লেখে বিশ্বভারতী University। বিশ্বভারতী মানেই তো University!!
তদুপরি, নিছক রস সৃষ্টির জন্যই তো রাজশেখর কলম ধরেননি। তিনি কি গোপাল ভাঁড়! তওবা, তওবা!!
আমার বইটার নাম শবনম্। অর্থাৎ শিশিরবিন্দু, হিমিকা, গৌরী। উপন্যাস। অতি মোলায়েম। নির্ভয়ে প্রিয়জনের হাতে তুলে দেওয়া যায়।
আমি অবসর সময়ে আস্তে আস্তে পূরবীর টীকা লিখছি। কবে শেষ হবে আল্লায় মালুম!
আশীর্বাদ জেনো।
শঙ্করাচার্যের মোহমুদগর থেকে : পরমে ব্রহ্মণি যোজিত চিত্ত, নন্দতি নন্দতি নন্দত্যেব। যার চিত্ত পরব্রহ্মে যুক্ত, তিনি নন্দিত হন, নন্দিত হন, নন্দিত হন।*
[*লেখক এই পত্রের উল্টোদিকে এই অংশ উল্টো করে লেখেন।]
.
(৪)
শান্তিনিকেতন
৩০।৩৬০
স্নেহাস্পদেষু,
কয়েকদিন পূর্বে তোমাকে চার পৃষ্ঠার একখানা চিঠি লিখি, ইতিমধ্যে তোমার দাদুর লেখাটি পাই। তিনি এত বেশি চমৎকার লেখেন যে, আমরা চমৎকৃত হয়েও চমৎকৃত হইনে। তিনি আমাদের অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছেন।
যা বলেছেন, সে সম্বন্ধে আমি আর কী বলব?
তবে ওই যে বলেছেন, কর্ণেজপন সেইটে যে হয়ে উঠে না। Prophet-রা সেই কর্ণেজপন নিজেরাই করে যান, Politician-রা তার হদ্দ রাখে না। হিটলার চূড়ান্তে পৌঁচেছিল। কিন্তু প্লাতো, কিংবা এ যুগের রবীন্দ্রনাথ এঁরা আদর্শ রাষ্ট্র সম্বন্ধে যা বলেছেন তার কর্ণেপন তো কেউ করে না। বিশেষ করে প্লাতো।
বিশেষ করে আমরা সব blase হয়ে গিয়েছি। একটা গল্প শোন। বর্মার যুদ্ধে একটা লোকের মাথা উড়ে গেল। সে মাটিতে পড়ে গেল। খানিকক্ষণ পর আরেকজন সেপাইয়ের আঙুলের ডগাটি উড়ে যাওয়াতে সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাপ্তেন বললে, তুই কী কাপুরুষ রে! ওই লোকটার মাথা উড়ে গেল, আর সে একটি শব্দ না বলে চুপ করে শুয়ে পড়ল। তুই কি না একটা আঙুলের ডগা যেতেই হাউমাউ করে উঠলি!
ট্রাম ঠিকমতো থামায়নি বলে একটা লোক চোট পেল (মনে কর, আমাদের চিকিত্সাসঙ্কটের হিরো যে রকম)। আমি তাই নিয়ে মৃদু কোলাহল করতে একটা লোক ভেংচি কেটে বললে, ও! মশাই বুঝি মফস্সলের লোক। দেখেননি কত লোক না খেয়ে মরে গেল, কত রেফুজি মর মর– আর আপনি চোটপাট লাগিয়েছেন একটা লোকের সামান্য চোট লেগেছে বলে।
ছোট হোক, বড় হোক, তুমি কিছু একটা আপত্তি করলেই, বড় বড় পাপের ফিরিস্তি শোনানো হবে তোমাকে। অর্থাৎ পাপাচার দেখে দেখে সবাই এমনি ব্লাজে হয়ে গিয়েছে যে কারও কানে আর জল যায় না।
ভেজালের কথাটা অতিশয় আঁটি। যে যুগে আইন করা হয়েছিল তখন ভেজাল ছিল অতি সামান্যই ওটা নিয়ে তখনকার চাণক্যরা বিশেষ ভাবিত হননি। তারা তখনকার জমিদারি প্রথার ফল জালের জন্য ফাঁসি, পরে চোদ্দ বছর জেল আইন করেন। এখন জাল খুবই কম, ভেজাল বেড়েছে– আইন সেই মান্ধাতা আমলের।