শেখ পদত্যাগ করিলেন। তামাম মধ্যপ্রাচ্যে হুলস্থুল পড়িয়া গেল। সকলের মুখে এক প্রশ্ন, রাজা শেখের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করিলেন কী করিয়া।
স্বিদকি তাহারই এক ক্রীড়নককে অজহরের শেখ নিযুক্ত করিলেন– কোনও ধর্মভীরু পণ্ডিতই তখন স্বিদকির পদলেহন করিতে সম্মত হন নাই। নতুন শেখ আশিজন দেশমান্য অধ্যাপককে পদচ্যুত করিলেন। অজহরের হাজার বৎসরের ইতিহাসে ওই একমাত্র মর্কট সিংহাসনে বসিয়াছিল।
তার পর অজহরের ছাত্রেরা যে কাণ্ড করিল, তাহা স্বিদকি সম্প্রদায়ের চিরকাল মনে থাকিবে। ট্রাম জ্বালাইয়া, বাস পোড়াইয়া, বোমা ফাটাইয়া স্বিদকির স্বাধিকার প্রমত্ততাকে বেত্রাঘাতে জর্জরিত করিল। বাঙালি পাঠকবর্গের অবগতির জন্য এস্থলে উল্লেখ প্রয়োজন যে, সাদ জগলুল পাশার আমলে হইতে আজ পর্যন্ত মিশরে যত রাজনৈতিক আন্দোলন হইয়াছে, তাহাতে নেতা ও কর্মীর অধিকাংশ অজহরি। তাহাদের জাল মিশরের সর্বত্র ছড়ানো। তুলনাস্থলে ১৯২০-এর খেলাফত আন্দোলনের একাগ্রতা পাঠককে স্মরণ করাইয়া দেই।
স্বিদকির মেরুদণ্ড ভাঙিল। আন্দোলনের শেষদিকে তাহার দক্ষিণহস্তে সেই দম্ভকর বজ্ৰবাহুতে পক্ষাঘাত হইল। মিশরি পরম সন্তোষের সঙ্গে বলিল- “আল্লা-হু-আকবর। বিদেশি শক্তি মিয়মাণ। রাজার চেতনা হইল। ওয়াদকে আবার ডাকা হইল।
অজহরের ছাত্রেরা পরমানন্দে শেখ অল-রাগিকে অজহরে ফিরাইয়া আনিতে গেল। শেখ প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেন, যে দেশের রাজা বিদেশির ক্রীড়নক হইয়া গণ্যমান্য দেশপ্রিয় অধ্যাপকদের লাঞ্ছনা করে, তাহার অধীনে কর্ম করার মতো বিড়ম্বনা আর কিছু নাই। ছাত্রেরা অনেক অনুনয় বিনয় করিল; কিন্তু শেখ অটল। তখন তাহারা শেখের অন্ধ বৃদ্ধ গুরুর দ্বারস্থ হইল। তিনি বলিলেন, শেখকে গিয়া বল আমি বৃদ্ধ, মৃত্যুর সম্মুখীন, কিন্তু এমন কোনও পুণ্য করিতে পারি নাই যে, জিন্নতের (স্বর্গের) আশা করিতে পারি। আমার একমাত্র ভরসা যে, মরাগির মতো শিষ্য আমার কাছে অধ্যয়ন করিয়াছেন। কিন্তু তিনিও যদি কর্তব্যপথ হইতে বিচ্যুত হন, তবে জিন্নতে যাইবার আমার শেষ আশা বিলীন হইবে।
শেখ অল-রাগি তৎক্ষণাৎ গুরুবাক্য শিরোধার্য করিয়াছিলেন।
শেখের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সমস্যা ছিল ইয়োরোপীয় সভ্যতার কতটুকু গ্রহণ করা যায়। বিংশ শতাব্দীর ইয়োরোপীয় জগৎকে উপেক্ষা করিয়া স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ষণ অসম্ভব অথচ ইয়োরোপের জড়বাদের তাণ্ডবলীলা তাহার শিক্ষাদীক্ষার সঙ্গে দেশে প্রবর্তন করার অর্থ দীন-দুনিয়ার সর্বনাশ।
মনে পড়িতেছে, প্রশ্ন উঠিয়াছিল রেডিয়োতে কুরানপাঠ শাস্ত্রসম্মত কি না। উগ্রপন্থিরা বলিলেন, রেডিয়োর প্রচুর চলতি শুড়িখানা ও বেশ্যালয়ে। সেই উচ্ছল উন্মত্ততার আবহাওয়ায় কুরানপাঠ কুরানের অবমাননা! শেষ ফতোয়া দিয়াছিলেন, শেখ অল-মরাগি। তিনি বলিলেন, ধার্মিকের গৃহে কুরানপাঠ অহরহ হইতেছে। কিন্তু আমি চাই কুরান যেন সর্বত্র পৌঁছে। আকণ্ঠ নিমজ্জিত পাপী তো কুরান শুনিতে ধার্মিকের দ্বারস্থ হয় না। সুরাসক্ত যদি অনিচ্ছায়ও একদিন রেডিয়োতে কুরান পাঠ শুনিয়া বিচলিত হয়, ধর্মপথে চলিবার তাহার বাসনা হয়, তবে বেতার ধন্য হইবে।
এই হিমালয়ের ন্যায় বিরাট পণ্ডিতের কথা যখন ভাবি, তখন মনে পড়ে তাহার ব্যবহারের জন্য শেখ সেই গাড়ি চড়িয়া দূর আবদিন প্রাসাদে যাইতেন রাজার সঙ্গে দেখা করিতে। সেই সময়ে মোটর ভ্রমণেচ্ছুক ছেলেরা, বিশেষত গ্রাম্যরা শেখের অফিসের সামনে ঝামেলা লাগাইত। শেখ গাড়িতে উঠিয়া ছেলেদের ডাকিয়া যেন নৌকাতে কাঁঠাল বোঝাই করিতেন। কাহাকেও বাদ দিবার ইচ্ছা শেখের নাই অথচ গাড়ি যত বিরাটই হউক, সে তো গাড়ি। দামি রোলস বটে (এক ধর্মপ্রাণ শেখের ব্যবহারার্থ অজহরকে ভেট দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখের আপসোসের অন্ত নাই যে, যথেষ্ট পরিমাণে প্রশস্ত নহে।
আবদিন প্রাসাদের সম্মুখে ছেলেরা নামিয়া যাইত। শেখ পই পই করিয়া আদেশ করিতেন, কেউ যেন ছিটকাইয়া না পড়ে; তিনি যাইবেন আর আসিবেন। তার পর দশবার করিয়া শুনিতেন কয়টি ছেলে আসিয়াছে ও দশবার করিয়া সে আদমশুমারি ভুলিয়া যাইতেন।
রাজাকে সৎপথে চলিবার উপদেশান্তে শেখ বাহির হইয়া সেই একপাল ব্যাঙকে এক ঝুড়িতে পুরিবার চেষ্টা করিতেন। কেউ এ কাফেতে ঢুকিয়াছে, কেউ ওই দোকানে গুম হইয়া গিয়াছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরিবার পথে শেখের দুর্ভাবনার অন্ত নাই। কেউ বাদ পড়িয়া যায় নাই তো, ড্রাইভারের আশ্বাসবাক্য কিছুতেই বিশ্বাস করিতেন না। বারে বারে বলিতেন, গাড়ি যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হইতেছে।
সেই শেখ জিন্নতবাসী হইলেন। আল্লাতালা তাহার আত্মাকে নিজের কাছে ফিরাইয়া লইয়াছেন। নিশ্চয়ই আমরা তাঁহার নিকট হইতে আসিয়াছি ও অবশ্যই আমরা তাহারই নিকটে ফিরিয়া যাইব।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ২.৯.১৯৪৫]
.
পলডি
আমাদের দেশে কালিদাস সম্বন্ধে যেসব গল্প চলতি আছে, তার অনেকগুলোই তার প্রথম যৌবনের হাবামি নিয়ে। উত্তর ভারতেও নিরেট হাবামির গল্প বানানো হলে সেগুলো সাধারণত শেখ চিল্লির ঘাড়ে চাপানো হয়। (এর উল্টো দিকও আছে– চালাকির গল্প বলতে হলে আমরা সেটা গোপালভাড়ের কাঁধে চাপাই)। এই করে করে কোনও কোনও দেশে অজ মূর্খামি অথবা মারাত্মক ফন্দিবাজির গল্পগুলো কোনও এক বিশেষ কল্পনামূলক বা সত্যিকার চরিত্রের চতুর্দিকে জড়ো হয়।