.
(৫)
১৯.৭.৫৫
ফিরোজকে ট্রেনে
অতএব হাতের লেখা টলটলায়মান
আমার মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে তুমি কি আমার মত এত সব দেশ-বিদেশ দেখবে? আজ আমি পাটনা থেকে দানাপুর– আরা– বার হয়ে দিল্লি যাচ্ছি।
কী নিবিড় ঘন বর্ষাই না নেমেছে। আকাশ বাতাস সবই শ্যামল স্নিগ্ধ শীতল। কামরার সব শার্সি ভোলা, তবু সব কিছু ঠাণ্ডা। বাইরের ভুবন ঝাপসা। দূর দিগন্তের সবুজ গ্রাম, তার উপর নীলাকাশের সুনীল মেঘ নেমে এসেছে। বৃষ্টি-কণা সারাক্ষণ তাকে ঝাপসা করে দিচ্ছে। কখনও দেখতে পাই, কখনও পাইনে।
ধরণী যেন সর্বাঙ্গ উন্মোচন করে নববরষণের মুক্তিস্নানে আন্দ্রি আসুপ্ত হয়ে আছেন।
কী সুন্দর দৃশ্য। হয়তো তুমি একদিন দেখবে।
—তোমার আব্বু
.
(৬)
ট্রেনে-টলটলায়মান
২৫.৭.৫৫
বাবা ফিরোজ,
তুমি যখনই গাড়িতে যাও না কেন, মোগলসরাই থেকে দু দিকে চোখ রাখবে। চুনার, বিন্ধ্যাচল অঞ্চল অপূর্ব সুন্দর।
১৯২৬-এ প্রথম এ জায়গা দেখি।
১৯৫৫-য় আজ আবার যাচ্ছি।
সেই সৌন্দর্য।
—আব্বু
.
(৭)
৩ অক্টোবর ৫৫
বাবা ফিরোজ,
আমার একটা বইয়ের নামদেশে বিদেশে। বাংলায় ইডিয়মদেশ, বিদেশে। অর্থাৎ সর্বত্র অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। আমি কিন্তু দেশে বিদেশে শব্দার্থে লিখেছি অর্থাৎ এ বইয়েতে কিছুটাদেশের বর্ণনা পাবে যথা পেশাওয়ার ইত্যাদি আর বাকিটা বিদেশের অর্থাৎ এ স্থলে কাবুলের।
দেশ-বিদেশের অন্য অর্থ ধরে।
আমি যদি কখনও দেশ-বিদেশে লিখি তবে তাতে যত্রতত্র সর্বত্রর বর্ণনা পাবে। সে-বই তা হলে বিয়াল্লিশ-ভলুম হবে। তার ফুরসৎ আমার নেই।
রবিঠাকুর লিখেছেন, (রবীন্দ্র রচনাবলী, ২৬ খণ্ড, পৃ. ৩২৪) রানি খুঁজতে বেরিয়েছিলাম দেশে বিদেশে।
তিনি দেশে বিদেশে কী অর্থে ব্যবহার করেছেন। একটু অনুসন্ধান করো তো।
—আব্বু
পুঃ আজ আমি খুব বকবকানিতে আছি। এ চিঠির আগে আরেকটা চিঠি লেখা হয়ে গেছে।
.
(৮)
১৯.১০.৫৫
বাবা ফিরোজ,
তোমরা যখন কটকে এসেছিলে তখন আমার alsatian কুকুর মাস্টারকে বড় ভালোবাসতে। বরঞ্চ বলা উচিত, মাস্টার তোমাদের অনেক বেশি ভালোবাসত। কে কতখানি কাকে ভালোবাসত সে কথা আরেকদিন হবে।
তোমার মা তখন স্থির করলেন, তোমাদের জন্য একটি কুকুর পুষবেন।
আমি যখন এবারে ঢাকায় গেলুম, তখন দেখি, ছোট্ট একটি ফুটফুটে কুকুর। কী সুন্দর। আর কী তেজ! এক লাথি মারলে সে তিন টুকরো হয়ে যাবে। অথচ আমাকে যা তাড়া লাগাল! তিন মিনিটেই কিন্তু দোস্তি হয়ে গেল যখন দেখলে, তোমরা সবাই আমার দিকে হাসি মুখে এগিয়ে আসছ।
ওর নাম কী? জাম্বু। সে কী, এক ফোঁটা পাপীর নাম জাম্বু!
তোমার মা বললেন, গ্যাভেরিয়ায় তোমার মাসিমার যে কুকুর আছে তার নাম জাম্বু। তুমি যখন সেখানে থাকতে তখন ওই জাম্বুর সঙ্গে তোমার খুব ভাব-সাব ছিল বলে ওকে তুমি জাম্বু বলে ডাকতে আরম্ভ করলে। বুঝলাম, তোমার বয়সে কুকুর মানেই জাম্বু।
তার সঙ্গে আমার কী বন্ধুত্বই না জমে উঠেছিল। আমি তাকে আদর করতুম, আর সে ন্যাজটি বর্মি পাখার মতো গোল করে মেলে দিয়ে ফ্যাশানেবল মেয়েদের মতো দোলাতে আরম্ভ করত। যখন ঘুমিয়ে থাকত তখনও মাঝে মাঝে চোখ একটুখানি খুলে দিয়ে মিটমিটিয়ে দেখত আমি তার পাশে বসে আছি তো। তোমরা দু ভায়েতে যখন তার ওপর বড় বেশি চোটপাট করতে তখন সে এসে আমার কাছে আশ্রয় নিত। অবশ্য বেশিক্ষণের জন্য নয়। আবার যেত তোমাদের কাছে। ভজু হামাগুড়ি দিয়ে কাছে এসে ন্যাজে দিত টান, আর তুমি দুই হাতে তার মুখ ফাঁক করে যে রকম উপর-নিচ টানতে তা দেখে পুরাণের কোন এক বকাসুর-বধ না কিসের এক ছবি মনে পড়ত। জাম্বুর তখনকার অবস্থা সত্যই করুণ। মুখ দু দিকে চেরা বলে চিৎকার পর্যন্ত করতে পারছে না। তোমাদেরও ভয়-ডর নেই। বোঝে না যে-কোনও মুহূর্তে ওই একরত্তি কুকুর তোমাদের কুটি-কুটি করে দিতে পারে। কিন্তু সে নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমার মাস্টার যে কি না তাগড়া অ্যালসেসিয়ান তাকে নিয়েও তোমরা কটকে ওইঅপকর্ম করতে। সে-ও জাম্বুর মতো অকাতরে সইত।
তোমার মা লিখেছেন, সে রাস্তায় বেরিয়ে গিয়ে পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে পাগল হয়ে যায়। তোমাদের স্কুলের চারটি মেয়েকে কামড়েছে। তোমাদের গায়েও নাকি আঁচড় রয়েছে। তোমাদের দু ভাইকে ১০টা ১২টা injection নিতে হয়েছে। ভাবো দেকিনি, কী কাণ্ড। তোমরা দু জনাই আমারই মতো delicate- নাজুক। তোমাদের কী কষ্ট হচ্ছে, তাই আমি ভাবতে ভাবতে
(পত্র অসমাপ্ত;
.
(৯)
৩। ১০। ৫৬
আজ ঢাকাতে এলুম
বাবা ফিরোজ,
আজকাল আমি জলে-ডাঙায় লিখছি। তার ইতিহাস তোমাকে বলি। ১৯৫৩ ইংরেজির শীতের শেষে আমি মৈমনসিং গিয়েছিলুম। তখন আমি অবিশ্বাসের শেষ অধ্যায়গুলো লিখছি। রোজ সকালে বারান্দায় এক কোণে বসে বই লিখি (তুমি তখন বড় জ্বালাতন করতে– তোমার ইচ্ছে, আমি তোমার সঙ্গে খেলাধুলা করি) আর তোমার মা আমাকে মাঝে মাঝে চা দিয়ে যান।
একদিন চুপ করে বসে আছি। তোমার মা জিগ্যেস করলেন, লিখছ না যে।
আমি বললুম, অবিশ্বাস্য শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই বসে বসে ভাবছি অন্য কী বই আরম্ভ করি। তোমার মা এক মুহূর্ত না ভেবেই বললেন, বাচ্চাদের জন্য একখানা বই লেখ।
আমি তদ্দণ্ডেই জলে-ডাঙায় লিখতে বসে গেলুম। এর কয়েকটি instalment আমি ৪৮-৪৯ সনে বসুমতীতে প্রকাশ করেছিলুম বটে কিন্তু তার পর ওটার কথা ভাবিইনি। তাই নতুন উৎসাহে বইটা লিখতে আরম্ভ করলুম।