তিনি দিনের পর দিন কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প এবং বিশেষ করে গান রচনা করে যেতেন এবং প্রত্যেকটি শেষ হলেই আমাদের ডেকে শোনাতেন। এই ভিন্ন রূপটি সম্বন্ধে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই সচেতন ছিলেন।
কোনও কবিতা লেখা শেষ হলে তিনি সেটি শ্রীযুক্তা নির্মলকুমারী মহলানবিশকে কপি করে পাঠাতেন। একবার একটি গান পাঠিয়ে সঙ্গের চিঠিতে লেখেন–
বলা বাহুল্য, বর্ষামঙ্গলের গানগুলো একটা-একটা করে রচনা করা হয়েছে। যারা বইয়ে পড়বে, যারা উৎসবের দিন শুনবে, তারা সবগুলো একসঙ্গে পাবে। প্রত্যেক গান যে অবকাশের সময় আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেটাকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে তারা দেখবে। আমার বিবেচনায় এতে একটা বড় জিনিসের অভাব ঘটল। আকাশের তারাগুলো ছিঁড়ে নিয়ে হার গাঁথলে সেটা বিশ্ব-বেনের বাজারে দামি জিনিস হতেও পারে, কিন্তু রসিকেরা জানে যে, ফাঁকা আকাশটাকে তৌল করা যায় না বটে কিন্তু ওটা তারাটির চেয়েও কম দামি নয়। আমার মতে যেদিন একটি গান দেখা দিলে, সেইদিনই তাকে স্বতন্ত্র অভ্যর্থনা না করে অনেকখানি নীরব সময়ের বুকে একটিমাত্র কৌস্তুভমণির মতো ঝুলিয়ে দেখাই ভালো। তাকে পাওয়া যায় বেশি। বিক্রমাদিত্যের সভায় কবিতা পড়া হত, দিনে দিনে ক্রমে ক্রমে– তখন ছাপাখানার দৈত্য কবিতার চারদিকের সময়কাশকে কালি দিয়ে লেপে দেয়নি। কবিও প্রতিদিন স্বতন্ত্র পুরস্কার পেতেন– উপভোগটা হাইড্রলিক জাতায় সংক্ষিপ্ত পিণ্ডাকারে এক গ্রাসের পরিমাণে গলায় তলিয়ে যেত না। লাইব্রেরিলোকে যেদিন কবিতার নির্বাসন হয়েছে, সেদিন কানে শোনার কবিতাকে চোখে-দেখার শিকল পরানো হল, কালের আদরের ধন পাব্লিশারের হাটের ভিড়ে হল নাকাল। উপায় নেই– নানা কারণে এটা হয়ে পড়েছে জটলা পাকানোর যুগ– কবিতাকেও অভিসারে যেতে হয় পটলডাঙার কলেজপাড়ায় অমনিবাসে চড়ে। আজ বাদলার দিনে আমার মন নিশ্বাস ফেলে বলছে, আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে–দুর্যোগে জন্মালুম ছাপার কালিদাস হয়ে–মাধবিকা, মালবিকারা কবিতা কিনে পড়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনে না। ইতি–১৫ই শ্রাবণ, ১৩৩৬ (দেশ, ১৩৬৮, পৃ. ৮৩৫)!
আমরা তাকে পেয়েছি যেভাবে তিনি চেয়েছিলেন তাঁরই ভাষায় বলি, আজকের দিনের মাধবিকা, মালবিকার মতো নয়।
কিন্তু এই রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে গঙ্গাজলে যে গঙ্গাপুজো করলুম, তার পর নিজের আর কোন অর্ঘ্য এনে বিড়ম্বিত হই?
.
মোল্লা ফয়েজ
অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের স্মরণ থাকিবার কথা আমানউল্লা আফগানিস্তানকে রাতারাতি ফ্রান্সভূমিতে পরিবর্তন করিতে গিয়া কী দুরবস্থায় রাজত্ব হারান। যুদ্ধে পরাজিত হইয়া তিনি কাবুল হইতে পলায়ন করিলে পর দস্যু-দলপতি হবিবউল্লা, তখলুস বাচ্চা-ই-সকাও (ভারতবর্ষে বাচ্চা-সক্কা নামে পরিচিত) কাবুল ও উত্তর আফগানিস্তানের বাদশাহ হন।
বাচ্চা ডাকাত। কাজেই রাজা হইয়া কাবুলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করিবার দুরভিসন্ধি তাহার ছিল না। শান্তি স্থাপন করা অর্থ লুটতরাজ বন্ধ করা, আর লুটতরাজ বন্ধ করিলে তাহার সৈন্যেরাই-বা মানিবে কেন? তাহাদিগকে তো ওই লোভেই দলবদ্ধ করিয়া আমানউল্লার সঙ্গে লড়ানো হইল। রাজকোষ হইতে অর্থ দিয়া তাহাদিগকে শান্ত করিবার কথাই উঠে না, কারণ আমানউল্লা তাহার অর্ধেক ফুকিয়া দিয়াছিলেন নানারকম বিবেকবুদ্ধিহীন, অর্থগৃধু দলপতিদিগকে বাচ্চার সঙ্গে লড়িবার জন্য প্ররোচিত করিতে গিয়া। দলপতিরা টাকা লইয়াছিল অসঙ্কোচে ও ততোধিক অসঙ্কোচে ও তৎপরতার সঙ্গে টাকা লইয়া উধাও-ও তাহারা হইয়াছিল। কিছু দিয়া কিছু হাতে রাখিয়া, টালবাহানা দিয়া লড়ানোর হুঁশিয়ার ফেরেব্বাজি জানিতেন আমানউল্লার পিতা আমির হবিবুল্লা ও তাঁহার পিতামহ, পরমনমস্য আমির আব্দুর রহমান।
জলের মতো অর্থ ব্যয় আর কলকাতা শহরে বলা চলে না কাজেই বলি ইনফ্লেশেনি অর্থ ব্যয় করিয়া যখন আমানউল্লা লড়াই ও অর্থ উভয়ই হারাইলেন তখন তাহার চৈতন্যোদয় হইল। সূর্যোদয়ের পূর্বেই এক কালরাত্রিতে তিনি বাকি অর্ধেক অর্থ লইয়া কান্দাহার মামার বাড়ি পলায়ন করিলেন– বিপদকালে আমির-ফকির সকলেই মামার বাড়ির সন্ধান লয়।
কান্দাহার ইন্তিহার মেহমানদারি করিল বটে, কিন্তু যুদ্ধে প্রাণ দিতে নারাজ এ তত্ত্বটিও বুঝাইয়া দিল। আমানউল্লা তখন দেশত্যাগ করিলেন।
এদিকে বাচ্চার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চমস্তম্ভীয় মোল্লাদের জেল্লাই বাড়িল কিন্তু অর্থাগম সরগরম হইল না। বাচ্চার সৈন্যকেই যখন লুট করিয়া জান বাঁচাইতে হয়, তখন মোল্লার তত্ত্বতালাশ করিবে কোন ইয়ার– ডাকুর সর্দারের তো কথাই উঠে না। তবুও বাচ্চা কৃতজ্ঞতা দেখাইবার জন্য মোল্লাদের চেল্লাচেল্লিতে কান দিলেন– তাহাদিগকে নানারকম ছোটখাটো চাকরি দিলেন। কিন্তু যে দেশে বিশেষ কায়দায় পাগড়ি পরিলেই মোল্লা হওয়া যায় সেখানে মোল্লার সংখ্যা সাকুল্যে বিল্লির চেয়ে বেশি। বাচ্চা নিরুপায় হইয়া ফালতুদিগকে মুহতসিব কর্মে নিযুক্ত করিয়া কাবুল বাসিন্দাদিগের পশ্চাতে লেলাইয়া দিলেন।
মুহতসিব এক অদ্ভুত কর্মচারী। ইনি একরকমরিলিজিয়স পুলিশম্যান। তাহার কর্ম হাতে চাবুক লইয়া রাস্তাঘাটে নিরীহ প্রাণীকে নানারকমে উদ্ব্যস্ত করা। আজানের পর তুমি এখানে ঘোরাঘুরি করিতেছ কেন, ঈদের নামাজে কয়বার সেজদা দিতে হয়, আসরের নামাজের পর নফল পড়া মুনাসিব কি না, ইফতারের নিয়ম কী? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া উত্তর না পাইলে মুহতসিব নাগরিকের পৃষ্ঠদেশে নির্মম চাবুক লাগান, অথবা নাগরিক ঠিকঠিক ব্যাপারটা বুঝিতে পারিয়া মুহতসিবের দক্ষিণহস্তে ক্ষিপ্রগতিতে কিঞ্চিৎ পারিতোষিক দিয়া পৃষ্ঠপ্রদর্শন নহে– পৃষ্ঠরক্ষা করে। মুহতসিব প্রতিষ্ঠানই খারাপ একথা বলা আমার উদ্দেশ্য নহে, কিন্তু অজ্ঞ মোল্লাকে বেতন না দিয়া নাগরিকের পশ্চাতে লাগাইয়া দিলে সে যে বহুদিন যাবৎ গৃহস্থের অন্ন ধ্বংস করিয়া কাননস্থ মহিষকে তাড়না করিবে না তাহাতে কী সন্দেহ? বিজ্ঞ এবং ধার্মিক মোল্লারা এই মতই পোষণ করিতেন।