ট্রেনে উঠেই তিনি হঠাৎ অত্যন্ত শান্ত হয়ে গেলেন। ভেনিস না পৌঁছনো পর্যন্ত এখন আর কিছু করার নেই।
গভীর রাত্রে স্লিপিং কোচের ক্ষীণালোকে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি কী প্রশান্ত মমতাময় তাঁর মুখচ্ছবি! খানিকক্ষণ পরই ইটালিতে ঢুকব– যে দেশের মাদোন্না-মাতৃমূর্তি সর্ব বিশ্বে সমাদৃত হয়। আমার মনে হল আমার এই মাটিলডের মুখে যে মাদোন্নার ছবি ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে এ ক-দিন ধরে প্রহরে প্রহরে, সে তো যে কোনও গির্জার দেবিকে উজ্জ্বল করে দিতে পারে। এ রমণী গর্ভে সন্তান না ধরেও মা-জননী মাদোন্নাদের ভিতর শাশ্বত আসন পেল।
কেন পাবে না? জাতকে আছে, একদা নিদারুণ দুর্ভিক্ষের সময় এক ভিখারিণী নগরপ্রান্তে খর্জুরবৃক্ষের অন্তরালে শিশুসন্তান প্রসব করে পৈশাচিক ক্ষুধার উৎপীড়নে গ্রাস করতে যাচ্ছিল তাকে। তারই পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক বন্ধ্যা শ্ৰেষ্ঠিনী, সন্তান কামনা করে মহাকালের মন্দিরে পূজা দিতে। মাতৃস্নেহাতুরা অনুনয় করে নবজাতককে কিনতে চাইলেন। পিশাচিনী অট্টহাস্য করে উত্তর দেয়, তার ক্ষুধা মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা করতে পারবে না। বরনারী বললেন, তবে তিষ্ঠ; এই যে আমার বন্ধ্যাবক্ষের সুপুষ্ট স্তন, অকর্মণ্য নিষ্ফল এ স্তন কোনও শিশুকে দুগ্ধ যোগাতে পারেনি– এটা আমি খর্জুরপত্র দ্বারা কর্তন করে তোমাকে দেব। তোমার ক্ষুধা নিবৃত্ত হবে। পাগলিনী আবার অট্টহাস্যে বলল, তুমি জানো না, আপন হাতে আপন মাংস কর্তন করাতে কি অসহ্য বেদনা, তাই বলছ। রমণী বাক্যব্যয় না করে কর্তন আরম্ভ করতে না করতেই দরদর বেগে নির্গত হল সেই বন্ধ্যা স্তন থেকে রক্তের বদলে অফুরন্ত মাতৃদুগ্ধ। ভিখারিণী-শিশু উভয়েই সে দুগ্ধ পান করে পরিতৃপ্ত হল। অলৌকিক অবিশ্বাস্য এ ঘটনার কথা শুনে তথাগতের শিষ্যরা তিনজনকেই নিয়ে এলেন তার সামনে। অমিতাভ সানন্দে বললেন, মাতৃস্নেহ অলৌকিক ক্রিয়া উৎপাদনে সক্ষম।
বঞ্চিতা মাটিলডের মুখে দিব্য জ্যোতি দেখা দেবে না কেন?
.
ভেনিস বন্দরে জাহাজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মাটিলডে আমার হাত ধরে বার বার অনুরোধ করলেন, আমি যেন বোম্বাই পৌঁছেই কেবল করি, ছেলেটি কবে কোন জাহাজে ইউরোপ পৌঁছচ্ছে। তার চোখে জল, কিন্তু তাতে আনন্দের রেশও ছিল।
বোম্বাই পৌঁছে খবর নিয়ে জানলুম, ছেলেটি চলে গেছে। মাটিলডেকে পাকা খবর জানিয়ে দিলুম।
বরোদায় পৌঁছবার মাসখানেক পরে বন্ধু ওয়াডিয়া– তাঁকে এসব কিছুই বলিনি– কথায় কথায় বললেন, কাণের ছেলেটি কখন যে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে কেউ টের পায়নি। খাটের উপর একখানা চিরকুট পাওয়া যায়। অসুস্থ শরীর নিয়ে সে চিরজীবন কারও বোঝা হয়ে থাকতে চায়নি।
আমার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোয়নি। হা হতভাগ্য! তুমি জানতেও পারলে না, স্বয়ং মা মেরি তোমার জন্য বন্দরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
আর মাটিলডে!
দ্বিজ
এই গত শারদীয়া বেতার জগতে কোষ্ঠীবিচার নামক একটি কথিকা এ-অধম নিবেদন করে। বিবরণটি ছিল সত্য ঘটনা অবলম্বনে বর্ণিত। তৎসত্ত্বেও আমার এক দোস্ত সেটি পড়ে কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হন। আমি সবিনয় বললুম, ব্রাদার, এটা বরহ জলজ্যান্ত ঘটেছিল; আমাকে দুষছ কেন? তিনি বললেন, তুমি সেটি রসস্বরূপে প্রকাশ করতে চেয়েছ; সেক্ষেত্রে সত্যি-মিথ্যের কোনও অজুহাত নেই। একদম খাঁটি কথা। তাই এবারে কিন্তু যেটি নিবেদন করব সেটি পড়ে তিনি প্রসন্ন হবেন, এমত আশা করি, আর আপনারা পাঁচজন তো আছেনই! এই সুবাদে আরেকটি সামান্য বক্তব্য আমার আছে। হিন্দু-মুসলমান বাঙালি-অবাঙালি কাউকেই আমি বেদনা দিতে চাইনে। দিলে সেটা অজানিত এবং তার জন্যে এইবেলাই বে-কৈফিয়ত মাফ চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আমার বক্তব্য দুষ্টবুদ্ধিজনিত ভ্রমাত্মক সপ্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত সেটি সংহরণ করতে আমি অক্ষম– এটা গুরুর আদেশ।
এদানির কিছু লোক আবার আমার কাছ থেকে প্রাচীন দিনের শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে ভালোমন্দ শুনতে চান। আমি তাঁদের লুক্কায়িত বক্তব্যটিও বিলক্ষণ মালুম করতে পেরেছি; সেটি এই, যা বুড়োচ্ছ, দুদিন বাদেই ভীমরতি ধরবে এবং তখন হয়ে দাঁড়াবে একটি চৌকস লিটারারি বোর; যদ্যবধি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ তোমার আপন কথা ধানাই-পানাই না করে আশ্রমের কথা কও, গুরুদেবের কথা কও ইত্যাদি।
তাই সই। দেশকাল ঠিক ঠিক রাখব। পাত্র ভিন্ন নামে ভিন্ন বেশে আত্মপ্রকাশ করবেন।
১৯২০/২১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কলেজ কোর্স খোলেন। ওই সময় গাঁধীজি সরকারি স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের গোলামি-তালিম বর্জন করতে আহ্বান জানান। ফলে ভারতের সর্বপ্রদেশ থেকে যেসব মেধাবী ছিল, গাঁধীজির বাণী গ্রহণ করল তারা, জমায়েত হল শান্তিনিকেতনে। আর এলেন কয়েকটি খাজা মাল, যারা বছরের পর বছর পৌনঃপুনিক দশমিকের পাইকিরি হিসাবে বেধড়ক ফেল মেরে যাচ্ছিলেন। অবশ্য এঁদের একজন বলেছিলেন, ওইস অ্যানসার বুক লিখেছিলুম, স্যার, যে এগজামিনার বলল এনকোর। তাইতে ফের একই পরীক্ষা দিতে হল। এঁদের মধ্যে আমার মতো গুণ্ডাপ্রকৃতির দু-চারটি কাবেল সন্তান ছিলেন।
ইতোমধ্যে এলেন বিশ্বনাথ তিরুমল রাও অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম্ থেকে। একে নিয়ে যখন দু দলে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল তখন ধরা পড়ল ইনি বরের পিসি, কনের মাসি। অর্থাৎ ইনি যেমন অনেকটা ইন্দ্রনাথের মতো অন্ধকার রাস্তায় স্যাডিস্ট ক্লাস-টিচারের মাথায় হঠাৎ কম্বল ফেলে তাকে কয়েক ঘা বসিয়ে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে এখানে চলে আসেন, ঠিক তেমনি কলাভবনে প্রবেশ করার পর দেখা গেল, তিনি একই হাতে পাঁচটা তুলি নাচাতে পারেন– যাদুকররা যেমন পাঁচটা বল নাচায়। স্কেচে ওস্তাদ, ফিনিশে তালেবর।