- বইয়ের নামঃ দ্বন্দ্বমধুর
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ স্টুডেন্ট ওয়েজ
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
চাচা-কাহিনী
বার্লিন শহরের উলান্ড স্ট্রীটের উপর ১৯২৯ খ্ৰীষ্টাব্দে হিন্দুস্থান হৌস নামে একটি রেস্তোরাঁ জন্ম নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে, বাঙালির যা স্বভাব, রেস্তোরাঁর এক কোণে একটি আড্ডা বসে যায়। আড়ার গোসাঁই ছিলেন চাচা, বরিশালের খাজা বাঙালি মুসলমান, আর চেলারা— গোসাঁই, মুখুজ্জে, সরকার, রায়, চ্যাংড়া গোলাম মৌলা ইত্যাদি।
রায় চুক চুক করে বিয়ার খাচ্ছিলেন আর গ্রাম-সম্পর্কে তাঁর ভাগনে গোলাম মৌলা ভয়ে ভয়ে তার দিকে মিট মিট করে তাকাচ্ছিল, পাছে তিনি বানচাল হয়ে যান। এ-মামলা চাচা রোজই দেখেন, কিছু বলেন না, আজ বললেন, ‘অত ডরাচ্ছিস কেন?’
মৌলা লাজুক ছেলে। মাথা নিচু করে বললে, ‘ওটা খাবার কী প্রয়োজন? আপনি তো কখনও খান নি, এতদিন বার্লিনে থেকেও। মামুরই বা কী দরকার?’
চাচা বললেন, ‘ওর বাপ খেত, ঠাকুরদা খেত, দাদামশাই খেত, মামারা খায় এ দেশে না এসেও। ও হল পাইকারি মাতাল, আর পাঁচটা হিন্দুস্থানীর মত পেচী মাতাল নয়। আর আমি কখনও খই নি তোকে কে বললে?’
আড্ডা একসঙ্গে বললে, ‘সে কী চাচা?’
এমন ভাবে কোরাস গাইলে, মনে হল, যেন বছরের পর বছর তারা ওই বাক্যগুলোই মোহোড়া দিয়ে আসছে।
ডান হাত গলাবন্ধ কোটের মধ্যিখোন দিয়ে ঢুকিয়ে, বাঁ হাতের তোলো চিত করে চাচা বললেন, ‘মদকে ইংরিজিতে বলে স্পিরিট, আর স্পিরিট মানে ভুত। অর্থাৎ মদে রয়েছে ভূত। সে-ভূত কখন কার ঘাড়ে চাপে তার কি কিছু ঠিক-ঠিকানা আছে? তবে ভাগ্যিস, ওভূত আমার ঘাড়ে মাত্র একদিনই চেপেছিল, একবারের তরে।’
গল্পের সন্ধান পেয়ে আড্ডা খুশ! আসন জমিয়ে সবাই বললে, ‘ছাডুন চাচা।’
রায় বললেন, ‘ভাগিনা, আরেকটা বিয়ার নিয়ে আয়।’
মৌলা অতি অনিচ্ছায় উঠে গেল! উঠবার সময় বললে, ‘এ নিয়ে আঠারটা।’
রায় শুধালেন, ‘বাড়তি না কমতি?’
ফিরে এলে চাচা বললেন, ফ্রিলাইন ফন ব্ৰাখেলকে চিনিস?’
লেডি-কিলার পুলিন সরকার বললে, ‘আহা, কৈসন সুন্দরী,
রূপসিনী ব্লন্দিনী
নরদিশি নন্দিনী।’
শ্ৰীধর মুখুজ্জে বললে, ‘চোপ-’
চাচা বললেন, ‘ওর সঙ্গে প্রেম করতে যাস নি। চুমো খেতে হলে তোকে উদুখল সঙ্গে নিয়ে পেছনে ঘুরতে হবে।’
বিয়ারের ভুড়ভুড়ির মত রায়ের গলা শোনা গেল, ‘কিংবা মই।’
গোসাঁই বললেন, ‘কিংবা দুই-ই। উদূখলের উপর। মই চাপিয়ে।’
শ্ৰীধর বললে, ‘কী জ্বালা! শাস্ত্র শ্রবণে এরা বাধা দিচ্ছে কেন? চাচা, আপনি চালান।’
চাচা বললেন, ‘সেই ফন ব্ৰাখেল আমায় বড় স্নেহ করত, তোরা জানিস। ভরাগ্রীষ্মকালে একদিন এসে বললে, ‘ক্লাইনার ইডিয়ট (হাবা-গঙ্গারাম), এবারে আমার জন্মদিনে তোমাকে আমাদের গায়ের বাড়িতে যেতে হবে। শহরে থেকে থেকে তুমি একদম পিলা মেরে গেছ, গায়ের রোদে রঙটিকে ফের একটু বাদামির আমেজ লাগিয়ে আসবে।’
আমি বললুম, ‘অর্থাৎ জুতোতে পালিশ লাগাতে বলছ? রোদুরে না বেরিয়ে বেরিয়ে কোনও গতিকে রঙটা একটু ভদ্রস্থ করে এনেছি, সেটাকে আবার নেটিভ-মার্কা করব? কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তুমি না হয় আমাকে সয়ে নিতে পোর; কিন্তু তোমার বাড়ির লোক? তোমার বাবা, কাক?’
ব্ৰাখেল বললে, ‘না হয় একটু বাঁদর-নাচই দেখালে।’।
চাচা বললেন, ‘যেতেই হল। ব্ৰাখেল আমার যা-সব উপকার করেছে তার বদলে আমি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেও যেতে পারি।’
মৌলা চট করে একবার ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে নিলে।
চাচা বললে, ‘অজ পাড়াগাঁ ইস্টিশন। প্যাসেঞ্জারে যেতে হল। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি, স্বয়ং স্টেশনমাস্টার সেলাম ঠুকে সামনে হাজির। তার পিছনে ছোটবাবু, মালবাবুঅবশ্য দাশের মত খালি গায়ে আলপাকার ওপর ব্রেসট্ৰিকেট পরা নয়, টিকিট-বাবু, দুচারজন তামাশা দেখনেওলা, পুরো পাক্কা প্রসেশনে বলেই হয়। ওই অজ স্টেশনে আমিই বোধ হয় প্রথম ভারতীয় নামলম, আর আমিই বোধ হয় শেষ।
স্টেশনমাস্টার বললে, ‘বাইরে গাড়ি তৈরি, এই দিকে আজ্ঞা হোক।’
বুঝলুম, ফন ব্ৰাখেলেরা শুধু বড়লোক নয়, বোধ হয় এ-অঞ্চলের জমিদার!
বাইরে এসে দেখি, প্রাচীন ফিটিং গাড়ি, কিন্তু বেশ শক্তসমখ। কোচম্যান তার চেয়েও বুড়ো, পরনে মনিং সুট, মাথায় চোঙার মত অপরা হ্যাট, আর ইয়া হিন্ডেনবুগি গোঁফ, এডওয়াড়ী দাড়ি, আর চোখ দুটো এবং নাকের ডগাটি সুজি রায়ের চোখের মত লাল, জবাকুসুমসঙ্কাশং।
কী একটা মন্ত্র পড়ে গেল; দাড়ি-গোঁপের ছাঁকনি দিয়ে যা বেরোল তার থেকে বুঝলুম, আমাকে ফিউডাল পদ্ধতিতে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে। এ চাপানের কী ওতোর মন্ত্র গাইতে হয়। ব্ৰাখেল আমাকে শিখিয়ে দেয় নি। কী আর করি, ‘বিলক্ষণ, বিলক্ষণ’ বলে যেতে লাগলুম, আর মনে মনে ব্ৰাখেলকে প্ৰাণ ভরে অভিসম্পাত করলুম, এ-সব বিপাকের জন্য আমাকে কায়দা—কেতা শিখিয়ে দেয় নি বলে।
আমি গাড়িতে বসতেই কোচম্যান আমার হাঁটুর উপর একখানা ভারী কম্বল চাপিয়ে দু-দিকে গুঁজে দিয়ে মিলিটারি কায়দায় গটগট করে গিয়ে কোচাবাক্সে বসল। তারপর চাবুকটা
মধ্যিখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলে। ইতিমধ্যে স্টেশনমাস্টারের ফুটফুটে মেয়েটি আমার অটোগ্রাফ আর স্ন্যাপ দুইই তুলে নিয়েছে।
মাঠের পর ঈষৎ খাড়াই, তারপর ঘন পাইন বন; বন থেকে বেরুতেই সামনে উঁচু পাহাড় আর তার উপর যমদূতের মত দাঁড়িয়ে এক কাসল। মহাভারতের শাস্তিপর্বে শরশয্যায় শুয়ে শুয়ে ভীষ্মদেব মেলা দুর্গের বয়ান করেছেন, এ দুর্গ যেন সব কটা মিলিয়ে লাবড়ি-ভর্তা।