আজ আর আমার ঠিক মনে নেই, মহারাজা নিজে মদ না খেলেও তার কটি ছেলে দিবারাত্র বোতল সেবা করে করে বাপ-মায়ের চোখের সামনে মারা যান। ওঁদের মদ খাওয়া বন্ধ করার জন্য কিছুদিনের তরে তিনি তাবৎ বরোদা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ড্রাই করে দেন, কিন্তু তাতেও কোনও ফলোদয় হয়নি। শেষ পর্যন্ত বাকি ছিলেন একমাত্র ধৈর্যশীল রাও। একেও সাদা চোখে বড় একটা দেখা যেত না।
মহারাজার বড় ছেলের ছেলে–তিনিই তখন যুবরাজপ্রতাপসিং রাও-ও প্রচুর মদ্যপান করতেন– এ নিয়ে বুড়ো মহারাজার বড়ই দুঃখ ছিল কিন্তু নাতি তখনও দু কান কাটা হয়ে যাননি। রাজা হওয়ার পর তিনিও সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে গেলেন এবং ভারত স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর তিনি আকাট মূর্খ ইয়ারবক্সির প্ররোচনায় ভারতের সঙ্গে লড়াই করতে চেয়েছিলেন। তিনি গদিচ্যুত হওয়ার পর তার ছেলে ফতেহ্ সিং রাও মহারাজা উপাধি পান– এবং বর্তমান ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে সংযুক্ত বলে অনেকেই তাকে চেনেন। শুনেছি, মানুষ হিসেবে চমৎকার।
কিন্তু এসব অনেক পরের কথা।
বুড়া মহারাজার মদ্যের প্রতি অনীহা ছিল বলে বরোদা শহরে সংযমের পরিচয় পাওয়া যেত– বিশেষ করে যখন অন্যান্য নেটিভ স্টেটে মদ্যপানটাই সবচেয়ে বড় রাজকার্য বলে বিবেচনা করা হত, ও প্রজারাও যখন রাজাদর্শ অনুকরণে পরাজুখ ছিল না।
কিন্তু বুড়া মহারাজা বিস্তর বিলাতফেৰ্তা জোগাড় করেছিলেন বলে প্রায়ই কারও না কারও বাড়িতে পার্টি বসত। দু-এক জায়গায় যে মদ নিয়ে বাড়াবাড়ি হত না, সে কথা বলতে পারিনে। তবে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করত গৃহকর্তার আপন সংযমের ওপর।
এরই দু-একটা পার্টিতে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়। ভুল বললুম, পরিচয় হয়। কারণ এরকম স্বল্পভাষী লোক আমি জীবনে কমই দেখেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি চুপ করে বসে থাকতেন একপাশে, এবং অতিশয় মনোযোগ সহকারে ধীরে ধীরে গেলাসের পর গেলাস নামিয়ে যেতেন। কিন্তু বানচাল হওয়া দূরে থাক, তাঁর চোখের পাতাটিও কখনও নড়তে দেখিনি। আমি জানতুম, ইনি বন্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছর দশেক পূর্বে ডক্টরেট পাস করে বরোদায় ফিরে এসে উচ্চতর পদে বহাল হন। আমিও বন্ থেকে বছর তিনেক পূর্বে পাস করে আসি ও তিনি যেসব গুরুর কাছে পড়াশোনা করেছিলেন, আমিও তাদের কয়েকজনের কাছে বিদ্যার্জন করার চেষ্টা করি। আমি তাই আশা করেছিলুম তিনি অন্তত আমার সঙ্গে দু-চারিটি কথা বলবেন–ব বিশ্ববিদ্যালয়, তার সহপাঠী, তার আমার উভয়ের শুরু, রাইন নদী, শহরের চতুর্দিকের বন-নদী-পাহাড়ের পিকনিক নিয়ে তিনি পুরনো দিনের স্মৃতি ঝালাবেন, নিদেন দু-একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করবেন। আমি দু-তিনবার চেষ্টা দিয়ে দেখলুম, আমার পক্ষে তিনি বন্ থেকে পাস না করে উত্তর মেরু থেকে পাস করে থাকলে একই ফল হত। সাপের খোলসের মতো তিনি বন শহরের স্মৃতি কোন আঁস্তাকুড়ে নির্বিকার চিত্তে ফেলে এসেছেন। আমি আর তাঁকে ঘাটালুম না।
এরপর কার্যোপলক্ষে আমি এক-আধবার তাঁর দফতরে যাই। এক্ষেত্রেও তদ্বৎ। নিতান্ত প্রয়োজন হলে বলেন ইয়েস, নইলে জিভে ক্লোরোফরম মেখে নিয়ে নিশ্চুপ।
বাড়ি ফিরে এসে তার থিসিসখানা জোগাড় করে নিয়ে পড়লুম। অত্যুকৃষ্ট জর্মনে লেখা। নিশ্চয়ই কোনও জর্মনের সাহায্য নিয়ে। তা সে আমরা সবাই নিয়েছি এবং এখনও সর্ব অজর্মনই নিশ্চয়ই নেয়, কিন্তু ইনি পেয়েছিলেন সত্যকারের জউরির সাহায্য। তবে তিনি এখন কতখানি জর্মন বলতে এবং বুঝতে পড়তে পারেন তার হদিস পেলুম না। কারণ বরোদায় আসে অতি অল্প জর্মন, তারাও আবার ইংরেজি শেখার জন্য তৎপর। তদুপরি তৃতীয় ব্যক্তির সাক্ষাতে দেখা হলে এবং সে যদি জর্মন না জানে তবে তার অজানা ভাষায় কথা বলাটা বেয়াদবিও বটে। এতাবৎ হয়তো তাই শ্ৰীযুত কাণের সামনে জর্মন বলার কোনও অনিবার্য পরিস্থিতি উপস্থিত হয়নি।
এর পরে আরও দু বৎসর কেটে গেছে ওই একইভাবে। তবে ইতোমধ্যে আমার সর্বজ্ঞ বন্ধু পারসি অধ্যাপক সোহরাব ওয়াডিয়া আমাকে বললেন, আপন অন্তরঙ্গ জাতভাইদের সঙ্গে নিভৃতে তিনি নাকি জিভটাতে লুব্রিকেটিং তেল ঢেলে দেন এবং তখন তাঁর কথাবার্তা নাকি flows smoothly like oil. রসনার ওপর অন্যত্র তার সংযম অবিশ্বাস্য।
এই দু বছর কাটার পর আমার হাতে ফোকটে কিঞ্চিৎ অর্থ জমে যায়। দয়াময় জানেন সেটা আমার দোষ নয়। সে যুগে বরোদায় খরচ করতে চাইলেও খরচ করার উপায় ছিল না। ওদিকে জর্মনিতে হিটলারের নাচন-কুদন দেখে অন্তত আমার মনে কোনও সন্দেহ রইল না, তার ওয়াটস্ নাচ এবারে জর্মনির গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরেও গড়াবে। এবং সেটা আকছারই গড়ায় প্রতিবেশী ফ্রান্সের আঙিনায়। দুই দেশেই আমার বিস্তর বন্ধু। এইবেলা তা হলে তাদের শেষ দর্শনে যাই। ১৯১৮ সালে জর্মনরা আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে ও রণাঙ্গনে গ্যাসও চালায়। এবারে শুরুই হবে ওসব দিয়ে অনেক দূরপাল্লার বোমারু এবং জঙ্গিবিমান নিয়ে, তীব্রতর বিষাক্ত গ্যাস নিয়ে। ধুন্দুমার শেষ হলে আমার কজন বন্ধু যে আস্ত চামড়া নিয়ে বেরিয়ে আসবেন বলা কঠিন।
১৯৩৮-এর গরমিকালে ভেনিস মিলান হয়ে বন্ শহরে পৌঁছলুম। জাহাজে বিশেষ কিছু লক্ষ করবার ফুরসত পাইনি। প্রথমদিনেই আলাপ হয়ে যায় এক ফ্রেঞ্চ ইভোচায়নার তরুণীর সঙ্গে। অপূর্ব সুন্দরী। অপূর্ব বললুম ভেবেচিন্তেই। আমার নিজের বিশ্বাস এবং আমার সে-বিশ্বাসে আমার এক বিশৃপর্যটক বন্ধু সোসাহে সায় দেন– দোআঁসলা রমণীরা সৌন্দর্যে সবসময়ই খাঁটিকে হার মানায়। পার্টিশনের পরের কথা বলতে পারিনে, কিন্তু তার পূর্বে কলকাতার ইলিয়ট রোড, ম্যাকলাউড স্ট্রিটের যে অংশে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সুন্দরীদের হাট বসত- খারাপ অর্থে নেবেন না– সেরকমটা আমি প্যারিস-ভিয়েনা কোথাও দেখিনি।